প্রেমেন্দ্রর তিন সেপাই
সৌরভ চক্রবর্তী
আমাদের বাংলা সাহিত্যে রয়েছে রকমারি চরিত্র-সম্ভার।
একেকজন লেখকই সৃষ্টি করেছেন একাধিক চরিত্র।
তাঁদের আবার কেউ গোয়েন্দা,
কেউ পুলিশ, কেউ বিজ্ঞানী তো আবার কেউ পশুপ্রেমী। এঁদের
একেকজনের একেকরকম অভ্যেস, আবার
বদভ্যেসও কম নয়। তো এঁদের সবার গল্প আমরা পড়েছি, কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না
এই গল্পের নায়কদের জন্ম কীভাবে হয়েছিল। কীভাবে
লেখকের মাথায় প্রথম আসে এইসব চরিত্র সৃষ্টির আইডিয়া। তো
এবার থেকে একপর্ণিকার পাতায় আমরা একে একে সেইসব না জানা গল্প জানার চেষ্টা করব।
সূত্রধার হিসেবে আমি তো রইলামই। এবারে
সংখ্যায় রইলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র, তাঁর খেরোর খাতার তিন সেপাইকে নিয়ে।
গুলরাজ ঘনশ্যাম দাশ
বাঙালি পাঠকদের কাছে বনমালী নস্কর লেনের ৭২ নম্বর মেসবাড়ি এমন
কিছু অপরিচিত জায়গা নয়। আর সেই মেসেরই বাসিন্দা আমাদের
ঘনশ্যামবাবু ওরফে ঘনাদা। মধ্যবয়সী ঢ্যাঙা-পটকা চেহারার লোকটির প্রথম
আবির্ভাব হয় ‘মশা’ গল্পে, দেব সাহিত্য কুটির প্রকাশিত
শারদসংখ্যা ‘আলপনা’য়। সালটা
ছিল ১৯৪৫। তারপর থেকে বছরভর বেরোতে থাকে
ঘনাদার একেকটি কারনামা। তৎকালীন বাঙালি পাঠক পেয়ে যায়
বিজ্ঞান-ইতিহাস-মিথোলজির মিশেলে তৈরি একদম
ঘরোয়া পাকে রান্না করা এক প্রিয় চরিত্রকে। মূলত
শিশু ও কিশোরদের জন্যে হলেও ঘনাদার ব্যাপ্তি ছড়িয়ে পড়ে প্রাপ্তবয়স্ক পাঠকদের মধ্যেও।
প্রেমেন্দ্র মিত্রকে তাই উভয় বয়সী পাঠকের তৃষ্ণা মেটাতে ঘনাদাকে
বসাতে হয় দুটো ভিন্ন আড্ডায়।
প্রথম আড্ডাটি পূর্বে উল্লেখিত পশ্চিমবঙ্গের বনমালী নস্কর লেনের
৭২ নম্বর মেস বাড়ি যেখানে ঘনাদার সাথে আড্ডায় বসত শিবু,
শিশির, গৌর আর সুধীর মানে আমাদের গল্পকথক। এই
চার অল্পবয়সী ছেলেরা ঘনাদাকে রীতিমতো তোয়াজ করত আর কায়দা করে শুনতে চাইত ঘনাদার অফুরন্ত
গুল থুড়ি গল্পের ভাণ্ডার থেকে একেকটি গল্প বা ঘনাদার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা।
ঘনাদাও তাদের ইচ্ছেটা ভালোভাবেই পূর্ণ করতেন।
শুরু করতেন একেকটি কল্পবিজ্ঞান বা ঐতিহাসিক কিম্বা অ্যাডভেঞ্চারের
বর্ণনা যেখানে ঘনাদা নিজেই থাকতেন হিরোর ভূমিকায় আর প্রত্যেকটা গল্পে সসম্মানে দুর্জেয়দের
জয় করে ফিরতেন অট্টহাস্য করতে করতে। এই
ধারার গল্প-উপন্যাসগুলোতে
আরও দুয়েকটা চরিত্র থাকত যেমন, রান্নার ঠাকুর রামভুজ আর সবরকম ফাইফরমাস পূরণ করার জন্যে বনোয়ারী।
এবার আসি দ্বিতীয় আড্ডায়। এটি
