সে এসেছে। রোজ এসময়ই একটা
শব্দ শুনতে পাই। মনে হয় ঘরে কেউ আছে। অদ্ভুত একটা শব্দ। রোজই কান খাড়া করে শুনবার
চেষ্টা করি। বুঝতে চাই কীসের শব্দ। বুঝতে পারি না। শব্দটা থামে মাঝে মাঝে, আবার
শুরু হয়। কতক্ষণ এভাবে জেগে থাকব? ঘুম নেমে আসে চোখে। তারপর ঘুমিয়ে পড়ি।
আজ রবিবার। রাতে জাগব বলে
দুপুরে একচোট ঘুমিয়ে নিয়েছি।
মছলন্দপুরের মতো এক অজ
পাড়া-গাঁ থেকে কলকাতায় এসেছি। এটা আমার মামাবাড়ি। আমার বাবা এক গরিব ইশকুল
মাষ্টার। মাধ্যমিক পাশ করার পর বাবা হস্টেলে রেখে আমায় কীভাবে পড়াবেন ভেবে
পাচ্ছিলেন না। আমার মামার অবস্থা বেশ ভালো। গড়িয়াহাটে তাঁর সোনার গয়নার দোকান আছে।
আমার রেজাল্ট ভালো হয়েছে শুনে মামা বললেন, টুকাই আমার বাড়িতে থেকে পড়বে। বাবা
এককথায় রাজি হয়ে গেলেন। কলকাতায় এসে কলেজে ভর্তি হয়েছি। মামাবাড়িতে সদস্য সংখ্যা আট। মামার
তিন ছেলেমেয়ে। এক দূরসম্পর্কের বিধবা মাসি ও তার দুই মেয়ে থাকে এখানেই। আর সারাদিনের
কাজের লোক নকুড়দা। ঠিকে ঝিরা আসে। কাজ সেরে চলে যায়।
আপাতত একতলার এই গুদামঘরে
আমার জায়গা হয়েছে। মামা বলেছেন, টিকলুদার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা সামনে। পাশ করে সে
হস্টেলে চলে যাবে। তখন টিকলুদার ঘরটা আমি পেয়ে যাব।
কয়েকমাসের ব্যাপার। আমি রাজি হয়েছি। এমনিতেই আমার কষ্ট সহ্য করার অভ্যেস আছে।
এই ঘরে একটাই মাত্র জানালা।
খোলা থাকলে রোদ, আলো, বাতাস সবই আসে। তবে এতদিন বন্ধ ছিল বলে কেমন একটা ভ্যাপসা
গন্ধ। একটা তক্তপোষ। সেটার পায়াগুলোর নিচে খান কয়েক ইট রেখে উঁচু করা হয়েছে।
তক্তপোষের নিচটা নানারকমের জিনিস দিয়ে ঠাসা। তক্তপোষের পাশে একটা ছোটো টেবিল আর
চেয়ার রেখেছি। টেবিলের উপরে আমার বইপত্র সাজানো। দেয়ালে জামাকাপড় ঝোলানোর হুক
টাঙিয়েছি। আমার ছাড়া শার্ট-প্যান্ট সেখানে ঝুলিয়ে রাখি। একটা ছোটো স্যুটকেসে আমার
বাকি জামাকাপড়। এই আমার সম্পত্তি। এক সপ্তাহ হল আমি কলেজে যাচ্ছি। বাসে চেপে গেলে মাত্র
কুড়ি মিনিট লাগে। খুব মন দিয়ে পড়াশোনা করছি। কিন্তু প্রতিদিন রাতে ঘুমের ব্যাঘাত।
কথাটা আমি এখনও পর্যন্ত কাউকে বলিনি। রাতে ভালো ঘুম হয় না বলে পরেরদিন ক্লাস করতে
করতেই ঘুম পেয়ে যায়।
আজ রাতে আমি জেগে আছি।
টিকলুদার থেকে একটা টর্চ যোগাড় করেছি। ঘরের আলো জ্বেলে রেখে আমি ঘুমোতে পারি না।
রোজ রাতে যে আসে, তার মনে হয় অন্ধকারেই কাজকর্মের সুবিধা। দু-একদিন আলো জ্বালিয়ে
দেখার চেষ্টা করেছি। কাউকে দেখতে পাইনি। কোথায় যে লুকিয়ে পড়ে! শব্দটাও থেমে যায় আলো
জ্বালালেই। একবার মনে হল চোর নয়। এই ঘরে এমন কীই বা সম্পত্তি আছে, যে চুরি করতে
আসবে!
