কচিপাতাঃ ছড়াঃ আমাদের স্কুলের ভূতুড়ে ঘর - শুভ্রনীল কর্মকার
আমাদের স্কুলের ভূতুড়ে ঘর
শুভ্রনীল কর্মকার
আমাদের স্কুলে ছিল একখানা ঘর,
ঢুকলে পরে বলত সবাই, ভূতের কাছে মর!
ঢুকলাম একবার আমি সেই ঘরেতে,
আমায় ডেকে বলল সবাই, চাস কি তুই মরতে?
ঢুকলাম ঘরে যেই দরজা হল বন্ধ!
আসতে লাগল নাকে আমার ইঁদুর-মরা গন্ধ।
পেছনে ফিরে দেখি, আসছে এক ছায়া!
ভাবলাম, সত্যিই আছে নাকি ভূতের
কোনও মায়া?
এমন সময় আচমকা হলাম অজ্ঞান,
তিনঘন্টা পরে প্রায় ফিরল আমার
জ্ঞান।
চোখ খুলে দেখি, সবাই তাকাচ্ছে ড্যাবড্যাব,
ভাবছে, আমি পাগল, নাকি ব্রেইন
হয়েছে জ্যাম?
আসলে ছিল সে এক শ্রমিকের ছায়া,
আমি ভয়ে ভেবেছিলাম কোনও ভূতের মায়া!
পরে দেখি আমি বসে, হাইস্কুল ক্লাসরুম!
এতকিছু হওয়ার আগে আমার পেয়েছিল
খুব ঘুম।
_____
অলঙ্করণঃ বিশ্বদীপ পাল
কচিপাতাঃ আঁকিবুঁকি - সাহিল খান
অঙ্কন শিল্পী
সাহিল খান
নবম শ্রেণী, দাদপুর বাতাসপুর হাই স্কুল
পশ্চিমবঙ্গ
লাজুক
স্বভাবের এই নবম শ্রেণীর ছাত্রটির স্বপ্নই হল ছবি আঁকা। সে ভবিষ্যৎ-পেশা হিসেবে
শিক্ষকতা করতেই চায়, কিন্তু সেটা না হলে সে চিত্রকর হওয়ার ইচ্ছা রাখে মনের গোপনে।
পড়াশোনার পাশাপাশি সমান তালে চলে ক্রিকেট ও ফুটবলপ্রেম, আর সাথে থাকে বাঙালির
বিখ্যাত মিষ্টি রসগোল্লা।
গল্পঃ শোধ - প্রসেনজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
শোধ
প্রসেনজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
“ড্যাড,
ক্যান আই এক্সপ্লোর দিস প্লেস?”
“ওকে
বেটা। তোমার সেলফোনে চার্জ আছে তো?”
“ইয়াপ।”
“ওটা অন
থাকে যেন। আর, বেশি দূরে যাবে না।”
বিএমডব্লুই
হোক বা মার্সিডিজ বেনজ, টায়ার বার্স্ট করলে সাইকেল ভ্যানের কাছেও লজ্জা পায়। আর সেইজন্যই
বোধহয় এক্ষুনি একটা সাইকেলভ্যানওয়ালা আমার প্রিয় ব্ল্যাক টাটা সাফারিটার দিকে
ঢুলুচোখের কৌতুকপূর্ণ অর্থবহ দৃষ্টি ঠেলে দিয়ে হেলেদুলে চলে গেল।
কলকাতা
থেকে যাচ্ছি চন্দননগর। আমার ছেলে সাবর্ণকে তার মামাবাড়ি পৌঁছে দিতে। তার মধ্যে এই
দিল্লি রোডে আমার গাড়ির পেছনের টায়ারটা বার্স্ট করে চিত্তির। অবশ্য সঙ্গে
স্টেপনি আছে। আমার ড্রাইভার শ্যামল এখন জ্যাক লাগাচ্ছে। শ্যামলটা ফাঁকিবাজ আর
মাথামোটা হলেও বড্ড বিশ্বাসী। একেবারে পুরাতন ভৃত্য টাইপ। বাবার মারুতি ওমনিটাও ওই
চালাত। আমার বন্ধুদের ড্রাইভারগুলো যে হারে তেল চুরি করে আর রোয়াব দেখায়, সেই
তুলনায় আমার শ্যামল গোবরে পদ্মফুল।
কিন্তু
ওই ব্যাটার জন্যই এখন আমাকে এই খা খা রোদ্দুরে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। কোথায় গাড়িতে
বসে এসিটা অন করে রাখব তার উপায় নেই। সাবর্ণর মা, মানে আমার গিন্নি এখন চন্দননগরেই
আছেন। চন্দননগরে লাঞ্চ সেরে চলে যাব বর্ধমান। সেখানে বিকেল পাঁচটায় খুব আর্জেন্ট
একটা মিটিং আছে আমার ফ্যাক্টরির ভবিষ্যতের ব্যাপারে। শ্যামলের উচিত ছিল কালকেই ফুল
ট্যাঙ্ক ভরিয়ে রাখা। কিন্তু তা করেননি মহারাজ। ফুয়েলের কাঁটা এখন ‘ই’ লেটারটাকে
ছোঁয়ার জন্য ব্যাকুল। তাই এসি চালানোরও উপায় নেই।
গাড়ির ভেতরটা
ভীষণ গরম। পাশে এদিক ওদিক কোনও দোকানপাট কিচ্ছু নেই। হেঁটে চলা লোকজনও খুব একটা
বেশি নয়। এই রুটি-স্যাঁকা গরমে খুব দরকার না পড়লে কেউ বেরোচ্ছে না।
একটা
কদমগাছ পেয়ে সেদিকেই ছুটলাম। একটু ছায়ায় দাঁড়াই।
গাছের
গুঁড়িতে কেউ মোটা ব্রাশ দিয়ে বাদামি রংয়ের একটা রাক্ষসের মুখ এঁকে গেছে। দেখে বেশ
হাসি পেল।
কিন্তু
হাসি বেশিক্ষণ টিকল না। এই গাছটা আমার খুব চেনা। মনের গভীর কুয়োয় একটা স্মৃতি পড়ে ছিল।
তার উপরে আরও অনেকরকম স্মৃতির স্তর পড়ে সেটা একেবারে ঢেকে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। আজ
সেই স্মৃতিটাই অন্য সব স্তর ফাটিয়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। এখন খুব ভালোভাবে মনে পড়ছে।
সেদিন ঠিক এই গাছটাই ছিল। কোনও ভুল নেই।
হিসেব
করে দেখলাম যে সেটা পাক্কা দশ বছর আগেকার কথা। সাবর্ণ তখনও জন্মায়নি। সেটাও
ছিল এরকমই গ্রীষ্মকাল। মা তো ছোটোবেলাতেই মারা গিয়েছেন, কিন্তু বাবা তখন বেঁচে
ছিলেন। এখনকার মতো সল্টলেকে বিশাল বড়ো বাড়ি তখন আমার ছিল না। মানিকতলায়
বাবার তিন কামরার একতলা বাড়িটায় থাকতাম। এখনকার মতো কসমেটিক্স কোম্পানির মালিকও
তখন আমি ছিলাম না। ছিলাম কেবিজি ফার্মাসিউটিক্যালসের সেলস ম্যানেজার। এখনকার মতো
কোটিপতি তখন ছিলাম না ঠিকই, তবে রোজগার খুব একটা খারাপ ছিল না। সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটা ছিল সেটার নাম শান্তি। ব্যাবসা করার কী
যে জ্বালা তা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। আজ দেড়মাস হল আমার ফ্যাক্টরি বন্ধ করে
দিতে হয়েছে। লেবার ইউনিয়নের লোকেরা নানারকম দাবিদাওয়ায় জেরবার করে দিচ্ছে। দু’পক্ষকেই
কিছুটা আপোস না করলে কখনও কোনও ভালো সংস্থা চলতে পারে না। কিন্তু ওরা আপোসে
বিন্দুমাত্রও রাজি নয়। টানা একবছর লড়াইয়ের পর বাধ্য হয়ে কারখানা বন্ধ রাখতে হয়েছে
আমায়। দেড়মাস হল কোনওরকম প্রডাকশন নেই। লেবার ইউনিয়নের হেড মিন্টু
ঘোষ নানারকমভাবে আমার পেছনে লেগেছে। খুন করার হুমকিও দিয়েছে দুয়েকবার।
দশ বছর
আগে সেটা ছিল বর্ষাকাল। সেদিন অফিসে কাজের বেশ চাপ ছিল। রাত সাড়ে দশটায়
অফিস থেকে বেরিয়ে দেখি ঝমাঝম বৃষ্টিতে কোনও গাড়িঘোড়া নেই। শেষে একটা অটোরিক্সা
দেখতে পেয়ে তাকে দাঁড় করিয়ে অনেক কষ্টে রাজি করালাম। তারপর পলিথিনের পর্দা সরিয়ে ভেতরে
ঢুকে বসলাম।
কিছুটা
রাস্তা যাবার পর হঠাৎ অটোওয়ালা অটো থামিয়ে নিজে ছাতা নিয়ে নামল। অন্য হাতে একটা
কালো কিছু নড়ে উঠল। সেটার থেকে দুটো কালো চকচকে চোখ বেরিয়ে আমার দিকে কুতকুত করে
চেয়ে থাকল। একটা কালো রঙের নেড়ি কুকুরের বাচ্চা। আমি বললাম, “ওটাকে নিয়ে কোথায়
যাচ্ছ?”
অটোওয়ালা
আবার ভেতরে ঢুকে বসে বলল, “আজকে আমার অটোর সামনে এসে পড়েছিল। একটুর জন্য বেঁচে
গেছে। ওই পাড়ার লোকেরা বলল, এর মা নেই। অন্য বাচ্চাগুলোও মরে গেছে। ওখানে থাকলে
গাড়িচাপা পড়ে যাবে। তাই নিয়ে এখানে ছেড়ে দিচ্ছি।”
“মানে!
এখানে ছাড়লে গাড়িচাপা পড়বে না?”
“এখানে
তো ভাতের হোটেল আছে। খেতে পেয়ে বেঁচে যাবে।”
“বলিহারি
তোমার বুদ্ধি!”
আমি
বলার সঙ্গে সঙ্গেই দেখলাম কুকুরের বাচ্চাটাও ‘হৌ হৌ’ করে অটোওয়ালাটাকে দু’বার বকে
দিয়ে আমার দিকে তাকাল। এতে আমি হেসেও ফেললাম, আর বাচ্চাটার ওপরে মায়াও পড়ে গেল।
এক হাতে
সুটকেস, আর এক হাতে কুকুরের বাচ্চা হাতে বাড়ি পৌঁছলাম।
দুনিয়ায়
কিছু কিছু মানুষ আছে যারা কুকুর, ইঁদুর, টিকটিকি আর আরশোলাকে সমানভাবে ঘেন্না করে
ও ভয় পায়। এই মানুষগুলোর দলপ্রধান হলেন আমার স্ত্রী। বাড়িতে কুকুরের বাচ্চা দেখার
সঙ্গে সঙ্গেই চরম সংঘাত ঘটল স্ত্রীয়ের সঙ্গে। তিনি কোনওমতেই বাড়িতে কুকুর মেনে
নেবেন না। অনেক অশান্তি সহ্য করে কুকুরটাকে ঠাঁই দিলাম বাড়ির ছাদে। ছাদে আমার
স্ত্রী ফুলের টব সাজিয়ে বাগান করেছিলেন। নানা রঙের গাঁদা,
চন্দ্রমল্লিকা, গোলাপ ইত্যাদি অনেক গাছ। তাদের মাঝে খেলে বেড়াতে লাগল ছোট্ট বাচ্চাটা।
কুচকুচে
গায়ের রং আর টলটলে চোখ। কুকুরটার নাম দিলাম দিঘি। সারাক্ষণ বাড়ির ছাদে খেলে বেড়ায়।
ওর মিষ্টি মুখটা দেখে অফিসে বেরোই। বাড়ি ফিরেই সোজা চলে যাই ছাদে। যতই নিঃশব্দে
বাড়ি ঢুকি না কেন, কী করে যেন ঠিক টের পায় সে। আমাকে দেখেই ঝাঁপিয়ে পড়ে আমার
হাঁটুর একটু নিচে। ওর সামনের নরম থাবাদুটোয় ভর দিয়ে, কান মুড়ে প্রাণপণে লেজ
নাড়ায় আর ‘হোউউউউউ’ করে গলা দিয়ে একটা আওয়াজ বের করে যার মর্মার্থ হল, “এতক্ষণ
কোথায় ছিলে? জানো না সারাদিন আমি কত একা ছিলাম? একা একটা ছাদে ঘুরে কাঁহাতক আর
কাক-চড়ুই তাড়িয়ে কাটানো যায় বলো তো?”