কলকাতার এক লেকের ধারে। এটি হল বয়স্কদের একটি আড্ডাখানা
যেটা সন্ধ্যাবেলা বসে। এখানেও মধ্যমণি সেই আমাদের
ঘনাদা আর তাঁর গপ্পগাছা। সঙ্গে বাকি মেম্বাররা বা বলা
ভালো শ্রোতারা হলেন হরিসাধনবাবু, শিবপদবাবু, রামশরণবাবু এবং ভবতারণবাবু। এই
আড্ডার গল্পগুলোর ধরন, বুনন
এবং ট্রিটমেন্ট মেসের গল্পগুলোর থেকে অনেকটাই আলাদা। একটু
প্রাপ্তবয়স্ক পাঠকদের কথা মাথায় রেখেই যেন লেখা এই গল্পগুলো। যদিও
কিশোররাও যেকোনও দিন তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতে পারে এই গল্প-উপন্যাসগুলো। এখানকার
কাহিনিগুলোতে ঘনাদা যতটা না নিজে হিরো হয়েছেন তার চেয়ে বেশি হিরো করিয়েছেন তাঁর পূর্বপুরুষদের, যারা পুরাকালের অনেক ঐতিহাসিক
ঘটনার সাক্ষী থেকেছেন, এমনকি
নিজ চক্ষে দেখেছেন ইনকা সভ্যতা বিনাশের কারণ। শিবাজিকে
আগ্রা থেকে পলায়ন করতেও দেখেছেন তাঁরা, সেটাও আবার মধ্যযুগের ভারতে বসে। তাহলেই
বোঝো গুল মারাটাকে, উফ্, বার বার ভুল বলছি, গল্প বলাটাকে কোন পর্যায়ে তুলে
নিয়ে গেছিলেন ঘনাদা! ভাবা
যায়!
ঘনাদার প্রত্যেকটি গল্পে বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা
যেমন ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, বোটানি, জুলজি ইত্যাদি তো বটেই, আলোচিত হয়েছে অনেক ঐতিহাসিক
প্রেক্ষাপটও। ঘনাদার কাহিনির বিষয়ে বারবার
ঘুরে ফিরে এসেছে মিথোলজি, এমনকি
মহাভারতের কথাও খুঁজে পাওয়া যায় কিছু গল্পে। লেখক
প্রেমেন্দ্র মিত্র যে কাহিনির বিন্যাস এবং তৎসম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়কে খুব সংশ্লিষ্ট
হয়ে অনুসন্ধান করে লিখতেন তা লেখাগুলো পড়লেই স্পষ্ট হয়। ‘ঘনাদা তস্য তস্য অমনিবাস’-এর শুরুতে লেখক জানিয়েছেন,
“নিজে যা কিছু অনুভব করি,
বিজ্ঞানের জগতের সেই রহস্য-রোমাঞ্চ-বিস্ময়ের স্বাদ পাঠকদেরও কিছু দিতে পারি কি না দেখবার জন্যেই একটু
কৌতুকের সুর মিশিয়ে ঘনাদাকে আসরে নামানো।”
ঘনাদার গল্পগুলোর আরেক বিশেষত্ব হল ঘনাদারই কিছু ‘ওয়ান লাইনার’। যেমন ধর, ‘মশা’
গল্পে দুর্জেয়দের পরাজিত করা ঘনাদা জানিয়েছিলেন, জীবনে একটিমাত্র মশা মেরেছেন
তিনি। মঙ্গলগ্রহে পাড়ি দিয়েছেন বলেও
জানিয়েছেন ঘনাদা। একটা গোপনীয় নক্সা হিমালয়ের
বিগ্রি হাসের কাছে লুকিয়ে এসেছেন বলেও যে ব্যক্তি আমাদের জানান, তাঁর নামও ওই ঘনাদাই।
তাহলেই বোঝো, গুলতাপ্পির ওয়ান লাইনার তিনি কেমন মারতে জানেন।
তাই তো এই বিষয়ের আরেক মাস্টার টেনিদাও তাঁর গল্পে তাঁকে গুরু
বলে উল্লেখ করেছিলেন।