চোখ বুজে চুপ করে শুয়েছিলাম।
সে এসেছে, টের পেলাম। সতর্ক হলাম। জানালাটা খোলা। তাই মৃদুমন্দ হাওয়া খেলছে ঘরে।
আর সেই হাওয়ায় আমার মশারিখানা নৌকোর মতো দুলছে। রাস্তায় একেবারেই আলো নেই। তাই
ঘরভরা অন্ধকার। তক্তপোষের নিচে ঢুকেছে সে। কারণ, শব্দটা সেখান থেকেই আসছে। কী এমন
সম্পত্তি আছে সেখানে! তক্তপোষের তলায় হাবিজাবি জিনিস দিয়ে ঠাসা। আমার কোনওদিনও কৌতূহল
হয়নি জিনিসগুলো নিয়ে। পুরনো জিনিসপত্র ছাড়া আর কীই বা হতে পারে! কিন্তু আজ একটা
হেস্তনেস্ত করব। যদি চোর হয়, আর সেই চোরকে আমি ধরতে পারি, তবে নিশ্চিত মামাবাড়িতে
আমার দাম বেড়ে যাবে। মুনিয়া আর রিমলি-ঝিমলির চোখে হিরো হয়ে যাব। টিকলুদা সাবাসি
দেবে। পিকলু অবশ্য হিংসে করবে। এমনিতেই সে আমাকে বিশেষ পছন্দ করে না। ভাবটা এমন,
যেন কোথা থেকে এসে জুড়ে বসেছে! আমি এখানে আসার পর হয়তো তার ভাগের মাছের টুকরোটা
একটু ছোটো সাইজের হয়ে যাচ্ছে। মুনিয়ার কাছেই শুনেছি, পিকলুর প্রিয় খাবার নাকি মাছ।
এ ছাড়া আমাকে হিংসে করার আর কী কারণ থাকতে পারে!
আজ তৈরি হয়েই শুয়েছিলাম। এই ঘরের
কোণে একটা মোটা লাঠি পড়েছিল। সেই লাঠিটা মাথার কাছে নিয়ে শুয়েছি। শব্দটা শুনে মশারি
তুলে সন্তর্পণে বিছানা ছেড়ে নামলাম। আমার এক হাতে টর্চ আর এক হাতে লাঠি। চোরটা কি
তক্তপোষের নিচেই? ওখান থেকেই ঠুং-ঠাং শব্দ আসছে। আমি খুব সাবধানে মেঝেতে বসলাম।
মাথা নিচু করে তক্তপোষের নীচটা দেখতে চাইছি। এত অন্ধকার, ঠিকমতো কিছু ঠাহর হচ্ছে
না। এখনই টর্চ জ্বালালে আমি বেকায়দায় পড়তে পারি। আবার টর্চ না জ্বালালে কিছুই
দেখতে পারছি না। তাই ঝুঁকি নিয়েই আমি টর্চটা জ্বালালাম। দেখি, একটা টিনের রংচটা
তোরঙ্গ, কিছু কাঁসার বাসনপত্র আর তিনটে বস্তা রয়েছে তক্তপোষের নিচে। তাহলে
কাঁসার বাসনে ধাক্কা লেগেই ঠুং-ঠাং শব্দ হয়েছিল। পেটমোটা বস্তাগুলোয় আবার কী আছে?
সোনাদানা কি কেউ বস্তায় ভরে রাখে? ব্যাঙ্কের লকার আছে, তাছাড়া মামীমার ঘরে তিন-তিনটে
লোহার আলমারি। সোনাদানা রাখলে তো সেখানেই রাখবে। আর
ওই পুরনো তোরঙ্গে এমন কিছুই থাকতে পারে না। সবচেয়ে বড়ো কথা, আমি যা ভাবছিলাম তা
নয়। তক্তপোষের নিচে কোনও মানুষের অস্তিত্বই নেই। তবে? আমি টর্চের আলো ঘোরাতে
থাকলাম। এদিকে আমার কৌতূহলের পারা ক্রমশ চড়ছে। যদি কোনও অশরীরী আত্মা হয়! একটু
একটু যে ঘাম হচ্ছে না, তা নয়। গলাটাও শুকিয়ে গেছে। তবু সাহসে ভর করে মাথা নিচু করে
আমি তক্তপোষের নিচে ঢুকলাম। সে অন্ধকারেই বোধহয় স্বচ্ছন্দ ছিল। হঠাৎ এক অদ্ভুতূড়ে
আলো আর একজন মানুষের উপস্থিতি তাকে ঘাবড়ে দিয়েছে। কারণ,
শব্দটা এখন আর শুনতে পাচ্ছি না। আমি প্রায়
হামাগুড়ি দিয়ে বস্তাগুলোর কাছে পৌঁছে গেলাম। এক এক করে টর্চ ফেললাম বস্তাগুলোর মুখের
কাছে। দুটো বস্তার মুখ সেলাই করা, একটা
বস্তার মুখ শুধু খোলা। কী আছে এতে! আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। তবু আমি অল্প মাথা