আমার
গিন্নি দিঘিকে খেতে দিতেন না। ওর মুখ দেখবেন না বলে ছাদে ওঠাও কমিয়ে দিলেন। বৃদ্ধ বাবা দুপুরে একবার ছাদে উঠে ওকে খাবার দিয়ে যেতেন।
একদিন
এক মহা বিপদ উপস্থিত হল। অফিসে কাজ করছিলাম। বাবা ফোন করে বাড়িতে ডাকলেন। গিয়ে
দেখি বিস্তর চেঁচামেচি চলছে। কী ব্যাপার? না, ছাদে উঠে দেখি তিনটে গাঁদাগাছ আর একটা
চন্দ্রমল্লিকার চারা ছিঁড়ে কুটি কুটি হয়ে মাটিতে গড়াচ্ছে। চারদিকে ছড়িয়ে রয়েছে বড়ো
বড়ো দুটো গোলাপের পাপড়িগুলো। চেঁচামেচি শুনে নিজের অন্যায় বুঝতে
পেরেই বোধহয় দিঘি ছাদের এককোণে লেজ গুটিয়ে বসে রয়েছে।
গিন্নির
প্রধান দাবি কুকুরটাকে বাড়ি থেকে তাড়াতে হবে। ফুলগাছগুলোর
দশা দেখে আমারই চোখে জল চলে এল, গিন্নির আর কী দোষ।
একটা
নাইলনের দড়ি রাখা ছিল কাপড়-চোপড় টাঙাবার জন্য। সেটাকে ভাঁজ করে বেশ করে পেটালাম
কুকুরটাকে। ওইটুকু বাচ্চা মার খেয়ে তারস্বরে চেঁচাতে লাগল। মনে হল সে যেন বলছে,
“আর করব না গো, এবারের মতো ছেড়ে দাও। জীবনের প্রথম ভুল। ক্ষমা করে দাও গো।”
দড়িটা
নিয়ে একবার নিজেরই হাতের ওপর কষিয়ে দিলাম আমি। সঙ্গে সঙ্গে লাল দাগ ফুটে উঠল আমার
চামড়ায়। বেশ যন্ত্রণা করল। ওইটুকু বাচ্চা কুকুরটাকে এইভাবে অন্তত কুড়ি ঘা তো
মেরেইছি। গায়ে লোম থাকার জন্য হয়ত ওর গায়ের লাল দাগগুলো আমি দেখতে পাইনি। এবার ওর
দিকে তাকিয়ে আমি কেঁদে ফেললাম।
পার্কস্ট্রিটে
থাকতেন আমার এক বন্ধুর দাদা রমাপদ দে। তাঁর খুব জীবজন্তুর শখ। প্রধানত কুকুরের। বিশাল
বাড়িতে ষোলটা নানা জাতের কুকুর রয়েছে। আর আছে দুটো খরগোশ, কুড়িটা পায়রা, একটা
শিম্পাঞ্জি। আমি রমাপদবাবুর কাছে ছুটলাম।
ভদ্রলোককে
ফোন করেই গেলাম। কলিং বেল বাজাবার পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যেই দরজা খুলে গেল। খুলে গেল
বলছি কারণ, সামনে কেউই ছিল না। ভেতরে ঢুকে দেখলাম দরজার পাশে আড়ালে একটা
শিম্পাঞ্জি ঘাপটি মেরে বসে। এবার সে দরজাটা বন্ধ করে লক লাগিয়ে একটু দূরে সোফায়
রমাপদবাবুর পাশে বসে কোকের টিনে চুমুক দিয়ে কোক খেতে লাগল।
রমাপদবাবুর
বাড়িতে ষোলটা কুকুর, কিন্তু আমাকে দেখে একটাও চেঁচাল না। ভদ্রলোক দুর্দান্ত
ট্রেনার। তাঁর নির্দেশেই সবাই চুপ করে আছে। বিশাল বসবার ঘরটার এদিক ওদিকে ছড়িয়ে
ছিটিয়ে বসে আছে কুকুরগুলো। তার মধ্যে ছ’টা নেড়ি। আমি যে কুকুরে ভয় পাই না সেটা
রমাপদবাবু জানেন। তা না হলে বাড়িতে কেউ এলে তাঁর নির্দেশে কুকুরগুলো আলাদা একটা ঘরে
চলে যায়। সেই ঘরের দরজা বন্ধ করার দরকার পড়ে না। রমাপদবাবুর নির্দেশ না পেলে তারা
কেউ ঘর থেকে বেরিয়ে আসে না।
আমি
রমাপদবাবুকে প্রণাম করে পাশের সিঙ্গল সোফাটায় বসে, “ভালো আছেন?” বলতেই দেখি তাঁর
জামার পকেট থেকে একটা ছোট্ট কুকুর মুখ বের করে আমাকে জুলজুল করে দেখছে। সাদা
রঙের কুকুর, চোখদুটো গোল গোল। ভীষণ মিষ্টি
মুখের সঙ্গে মিরক্যাটের মুখের কিছুটা মিল রয়েছে। কুকুরটাকে দেখলেই খুব হাসি
পায় আর আদর করতে ইচ্ছে করে। বললাম, “কোনও কুকুরের বাচ্চা হল বুঝি? কী নাম ওর?”
বললেন,
“আরে, বাচ্চা কী বলছ হে! দু’বছর বয়স ওর। যৌবনের তাজা রক্ত বইছে শরীরে। ভাগ্যিস
তোমার কথা বোঝেনি, বুঝলে চেঁচামেচি শুরু করে দিত। এ হল আমার কুকুরের দলে সতের
নম্বর সংযোজন। ওর জাতের নাম চিহুয়াহুয়া। দুনিয়ার সবচেয়ে ছোটো কুকুর হিসেবে রেকর্ড
করা জাত। তাই নিজের সম্মান বজায় রাখতে পকেটে ঢুকে বসে থাকে। ওর নামি দিয়েছি,
মলিকিউল।”
“আচ্ছা,
শিম্পাঞ্জিটা দরজা খুলে দিয়ে আড়ালে ঘাপটি মারছিল কেন?”
“কে,
চ্যাম্পিয়ন? আরে আর বোলো না। ভাবো একবার ব্যাপারটা। কোনও গেস্ট বাড়িতে এল আর দেখল
দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছে মূর্তিমান একটা শিম্পাঞ্জি। তার অবস্থাটা কী হবে? সেলস
পার্সন এবাড়িতে ঢুকতে পারে না ঠিকই, কিন্তু কত দরকারি লোকও ভয় পেয়ে পালিয়েছে। তাই
চ্যাম্পিয়নকে বলেছি দরজা খুলেই লুকিয়ে পড়বি। হা হা হা হা!”
একচোট
হাসি আর খোশগল্পের মধ্যে চা চলে এল। কিচেন থেকে একটা চাকা লাগানো সার্ভিং
টেবল ঠেলে চ্যাম্পিয়নই নিয়ে এল। তাতে চায়ের সঙ্গে দু’প্লেট ফিশ ফিঙ্গারের ধোঁয়া
ওঠা সত্ত্বেও চ্যাম্পিয়নের নির্লোভ ভাবমূর্তি দেখে বেশ অবাক লাগল। কারণ, এ যে মাংস
আর মাছ দুটোরই অত্যন্ত ভক্ত সেটা আমাকে রমাপদবাবু বলেছিলেন।
একটা
ফিশ ফিঙ্গারে ভিজে কামড় বসিয়ে এবার আমি প্রয়োজনীয় কথাটা তুললাম। দিঘিকে নিয়ে
বাড়িতে যে সমস্যা হচ্ছে সেটা জানালাম। দিঘি নিজেও বাড়িতে যে বেশ অনিষ্ট করছে সেটাও
বললাম।
“অনিষ্ট
করছে! হোয়াট ডু ইউ মিন?” হাঁ হাঁ করে উঠলেন রমাপদবাবু।
“না,
মানে এই তো সবে টবের গাছপালা ছেঁড়া দিয়ে শুরু করল। এরপরে আর কী করবে না করবে...”
“দূর
করে দাও!” আমাকে আশ্চর্য করে গলার পারদ সামান্য চড়ালেন ভদ্রলোক, “অনিষ্ট করলে
সিম্পলি দূর করে দাও। রাস্তা থেকে কুড়িয়ে আনা একটা ফালতু নেড়ি কুত্তা। তার
জন্য বাড়িতে অনিষ্ট সহ্য করবে কেন?”
“রমাপদবাবু,
আপনি এই কথা বলছেন!”
“হ্যাঁ,
বলছি। তোমার নিজের একটা সন্তান হোক, লক্ষ করে দেখবে সে তার ছোটোবেলায় একটা কুকুরের
চেয়ে অন্তত কুড়িগুণ বেশি অনিষ্ট করে। সুন্দর পেন্ট করা দেওয়ালে পেন্সিল দিয়ে
হিজিবিজি কেটে, রং বুলিয়ে নষ্ট করে না? দামি দামি খেলনা ছুড়ে ছুড়ে ভেঙে ফেলে না?
বইখাতা ছিঁড়ে কুটিকুটি করে না? ল্যাপটপে দুধ ঢেলে দেয় না? বারান্দার রেলিং থেকে সেলফোন
ছুড়ে ফেলে দেয় না? যেখানে সেখানে যখন তখন কুকর্ম করে ভোগায় না? খাবার সময় জ্বালায়
না? রাস্তায় বেরোলেই হাজাররকম বায়না করে না? রাতে ঘুমোতে না দিয়ে জাগিয়ে রাখে না?”
“কী
বলছেন রমাপদবাবু, সে তো মানুষ—” আমি মৃদু প্রতিবাদ করে উঠলাম।
“সেটাই
হচ্ছে আসল কথা। মানুষ। মানুষ বলে শতদোষ মাফ। আর জানোয়ার বলে একটা হাফ দোষও বিরাট
অপরাধ বলে মনে হয়। তাই তো?”
এ কথায়
সম্মতি না জানিয়ে উপায় নেই। সত্যিই মানুষের হাজার অপরাধ আমরা ক্ষমা করি কিন্তু
জানোয়ার একটা ছোটো কিছু করলেই আমরা অতিষ্ট হয়ে উঠি। নির্বিচারে তাদেরকে অপমান করি।
অথচ তারা মানুষের চেয়ে অনেক বেশি আত্মনির্ভরশীল। খাওয়া, ঘুমোনো ইত্যাদি কোনও কিছুই
তাদের বলে দিতে হয় না। তাছাড়া, অতি অল্পেই সন্তুষ্ট তারা।
আমি
মাথা নিচে নামাতে বাধ্য হলাম। আশেপাশের কুকুরগুলো কিছু বুঝতে পারছে কি না জানি না।
তবে তাদের অনেকেই আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
“শোনো
বিরূপাক্ষ,” রমাপদবাবুর গলা মোলায়েম, “তুমি তো ছোটোবেলায় রচনা বইতে পড়েছ যে কুকুর
প্রভুভক্ত প্রাণী?”
“হ্যাঁ,
সে তো সবাই পড়েছে।”
“তাহলে
জেনে রাখো যে, পৃথিবীতে যত প্রাণী আছে তাদের মধ্যে কুকুরই মানুষকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে।”
“তাই?”
“কেন
বাসে বলতে পারো?”
এই
উত্তরটাও খুবই সোজা। তাই বললাম, “সিম্পল, খাবার খেতে পাবে বলে।”
“দশে
চার পেলে, বিরূপাক্ষ।” রমাপদবাবু তাঁর গম্ভীর মুখে এক মিলিমিটার হাসির হসন্ত লাগিয়ে
বললেন, “খাবার তো আছেই। কিন্তু তার অনেক ওপরে আছে ভালোবাসা। তুমি কিচ্ছুটি খেতে না
দিয়ে একটা কুকুরকে আদর করো, দ্বিতীয়দিনও সে লেজ নাড়িয়ে তোমার কাছে আসবে। মলিকিউলকে
দিয়েই ফার্স্ট ট্রাই করতে পার।”
আমি
সম্মতি জানালাম।
রমাপদবাবু
বললেন, “এখন কথা হচ্ছে মানুষ তো আর স্বার্থ ছাড়া চলে না। সে কুকুর পুষবে তার
স্বার্থেই। কুকুরের উপকারিতা মানবজাতি কী করে ভুলতে পারে বলো? সবচেয়ে ভীতু কুকুরটা
ভয় পেয়েও যেটুকু চেঁচামেচি করে তাতেও চোর-ডাকাত বাড়িতে ঘেঁষে না। অন্ধ প্রভুকে
গাইড করা, অপরাধমূলক কাজে সাহায্য করা, মহাকাশযাত্রায় প্রতিনিধিত্ব করা এসব তো
সকলেই জানে। তুমি জানো, সুন্দরবনে বাঘের উপদ্রবে তটস্থ গ্রামবাসীরা কুকুর পুষছে
পাহারা দেবার জন্যে? আমি তো বলব আমাদের শহরেও প্রত্যেক বাড়িতে যেমন একটা করে
বাগানের জন্য জায়গা রাখা উচিত তেমনি অন্তত একটা করে কুকুরও পোষা উচিত। পৃথিবীতে এত
জানোয়ার থাকতে মহাভারতে মহাপ্রয়াণের পথে পাণ্ডবদের সঙ্গ একটা কুকুরেই নিল কেন বলতে
পার?”