এই বিষয়ে লেখকের স্পান ম্যাগাজিনকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকার উল্লেখযোগ্য।
তিনি সেখানে বলেছেন যে ঘনাদা হয়তো বা লম্বা লম্বা বুলি আওড়ায়, কিন্তু গল্পগুলোর একটা বৈজ্ঞানিক
ভিত্তি রয়েছে। আর আমরাও যুক্তি খুঁজতে গেলে
লেখকের কথার সাথেই একমত হই।
ঘনাদার প্রথম সাদাকালো কমিক্স লিখেছিলেন অনিল কর্মকার এবং সেটার
ইলাস্ট্রেশন করেন গৌতম কর্মকার। বেরিয়েছিল
কিশোর জ্ঞানবিজ্ঞান পত্রিকায়। ঘনাদার
শেষ গল্প বেরোয় ১৯৮৪ সালে, কিশোর জ্ঞানবিজ্ঞান পত্রিকার পূজাসংখ্যায়।
এর ঠিক একবছর আগে গঠিত হয় ঘনাদা ফ্যান ক্লাব।
গঠিত হয়েছিল লেখকেরই বাড়িতে,
কালীঘাটে। ঝন্টুমামা
স্রষ্টা সিদ্ধার্থ ঘোষ এই ক্লাবের প্রস্তাব আনেন। কিন্নর
রায়ও ছিলেন এই ক্লাবের মেম্বার। বর্তমানে ঘনাদা
গ্যালারি বলে একটি সাইট রয়েছে যেখানে ঘনাদার সমস্ত ছবিসহ সবকিছুই পাঠকদের নাগালের মধ্যে।
এছাড়াও গল্পগুলো তিনটি বইয়ে সমগ্র আকারে বেরিয়েছে।
*****
মামাবাবু
আমাদের বাংলা সাহিত্যে মাম-ভাগ্নে, কাকা-ভাতিজা সিরিজগুলো খুবই জনপ্রিয়। তাই মাঝে মাঝেই জানতে ইচ্ছে
করত এই সিরিজের জন্ম কবে, কার
হাতে।
আবার লক্ষ করলে দেখা যাবে, বেশিরভাগ
ক্ষেত্রেই এই সিরিজগুলো হয় অ্যাডভেঞ্চারধর্মী। তাহলে
কি ওই প্রথম সিরিজখানাও তাই ছিল ? এরকম
অনেকগুলো প্রশ্ন যত্নবান পাঠকের মস্তক আকর্ষণ করতেই পারে। তাঁদের
জন্যে স্বয়ং উপস্থিত সেই ব্যক্তি যাকে দিয়ে মামা-ভাগ্নে সিরিজের শুরু। ঠিক, প্রেমেন্দ্র
মিত্রের আরেক আশ্চর্য সৃষ্টি ‘মামাবাবু’র কথাই বলছি
– দুঃসাহসিক অভিযানের রোমাঞ্চের সাথে বিজ্ঞানের জিজ্ঞাসাকে
মিশিয়ে লেখা এক লার্জার দেন লাইফ চরিত্র।
মামাবাবু
তাঁর প্রথম অভিযান শুরু করেন ‘কুহকের
দেশে’ নামক একটি উপন্যাসে। উপন্যাসটি
ছাপা হয়েছিল বিগত শতকের তিরিশের দশকের প্রথমদিকে,
‘মৌচাক’ পত্রিকায়। যদিও
মামাবাবু তখনও পাঠকমনে ততটা সাড়া ফেলতে পারেননি। সেটা
পেরেছিলেন তাঁর দ্বিতীয় অভিযানে। ১৯৪৮ সালে সিগনেট প্রেস থেকে প্রকাশিত হয় এক আনপুটডাউনেবল
উপন্যাস – ‘ড্র্যাগনের নিঃশ্বাস’।
বইটির প্রচ্ছদ আঁকেন সত্যজিৎ রায়। এই বইটি বেরোবার পর পাঠকদের
মনে নতুনভাবে দাগ কাটে ‘মামাবাবু
সিরিজ’। কল্পবিজ্ঞান জায়গা করে নেয় বাঙালি পাঠকদের মনে। যদিও
এরপর অনেকদিন ‘মামাবাবু’ লিখলেন না লেখক। এরই
মাঝে প্রায় পনেরো বছর পর শ্রীপ্রকাশ ভবন থেকে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল মামাবাবুর
প্রথম উপন্যাস ‘কুহকের দেশে’। তখন সমগ্র বিশ্বের মতো আমাদের
