২০০১ সালের ২৫ জুলাই থেকে
শুরু হয়ে ২৩ সেপ্টেম্বর অবধি কেরালার নানা এলাকায় মাঝেমাঝেই লাল রঙয়ের বৃষ্টি
হয়েছিল। সবচেয়ে বেশি পরিমাণে এই বৃষ্টি হয়েছিল কোট্টায়াম আর ইদুক্কি জেলায়। এই
বৃষ্টির জলের চেহারা অনেকটা রক্তের মতো। কাপড়চোপড়ে লাগলে সেইরকমের দাগ ধরেছিল।
বৃষ্টিটা প্রথম শুরু হবার আগে নাকি প্রচণ্ড জোরে বাজ পড়ার মতো শব্দ হয়েছিল। দেখা
গিয়েছিল তীব্র আলোর ঝলক। বহু গাছের থেকে ঝরে পড়েছিল পুড়ে ও কুঁকড়ে যাওয়া পাতার
রাশ। হঠাৎ করেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল বেশ কিছু কুয়ো।
ব্যাপারটা নিয়ে সরকারি
তদন্তও একটা হয়। তাতে বলা হল, ওই বৃষ্টির জলের নমুনাতে কোনও ধরনের উল্কারজ বা
আগ্নেয়ভস্মের চিহ্ন ছিল না। ছিল না কোনও রাসায়নিকের চিহ্নও। সরকারি ব্যাখ্যাটা হল,
ঘটনার আগে বেশ কয়েকদিন ধরে প্রচণ্ড বৃষ্টির ফলে ওই এলাকায় কিছু বিশেষ ধরনের
লিচেনের (শৈবাল ও ছত্রাকের মাঝামাঝি একধরনের অতি ক্ষুদ্র উদ্ভিদ) খুব বাড়বাড়ন্ত হয়েছিল।
তাদেরই স্পোর বা বলতে পার, বীজ বাতাসে ভেসে ভেসে মেঘের গায়ে গিয়ে পৌঁছেছিল। আর
তাতেই রক্তের রঙ ধরেছে বৃষ্টিতে। গবেষকেরা অবশ্য কেমন করে অতদিন ধরে বৃষ্টিতে রঙ
ধরাবার মতো পরিমাণে স্পোর মেঘে গিয়ে পৌঁছুল তার কোনও সুষ্ঠু ব্যাখ্যা দিতে
পারেননি। আবার বৃষ্টিরাঙানো মাটির কিছু নমুনা পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছিল, তাতে
অ্যালুমিনিয়ামের পরিমাণ বেশ বেশি অথচ ফসফরাসের পরিমাণ খুবই কম। আমাদের পরিচিত
সমস্ত জীবকোষে কিন্তু এই দুই উপাদানের ঘনত্বের হিসেবটা ঠিক উলটো। মানে প্রথমটা
তাতে থাকে অনেক কম পরিমাণে, কিন্তু পরেরটির পরিমাণ তাতে থাকে বেশি।
২০০৩ সালে কোট্টায়ামের
মহাত্মা গান্ধী বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই বিজ্ঞানী গডফ্রে লুইস এবং এ সন্তোষ কুমার সেই
বৃষ্টির জলের নমুনা পরীক্ষা করে একটা গবেষণাপত্র লিখলেন। তাতে দেখা গেল, জলের
মধ্যে থাকা লাল রঞ্জক পদার্থগুলো জৈব উপাদানে ভরপুর। অথচ তাতে আগে বলা দুই মৌলের
ঘনত্বের যে হিসেব তাতে পার্থিব কোনও জীবকোষের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে তা মেলে না।
তাহলে? আর একটা হিসেব দিলেন গডফ্রেরা। তা হল, এক লিটার জলে ওই রঞ্জক কণার পরিমাণ
১০০ মিলিগ্রাম। সেই হিসেবে মোট যত লাল বৃষ্টি ওই এলাকায় হয়েছিল তাতে মোট রঞ্জকের
হিসেব দাঁড়াল ৫০ টন! এত পরিমাণ স্পোর কি বাতাসে ভেসে ওঠা সম্ভব? আশ্চর্যের ওপর