রমাপদবাবুর
কথা শোনার পরে তাঁর বাড়ির সতেরটা কুকুরের দিকে তাকিয়ে তাদেরকে যেন অনেক আপন বলে
মনে হতে লাগল। খাবারও নয়, শুধু একটু ভালোবাসার বিনিময়ে তারা তাদের প্রাণ পর্যন্ত
উৎসর্গ করতে পারে। কী আশ্চর্য মানুষভক্ত জীব!
আমার যা
জানার ছিল জানা হয়ে গিয়েছে। এখন বাড়ি গিয়ে স্ত্রীকে যে করেই হোক বুঝিয়ে রাজি করাতে
হবে।
বেরোবার
সময় রমাপদবাবু বললেন, “আমার কী বিশ্বাস জানো? তোমার কুকুর নিজেই তার জায়গা করে
নেবে।”
বাড়ি
ফিরে স্ত্রীকে অনেক বোঝানোর পরে তিনি রাজি হলেন। কিন্তু একটা শর্তে, দিঘিকে বেঁধে
রাখতে হবে। ছাদে খুব ছোটো একটা ঘর ছিল। ছোটোবেলায় সেটাই ছিল আমার পড়ার ঘর, আর বড়ো
হয়েও অনেক সময় খুব মনোযোগের কাজ হলে আমি সেই ঘরে চলে যেতাম। বড্ড প্রিয় সেই ঘরে
দরকারি কাগজ বোঝাই দুটো আলমারি, টেবিল-চেয়ার আর ছোটো একটা খাট ছিল। সেই ঘরেরই
গোড়ায় চেন দিয়ে বাঁধলাম দিঘিকে। সে প্রথমে আশ্চর্য হল, তারপরে একটু মনমরা। কিন্তু
প্রতিবাদ জানাল না।
দশ বছর
বয়সে একজন মানুষের মধ্যে যেরকম শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ঘটে, কুকুরে মধ্যে প্রথম এক
বছরেই ততটা ঘটে যায়। দিঘির যখন প্রায় এক বছর বয়স তখন সে একটা কাণ্ড করে বসল। এক
রবিবারের দুপুরে ওর চিৎকার শুনে ছাদে গিয়ে দেখি ও প্রাণপণে চেন ছিঁড়ে বেরিয়ে আসার
চেষ্টা করছে আর আমার একটা আলমারির কাছে যেতে চাইছে। আমি ওকে খুলে দিতেই ও
আলমারিটায় ঝাঁপিয়ে পড়ে দরজাটা আঁচড়াতে লাগল। আলমারিটা খুলে ফেললাম। ওই
আলমারিতে আমার অনেক ফাইল ছিল। কয়েকটা ফাইলের গায়ে কাগজের কুচির পাহাড় জমে থাকতে
দেখেই বুঝলাম নেংটি ইঁদুর বাসা করেছে। সর্বনাশের মাথায় টাক! ওখানে যে আমার অনেক
পরীক্ষার সার্টিফিকেট রয়েছে, অফিসের খুব দরকারি কাগজপত্রও রয়েছে। আর
রয়েছে আমার আর গিন্নি ভোটার আইডি, পাসপোর্ট। দেড় মাস এই ঘরে ঢুকিনি, আলমারিটাও
খুলিনি, আর এই অবস্থা!
ঝটপট
ফাইলগুলো খুলে দেখলাম বেশ কিছু কাগজ নষ্ট হয়েছে বটে, একটা সার্টিফিকেটের কোনাটাও
খেয়েছে ইঁদুরে। তবে খুব দরকারি কাগজগুলো এখনও দৈবক্রমে বেঁচে রয়েছে। হাঁফ ছেড়ে
বাঁচলাম। দিঘির ওপরে কৃতজ্ঞতায় মনটা ভরে গেল। ও দেখি মাথা নিচু করে আছে। বড্ড
লজ্জা পেয়েছে বোধহয়। হাঁটু গেড়ে বসে ওর মুখটা তুলে একটা চুমু খেতে যাব, দেখি ওর মুখ
থেকে একটা নেংটি ইঁদুর ঝুলছে।
এই
কুকুরকে আর বেঁধে রাখা চলে না। বাবা বললেন, “ও কিন্তু বেশ কয়েকদিন ধরেই ছাদের ঘরের
দরজার ফাঁকে নাক ঢুকিয়ে শোঁকাশুঁকি করছিল।”
গিন্নিও
মানলেন দিঘি আমাদের একটা বড়ো ক্ষতির হাত থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। কোনও ট্রেনিং ছাড়াই
ও একটা স্নিফার ডগের কাজ করেছে। ওকে ছেড়ে রাখা যেতে পারে তবে গিন্নির কাছে যেন না
ঘেঁষে। আমি সুযোগ পেয়ে শুনিয়ে দিলাম, “ওরা বোঝে কে ওদেরকে ভালোবাসে
আর কে বাসে না।”
এর কয়েক
মাস পরে গিন্নি চললেন মাস কয়েকের জন্য তাঁর বাপের বাড়ি চন্দননগরে থাকতে। তিনি
সন্তানসম্ভবা হয়েছিলেন। মুশকিল হল আমাকেও কম্পানি ছ’মাসের জন্য দিল্লিতে পাঠিয়ে
দিল। বাবাকে দেখাশোনার জন্য আয়া রেখে দিলাম। কিন্তু দিঘির কী হবে? তাকে আমাদের
পাড়ায় ছেড়ে দিলাম। সারাদিন টো টো করে বেড়াত আর রাতের সময়ে আমাদের বাড়ির রকে এসে
শুত। কাজের লোককে বলে রেখেছিলাম রকের ধারে গামলায় খাবার নিয়ে দু’বেলা যেন রেখে
দেয়। তাই দিত।
তিন মাসের
মাথায় শ্বশুরবাড়ি থেকে দিল্লিতে ফোন এল। আমার গিন্নির একটা মিষ্টি ছেলে হয়েছে। আনন্দে
পাগল হয়ে গেলাম। কিন্তু কোম্পানি কিছুতেই কাজ ফেলে কলকাতা আসতে দেবে না। রাগের
চোটে দিলাম চাকরি ছেড়ে।
চন্দননগরে
গিয়ে ছেলের মুখ দেখলাম। নাম রাখলাম সাবর্ণ। গিন্নি আরও কয়েকমাসের জন্য তাঁর বাপের
বাড়িতে রয়ে গেলেন। আমি ফিরে এলাম আমার বাড়ি।
এসে
দেখি সাংঘাতিক কাণ্ড ঘটিয়েছে আমার প্রিয় কুকুর দিঘি। ছাদে যাবার সিঁড়ির নিচে সে
তিনটে বাচ্চা পেড়ে বসে আছে। জীবজন্তুরা মা হলে সাধারণত কাউকে কাছে ঘেঁষতে দেয় না। কিন্তু
দিঘি অন্যরকম। ও এমনভাবে আহ্লাদে আটখানা হয়ে বাচ্চাগুলোকে আর আমাকে দেখতে লাগল যেন
মনে হল পুজোর নতুন জামা বের করে দেখাচ্ছে। বাবা বললেন, যেদিন সাবর্ণ জন্মেছে
সেইদিনই নাকি দিঘির বাচ্চা তিনটে হয়েছে।
ফোন করে
ব্যাপারটা গিন্নিকে বলার সাহস হল না।
যেকোনও
শিশুকেই ভগবান খুব সুন্দর করে তৈরি করেন। তা সে মানুষেরই হোক বা কুকুরের। তাই
তিনদিনে একবার চন্দননগরে ছুটে যেতাম সাবর্ণকে আদর করতে আর বাড়িতে যতক্ষণ থাকতাম
দিঘির বাচ্চা তিনটেকে খুব চটকাতাম।
দিঘির
দুই ছেলে, এক মেয়ে। তিনটের তিনধরনের রং। মেয়ে বাচ্চাটা খুব আদুরে। গায়ে তার সাদা
আর ব্রাউন ছোপ আর কপালে বড়ো ব্রাউন রঙের ফুটকি। দেখতে অনেকটা তাসের হার্ট সাইনের
মতো। আমি মেয়েটার নাম দিলাম লাল পান বিবি। সংক্ষেপে বিবি। একটা সাদার রঙের ছেলে
বাচ্চা সারাক্ষণ বিবির সঙ্গে খুনসুটি করছে। তার নাম দিলাম সাহেব। অন্যটা কালো
রঙের, খুব শান্ত আর বিবির অনুগত। সে হয়ে গেল গোলাম। তাহলে দাঁড়াল
সাহেব-বিবি-গোলাম।
মাস দুয়েক
পরে আমার স্ত্রী সাবর্ণকে নিয়ে বাড়িতে ঢুকে রণক্ষেত্রে বাধিয়ে দিলেন। বললেন, “এ-বাড়িতে
হয় তোমার কুকুর থাকবে নয় আমি আর তোমার ছেলে।” এই বলে তিনি আবার চন্দননগরে ফিরে
গেলেন।
অনেক
বোঝালাম গিন্নিকে। ঝগড়াও করলাম। কাকুতি-মিনতিও করলাম। কিন্তু তিনি তাঁর সিদ্ধান্তে
অনড়। তাই শেষে বাধ্য হয়ে বললাম, “চৈত্র মাস সবে পড়েছে। শুধু এই মাসটা যেতে দাও।
বৈশাখ এলেই দেখছি কী করা যায়।”
বৈশাখ
মাস পড়ল। আমিও টালবাহানা করতে লাগলাম। কিন্তু শেষরক্ষা করতে পারলাম না। আমার
গিন্নি খুব ভালো রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন। প্রতি পঁচিশে বৈশাখ চন্দননগরে তাঁদের
বাড়িতে খুব বড়ো করে রবীন্দ্রজয়ন্তী হয়। সেইদিন আমি গিন্নি আর সাবর্ণকে আনতে যাব
বলে বাবার মারুতি ওমনিতে উঠলাম। দিঘি আর তার তিন বাচ্চাকেও তুলে নিলাম। দিঘির তো ভারি আনন্দ। তার হয়তো শৈশবে দেখা গাড়িঘোড়া আর পিচঢালা
রাস্তার কথা মনে পড়ে গেল। সে কান মুড়ে হাওয়া খেতে খেতে যেন তার বাচ্চাদের বলতে
লাগল, দেখেছিস, তোদের নিয়ে কেমন ঘুরতে বেরিয়েছি?
সে
দিনটাতেও ছিল আজকের মতো চড়া রোদ। দিল্লি রোড দিয়ে যেতে যেতে ড্রাইভার শ্যামলকে
থামতে বলেছিলাম ঠিক এই জায়গাটায়। এই কদমগাছের নিচে একটু ছায়া দেখতে
পেয়ে গাড়ি থেকে নেমেছিলাম। দিঘি আর সাহেব-বিবি-গোলামদেরও নামিয়েছিলাম। গাছের
গুঁড়িটায় গিয়ে বসেছিলাম। আমার দেখাদেখি দিঘিও বসেছিল, আর তার বাচ্চাগুলোও। দিঘিকে
ঘিরে বাচ্চাগুলো খেলা করছিল আর দিঘি তাদের দিকে স্নেহভরা দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল। মাঝে
মাঝে আমার দিকে তাকিয়ে যেন বলছিল, “হি হি, বাচ্চাগুলো কী দুষ্টু, না?”
হঠাৎ
আমি গাড়িতে উঠে পড়লাম। শ্যামলকে বলাই ছিল, সে ইঞ্জিন চালু রেখেছিল। গাড়িতে উঠেই
সপাটে দরজা বন্ধ করে দিলাম। তখনও দিঘি ব্যাপারটা বোঝেনি। মানুষের বিশ্বাসঘাতকতা
বোঝা তার কম্ম নয়। বুঝল যখন গাড়ি চলতে শুরু করল। সেই মুহূর্তে নজরে এল সেই কদমগাছের
গুঁড়িতে আঁকা রাক্ষসের মুখটা।
গাড়ি
ফুল পিক-আপে চলতে শুরু করেছে। আমার পেছন ঘুরে দেখার ক্ষমতা নেই। তবে ড্রাইভারের
লুকিং গ্লাসে দেখতে পেয়ে গেলাম ভয়াবহ দৃশ্য। দিঘি প্রাণপণে ছুটে আসছে আমাদের গাড়ির
দিকে। তার পেছনে তার বাচ্চা তিনটেও ছুটে চলেছে। তাদের সঙ্গে গাড়ির দূরত্ব ক্রমশ
বেড়ে চলেছে। আস্তে আস্তে তারা বিন্দুতে পরিণত হচ্ছে কিন্তু ছোটা থামায়নি। থামাল
যখন ঘটনাটা ঘটল। একটা বাচ্চা কোনও কারণে পড়ে গেল আর একটা ম্যাটাডর এসে দিল তাকে
সম্পূর্ণ পিষে। কোন বাচ্চাটা বুঝতে পারলাম না। অঝোরে কেঁদে ফেললেও গাড়ি থামাতে
পারলাম না। লুকিং গ্লাস দিয়ে শুধু দেখলাম, দেওয়ালে মশা মারলে যেমন তার রক্ত ছিটকে
যায়, ঠিক তেমন দূরে রাস্তায় থেবড়ে আছে চাপ চাপ রক্ত।
“স্যার
হয়ে গেছে, আপনি ছোটোবাবুকে ডাকুন, আমি একটু আসছি।” আমাকে দশ বছর আগের স্মৃতির
কুয়ো থেকে তুলে এক ঝটকায় বাইরে এনে ফেলল আমার ড্রাইভার শ্যামল। গাড়ির চাকা লাগানো
হয়ে গিয়েছে। এবারে সাবর্ণকে ডাকতে হবে। কিন্তু রাস্তায় একটা গাড়িতে চোখ পড়তেই আমার
বুকটা কেঁপে উঠল। ওটা মিন্টু ঘোষের টাটা সুমোটা না?