বাঙালি পাঠকের মনেও কোথাও যেন কল্পবিজ্ঞান কাহিনির প্রবল চাহিদা, কিন্তু জোগান খুবই অল্প। তাই
লেখক আবার কলম তুললেন। মামাবাবু আবার ছুটলেন। অন্যসব
কাহিনি পড়তে পড়তে হরাইজন্টাল হয়ে যাওয়া পাঠকরা আবার ভার্টিক্যাল হয়ে বসল টানটান উত্তেজনা
নিয়ে।
ষাটের দশকে আলফা-বিটা
থেকে প্রকাশ পেল মামাবাবুর তিনটি কাহিনি – ‘মামাবাবুর প্রতিদান’, ‘আবার সেই মেয়েটি’ এবং ‘অতলের গুপ্তধন’। অনেকদিন
পর মামাবাবুকে ফেরালেন লেখক। তাই সেইমতো তিনটি কাহিনি সমন্বিত গ্রন্থের নাম রাখা
হল ‘মামাবাবু ফিরলেন’।
যেকোনও কাহিনিকারই তাঁর গল্পগুলোতে রেখে যান তাঁর অধীত অভিজ্ঞতার নির্যাস। প্রেমেন্দ্র
মিত্রের বেলায় যেন তা আরও প্রকট। দে’জ
পাবলিশিং থেকে বের হওয়া ‘মামাবাবু
সমগ্র’ বইটির সম্পাদক সুরজিৎ দাশগুপ্ত
বইটির অবতারণায় এ-বিষয়ে বলতে গিয়ে এমনটাই মনে
করছেন।
তাঁর উদাহরণস্বরূপ তিনি মামাবাবুর ষষ্ঠ কাহিনি
‘খুনে পাহাড়ি’র
কথা বলেছেন।
প্রেমেন্দ্র মিত্র তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্রের কর্মস্থল ওড়িশার সুন্দরগড় জেলার টেনসা
শিল্পনগরে কিছুকাল কাটিয়ে এসে লিখেছিলেন এই কাহিনি। সঙ্গে
মিশেল সেই অদ্ভুত কল্পনা যা সবসময়ই টেনেছে আমাদের।
১৯৭২ সালে শৈব্যা পুস্তকালয় থেকে বের হয়
‘খুনে পাহাড়’ যা
পরবর্তীকালে নাম পরিবর্তন করে হয় ‘পাহাড়ের
নাম করালী’। ১৯৮৩ সালে মামাবাবুর সমগ্র লেখাগুলোকে একত্র করে
বিদ্যোদয় লাইব্রেরি থেকে প্রকাশ পায় প্রথম ‘মামাবাবু সমগ্র’ যা
পাঠকদের মধ্যে সাড়া ফেলে দেয়। তাতে সময় অনুসারে এবং বিগত ভুলত্রুটিগুলোকে দূর করে
সাজিয়ে-গুছিয়ে মামাবাবুকে আমাদের
সামনে উপস্থিত করা হয়। ২০০৮ সালে সুরজিৎ দাশগুপ্তের সম্পাদনায় দে’জ পাবলিশিং থেকে বর্তমান বাজার চলতি ‘মামাবাবু সমগ্র’
প্রকাশ পায়।
এবার ফিরি মামাবাবুর গপ্পগুলোতে। গল্পের
ঘোড়াগুলো প্রতিবারেই ছুটেছে প্রেমেন্দ্রিক ছোঁয়া নিয়ে। খুব
মন দিয়ে ভাবলে কোনও এক বিশেষ গোত্রের মধ্যে ফেলাও যাবে না কাহিনিগুলোকে।
কখনও অ্যাডভেঞ্চার, পরক্ষণেই রহস্য কিম্বা একটি গল্প ছোটোদের তো পরেরটি আমাদের মতো
বড়ো বাচ্চাদের কথা ভেবে। তবুও সব গল্পেরই লেখনী টানটান, বাঁধুনি অটুট।
তাই পড়ার সময় দেখেছি যাকে বলে আনপুটডাউনেবল।
যদি কোনও গল্প মাঝপথে ছেড়ে কোনও কাজে উঠেছি তো মাথার পেছনটায় একটা
টনটনে প্রশ্ন থেকেই যায়। প্রশ্নটা ফিরে ফিরে আসে, ‘শেষটায় কী হবে? যেরকম ভাবছি তেমন, নাকি আছে কোনও টুইস্ট! নাকি যুক্ত হবে আরও নতুন কোনও
চরিত্র?’