আশ্চর্য, আরেকটা পরীক্ষায় দেখা গেল, পার্থিব জীবকোষে যে দুটো রাসায়নিকের
অবশ্যম্ভাবী উপস্থিতি থাকে সেই ডিএনএ বা আরএনএ-র কোনও চিহ্ন নেই ওদের মধ্যে।
‘অ্যাস্ট্রোফিজিক্স
অ্যান্ড স্পেস সায়েন্স’ পত্রিকায় তাঁদের প্রকাশিত গবেষণাপত্রটি বেশ সাড়া ফেলেছিল
বিজ্ঞানীমহলে। তাঁরা দাবি করছেন, এগুলি পৃথিবীর বাইরের থেকে আসা জীবদেহের অংশ।
পৃথিবীর আবহাওয়ায় ঢুকে আসা কোনও ছোট ধূমকেতু বা উল্কাপিণ্ডের বিস্ফোরণের ফলেই হয়তো
তারা ছড়িয়ে পড়েছিল মেঘের ভেতর। সঙ্গে ওই লাল রঞ্জকের একটা কণার বিবর্ধিত ছবি
দিলাম। লুইসদের দাবি, এগুলো কোনও মহাজাগতিক জীবকোষ।
বহু
গবেষণা এখনও চলছে ওই লাল বৃষ্টি নিয়ে। বিজ্ঞানী চন্দ্র ওয়াইক্রমসিঙ্ঘে দাবি
করেছেন, তাঁর পরীক্ষায় ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে ওদের মধ্যে ডিএনএ-র উপস্থিতির। তবে
নিশ্চিত ফল এখনও পাওয়া যায়নি। চলছে তত্ত্ব ও বিপরীত তত্ত্বের লড়াইও। তবে শেষমেশ
যদি লুইসদের তত্ত্বটা ধোপে টেঁকে তবে এটা হবে প্যানস্পারমিয়া তত্ত্বের (ফ্রেড হয়েল
ও চন্দ্র ওয়াইক্রমসিঙ্ঘের এই তত্ত্ব বলে, মহাবিশ্বের অন্য কোথাও থেকে ধূমকেতু বা
উল্কায় সওয়ার হয়েই পৃথিবীতে এসেছিল প্রথম প্রাণকণারা) প্রথম প্রত্যক্ষ প্রমাণ।
২০০৭-এর ২১ অগাস্ট নাকি কোঝিকোড় জেলার উত্তর অংশে আবার কোথাও কোথাও এই লাল বৃষ্টি
হয়েছে। গবেষণা চলছে তার নমুনা নিয়েও।
কেরালাতে
এই রক্তবৃষ্টি ফের হয়েছে ২০০৯ ও ২০১১-তে। ২০১২ সালের নভেম্বর মাসে শ্রীলঙ্কার
তিনটে জায়গায় ফের লাল বৃষ্টি হলে সে দেশের সরকার সে দেশের পরীক্ষা করে রায়
দিয়েছেন, ওতে রয়েছে লাল ও হলুদ রঙের জৈববস্তুর উপস্থিতি। রিপোর্টে আরও একটা
রহস্যময় কথা বলা হয়েছে, আলোর সংস্পর্শে এলে সেগুলো নাকি বাঁচতে পারে না।
সব
মিলিয়ে এই রক্তবৃষ্টি আমাদের সামনে একটা নতুন রহস্যের দুনিয়ার দরজায় দাঁড় করিয়ে
দিয়েছে। তার ওপারে ঠিক কী আছে কে জানে।
_____
ছবিঃ আন্তর্জাল
ছবিঃ আন্তর্জাল
সত্যি কত অপার রহস্য ছড়িয়ে আছে এই মহাজগতে! এগুলোর সামনে এলে সেই বিস্ময় স্তব্ধ করে দেয়। আমরা সকলেই যে আদতে অন্য কোন নক্ষত্রের সন্তান সন্ততি সে তত্ব তো পরোক্ষ ভাবে দীর্ঘকাল ধরেই চর্চিত। নইলে জীব দেহের মূল এক উপাদান কার্বন এত বিপুল পরিমাণে শুধু সূর্যের পেটের মধ্যে ঘটা ফিউসন-এ তো তৈরী হওয়া অসম্ভব। এখন এমন কোন প্রত্যক্ষ প্রমাণ সেই তত্ব কে প্রতিষ্ঠা দিতে পারে হয় তো একদিন।
ReplyDeleteখুব সহজ ভাষায় লেখা। বুঝতে কারও অসুবিধা হবে না।
ReplyDelete