একেবারে
ঠিক দেখেছি। ওতে মিন্টু ঘোষ আর তার দলবল রয়েছে। ক’দিন ধরেই সন্দেহ হচ্ছিল আমার
ফ্যাক্টরির লেবার ইউনিয়নের হেড মিন্টু ঘোষ আমাকে ফলো করছে। আমার উপরে ওর অনেক রাগ
জমে আছে। আমার ক্ষতি করতে চায় ও।
ঝটপট
মোবাইলটা বের করে সাবর্ণর নাম্বারে ডায়াল করলাম। কিন্তু রিং বেজেই চলেছে। সাবর্ণ
ধরছে না। সর্বনাশ! গাড়ি চালিয়েও যাবার উপায় নেই কারণ, গাড়ির চাবি শ্যামলের কাছে আর
শ্যামল টয়লেট করতে গেল।
মিন্টু ঘোষের
গাড়িটা প্রায় দুশো মিটার দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। ওখানে কী হচ্ছে বুঝতে পারছি না।
প্রাণপণে ছুটলাম।
এই গরমে
এভাবে ছোটা অসম্ভব। কিন্তু ছুটতে আমাকে হবেই। দূরে মিন্টু ঘোষের টাটা সুমোটা
দাঁড়িয়ে আছে দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু ও কী! টাটা সুমো যে আবার চলতে শুরু করল! দূরে
মিলিয়ে যাচ্ছে যে! ওরা আমার সাবর্ণকে কিডন্যাপ করল!
নাহ্। এই
তো সাবর্ণ। এই তো আমার সোনামণি। রাস্তার ধারে ঝুঁকে পড়ে ওর সেলফোনটা কুড়োচ্ছে।
একটা নয়, এতটা পথ দৌড়ে আমি একটার পর একটা হাঁফ ছেড়েই যাচ্ছি। তাই দেখে সাবর্ণ বলল,
“ড্যাড, হোয়াই ওয়্যার ইউ রানিং?”
“বেটা,
তোমাকে ওরা কিডন্যাপ করতে এসেছিল?”
“কিডন্যাপ?
আমাকে? হাউ সিলি! বেনটেনের রিস্টে আল্টিম্যাট্রিক্স থাকতে সে কখনও কিডন্যাপড হতে
পারে?” এই বলে সাবর্ণ তার বাঁহাতের সবুজ ভজকটমার্কা ঘড়িটা তুলে দেখাল।
আমি
হাঁটু গেড়ে বসে সাবর্ণকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললাম, “একটা আল্টিম্যাট্রিক্স দিয়েই তুমি
শত্রুদের মোকাবিলা করে ফেললে?”
“না,
না। আরও আছে না? গুয়েন অ্যান্ড ক্যাভিন।”
“তারা
আবার কে?”
“বাহ্
রে! তাও জানো না? আরে বাবা, গুয়েন হল বেনটেনের কাজিন আর ক্যাভিন হল বেনটেনের
ফ্রেন্ড।”
“ও ব্বাবা!
তিনজনে মিলে কিডন্যাপারদের ঘায়েল করে ফেললে?”
“না, আর
একজনও ছিল। ওয়ান হান্ড্রেড ওয়ান ডালমিশিয়ানের একটা। বাকি হান্ড্রেডখানা খুঁজেই
পাচ্ছি না কিছুতেই।”
ছেলের
কথা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। বললাম, “কোথায় তারা?”
“ওই
যে।” সাবর্ণ আঙুল তুলে সামনের দিখে দেখাল। একটা বড়ো কুকুর আর তার দুটো বড়ো সাইজের বাচ্চা
দূর থেকে এদিকে এগিয়ে আসছে।
কী
হয়েছিল জিজ্ঞাসা করতে সাবর্ণ বলল, “আমি তো গুয়েন আর ক্যাভিনকে পেয়ে খেলছিলাম আর
ডালমিশিয়ন তাকিয়ে তাকিয়ে হাসছিল। তখন একটা গাড়ি এসে থামল। তার থেকে চারটে কালো
কালো বড়ো বড়ো লোক নেমে আমাকে ধরতে এল। আমি তো দেখেই বুঝেছি ওরা এলিয়েন। আমার
কাছে তো আল্টিম্যাট্রিকস আছে। সেটা ঘুরিয়ে ঠিক পাওয়ারটা চুজ করতে না করতেই ওরা
আমার হাত ধরে ফেলল। আমি সেলফোন দিয়ে গুয়েন-ক্যাভিনের ছবি তুলছিলাম তো, সেলফোনটাও
হাত থেকে পড়ে গেল। এই সময়ে ডালমিশিয়ন ঝাঁপিয়ে পড়ে লোকটার হাতে জোরসে কামড়ে দিল।
সেই দেখে গুয়েন আর ক্যাভিনও ওদের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তারপর আমি একটা ঝটকা দিতেই ওরা
আমাকে ফেলে গাড়িতে উঠে পালাল। আর গুয়েন-ক্যাভিন-ডালমিশিয়ানরা ওদের গাড়িটা তাড়া করে
ছুটে গেল। হি হি হি।”
তিনটে
কুকুর এতক্ষণে আমার একেবারে কাছে চলে এসে লেজ নাড়াচ্ছে। মা-কুকুরটা একটু বেশিই
খুশি মনে হল। ও কি আমাকে চিনতে পেরেছে? এতদিন পরে চিনতে না পারারই কথা। পারুক বা
না পারুক, সাবর্ণর কাছে যে ভালোবাসা ওরা এইটুকু সময়ে পেয়েছে সেটুকুরই প্রতিদান ওরা
দিতে পারে নিজেদের প্রাণ দিয়েও। ওরা জানোয়ার। শোধ নিতে ওরা জানে না। জানে শুধু ভালোবাসতে।
আমার
গাড়ি অবধি হেঁটৈ এল তিনটে কুকুর। কৃতজ্ঞতায় আমার চোখ ভিজে গেল। মা-কুকুরটার গলা না
জড়িয়ে থাকতে পারলাম না। গায়ে তার সাদা-ব্রাউন ছোপ আর কপালে বড়ো ব্রাউন রঙের ফুটকি।
দেখতে অনেকটা তাসের হার্ট সাইনের মতো। এ হল সেই লাল-পান-বিবি। দিঘির মেয়ে। এই দশ বছরে
দিঘি হয়ত মরে গিয়েছে। কিন্তু তার ভালোবাসা রয়ে গিয়েছে তার বংশের রক্তে।
_____
অলঙ্করণঃ মানস
পাল
গল্পঃ খুশির দরজা খুলে - মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য
খুশির দরজা খুলে
মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য
ক’দিন ধরে বেজায় মনখারাপ
শ্বেতার। অজেয়র অবস্থাও তথৈবচ। অফিস ছুটি নিয়ে বাড়ি আর নার্সিং হোমে দৌড়চ্ছে শাটল
ককের মতো। ক্লাস সিক্সে পড়া রিন্টির অসুবিধে শুরু হয়েছিল জ্বর আর গলা ব্যথা দিয়ে।
তিনদিনের অ্যান্টিবায়োটিকে যখন কাজ হল না তখন ডাক্তার এনএসওয়ান পরীক্ষা করালেন।
তাতেই ডেঙ্গির জীবাণু পাওয়া গেল। নার্সিং হোমে ভর্তি করা হল সঙ্গে সঙ্গে। তড়িঘড়ি
ম্যাক এলাইজা টেস্টের জন্য রক্তের নমুনা পাঠালেন ওঁরা।
ভরা বর্ষা। ডুয়ার্সজুড়ে
শুরু হয়েছে ডেঙ্গির উপদ্রব। ক্রমশ মহামারীর আকার ধারণ করছে এই রোগ। কাল রিন্টির
পাশের বেডের এক পেশেন্ট মারা গেছেন ডেঙ্গি শক সিনড্রোমে। মিডিয়ার লোকজন এসেছিল বুম
আর ক্যামেরা নিয়ে। সন্ধেবেলা সেই খবর ফলাও করে দেখিয়েছে টিভিতে।
কাল রিন্টির প্লেটলেট
কাউন্ট ঝপ ঝপ করে নেমে আসছিল। দেড় লাখ থেকে এক লাখ, সেখান থেকে পঞ্চাশ হাজার। ভয়
পেয়ে গিয়েছিল অজেয় আর শ্বেতা। চিন্তিত ছিলেন ডাক্তারবাবুও। তবে শেষ অবধি প্লেটলেট
আর ড্রপ করেনি। বরং আজ সকালের রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে সেটা পঁয়ষট্টি হাজারে উঠেছে।
জ্বরটাও আর নেই। তাতে সামান্য স্বস্তি এসেছে। নির্ঘুম রাত কাটিয়ে সকাল সকাল
নার্সিং হোমে চলে এসেছিল শ্বেতা-অজেয়। সিসিইউ থেকে রিন্টিকে কেবিনে শিফট করা হয়েছে
আজ সকালে।
রিন্টি শুকনো মুখে অনুযোগ
করছিল শ্বেতার কাছে। তাকে দেখতে আত্মীয়স্বজনরাই শুধু এসেছে। কোনও বন্ধু এখনও
আসেনি। শ্বেতা সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিল, “এখনও তো কেউ খবর পায়নি। দেখে নিস, আজকেই
তোর কোনও না কোনও বন্ধু তোকে দেখতে আসবে।”
মেয়ের সঙ্গে গল্প করে
ভিজিটিং আওয়ার ফুরোবার পর অজেয় আর শ্বেতা বেরিয়ে আসছিল কেবিন থেকে। তখনই চোখ পড়েছে
অশীতিপর মানুষটির দিকে।
লাউঞ্জের বাইরে একটা বড়ো
চাতাল। সেখানে ফাইবারের চেয়ার সারি দিয়ে বসানো। চেয়ারে বসে থাকা সাদা বুশ শার্ট আর
খয়েরিরঙা ঢোলা ট্রাউজার পরা প্রবীণ মানুষটিকে দেখে থমকে গেল দু’জনে। ফর্সা ধবধবে
মুখে অজস্র রেখার আঁকিবুঁকি, ছোটো ছোটো চোখ, দাড়িগোঁফবিহীন মঙ্গোলয়েড মুখ, মাথায়
পাহাড়ি টুপি। ক্রিসমাসের ছুটিতে লামাহাটায় এই ভদ্রলোকের হোম স্টেতেই দু’দিনের জন্য
অতিথি হয়েছিল না তারা!
হ্যাঁ, উনিই তো।
লামাহাটায় যে দুটো দিন ওরা ছিল তার মধ্যেই রিন্টির সঙ্গে দিব্যি ভাব হয়ে গিয়েছিল
ভদ্রলোকের। রিন্টিকে উনি ডাকতেন লিটল প্রিন্সেস বলে। রামায়ণ, মহাভারত, ইলিয়াড,
ওডিসির মতো মহাকাব্য থেকে গল্প শোনাতেন। রিন্টি রীতিমতো ভক্ত হয়ে গিয়েছিল ওঁর। কী
যেন নাম ভদ্রলোকের? হ্যাঁ মনে পড়েছে, রিনচেন শেরপা। মোটা ফ্রেমের হাই পাওয়ারের
চশমা পরতেন। সেই চশমাটা চোখে না থাকায় চিনতে একটু অসুবিধে হচ্ছিল। ইনি কী করছেন এই
নার্সিং হোমে?