ঠিক। এই চরিত্রের অনুপ্রবেশ প্রেমেন্দ্র
মিত্রের অন্যান্য গল্পের মতো এখানেও ঘটেছে অবাধ। কিন্তু
সকলেই স্বতন্ত্র এবং নিজের নিজের পার্ট খুব অবলীলায় সামলেছেন। কোথাও
বাড়বাড়ন্ত লাগে না এত চরিত্রের ঘনঘটাকে। আর
এতটা উপাদেয় বলেই বাধ্য হয়ে ফিরতে হয় গল্পে। আর
গল্পে ফেরা মানেই ‘কুহকের
দেশে’ ফেরা।
মামাবাবু তাঁর প্রথম অভিযান শুরু করেন
‘কুহকের দেশে’ গল্পে। সামান্য
একটি মৌমাছির কারণে কী করে তিনটি বড়ো বড়ো রাজ্যের মধ্যে যুদ্ধ লেগে যেতে পারত, সেই নিয়ে গল্প।
মৌমাছি মানেই মধু, আর এই মধু নিয়েই গোল। মধু
আর মৌমাছি খুঁজতে বেরিয়ে হিমালয়ের দুর্গম পার্বত্য অরণ্যের অ্যাডভেঞ্চার।
পড়তে পড়তে মাঝে মাঝে বিভূতিভূষণের বিখ্যাত ‘চাঁদের পাহাড়’-এর কথাও মনে পড়ে যায়।
শেষপর্যন্ত কী আবিষ্কৃত হয় সেটাই প্রশ্ন। উত্তর
এখানে মিলছে না। তার জন্য মামাবাবুর বই জোগাড়
করে পড়তে হবে। আর যদি না পড়া হয় তবে এটাও
জানা যাবে না যে ‘ড্র্যাগনের
নিঃশ্বাস’ গল্পে
যে দেশ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিল সে দেশে গিয়ে মামাবাবু কী রহস্য উদ্ধার করেন।
এই দুটি গল্প মূলত ছোটোদের কথা ভেবেই লেখক লিখেছিলেন।
তারপর প্রায় এক যুগ আর কোনও মামাবাবুর কাহিনি লেখক লিখেননি।
এরপর যখন তিনি ‘মামাবাবু ফিরলেন’ বইটি প্রকাশ করলেন, তাতে যে ক’টা গল্প লিখলেন, মানে ‘মামাবাবুর প্রতিদান’, ‘আবার সেই মেয়েটি’ এবং ‘অতলের
গুপ্তধন’ - এই
গল্পগুলো শুধুমাত্র ছোটোদের জন্য লিখলেন না। রাখলেন
বড়োদের ভালো লাগার মতো উপাদানও। কেন
সেটা করলেন হয়তো লেখকই ভালো বলতে পারতেন। কিন্তু
আমার মনে হয় এটাও একটা কারণ, যে প্রজন্মের মধ্যে মামাবাবু কাহিনি প্রথম সাড়া ফেলেছিল তাঁরাই
এক যুগ পরে যখন প্রাপ্তবয়স্ক হয় তখন তাঁদের ভালো লাগার কথাই লেখক প্রাধান্য দেন।
যদিও পরবর্তী প্রজন্মও মামাবাবু কাহিনিকে আপন করে নিয়েছিল।
এখানে আরও একটি দিক উল্লেখযোগ্য যে
‘অতলের গুপ্তধন’ গল্পটির বিষয়ের সঙ্গে প্রেমেন্দ্র মিত্রের ঘনাদা উপন্যাস ‘সূর্য কাঁদলে সোনা’-র বিষয়ের এক ঐতিহাসিক মিল রয়েছে।
বিষয়টির উল্লেখও সম্পাদক করেছেন
‘মামাবাবু সমগ্র’-র মধ্যে।
আরও একটি বিষয়ের উল্লেখ করা যেতে পারে। ১৯৭২
সালে শৈব্যা পুস্তকালয় থেকে প্রকাশিত হয়েছিল মামাবাবুর ষষ্ঠ কাহিনি ‘খুনে পাহাড়’ নাম নিয়ে।
এই গল্পটির প্রথম প্রকাশের সময় নাম ছিল