উঁঠিয়ে মুখখোলা বস্তাটার ভেতরে হাত ঢোকালাম। মনে হল, একটা নরম লোমশ প্রাণীর গায়ে
হাত দিলাম। ভয়ে শিউরে উঠলাম। এবার টর্চের আলোটা ফেললাম বস্তার ভেতরে। দেখি বস্তাভরা
চাল আর তার মধ্যে বসে আছে এক প্রকান্ড সাইজের ইঁদুর। ধূসর তার গায়ের রঙ।
কালোপুঁতির মতো চোখদুটো জ্বলছে। সে এমনভাবে আমাকে দেখছে যে, পারলে চাল ছেড়ে সে
আমাকেই চিবিয়ে খাবে। ইঁদুরটা কিন্তু মোটেও ভয় পেল না। বরং
আমাকে দেখে বিরক্ত হল। কারণ, এই ঘরটাই ওর রাজত্ব। দিনের বেলায় সে লুকিয়ে থাকে,
কারণ গুদাম ঘর হওয়ার জন্য বাড়ির মেয়ে-ঝিরা নিশ্চয়ই এ ঘরে যাতায়াত করে। ইঁদুরবাবাজি
তাই বেরোন রাতের বেলায় চুপিচুপি। এতদিন টের পায়নি তার সাম্রাজ্য দখল করে বসে আছে
আর একজন। এবার ঘরে পাহারা বসেছে।
ইঁদুরটা এতদিন জানত, এখানে
বস্তা বস্তা চাল, যতখুশি খাও, বাধা দেবার কেউ নেই। এখন সে ধরা পড়ে গেছে। কিচকিচ
একটা আওয়াজ করে সে প্রতিবাদ জানাল। তারপর আমার হাতে দাঁত বসাতে গেল। ভাগ্যিস! আমি
ঠিক সময়মতো আমার হাতটা সরিয়ে নিয়েছি। আমার হাতের
থেকে টর্চটা পড়ে গেল। নেভেনি। টর্চের আলোটা চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। ইঁদুরটা
এবার বেরিয়ে এল বস্তার ভেতর থেকে। মাটি ঘেঁষে, আধা অন্ধকারে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে
থাকল পেছনের পায়ে ভর করে। অনেকটা আমারই মতো বসা তার। সামান্য উবু হয়ে বসে মানুষ
যেমন হুঁকো থেকে তামাক টানে, বসার পোজটা ঠিক তেমনই লাগছে।
ইঁদুরটা এতটুকু নড়ল না। এ কী রে
বাবা! একটা জলজ্যান্ত মানুষ তার সামনে বসে আছে, আর সে ভয় পাচ্ছে না মোটে! আমার খুব
রাগ হচ্ছে। অপমানিত বোধ করছি। এবার চরম
বিরক্তিতে সে পেছনের একটা পা তুলে আমাকে লাথি দেখাল। তারপর
মাটিতে গড়াগড়ি খেল কিছুক্ষণ। আবার উঠে বসল। তার চোখের দৃষ্টি এবার আস্তে আস্তে একটু
করুণ হয়ে আসছে। আমার মনে হল, সে বলতে চাইছে, এস, সন্ধি করি। এই ঘরে এতদিন আমার একমাত্র
অধিকার ছিল। এখন তুমি কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসেছ। তোমাকে মাফ করলাম। এবার কেটে
পড়। তুমি তোমার নিজের কাজ কর, আমাকে আমার কাজ করতে দাও। এই ব্রহ্মরূপ খাবার খেয়ে
আমি প্রাণধারণ করি।
আমার এবার সত্যি সত্যি দয়া
হল। সত্যিই তো আমি এই ঘরে উড়ে আসা এক জীব। এই গুদামঘরে ওর পূর্ণ অধিকার। হয়তো ওর
এখানেই জন্ম, এখানেই বড়ো হয়েছে, এখানেই মৃত্যু ঘটবে। আমি
এই ঘরে আর ক’দিন! ইঁদুরটাকে চোখের ইশারায় আশ্বস্ত করে আমি হামাগুড়ি দিয়ে তক্তপোষের
নিচ থেকে বেরিয়ে এলাম।
মশারি তুলে বিছানায় এসে শুয়ে
পড়েছি। টর্চ নিভিয়ে বালিশের পাশে রেখে দিলাম। চোখে ঘুম নেমে আসছে। শুনতে পাচ্ছি
আবার সেই শব্দ। ইঁদুরটা মনের সুখে চাল চিবোচ্ছে। আর কিচকিচ শব্দে আমাকে বোধহয় কৃতজ্ঞতা
জানাচ্ছে।
_____
অলঙ্করণঃ পুণ্ডরীক গুপ্ত
বাহ্, বেশ লাগলো।
ReplyDeleteবাহ
ReplyDeleteভাষা, লিখনভঙ্গি, আখ্যান বেশ ভালো ও ছোটদের উপযোগী। (সুজিতকুমার নাহা)
ReplyDelete