শ্বেতা প্রশ্নটা করতে
অজেয় বলল, “ভদ্রলোক কথায় কথায় বলেছিলেন, চোখ নিয়ে ওঁর সমস্যা বহুদিনের। রেটিনার ভেতরের
রক্তনালী থেকে চুঁইয়ে জল বের হয় বলে আবছা দেখেন। দৃষ্টি বেশি ঝাপসা হলে ক্লিনিকে
গিয়ে চোখের মধ্যে ইনজেকশন নিতে হয়। ইনজেকশনটাও মহার্ঘ। পাহাড়ে চোখের এই জটিল রোগের
চিকিৎসার সুযোগ নেই। সেজন্য সমতলে নির্দিষ্ট সময় অন্তর যেতে হয় তাঁকে। সেখানকার
চোখের ডাক্তার রেটিনা স্ক্যান করিয়ে বলে দিতে পারেন পরের ইনজেকশনগুলো কোন কোন সময়ে
প্রয়োজন হবে।
শ্বেতা বলল, “তার মানে
উনি চোখ দেখাতেই এসেছেন এই নার্সিং হোমে। চলো, কথা বলে আসি ওঁর সঙ্গে।”
গোলগাল চেহারার মানুষটি
শান্তভাবে বসে আছেন। সম্ভবত অপেক্ষা করছেন চোখের ডাক্তারের। নিবিষ্টমনে তাকিয়ে
আছেন দূরের দেওয়ালটার দিকে। গুটিকয়েক পাখি দেওয়ালের কোণে একটা খাঁজের মধ্যে বাসা
বানাচ্ছে। খড়কুটো নিয়ে আসছে কোথা কোথা থেকে। সেগুলো রেখে আবার উড়ে যাচ্ছে। আবার
আসছে। মহা ব্যস্ত যেন তারা। চশমা ছাড়া ভদ্রলোক আদৌ কিছু দেখতে পাচ্ছেন কি না কে
জানে।
শ্বেতা ওঁর সামনে গিয়ে
মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করল, “ভালো আছেন?”
রিনচেন শেরপা চিনতে
পারেননি। অন্যমনস্ক গলায় বললেন, “পাখিগুলো কেমন বাসা বানাচ্ছে, দেখেছেন? সাধারণ
নৈমিত্তিক ঘটনা। কিন্তু এই সাধারণ দৃশ্যটাই আমার মনটাকে সুস্থির করে দিচ্ছে। এই যে
জগৎসংসার ঠিকঠাক চলছে, পাখিগুলো একমনে নিজেদের কাজ করছে, এতে বেশ একটা ভরসা পাওয়া
যাচ্ছে। কী বলেন?”
ভদ্রলোক একইরকম আছেন।
সবসময় ভাবের ঘোরে থাকেন। একসময় স্কুলে পড়াতেন। একমাত্র মেয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর
ডাক্তার। বছরে একবার বাড়িতে আসে, বাবার সঙ্গে ক’টা দিন কাটিয়ে যায়। রিনচেনের
স্ত্রীবিয়োগ হয়েছে বহুদিন আগে। বাড়িটা ফাঁকা পড়ে থাকে বলে হোম স্টে চালু করেছেন।
একজন পরিচারক আছে। সে ছেলেটিই অতিথির দেখভাল করে। নিজের সংসার বলতে রিনচেনের কিছু
নেই। কিন্তু চারপাশে দিব্যি সংসার তৈরি করে নিয়েছেন। এলাকার সমস্ত ছেলেমেয়ে ওঁর
ভক্ত। বাচ্চাগুলোর সঙ্গে দাবা, লুডো, চাইনিজ চেকারের মতো ইনডোর গেম খেলেন মনের
আনন্দে।
রিনচেনের লামাহাটার
বাড়িটার কথা মনে পড়ল শ্বেতার। অল্প কিছু দৈনন্দিন সামগ্রী নিয়ে পরিতৃপ্ত নিরাভরণ
বাড়িটিতে সবই পুরনো। বৃদ্ধ হেসে বলতেন, “এই বাড়িটা পুরনো, বাড়ির আসবাবপত্র থেকে
সবকিছুই পুরনো। এখানে শুধু আমিই ছেলেমানুষ। লিটল প্রিন্সেসের মতো।”
শ্বেতা জানতে চেয়েছিল,
“এই যে এত বড়ো বাড়িতে একা একা থাকেন, মনখারাপ লাগে না আপনার?”
বৃদ্ধ বিমনা স্বরে
বলেছিলেন, “কোনও-কোনওদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে মনটা একটু ভারী ভারী লাগে ঠিকই। তখন
কাছেপিঠের বাচ্চাগুলোকে ডেকে ওদের সঙ্গে দুয়েক রাউন্ড গুলি খেলে নিই। ওরা আমার সব
গুলি জিতে নেয়। কিন্তু আমার মনটা ফুরফুরে হয়ে যায়।”
পাশের ফাঁকা চেয়ারদুটোতে
বসল অজেয় আর শ্বেতা। কৌতূহলী স্বরে অজেয় বলল, “পাহাড়ে লাগাতার হরতাল ডেকেছে
অ্যাক্টিভিস্টরা। গাড়িঘোড়া চলছে না। দোকানপাট-অফিসকাছারি সব বন্ধ। আপনি এর মধ্যে এলেন
কী করে?”
রিনচেন মৃদু গলায় বললেন,
“আমাকে আসতেই হত। ড্রাইভার ছেলেটিকে আগের দিন রাত্তিরে আমার বাড়িতে ডেকে
নিয়েছিলাম। ভোররাতে দু’জনে আমার গাড়িটায় চেপে সমতলের দিকে নেমে আসছিলাম। লামাহাটা
থেকে পেশক অবধি এসেছি নির্বিঘ্নে। কিন্তু পেশক ছাড়াবার পর একটা জায়গায় কিছু লোক
আমাদের বাধা দিল। ড্রাইভারকে ধাক্কা দিয়ে নামিয়ে দিল গাড়ি থেকে। আমার চশমাটা কেড়ে
নিয়ে ফেলে দিল খাদে। আমার গাড়িটাও আটকে রেখে দিল গায়ের জোরে। ড্রাইভার থেকে গেল
গাড়ির সঙ্গে। আমি হেঁটেই রওনা দিলাম শিলিগুড়ির দিকে।”
রিনচেনের বয়স আশির ওপাশে।
তবুও শারীরিক অসুবিধে অগ্রাহ্য করে এতটা পথ হেঁটেছেন রাস্তা দিয়ে। ক্লান্ত হলে
বিশ্রাম নিয়েছেন। একটু ভালো লাগলে আবার নতুন করে হাঁটা শুরু করেছেন। বনধে গাড়িঘোড়া
চলছে না পাহাড়ি পথে। রাস্তায় মানুষজনও অপ্রতুল। দোকানপাট বন্ধ থাকায় জল অবধি খেতে
পারেননি। ভাগ্য ভালো রাস্তায় একটা পুলিশের জীপ পেট্রোলিং করছিল। ডিউটি অফিসার
বয়স্ক মানুষটিকে ক্লান্ত-বিধ্বস্ত অবস্থায় নেমে আসতে দেখে গাড়ি দাঁড় করান। পুরো
ঘটনা শুনে তিনি নিজেই ওঁকে গাড়িতে তুলে নিয়ে পৌঁছে দিয়ে গেছেন এখানে।
অজেয় বলল, “পাহাড়ে এই
গণ্ডগোলের মধ্যে রাস্তায় নেমেছিলেন কেন? চোখের ডাক্তার কি আজকেই ডেট দিয়েছেন
আপনাকে?”
রিনচেন কি অজেয়কে চিনতে
পেরেছেন? পরিচিত মানুষকে দেখলে শরীরী ভাষায় যে প্রতিফলন হয় সেটা দেখা গেল না।
বৃদ্ধ বললেন, “চোখ দেখাতে
আসিনি এখানে। আমি তো কলকাতার একটা ক্লিনিকে চোখ দেখাই।”
অজেয় বলল, “ও, আচ্ছা।
তাহলে কি আপনার কোনও আত্মীয়স্বজন ভর্তি আছেন এখানে?”
রিনচেন শেরপা ঘাড় নেড়ে
বললেন, “আমার এক ছোট্ট বন্ধু অসুস্থ হয়ে ভর্তি আছে এখানে। তাকে দেখতেই এসেছি। তাকে
আমি ডাকতাম লিটল প্রিন্সেস বলে। কিন্তু সেই নাম বলায় রিসেপশনিস্টরা আমাকে হেল্প
করতে পারছেন না। ওঁদেরকেও দোষ দেওয়া যায় না। এদিকে ভিজিটিং আওয়ারও শেষ হয়ে গেছে।
বাধ্য হয়ে বসে আছি এখানে। কী করব বুঝতে পারছি না।”
অজেয় হাঁ করে ভদ্রলোককে
দেখছে। শ্বেতার দিকে তাকাল একবার। অস্ফুটে বলল, “কী আশ্চর্য! আপনি রিন্টিকে দেখতে
এসেছেন অত দূর থেকে? কে আপনাকে খবর দিল?”
বৃদ্ধ বললেন, “কাল
ক্রিকেট দেখছিলাম। চ্যানেল সার্ফ করতে করতে হঠাৎ একটা নিউজ চ্যানেলে চোখ আটকে
গিয়েছিল। এই নার্সিং হোমে দেখলাম একজন ডেঙ্গিতে মারা গেছে। মৃত পেশেন্টের পাশের
বেডে দেখলাম লিটল প্রিন্সেস শুয়ে আছে। মনটা দুলে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে ডেকে নিলাম
ড্রাইভারকে।”
প্রবীণ মানুষটির কপালে বয়সজনিত
রেখার কাটাকুটি। কপালে বাড়তি কিছু ভাঁজ ফেলে বৃদ্ধ চোখ কুঁচকে দেখলেন অজেয়কে। মৃদু
স্বরে বললেন, “চশমা ছাড়া ঝাপসা দেখি সব। এতক্ষণ পারিনি, এবার গলার আওয়াজ শুনে
চিনতে পেরেছি আপনাদের। এখন কেমন আছে লিটল প্রিন্সেস?”
অজেয় বলল, “কাল অবস্থা
একটু ক্রিটিক্যাল ছিল। আজ রিন্টি একটু ভালো আছে। ডাক্তার বলেছেন, বিপদ খানিকটা
কেটেছে। সিসিইউ থেকে কেবিনে শিফট করা হয়েছে আজ সকালে।”
রিনচেন উঠে দাঁড়ালেন।
শশব্যস্ত হয়ে বললেন, “চলুন, প্লিজ আমাকে নিয়ে চলুন। যার জন্য এতটা পথ আসা সেই লিটল
প্রিন্সেসকে দেখে আসি একবার।”
হ্যান্ডব্যাগ থেকে রুমাল
বের করল শ্বেতা। দু’চোখে কোণে জমে থাকা জলের বিন্দুদুটো মুছে নিল সন্তর্পণে। এই
অশ্রু বুকচাপা কষ্টের নয়। অপার আনন্দের। সকালেই মনখারাপ করা মেয়েকে সান্ত্বনা দিয়ে
শ্বেতা বলেছিল, আজকেই তার কোনও না কোনও বন্ধু তাকে দেখতে আসবে। সেই কথাটা যে এভাবে
ফলে যাবে কে জানত!
মনখারাপ দূরে সরিয়ে খুশির
দরজা খুলে পাহাড় থেকে নেমে এসেছেন এই ঈশ্বরের দূত। হ্যাঁ, ঈশ্বরের দূতই তো। নইলে
সম্পূর্ণ অপরিচিত অনাত্মীয় একটি মেয়ের জন্য এমন কষ্ট কেউ স্বীকার করে কখনও! এমন
দু-চারজন দেবতুল্য মানুষ আছেন বলেই পৃথিবীটা বাসযোগ্য আছে এখনও।
শ্বেতা বড়ো করে একটা শ্বাস
ফেলল। অজেয়র দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, “ভিজিটিং আওয়ার শেষ হল এইমাত্র। কিন্তু অনুরোধ
করলে কি ওঁকে দু’মিনিটের জন্য ভেতরে যাওয়ার অনুমতি দেবে না ওঁরা? তুমি বলেই দ্যাখো
না একবার।”
_____
অলঙ্করণঃ মানস পাল
গল্পঃ জুরাসিক গ্রহ - গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়
জুরাসিক
গ্রহ
গৌতম
গঙ্গোপাধ্যায়
প্ল্যানেটারি
সার্ভে মিশনঃ ক্যাপ্টেন স্তেপিনার লগবুক
ওয়ার্ম
হোল জাম্পের পরে আমরা প্রথমে টাউ সেটি সিস্টেমটাকে সার্ভে করি। পাঁচটা বড়ো গ্রহের মধ্যে দুটো গ্যাস দানব। দ্বিতীয় গ্রহ
ওডিনের মুক্ত অক্সিজেনের অস্তিত্বসংক্রান্ত স্পেকট্রোস্কোপিক পর্যবেক্ষণ ভেরিফাই
করেছি। অক্সিজেন আছে মানে প্রাণের অস্তিত্ব আছে। ডায়রেক্টিভ অনুযায়ী
আমরা ওডিনের থেকে এক লক্ষ কিলোমিটার দূরের কক্ষপথে উদ্দালককে রাখি।
স্তেপিনা
ভিউ স্ক্রিন থেকে চোখ সরালেন। নিচের গ্রহটা সবুজে অনেকটা ঢেকে আছে। মরুভূমিও আছে
কয়েকটা। দুই মেরুরই রঙ সাদা। হঠাৎ করে দেখলে পৃথিবী বলে ভুল হতে পারে। তবে মহাদেশগুলো
একেবারেই অন্যরকম দেখতে। মাত্র দুটো বড়ো মহাদেশ আর বেশ কয়েকটা দ্বীপপুঞ্জ আছে। মহাদেশদুটোর
নাম দেওয়া হয়েছে আলফা ও বিটা। ওডিন গ্রহটা পৃথিবীর থেকে সামান্য ছোটো, ভরও সামান্য
কম। দিনের দৈর্ঘ্য প্রায় তেরো ঘণ্টা।
“রেডিও?”