‘পাহাড়ের নাম করালী’।
*****
মেজকর্তা
কলকাতার সবচেয়ে লম্বা দৌড়ের পঁয়তাল্লিশ নম্বর বাসে পাওয়া যায় একটি লাল শালুতে
মোড়া খেরোর খাতা।
বালিগঞ্জ থেকে এয়ারপোর্ট যাবার পথে বাঙ্গুর পেরিয়ে লেখক তাঁর পাশের সীটে পড়ে
থাকতে দেখেন খাতাটিকে। যাত্রীদের এবং কন্ডাক্টরকে কথা দেন যে মালিকের পরিচয়
পেয়ে গেলে তিনিই ফেরত দিয়ে আসবেন নিজে গিয়ে। আসলে ওসব ছিল লোক-ভোলানো কথা। লেখকের
লোভ হয়েছিল ওই খেরোর খাতাটি পড়ার। তাঁর কারণ আর কিছুই নয়,
একনজরে লেখক দেখে নিয়েছিলেন ওই খেরোর খাতার বিষয়বস্তু – ভূত শিকার। এরকম
খাতা রাস্তাঘাটে কোথাও পেলে তুমিও ছাড়তে না, ছাড়তাম না আমিও , লেখকও
ছাড়েননি।
ঘনাদা অমর চরিত্র স্রষ্টা লেখক প্রেমেন্দ্র মিত্র সেই খেরোর খাতা নিয়ে এসেছিলেন
আর অনেক কষ্ট করে সেই লেখাগুলো উদ্ধার করে আমাদের শুনিয়েছিলেন কাহিনির আকারে। আর
অনেক চেষ্টা করেও প্রেমেন্দ্রবাবু যেটা পারেননি সেটা হল ওই খেরোর খাতার মালিকের প্রকৃত
নাম উদ্ধার করতে।
শুধু পেয়েছিলেন একটি চিঠি যাতে মালিকের নাম হিসেবে পাওয়া গেল বাবুয়ানামার্কা
এক নাম – মেজকর্তা।
১৯৮০ সালে ‘ভূত
শিকারি মেজকর্তা’ নামে একটি গল্পগ্রন্থ প্রকাশ
পায় যাতে মেজকর্তার ছ’টি
গল্প ছিল।
১৯৮৬ সালে এর সাথে আরও তিনটি গল্প যুক্ত হয়ে প্রকাশ পায় ‘মেজকর্তার ভৌতিক গল্প’
গ্রন্থটি।
এসবই জানা যায় বর্তমানে দে’জ
পাবলিশিং কর্তৃক প্রকাশিত ‘ভূত
শিকারি মেজকর্তা এবং’ গ্রন্থটির
মাধ্যমে।
মাত্র ন’টি ছোটো-মাঝারি গল্পের মাধ্যমে একটি চরিত্রকে বিখ্যাত হয়ে
যেতে খুব কমই দেখা গেছে। হয়তো প্রেমেন্দ্র মিত্রের মতো লেখক বলেই সেরকম সম্ভব
হয়েছে।
লেখক গৎবাঁধা ভূতের গল্পের ছকে বিশ্বাস করতেন না। ভূতের
গল্প না বলে সেগুলোকে ভয়ের গল্প বলতেই আমার মনে হয়েছে লেখক বেশি পছন্দ করতেন। কারণ, লেখকের মতে রাগ,
হিংসা, ঘৃণা, ভালোবাসা, দয়ামায়ার মতো বিষয় নিয়ে যখন গল্প হয় তখন ভয়ই বা বাদ যায় কেন? আর যে সে গুন্ডা-বদমাশের ভয় নয়। বুদ্ধির নাগালের বাইরে গা ছমছম করা ভয় হতে হবে বিষয়বস্তু। তা
বলে আঁশশ্যাওড়া গোছের গাছ থেকে লম্বা কঙ্কাল বেরনো পাতি বিষয় নিয়ে লেখার ঘোর বিরোধী
লেখক।
ভয়ের লেখা হতে হবে এমন যা খুব পাকা লেখকের হাত দিয়েও রোজ বেরোবে না, আর পড়ার সময় পাঠকের শিরদাঁড়া বরাবর বেয়ে যেতে হবে
ঠাণ্ডা হিমেল স্রোত। তবেই না হল ভয়ের গপ্প!
