মধুমিতা ভট্টাচার্য
ঘটনাটা আমার মেজদার মুখে যেমন শুনেছি তেমন বলছি। আমার পিসতুতো ভাই পিকলুর গোয়েন্দাগিরির গল্প।
ফেলুদার একনিষ্ঠ ভক্ত যদি কেউ থাকেন তাহলে একডাকে পিকলুর নাম করতে হয়। আমিও ফেলুদার গপ্পো পেলে আর কিছু চাই না। ‘গ্যাংটকে গন্ডগোল’, ‘বাদশাহী আংটি’, ‘সোনার কেল্লা’- উফস্, কী রোমহর্ষক কান্ডকারখানা! পিকলু আবার সত্যজিৎ রায়ের আঁকা ফেলুদার একখানা ছবি বাঁধিয়ে শোবার ঘরে টাঙিয়ে রেখেছিল। পিকলু একেবারে একখানা জলজ্যান্ত একলব্য। ১৯৭২ এডিশন।
ফেলুদার একনিষ্ঠ ভক্ত যদি কেউ থাকেন তাহলে একডাকে পিকলুর নাম করতে হয়। আমিও ফেলুদার গপ্পো পেলে আর কিছু চাই না। ‘গ্যাংটকে গন্ডগোল’, ‘বাদশাহী আংটি’, ‘সোনার কেল্লা’- উফস্, কী রোমহর্ষক কান্ডকারখানা! পিকলু আবার সত্যজিৎ রায়ের আঁকা ফেলুদার একখানা ছবি বাঁধিয়ে শোবার ঘরে টাঙিয়ে রেখেছিল। পিকলু একেবারে একখানা জলজ্যান্ত একলব্য। ১৯৭২ এডিশন।
পিকলু ঠিক করেছে বড়ো হয়ে সে শখের গোয়েন্দা হবে। তার বয়েস এখন সাড়ে তেরো কি চৌদ্দ, অর্থাৎ ফেলুদার আসিস্ট্যান্ট তোপসের সমান। পিকলু তাই এখন তৈরি হচ্ছে। জলখাবারের পয়সা বাঁচিয়ে একখানা ম্যাগনিফাইং গ্লাস কিনেছে। আর কিছু মেক-আপ করার সরঞ্জাম কিনেছে ছদ্মবেশ ধারণ করার জন্য। বাকি রইল নিজের নাম ছাপানো কার্ড তৈরি করা। কার্ডে নাম ছাপানো থাকবে – এস.জি. পিকলু - অর্থাৎ, সেনগুপ্ত পিকলু।
পিকলু অনেকদিন থেকেই সুযোগ খুঁজছিল একটা রহস্য-রোমাঞ্চ কেস পাওয়ার জন্য। তাহলে কেরামতি দেখিয়ে দেবে এবং সকলের উপহাসের আচ্ছা জবাব দিতে পারবে। অবশেষে সুযোগ এসে গেল।
অ্যাডভোকেট জ্যাঠামশাই ডেলি প্যাসেঞ্জার। রোজ আলিপুর কোর্টে যান ট্রেনে চেপে। একদিন ট্রেনে যেতে যেতে আর এক যাত্রীর পোর্টফোলিও ব্যাগের সঙ্গে নিজেরটা পালটাপালটি হয়ে গেল। তাঁর নিজের ব্যাগটিতে মক্কেলের কিছু মূল্যবান কাগজপত্র ছিল।
খবর শুনে পিকলু ভাবল যে নিশ্চয়ই শত্রুপক্ষের চর জ্যাঠামশাইকে ফলো করছিল এবং একইরকমের একটা ব্যাগ নিয়ে ট্রেনে জ্যাঠামশাইর পাশে বসেছিল। অবশেষে জ্যাঠামশাইয়ের অজ্ঞাতসারে ব্যাগ পালটাপালটি করে মাঝপথে চম্পট দেয়। বদলি ব্যাগের ভেতর পাওয়া গেল একটা নাটকের বই ও একটা বড়ো তোয়ালে। ঐ তোয়ালের গায়ে লেগেছিল আধহাতটাক লম্বা দু-তিনটে লালচে চুল। আর ছিল জবাকুসুম তেলের গন্ধ।
পিকলু কর্মপদ্ধতি স্থির করে নিল। তার ধারণায় শত্রুর চরের মাথায় বড়ো বড়ো লালচে চুল এবং সে ব্যবহার করে জবাকুসুম তেল।
পিকলুর গোয়েন্দাগিরি শুরু হল। রোজ সে শেয়ালদার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকে আর সতর্ক দৃষ্টি দিয়ে জ্যাঠামশাইয়ের মার্কামারা ব্যাগ খুঁজে বেড়ায়। বিশেষ খেয়াল রাখে, শত্রুর চরের মাথায় বড়ো বড়ো লালচে চুল থাকবে এবং কাছে এলে জবাকুসুম তেলের গন্ধ পাওয়া যাবে।
অবশেষে দিন তিনেক পরে এক বিকেলে পিকলুর বরাত খুলে গেল। সে দেখল, একটা লোক শেয়ালদা স্টেশনের মেন গেট দিয়ে ঢুকছে। হাতে তাঁর ঐরকম মার্কামারা ব্যাগ। লোকটার পরনে খাকি প্যান্ট ও শার্ট, আর মাথায় রয়েছে শোলার হ্যাট। লোকটা পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় পিকলু জবাকুসুম জবাকুসুম গন্ধ পেল। পিকলু ভাবল, লোকটা বোধহয় ওর লালচে চুলগুলো আড়াল করার জন্য শোলার হ্যাট মাথায় দিয়েছে।
পিকলু লোকটাকে ফলো করল। লোকটা নর্থ স্টেশনে গেল। একজন টিকিট কালেকটরকে কিছু বলল। লোকটা আবার মেন স্টেশনে গেল। এনকোয়ারিতে কিছু বলল। লোকটা সাউথ স্টেশনে গেল, টিকিট কাটল এবং প্ল্যাটফর্মে ঢুকে পড়ল। পিকলু অস্থির হয়ে উঠল। পাখি বুঝি হাতছাড়া হল। পিকলু দৌড়ে গিয়ে প্ল্যাটফর্ম টিকিট কাটল এবং ছুটতে ছুটতে লোকটার কাছে গিয়ে শোলার টুপিটা এক ঝাপটা মেরে ফেলে দিল।
মাই গড, লোকটার মাথা ভর্তি টাক! স্রেফ সাহারা মরুভূমি। আর কান ঘেঁষে ছোটো ছোটো চুলগুলো নিকষ কালো। ছিঃ ছিঃ, কী লজ্জা! পিকলু ফের দৌড় দিল। ঝাঁপ দিয়ে সে সদ্য চলন্ত একটা ট্রেনের হাতল ধরে ঝুলে পড়ল। পিকলু পালাচ্ছে। হতাশায় ও লজ্জায়। প্ল্যাটফর্ম ভর্তি লোক অবাক হয়ে পলায়মান পিকলুর দিকে তাকিয়ে রইল।
( পিকলুর জ্যাঠামশাই কাগজপত্রসহ ব্যাগ ফিরে পেয়েছিলেন। বদলি ব্যাগের মালিক ছিলেন এক নামী অভিনেতা। ঐতিহাসিক নাটকে সাহেব সাজেন। )
বিঃ দ্রঃ বিশেষ পুরস্কারে ভূষিত এই গল্পটি ১৯৭২ সালে আনন্দমেলায় প্রকাশিত।
_____
অলঙ্করণঃ মণিশঙ্কর দাশ
No comments:
Post a Comment