রেডিও
অপারেটর মুরলী সিটটা ঘুরিয়ে কান থেকে হেড ফোন নামাল। স্তেপিনা হাসি
চাপলেন। কম্পিউটার যেকোনও মানুষের চেয়ে তাড়াতাড়ি নির্ভুলভাবে সিগন্যাল বিশ্লেষণ
করতে পারে, কিন্তু তাঁর চেনা সব রেডিও অপারেটরই সিটে বসে প্রথমেই হেড ফোনটা কানে
লাগায়। মুরলী সম্ভবত হেড ফোন দিয়ে মিউজিক শোনে। ওকে সিটের হাতলে তাল দিতে দেখেছেন। তবে কাজে কোনও ত্রুটি
নেই।
“ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক
স্পেকট্রামে নয়েজ ছাড়া কিছু নেই। গ্যাস দানব সেটি ফোর আর ফাইভ থেকে রেডিও নয়েজ আসছে।”
ফোর
বৃহস্পতির থেকে সামান্য বড়ো। ফাইভ আয়তনে ইউরেনাসের মতো।
“মারিক?”
কম্যান্ডার
মারিক স্তেপিনার ডেপুটি। তিনি রাডারের পর্দায় চোখ রেখেছিলেন।
“ক্লিয়ার।
কোনও কৃত্রিম উপগ্রহ বা স্পেস স্টেশনের চিহ্ন নেই।”
ওডিনের
কোনও চাঁদ যে নেই সেটা আগেই জানা গেছে।
“ডক্টর
এনোবোয়া?”
এক্সোবায়োলজিস্ট
এনোবোয়া সার্ভে মিশনের প্রধান বিজ্ঞানী। তিনিও এতক্ষণ তাঁর সামনের
ভিউ-স্ক্রিন থেকে চোখ সরাচ্ছিলেন না। উদ্দালকের মূল টেলিস্কোপটা
এই মুহূর্তে তাঁর দখলে।
“উন্নত
সভ্যতার চিহ্ন নেই। বড়ো শহর জাতীয় কিছু নেই। বুদ্ধিমান প্রাণী থাকলেও তারা পৃথিবীর প্রস্তরযুগের স্তর পেরোয়নি। এতদূর থেকে আর কিছু বলা সম্ভব নয়।”
“জীবন
আছে তো?”
“নিশ্চয়ই,
সবুজটা ক্লোরোফিলের রঙ, স্পেকট্রাম হুবহু মিলে যাচ্ছে। পৃথিবীর মতো করে ভাবলে উদ্ভিদ আর প্রাণী দুইই নিশ্চয়ই আছে। তবে ক্যাপ্টেন, আগেও বলেছি, খোলা মনে চলতে হবে।”
“আমার
মন যথেষ্টই খোলা।” একটু শীতল গলায় বললেন স্তেপিনা।
“দুঃখিত,
আমি কথাটা ওভাবে বলতে চাইনি। আসলে এক্সোবায়োলজির কোর্সে আমরা প্রথমেই শেখাই পৃথিবীর
জীবজগতের নিয়ম অন্যত্র চলতে নাই পারে। বহুকোষী উদ্ভিদ আর প্রাণীদের ওডিনে হয়তো
আলাদা করা যাবে না।”
স্তেপিনা
ভাবলেন, আমি কি আপনার ছাত্র? মুখে শুধু বললেন, “রেকমেন্ডেশন?”
“ওডিনের
থেকে পাঁচ হাজার কিলোমিটার উপরের কক্ষপথে উদ্দালককে রাখা হোক।”
স্তেপিনা
মনে মনে হাসেন। বিজ্ঞানীদের নিয়ে এই সমস্যা। মিশনের সিকিউরিটি ডায়রেক্টিভে পরিষ্কার
করে বলে দেওয়া আছে ওডিনের কত কাছে উদ্দালককে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। কিন্তু এনোবোয়ার আর তর সইছে না।
“মারিক?”
“আমারও
মত ওডিনের কাছে যাওয়া। কিন্তু ডায়রেক্টিভ অনুযায়ী
দশ হাজার কিলোমিটারের বেশি কাছে উদ্দালককে কখনওই নিয়ে যাওয়া যাবে না।” মারিকের স্পষ্ট মত।
“কিন্তু
ক্যাপ্টেন, ডায়রেক্টিভ তো বানানো হয়েছিল সম্ভাব্য
বিপদের কথা ভেবে। ওডিনের থেকে উদ্দালকের কোনও
বিপদের সম্ভাবনা নেই।” এনোবোয়ার আপত্তিটা প্রত্যাশিত।
“আপনার
মত রেকর্ডে রইল। অ্যাস্ট্রোগেটর, ওডিনের দশ হাজার কিলোমিটার উপরে কক্ষপথের
জন্য রকেটকে রেডি কর।”
অ্যাস্ট্রোগেটর
পেন লি সামনের কম্পিউটারকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিলেন। এনোবোয়ার মুখ দেখে বোঝা গেল যে
তিনি অখুশি, তবে কথা বাড়ালেন না।
প্ল্যানেটারি
সার্ভে মিশনঃ ক্যাপ্টেন স্তেপিনার লগবুক
দশ
হাজার কিলোমিটার উপরের কক্ষপথ থেকে আটচল্লিশ ঘণ্টা ধরে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করা
হয়। তারপর মিশনের ডায়রেক্টিভ অনুযায়ী প্রথম ধাপে রোবট ল্যান্ডার সঞ্জয়কে ওডিনে নামানো
হয়। এককোষী জীব বা ভাইরাস সংক্রমণ রোধের জন্য সমস্ত সাবধানতা অবলম্বন করা হয়েছিল। প্রথম
ল্যান্ডিংয়ের জন্য আলফা মহাদেশকে বেছে নেয়া হয়েছিল।
উদ্দালকের
কেউই প্রায় ভিউ-স্ক্রিনগুলো থেকে চোখ সরাচ্ছেন না। এতক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে এটুকু
বোঝা গেছে যে ওডিনে বড়ো প্রাণী আছে। বা এনোবোয়ার কথামতো বললে, এমন জীব আছে যারা
চলতে ফিরতে সক্ষম। কিন্তু তাদের চেহারা এতদূর থেকে বোঝা যাচ্ছে না। সঞ্জয়কে
রাত্রিবেলা নামানো হয়েছে যাতে প্রাণীরা ভয় না পায়। অন্ধকারে শুধু রাডারের সাহায্যে
রিমোট ল্যান্ডিং অসম্ভব, তাই অবলোহিত আলো ব্যবহার করতে হয়েছে। টাউ সেটি জি টাইপ নক্ষত্র, তার আলোর
যা রং, প্রাণীদের চোখ ইনফ্রারেড সেনসিটিভ না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। ভোরবেলা
প্রাণীরা জল খেতে আসবে ধরে নিয়ে সঞ্জয়কে একটা বড়ো লেকের কাছে নামানো হয়েছে।
ক্যামেরাগুলোর
ছবিদের ভিউ-স্ক্রিনের বিভিন্ন অংশে দেয়া আছে। আলো ফুটছে। কেউ একজন হঠাৎ বললেন, “উপরের
ডানদিকের কোণে!”
গাছগুলো
নড়ছে, বেশ বড়ো প্রাণী সন্দেহ নেই। জঙ্গল ঠেলে বেরিয়ে এল।
প্রথমে
কারওর মুখে কথা সরছে না। ঘোর কাটিয়ে স্তেপিনা বললেন, “জুম।”
ক্যামেরা
টেকনিশিয়ান সিতারা প্রাণীটার ছবিটাকে পর্দায় বড়ো করে।
“অসম্ভব! এ তো অবিকল মিলে যাচ্ছে!” এনোবোয়া প্রায় চিৎকার করে উঠলেন।
“কী
অসম্ভব? অসম্ভব কেন?” উদ্দালকের সবচেয়ে কমবয়সী ক্রু সিতারা জিজ্ঞাসা করেন।
“এ তো
একটা ডাইনোসর! স্টেগোসরাস! এখানে কেমন করে?”
“পৃথিবীতে
যদি স্টেগোসরাস জন্মাতে পারে তাহলে ওডিনে নয় কেন?”
“এক্সোবায়োলজিতে
একটা কথা বারবার বলা হয়। বিবর্তনের এতরকম পথ আছে
যে আলাদা আলাদা রাস্তায় কখনও একই জীবের জন্ম হবে না। কাছাকাছি
হবে, কিন্তু এক নয়। যেমন হাঙর আর তিমি, জলের মধ্যে দিয়ে সাঁতার কাটার সুবিধার
জন্য একইরকম চেহারা, কিন্তু তাদের কেউ গুলিয়ে ফেলবে না। কিন্তু এ তো স্টেগোসরাসের ফসিল
থেকে পাওয়া চেহারার সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে!” মনে হল এনোবোয়া সিতারাকে নয়, নিজেকেই
বোঝাচ্ছেন।
বিস্ময়ের
সেখানেই শেষ নয়। কারণ, যে সমস্ত প্রাণী ক্যামেরাতে ধরা পড়ল তাদের অনেকগুলোকেই
পৃথিবীর মিউজিয়ামে দেখতে পাওয়া যায়। কেউ একটা কম্পিউটারের এনসাইক্লোপিডিয়া থেকে
জুরাসিকের ডাইনোসরদের ছবিগুলো পরপর পর্দায় ফেলেছিল যাতে তাদের চেনা যায়। এনোবোয়ার
বিরক্তি ও বিস্ময় ক্রমশই বাড়ছিল। শেষকালে জঙ্গল থেকে যখন একদল অ্যালোসরাস বেরিয়ে একটা বিরাট
ব্রাকিওসরাসকে আক্রমণ করল তখন তিনি শুধু মাথার চুল ছিঁড়তে বাকি রাখলেন। মিশনের
জেনেটিসিস্ট ডক্টর হ্যামারস্মিডের সঙ্গে আলোচনা করছিলেন। অন্যদের কাছে অবশ্য সেটা তর্কাতর্কির
মতো শোনাচ্ছিল।
“আপনি
আমাকে বোঝান, দুটো আলাদা সৌরজগতে, দুটো সম্পূর্ণ আলাদা গ্রহে কেমন করে একই প্রাণীর
সৃষ্টি হতে পারে? তাও একটা দুটো নয়, এ যেন মনে হচ্ছে লেট জুরাসিক যুগের উপরে তৈরি
ডকুমেন্টারি থ্রিভি দেখছি।” এনোবোয়া রাগত স্বরে বলেন। “ডারউইন দেখলে আত্মহত্যা করতেন।”
“শান্ত
হন, ডক্টর এনোবোয়া। নিশ্চয়ই এর একটা ব্যাখ্যা আছে। এখন না বুঝলেও আরও তথ্য পেলে
বুঝতে পারব।”
“টিস্যুর
নমুনা দরকার। কোষ জাতীয় কিছু তো
থাকবেই, তার গঠনটা জানতে হবে। আমরা ভাবছিলাম ডিএনএ ছাড়া প্রাণ সম্ভব কি না, আর এখন
দেখছি জুরাসিক যুগে এসে পড়েছি। কে ভেবেছিল যে নতুন গ্রহে অভিযান করতে গিয়ে জীবাশ্মবিদ
লাগবে?”
সঞ্জয়ের
রোবট আর্ম দিয়ে উদ্ভিদের নমুনা সংগ্রহ করা গেছে, কিন্তু সেখানে অণুবীক্ষণ দিয়ে কোষ
পরীক্ষা করার ব্যবস্থা নেই। নমুনা উদ্দালকে নিয়ে আসতে হবে। ঠিক ছিল আটচল্লিশ ঘণ্টা
ওডিনে থাকবে সঞ্জয়। কিন্তু এনোবোয়া অত দেরি করতে রাজি নন। তাই ঠিক হল যে যত
তাড়াতাড়ি সম্ভব সঞ্জয়কে ফিরিয়ে আনা হবে। সেই মুহূর্তে অবশ্য সঞ্জয়ের সঙ্গে যোগাযোগ
করা সম্ভব ছিল না, কারণ উদ্দালক তখন ওডিনের বিপরীত দিকে। আধঘণ্টা পরে
আবার যোগস্থাপন করে যাবে।
উদ্দালকের
বাকি সমস্ত যন্ত্রপাতি নানারকম তথ্য সংগ্রহে ব্যস্ত। স্তেপিনা
সারাক্ষণ সমস্ত দিকে নজর রাখছেন। আধঘণ্টা পরে দেখলেন মুরলী ভুরু কুঁচকে
কম্পিউটারকে নানারকম নির্দেশ দিচ্ছেন।
“সমস্যা
হল নাকি?”