এগুলো সবই লেখক নিজে লিখে গেছেন ‘ভূত কেন’ শীর্ষক মুখবন্ধে, যা প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৪ সালে তাঁরই ‘ভৌতিক অমনিবাস’
গল্পগ্রন্থে।
এই সবগুলো গুণাগুণ বজায় রেখে উনি লিখে গেছেন মেজকর্তার কীর্তিকলাপ। মেজকর্তা
মোটামুটি বেশ সচ্ছল এক পরিবারের ছেলে, যা
ওঁর কথাবার্তায় পরিষ্কার। তাই খাওয়াপরার যখন চিন্তা নেই তখন উনি মজে থাকেন
তাঁর এক অদ্ভুত বিটকেলে শখ নিয়ে – ভূত
শিকার করার শখ।
চর মারফত উনি খবর পান কখন কোথায় কোন হানাবাড়ি আছে যেখানে ভূত থাকতে পারে। তারপর
নিজে গিয়ে উঠেন সে বাড়িতে। করেন রাত্রিবাস। আর
হানাবাড়ি মানেই যে সবসময় এঁদো পাড়াগাঁ, সেটা ভাবলেই পাঠক ঠকেছেন। কলকাতার
ইট-কাঠ-পাথরের বাড়িতেও, এমনকি এক গল্পে একটি লাইব্রেরিতেও
তিনরাত কাটিয়েছেন মেজকর্তা। অনেকেই
থাকেন যারা এরকম হানাবাড়িতে গিয়ে তেনাদের দর্শন পেলেই জ্ঞান হারান।
মেজকর্তা সেই শ্রেণীর নন। এরকমও
হয়েছে, তিনি মানুষ জানতে পেরে এক
ভূত তোতলাতে তোতলাতে তল্লাট ছাড়া হয়েছিল।
এটা মানতেই হয় অন্যসব ভূতের কাহিনি থেকে মেজকর্তা-কাহিনি অনেকটাই আলাদা। আলাদা তাঁর বর্ণনায়,
আলাদা মাঝেমাঝেই কাহিনি থামিয়ে লেখকের নিজস্ব বক্তব্য বলার স্টাইলে যেখানে
সাসপেন্স বাড়তে থাকে।
বর্তমানে প্রচুর বিখ্যাত বিখ্যাত ভূতের গল্প লেখা হচ্ছে। রয়েছে
প্রচুর চরিত্র।
কিন্তু তবুও মেজকর্তার মতো চরিত্র প্রায় নেই যিনি ভূতেদের জন্য ভাবেন, দুঃখ পান, রেগে যান – এককথায় ভূত স্পেশালিস্ট বলা
চলে।
এবারের কিস্তিতে এতটুকুই। আগামীবার তোমাদের সামনে মেলে ধরব অন্য এক লেখকের
মানসপুত্রদের।
আর ততদিন যাদের ঘনাদার সাথে আড্ডা মারার তারা মার দেদার আড্ডা। কেউ
কেউ মামাবাবুর সাথে বেরিয়ে পড় অ্যাডভেঞ্চারে। বাকিরা
ভূতের গপ্প শুনতে বসে পড় মেজকর্তার কাছে। উৎসবের মরশুম চলছে। সুতরাং
আর দেরি নয়।
ভালো থেকো সবাই।
_____
ছবিঃ আন্তর্জাল
মূল্যবান এই রচনাটিতে 'ঘনাদা গ্যালারি'-র উল্লেখ করার জন্য অশেষ ধন্যবাদ সৌরভ বাবু ।
ReplyDeleteপ্রসঙ্গত, এই হলো 'ঘনাদা গ্যালারি' ওয়েবসাইটের লিংক :
https://ghanada.wix.com/ghanada-gallery
ভালো থাকবেন ।।