“যত সমস্যা সব আমারই জন্যে
তৈরি থাকে। সত্যিই ভাগ্যটা বড়ো খারাপ। মাঝরাস্তায় আজকেই বাসটা খারাপ হতে হল! এখন
এতখানি রাস্তা, একা
যেতে হবে। রাস্তায় তো কাউকে দেখতেও পাচ্ছি না!” গজগজ করতে করতে রাস্তায় হাঁটছিল
সহেলী।
আসলে এমনিতেই আজ অফিসে প্রচুর
চাপ ছিল। তারপরে আবার মাঝরাস্তায় বাস খারাপ। তবুও অনেকক্ষণ
অপেক্ষা করেছিল। আর তাতেই বিপত্তি বাড়ল। পরের বাসস্টপ অনেকটা রাস্তা। বাধ্য হয়ে
ঘুরপথ ধরেছিল সহেলী। বাসের কন্ডাক্টার আর ড্রাইভারদাদা বারবার ওকে বারণ করেছিল,
“ম্যাডামজী, ওই রাস্তায় যাবেন না। মৃত্যু ওৎ পেতে থাকে।”
স্বভাবতই ও শোনেনি। কিন্তু
এখন মনে হচ্ছে বড্ড ভুল করেছে। দু’ধারে ঘন জঙ্গল হয়ে আছে রাস্তার। একটা লোককেও
দেখতে পাচ্ছে না। শুধু মোবাইলের আলোয় যেটুকু যা আলো। দূরে চাপ
চাপ অন্ধকার। অন্য সময় এই অন্ধকার ভালোবাসলেও আজ কীরকম যেন একটা অস্বস্তি হচ্ছে
সহেলীর। ভূতে না ভয় পেলেও আজকালকার মানুষ, সত্যিই ভূতের চেয়েও ভয়ংকর!
এসবই ভাবতে ভাবতে এগিয়ে
যাচ্ছিল ও। হঠাৎ পেছনে পায়ের আওয়াজে চমকে উঠল। কেউ কি আসছে? পেছনদিকে
মোবাইলের আলোটা ফেলল সহেলী। আরে, ওই তো একজন আসছে মনে হয়! হাঁফ ছেড়ে বাঁচল যেন। কাছে আসতে
দেখল এক বয়স্ক ভদ্রলোক। মাথার চুলগুলো পুরো সাদা হয়ে গেছে। হাতে লাঠি, কুঁজো হয়ে
হাঁটেন।
“আরে, আপনিও কি ওই
বাসে ছিলেন? কতক্ষণ
ধরে একা হেঁটে চলেছি। আর পাঁচ মিনিটের রাস্তা অবশ্য। তবুও ভালো আপনার দেখা পেলাম।
সত্যি বলতে কী, বেশ ভয় ভয় করছিল এতক্ষণ।”
একটানা কথাগুলো বলে থামল
সহেলী। আসলে এতটা সময় একা হাঁটতে হাঁটতে বেশ ভয় পাচ্ছিল। তাই একজনকে পেয়ে গড়গড় করে
কথা বলতে শুরু করে দিল। কিন্তু অবাক হয়ে দেখল, যার উদ্দেশ্যে এতগুলো কথা বলা, তিনি শুধু
অবাক হয়ে একবার তাকালেন সহেলীর দিকে। অথচ কোনও কথাই বললেন না। কিন্তু সহেলী তো চুপ
করে থাকার মেয়ে নয়। চেনা অচেনা নির্বিশেষে সে অবিরাম বকে যেতে পারে। সে বলেই চলেছে, “কী সমস্যা
বলুন তো! এভাবে মাঝরাস্তায় বাস খারাপ হল। একটা গাড়িও দাঁড়াচ্ছিল না। সবাই বড়ো
স্বার্থপর। আসলে বড়ো রাস্তায় অনেকটা হাঁটতে হত। তাই এই রাস্তাটা ধরলাম। একটাও লোক
নেই কেন বলুন তো? আর
কী অন্ধকার! আরে এই তো,
বাসস্টপ চলেই এল। আচ্ছা আপনি কী রোজ যাতায়াত করেন এই রাস্তায়? আসলে আপনার
হাতে আলো নেই তো। এই অন্ধকারে হাঁটতেন কী করে?”
আরও হয়তো কিছু বলত সহেলী।
তার আগেই ওপাশ থেকে গমগমে গলায় ভেসে এল, “আপনার বাসস্টপ তো এসে গেল। কিন্তু
আপনি হয়তো আমায় দেখে ভালো করলেন না। আমায় সবাই দেখতে পায় না। আর যারা
দেখে তারা বাঁচে না। সাবধানে ফিরবেন। আমি চলি।”
অন্ধকারে আবার উল্টোদিকে
হাঁটতে শুরু করে দিয়েছেন ভদ্রলোক। প্রথমে অবাক হয়ে তাকিয়েছিল ভদ্রলোকের যাওয়ার
দিকে। তারপরেই খুব একচোট হেসে নিল সহেলী। উফ্! এতক্ষণ ধরে কি ও এক মাতালের সাথে
বকতে বকতে আসছিল! সত্যিই, এটা ওর দ্বারাই সম্ভব।
বন্ধুরা এ নিয়ে অনেক হাসাহাসিও করে। আসলে কথা না বলতে পারলে ওর কীরকম পাগল পাগল
লাগে নিজেকে। অবশ্য কতটা সুস্থ ও তা নিয়ে সবার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কিন্তু ওনাকে তো
মাতাল বলে মনেই হয়নি। কথাও তো বলছিলেন না।
কীসব বলে গেল! নিজের মনেই
হাসতে হাসতে রাস্তা পেরোচ্ছিল ও। ওপারে যেতে
গিয়েই চমকে উঠল। পেছন থেকে কে যেন ডাকছে মনে হচ্ছে। এখানে আবার কে ডাকছে ভেবে মুখটা
ফেরাতেই অবাক হয়ে গেল সহেলী। সূর্য না? হ্যাঁ, সূর্যই তো! তবে যে...!