“বুঝতে
পারছি না। সঞ্জয়ের থেকে কোনও সিগন্যাল পাচ্ছি না।” মুরলী বলেন।
“কোনও
জন্তু হয়তো সঞ্জয়কে ড্যামেজ করেছে।”
“হতে
পারে। সঞ্জয়ের সব ইলেকট্রনিক্সই সলিড স্টেট। কিন্তু...”
“কিন্তু
ব্রন্টোসরাস মাড়িয়ে দিলে কী হবে, সেকথা ভেবে তৈরি নয়।” কথাটা শেষ করেন স্তেপিনা।
“ডক্টর এনোবোয়া, মারিক, আপনারা এদিকে আসবেন?”
প্ল্যানেটারি
সার্ভে মিশনঃ ক্যাপ্টেন স্তেপিনার লগবুক
আর্মস্ট্রং
ল্যান্ডারের সাহায্যে প্রাণীবিশেষজ্ঞ ডক্টর সায়নী, কম্যান্ডার মারিক এবং ক্যাডেট
স্মিথ ও সাইরাস ওডিনে নামেন। প্রাথমিক লক্ষ্য হল উদ্ভিদ ও ছোটো প্রাণীর নমুনা সংগ্রহ, দ্বিতীয়
লক্ষ্য সঞ্জয়ের অবস্থা দেখা। ডক্টর এনোবোয়া ল্যান্ডিং পার্টির সদস্য হতে চেয়েছিলেন,
কিন্তু ডায়রেক্টিভে তার সুযোগ নেই। ল্যান্ডারের দায়িত্বে ছিলেন কম্যান্ডার মারিক।
মারিক আর্মস্ট্রংয়ের এয়ার-লকের হাতলটা ডান হাতে ধরলেন। স্টানার
পিস্তলটা বাঁ হাতে, ম্যাক্সিমাম সেটিংয়ে রাখা।
সায়নী পিস্তল নিতে রাজি হননি। যদিও অ্যালোসরাস বা তার চেয়েও বড়ো টরভোসরাসের জন্য
স্টানার কী কাজে লাগবে মারিকের নিজেরও সন্দেহ আছে। আর্মস্ট্রং
থেকে তাঁদের লেজার ক্যানন দিয়ে অবশ্য কভার করছে সাইরাস ও স্মিথ। প্রায় একঘণ্টা আগে তাঁরা ওডিনে নেমেছেন, নানারকম চেক করতে হচ্ছিল বাইরে পা দেওয়ার আগে। সব পরীক্ষাতে সবুজ সংকেত পাওয়ার পরেই গ্রহের মাটিতে নামার অনুমতি মিলেছে।
সায়নী স্পেস-স্যুট রেডিওতে বললেন, “স্পেস নেভিতে নিশ্চয়ই জঙ্গলে সারভাইভাল কোর্স করানো হয়
না। আমার সামান্য অভিজ্ঞতা আছে। রোয়ান্ডাতে গরিলা আর
সুন্দরবনে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের পিছু নিয়ে দিনের পর দিন কাটিয়েছি। অবশ্য তারা
কেউই দশ মিটার লম্বা নয়।”
বায়ুচাপ
সমান হল, দরজাটা খুলে গেল। মারিক প্রথম মানুষ যিনি সৌরজগতের বাইরে কোনও গ্রহের মাটিতে পা
দিলেন। পেছনে সায়নী। রেডিওতে উদ্দালককে রিপোর্ট
করলেন মারিক। সায়নী ততক্ষণে বিশেষভাবে তৈরি পাত্রে সংগ্রহ করছেন নানা গাছের পাতা। একটা প্রজাপতির মতো
পোকাকে জাল দিয়ে ধরলেন।
সঞ্জয়
সামান্য দূরে। দু’জনে সেদিকে সাবধানে পা বাড়ালেন। চারদিকে নজর। বাইরে থেকে দেখে
সঞ্জয়ের কী হয়েছে বোঝার উপায় নেই। অন্তত ডাইনোসর চাপা পড়েনি। উদ্দালকের ইঞ্জিনিয়ার
এস্টিনের সঙ্গে রেডিওতে কথা বলতে বলতে সঞ্জয়ের সার্কিট পরীক্ষা শুরু করলেন মারিক।
“সমস্ত
সার্কিট পুড়ে গেছে। বাজ পড়েছিল নাকি!” অবাক গলায় বললেন মারিক। “কোর মেমরি তো
আইসোলেটেড। সেটা কেমন করে পুড়ল? এর থেকে আর কিছু পাওয়া যাবে না। একে আবার আকাশে
তুলতে হলে ফুল ইঞ্জিনিয়ারিং ওভারহল লাগবে। ক্যাপ্টেন, আমার রেকমেন্ডেশন সঞ্জয়কে
এখানেই ফেলে যাওয়া হোক।”
“রেকর্ড।” রেডিওতে স্তেপিনা
বললেন।
হঠাৎ
মাটি কাঁপতে শুরু করল। মারিক সার্কিট-বোর্ড থেকে চোখ তুলে তাকালেন। জঙ্গল থেকে
বেরিয়ে হেলে দুলে লেকের দিকে আসছে একটা বিরাট ডাইনোসর। এনোবোয়া রেডিওতে বলেন, “সুপারসরাস। এত বড়ো হয়? ভয় পাবেন
না, মাংসাশী নয়।”
তা
হয়তো নয়, কিন্তু অন্তত চল্লিশ মিটার লম্বা ওই প্রাণীটা তো খেয়াল না করে তাঁদের উপর
পা চাপিয়ে দিতে পারে। ওজন চল্লিশ টনের কম নয় জন্তুটার। গলা আর লেজই
দশ মিটার করে লম্বা। প্রতি পদক্ষেপে মাটি কেঁপে উঠছে। সায়নী আর মারিক পাশাপাশি
দাঁড়িয়ে। তাঁদের দিকে ফিরে তাকাল ওটা। চোখে বুদ্ধিমত্তার চিহ্ন নেই। ধীরেসুস্থে লেকের
ধারে গিয়ে মুখ নামিয়ে জল খেতে লাগল।
মারিক
বললেন, “বারো আলোকবর্ষ দূর থেকে এসেছি, পাত্তাই দিল না। খুশি হব না দুঃখ পাব বুঝতে
পারছি না।”
সায়নী
বললেন, “তৃণভোজী প্রাণীদের মধ্যে বুদ্ধির বিকাশ হওয়া শক্ত। গরু আপনাকে ভাইরে বলে
জড়িয়ে ধরলে আপনি খুশি হবেন?”
সুপারসরাসটা
জঙ্গলের মধ্যে ফিরে যাচ্ছে। সায়নী তার দিকে তাকিয়ে আছেন, এমন সময় মারিক তাঁর হাত ধরে
টানলেন। বড়ো ডাইনোসরটার পিছু নিয়েই বোধহয় হাজির হয়েছিল একটা অ্যালোসরাস। সামনে সহজ
শিকার পেয়ে এদিকেই আসছে। স্পেস-স্যুট পরে দৌড়নোর উপায় নেই, লাভও হত না। খুব বড়ো স্পেসিমেন
নয়, মাত্র পাঁচ মিটার লম্বা। কিন্তু দু’জন মানুষকে মারার পক্ষে যথেষ্ট। মারিক
স্টানার বার করে ঘোড়া টিপলেন। সুপারসনিক সাউন্ডের ধাক্কা এক টন ওজনের প্রাণীটা বোধহয়
টেরও পেল না। আর উপায় নেই। মারিক স্যুট রেডিওতে বললেন, “সাইরাস, অ্যালোসরাসটাকে টার্গেট
করো। প্রথমে লো ইনটেনসিটি, তাতে না পালালে মেরে ফেলতে হবে।”
“কম্যান্ডার,” সাইরাসের ভয়ার্ত
গলা, “সামনের দানবটার জন্য আপনাদের দেখতে পাচ্ছি না। কাকে টার্গেট করব?”
আর্মস্ট্রং আর সঞ্জয়ের
মাঝখানে এসে পড়েছে সুপারসরাসের বিশাল দেহ। মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিলেন মারিক। সায়নীর
হাত ধরে দৌড়লেন একটা বিশাল মহীরুহের দিকে। রেডিওতে
বললেন, “ম্যাক্সিমাম বার্ন, সামনের জন্তুটার বডিতে। আবার
বলছি, মাথায় নয়, বডিতে।”
অ্যালোসরাস তাঁদের পিছু
নিয়েছে। সায়নীকে মারিক টেনে নিলেন গাছের পেছনে। তারপরেই জায়গাটায় দক্ষযজ্ঞ বেঁধে
গেল। লেজার ক্যাননে সুপারসরাসের ছেঁকার বেশি কিছু লাগেনি। কিন্তু তাতেই সে ধড়মড়
করে উঠল। দশ মিটার লম্বা লেজটা এদিক ওদিক চাবুকের মতো যাচ্ছে। বিশাল গাছটার আড়ালে
থাকায় মারিকরা বেঁচে গেলেন, কিন্তু লেজের ধাক্কায় অ্যালোসরাসটা ছিটকে পড়ল অন্তত
তিরিশ মিটার দূরে। আর উঠল না।
সুপারসরাসটা শেষপর্যন্ত
জঙ্গলে ঢুকে গেল। দু’জনে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে সাবধানে পা বাড়ালেন পড়ে থাকা অ্যালোসরাসের
দিকে। ঘাড়টা এমন কোণে মুচড়েছে যে মনে হয় না
আর ওঠার ক্ষমতা আছে। কিন্তু প্রাণ তখনও বেরোয়নি, ছটফট করছে। সায়নী স্ক্যালপেল হাতে
এগিয়ে যাচ্ছিলেন। মারিক টেনে ধরলেন, “নখের আঁচড় লাগলে স্পেস-স্যুটের তো দফারফা
হবেই, মেজর ইনজুরিও হতে পারে। অপেক্ষা করুন। লেজার ক্যানন
দিয়ে ওকে আগে শেষ করে দিতে বলি।”
“মাথাটা বাঁচিয়ে রাখতে বলুন।
ব্রেন ডেভলপমেন্টটা দেখব।”
প্ল্যানেটারি সার্ভে মিশনঃ
ক্যাপ্টেন স্তেপিনার লগবুক
আলোচনার পরে সিদ্ধান্ত হয় যে
ওডিনের ডাইনোসরদের সম্বন্ধে আরও তথ্য জোগাড় করা প্রাথমিক কাজ। চিফ
ইঞ্জিনিয়ার এস্টিন কয়েকটা লাইট ওয়েট হাইক্যালিবার প্রজেক্টাইল ওয়েপন তৈরি করেছেন।
এছাড়া ড্রোন ক্যামেরাতে মাউন্টের জন্য একটা ছোটো লেজার গানও তৈরি করেছেন। সম্ভাব্য
বিপদের কথা মনে রেখে ল্যান্ডিং পার্টিতে সদস্য সংখ্যা বাড়িয়ে করা হয় সাত।
বিটা
আলফার থেকে ছোটো। দুটোর মধ্যে দূরত্ব প্রায় এগারো হাজার কিলোমিটার। আর্মস্ট্রং
এবারে সকালবেলা নেমেছে। আর্মস্ট্রঙের প্রচণ্ড
আওয়াজে আশপাশ থেকে সব জন্তু পালিয়ে গেছে। ল্যান্ডারে দু’জনকে ডিউটিতে রেখে বাকিরা
বেরোলেন। দলে আছেন কম্যান্ডার মারিক, ডক্টর সায়নী ও ডক্টর হ্যামারস্মিড। সঙ্গে আছে
সিতারা ও সাইরাস। সকলের হাতেই কোনও না কোনওরকম অস্ত্র, এমনকি সায়নীকেও একটা বন্দুক
নিতে হয়েছে।
মারিক
লোকাল সার্কিটে রেডিওতে হ্যামারস্মিডকে বললেন, “আমার এই জায়গাটাকে কী মনে হচ্ছে
জানেন? ঠিক যেন একটা সাফারি পার্ক। আমরা অনধিকার প্রবেশ করেছি। জানি না বোকার মতো
কথা বলছি কি না।”
হ্যামারস্মিড
হাসলেন না। গম্ভীরভাবেই বললেন, “কিংবা চিড়িয়াখানা। শিকারের জন্যও ডাইনোসরদের পৃথিবী
থেকে কেউ ধরে এনে রাখতে পারে।”
“কিন্তু
কারা ধরে এনেছে? তারা গেল কোথায়?” সিতারা অবাক হয়ে জানতে চায়।
“জানি
না। আমার কাছে তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটা হল, বিবর্তনটা থমকে গেছে কেন। এত কোটি
বছর পরেও ডাইনোসরগুলো একইরকম রয়ে গেছে, একটুও পাল্টায়নি। এটা কেমনভাবে সম্ভব হল?