না, আর কিছু
ভাবার আগেই সূর্য এগিয়ে এল ওর দিকে। “কী রে, কেমন আছিস? এই রাস্তা
দিয়ে এলি? জানিস
না রাস্তাটা
ভালো নয়?”
সহেলী বলল, “তুইও একথা
বলছিস! এই তুই বিজ্ঞানের ছাত্র!”
“ছিলাম।”
মৃদু হেসে বলল সূর্য।
“ছিলিস মানে! এখন কি
কবিতা লিখিস? নেশাটা
আছে এখনও?” সহেলী
জিজ্ঞেস করল।
কলেজের বন্ধু ওরা। সূর্য ছিল
লেখাপড়ায় দুর্দান্ত। কিন্তু সারাদিন কবিতা লিখে বেড়াত। এই নিয়ে নাকি ওর বাড়িতেও
খুব অশান্তি হত। কলেজ শেষ,
যে যার মতো ছিটকে পড়েছিল। তবে সহেলী শুনেছিল, সূর্য নাকি খুব আশ্চর্যজনকভাবে
মারা গিয়েছে।
উফ্, কত ভুল খবর! ভাগ্যিস ভূত
বলে আঁতকে উঠিনি! নিজের মনেই হেসে উঠল সহেলী।
“কী ভাবছিস? আমি ভূত?”
“না মানে, যে খবরটা
শুনেছিলাম...” আমতা আমতা করে বলল সহেলী।
“ধুস্! পালিয়েছিলাম বাড়ি
থেকে। চ, তোকে
বাসে তুলে দিই।”
“কী করছিস আজকাল?” সহেলী
জিজ্ঞেস করল।
“ডাক দিয়ে বেড়াই।”
“মানে?” অবাক হয়ে
জিজ্ঞেস করল সহেলী।
হা হা করে হেসে উঠল সূর্য। “বুঝবি
না, চ।”
ওপারে গিয়ে তো আর এক কান্ড।
এক্ষুনি নাকি অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। লোকে লোকারণ্য হয়ে গেছে। রক্তে ভাসছে চারদিক।
রক্ত দেখেই চোখ বন্ধ করে ফেলেছে সহেলী। কোনওরকমে চোখ বন্ধ করে বাকি রাস্তাটুকু
পেরলো। সবাই বলছে একটা মেয়েকে লরি থেঁতলে দিয়ে চলে গিয়েছে।
সহেলী একটু দূরে গিয়ে দাঁড়াল। এমনিই
এত রক্ত দেখে শরীরটা খারাপ লাগছে। আজ আদৌ বাড়ি যাওয়া হবে! এক্ষুনি তো রাস্তা বন্ধ হয়ে
যাবে। ওই একটা বাস আসছে। যাক। থামতেই
সূর্যকে বিদায় জানিয়ে উঠে পড়ল ও। কিন্তু আসার সময় মেয়েটির পা চোখে পড়েছিল।
জুতোদুটো বড্ড চেনা চেনা লাগছিল। কোথায় যে দেখেছি, কোথায় যে দেখেছি! উফ্! আজ যে কী
হচ্ছে! কিছুতেই মনে করতে পারছিল না সহেলী। তাহলে কি ওরই কোনও বন্ধু? ইসস্,
স্বার্থপরের মতো ও চলে এল! কিন্তু কে? না, না, তা যেন না হয়! ভাড়া দিতে গিয়েই চমকে
উঠল। মেরুদন্ড বেয়ে বরফের স্রোত নেমে গেল সহেলীর। মনে পড়ে গিয়েছে জুতোজোড়া
কোথায় দেখেছে। দু’বছর আগে মেলা থেকে ও আর ওর বোন কুহেলী বাবার কাছে বায়না করে একই
জুতো কিনেছিল। সহেলী আর কুহেলী দুই বোন, যমজ। মাও গুলিয়ে ফেলে ওদের। তাহলে কি... মৃত্যুও ভুল
করল? কাকে
ডাকতে এসেছিল সূর্য?
হিসেবগুলো মেলানোর আগেই জ্ঞান হারাল সহেলী।
_____
অলঙ্করণঃ পুণ্ডরীক গুপ্ত
দারুণ হয়েছে। আরো চাই
ReplyDeleteধন্যবাদ দাদা
Deleteঅসাধারণ
ReplyDeleteধন্যবাদ ☺
ReplyDelete