ফিরে গিয়ে ভালো করে অ্যালোসরাসের কোষগুলো দেখতে হবে।”
মারিক
অবাক হয়ে ভাবলেন, ভিনগ্রহের উন্নত বুদ্ধিমান প্রাণীদের সন্ধান পাওয়ার থেকেও
ডাইনোসররা কেন বিবর্তিত হয়নি তা নিয়ে হ্যামারস্মিড বেশি চিন্তিত।
অল্প
থেমে হ্যামারস্মিড যোগ করেন, “তাছাড়া একটা জিনিস চুরি করতে হবে।”
“কী
জিনিস?” সিতারা জানতে চায়।
“ডাইনোসরের
ডিম।”
“ওরে
বাবা! আমার ছোটোবেলা কেটেছে গ্রামে। তা দিচ্ছে এরকম একটা মুরগির থেকে
ডিম চুরি করতে গিয়েছিলাম। আমায় যা ঠুকরে দিয়েছিল, এখনও হাতে দাগ আছে। একবার একটা বহু পুরনো সিনেমা দেখেছিলাম, এত পুরনো যে থ্রি-ডায়মেনশনালও
নয়। নাম ছিল বোধহয় জুরাসিক প্লেস। সেখানে একটা টাইরানোসরাসের বাচ্চা
চুরি গিয়েছিল বলে সে তুলকালাম বাঁধিয়েছিল।”
হ্যামারস্মিড এবার হেসে
ফেলেন, “সে তো গল্প। ডাইনোসররা ডিমে তা দিত কি না তাই ঠিক জানি না। কুমির বা কচ্ছপ
দেয় না। এবার সঙ্গে যেরকম গোটা একটা অস্ত্রাগার নিয়ে যাচ্ছি, টরভোসরাস তাড়া করলেও
ভয়ের কিছু নেই।” কাঁধের প্রজেক্টাইল ওয়েপনটাতে চাপড় মেরে হ্যামারস্মিড বলে চললেন, “আমি
একটা মিউজিয়ামে এস্টিনের ডিজাইন করা এই বন্দুকটার মতো একটা অস্ত্র দেখেছিলাম।
সেটার নাম ছিল অ্যাসল্ট রাইফেল। আমারটায় কিন্তু এক্সপ্লোসিভ বুলেট নেই। ঘুমপাড়ানি
গুলি আছে। মাঝারি সাইজের ডাইনোসরের পক্ষে যথেষ্ট। ঠিকঠাক চললে মা কিছু বোঝার আগেই
আমরা কাজ সেরে ফেলব। কয়েকটা ডিম আর মায়ের টিস্যুর নমুনা, ব্যস, আমাদের কাজ শেষ।”
সাইরাস এতক্ষণ চুপ করে ছিলেন।
এবার বললেন, “আমরা তো ইচ্ছা করলে যেকোনও জন্তুকেই মেরে ফেলতে পারি। এত কষ্ট করে
বিপদের ঝুঁকি নিয়ে ডিম চুরি করতে যাচ্ছি কেন?”
হ্যামারস্মিড বললেন, “সাবধান
থাকা ভালো।”
“কীসের ভয় আমাদের?” উপরের
দিকে ড্রোনটার দিকে ইঙ্গিত করে সাইরাস বললেন, “এই গ্রহের কোনও জন্তুর ক্ষমতা আছে
ওই লেজার গান থেকে বাঁচার?”
সায়নী বললেন, “এখনও পর্যন্ত
যা দেখেছি, তাতে আপনার কথা ঠিক হতেও পারে। কিন্তু আমরা
এই গ্রহটার কতটুকু চিনেছি? সাহারা মরুভূমির মাঝখানে বা অ্যান্টার্কটিকাতে কয়েক ঘণ্টা
কাটালে কি বলা যায় পৃথিবী
সম্পর্কে আমরা সব জেনে গেছি? একটা কথা মনে রাখবেন সবসময়, কয়েক কোটি বছর আগে যাদের
অন্য নক্ষত্রে যাওয়ার মতো সামর্থ্য ছিল তাদের ক্ষমতা এখন কোথায় পৌঁছোতে পারে
আমাদের পক্ষে ধারণা করাই সম্ভব নয়। তাদের চিড়িয়াখানাতে ঢুকে জন্তুজানোয়ারকে মারতে
হলে তার জন্য খুব জোরালো কারণ থাকা উচিত।”
“ডাইনোসরদের ডিম যা ভারী হবে,
আমরা তুলে আনতে পারব তো?” সিতারা জানতে চাইলেন।
“পাখিদের হিসাব থেকে আমরা
দেখেছি যে দেহের ভর একশো গুণ বাড়লে ডিমের ভর বাড়ে কুড়িগুণ। তাই এক টন ওজনের
প্রাণীর ডিম পাঁচ-সাত কিলোগ্রামের বেশি হওয়ার কথা নয়। চিন্তার কিছু নেই, একটা
ছোটোখাটো তৃণভোজী ডাইনোসরকে টার্গেট করব।” হ্যামারস্মিড বললেন।
গভীর
জঙ্গলে ঢোকার ঝুঁকি নেওয়া যাবে না, সেখানে ড্রোনও যেতে পারবে না, গাছে আটকে যেতে
পারে। তাছাড়া কোথা থেকে বিপদ আসবে দেখা যাবে না। তাই তাঁরা জঙ্গলের ধার ধরে
নিঃশব্দে এগোলেন। সৌভাগ্যক্রমে কোনও বিপজ্জনক প্রাণীর সঙ্গে দেখা হয়নি। কয়েকটা বড়ো
ডাইনোসর দেখা গেল, কিন্তু ডিমের কোনও চিহ্ন পাওয়া গেল না।
কিলোমিটার
দেড়েক যাওয়ার পরে সায়নী হাত তুলে সবাইকে দাঁড়াতে বললেন। হেলমেটের সঙ্গে লাগানো
ক্যামেরাটার ছবি অটোমেটিকালি জুম করল প্রায় পঞ্চাশ মিটার সামনে একটা ঝোপের উপর।
সিতারা
ফিসফিস করে বললেন, “এটা ছোটোখাটো? ওর একটা ডিমেই তো আমাদের সকলের ব্রেকফাস্ট,
লাঞ্চ, ডিনার হয়ে যাবে।”
সত্যিই
প্রাণীটা লম্বায় হাতির চেয়েও বড়ো। ঝোপটা খুব ঘন নয়, ভেতর দেখা যাচ্ছে। প্রায়
জিরাফের মতো লম্বা গলাটা ঝোপের উপরে উঠে এসেছে, মাথাটা এদিক ওদিক ঘুরছে।
সায়নী
বললেন, “এর চেয়ে ছোটো স্পেসিমেন পেতে গেলে কতদূর যেতে হবে কে জানে। ট্রাঙ্কুইলাইজারের
যা ডোজ, একে অজ্ঞান করা যাবে। সিতারা, আস্তে কথা বলার কোনও দরকার নেই। আমাদের
কথাবার্তার শব্দ স্যুটের বাইরে বেরোচ্ছে না। ডক্টর হ্যামারস্মিড, দেখা যাচ্ছে ডাইনোসররা
কেউ কেউ অন্তত ডিমে তা দিত।”
সত্যিই
প্রাণীটা ডিমের উপর বসে আছে।
“ডক্টর
এনোবোয়া?”
“সম্ভবত
ইউরোপাসরাস, নিঃসন্দেহে তৃণভোজী।”
হ্যামারস্মিড
বললেন, “ওকে বাইরে আনতে পারলে ভালো হয়। না হলে গুলি খেয়ে ছটফট করলে ডিমগুলো ভেঙে
যেতে পারে।”
মারিক
কিছুটা এগিয়ে গিয়ে জন্তুটার দৃষ্টির আওতায় গেলেন। তারপর স্যুটের বাইরের মাইক অন
করে নানারকম আওয়াজ করে ইউরোপাসরাসটাকে বিরক্ত করতে লাগলেন। তাতেও যখন কাজ হল না
তখন পাথর তুলে ছুড়তে শুরু করলেন। বেচারা ডাইনোসরাসটা বোধহয় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে
গেছে। শেষে বিরক্ত হয়েই নিশ্চয়ই মারিককে তাড়াতে উঠল। ঝোপের বাইরে আসার পরেই
হ্যামারস্মিড বন্দুকটা তুললেন। একটা জোর আওয়াজ, জন্তুটা ছটফট করে উঠল। আরও কয়েক পা
এদিক ওদিক টলতে টলতে গেল। তারপরেই দড়াম করে মাটিতে পড়ল।
হ্যামারস্মিড
বললেন, “পাঁচ মিনিট সময়, তারপরেই কিন্তু জ্ঞান ফিরে আসবে।”
অভিযাত্রীরা
কাজে নেমে পড়লেন। সাইরাস পিঠের ব্যাগে তিনটে
ডিম তুলে নিলেন। তার চেয়ে বেশি নেওয়া সম্ভব
নয়। সায়নী দেহের বিভিন্ন অংশ
থেকে টিস্যুর নমুনা নিয়ে নিলেন।
তাঁরা
যখন একশো মিটার দূরে সরে গেছেন তখনই জন্তুটা উঠে বসছে। টলতে টলতে আবার ঝোপের মধ্যে ঢুকে গেল।
“এখনও
পর্যন্ত একটাও পুরুষ ডাইনোসর দেখিনি, তাই না?” সায়নী হ্যামারস্মিডকে বললেন।
“ঠিক। সব ডাইনোসরগুলোই মেয়ে। আমাদের সন্দেহটা আরও জোরদার হচ্ছে।”
সিতারা
অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “তাহলে বাচ্চা জন্মায়
কেমন করে?”
হ্যামারস্মিড
বললেন, “পৃথিবীতেও এমন সরীসৃপ, পতঙ্গ আছে যাদের শিশু জন্মানোর জন্য বাবার প্রয়োজন হয় না। একে বলে পার্থেনোজেনেসিস।”
“কী
সন্দেহ করছেন?” সিতারা নাছোড়বান্দা।
“সেটা
কোষ বিশ্লেষণের পরেই বোঝা যাবে। আগে থেকে বলতে চাই না।”
কথা
বলতে বলতে অনেকটা চলে এসেছেন। এমন সময় হঠাৎ সিতারা চিৎকার করে উঠলেন, “সাবধান!
উপরে।”
খেয়াল
করেননি যে স্যুট মাইকে কথা বলছেন। বাকিরা প্রচণ্ড জোর আওয়াজে চমকে গিয়ে বুঝতেই
পারেননি কে কী বলল। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলেন সিতারা উপর দিকে বন্দুকটা তাক করে
আছেন। সবাই উপরে তাকালেন। ড্রোনটাকে জীবন্ত ভেবে আক্রমণ করেছে একটা উড়ন্ত প্রাণী।
উপর থেকে এসেছে বলে ড্রোনের ক্যামেরাতে দেখা যায়নি। জন্তুটার ডানার এপাশ থেকে ওপাশ
হবে অন্তত দশ মিটার, একটা প্রথম যুগের
প্লেনের মতো বড়ো। তার উপরে পাক খাচ্ছে আরও একটা।
“টেরোসর।” সায়নী বললেন।
“উড়ন্ত
ডাইনোসর!” সাইরাসও বন্দুক উপর দিকে তুলে রেখেছেন। মারিকের অর্ডার না পেলে কেউই
অবশ্য কেউই ফায়ার করবেন না।
“টেরোসররা
সরীসৃপ বটে, কিন্তু ডাইনোসর নয়। কারণ...” এনোবোয়ার গলা ভেসে এল।
“ওসব
কথা পরে হবে। দাঁড়ান, আগে এ দুটোকে সামলাই।” মারিক বিজ্ঞানীকে
থামিয়ে দেন।
ড্রোনটা
বিপজ্জনকভাবে এদিক ওদিক দুলছে। তাই লেজার গান থেকে ফায়ার করা যাচ্ছে না, কার গায়ে
লেগে যাবে।
ড্রোনটা
শেষপর্যন্ত নিচে ক্র্যাশ করল। কিন্তু টেরোসরের পাতলা চামড়ার ডানাটাও ড্রোনের প্রপেলারে
ছিঁড়েখুঁড়ে গেছে। আর উড়তে পারছে না, কষ্ট করে সোজা হল। প্রাণীটার ডানাটা বিরাট বড়ো
হলেও দেহটা একটা বড়ো কুকুরের সাইজের। সামনের মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে বিশাল সূচালো
মুখটা হাঁ করল। সারি সারি দাঁত দেখা গেল।
বাকিরা
প্রায় মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেদিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ ‘ডাউন’ বলেই মারিক সায়নী আর
সিতারাকে ধরে মাটিতে শুয়ে পড়লেন। সাইরাসও প্রায় সঙ্গে সঙ্গে হ্যামারস্মিডকে ধাক্কা
মেরে ফেলে দিয়ে তার পাশে ঝাঁপ দিলেন। পরের মুহূর্তেই দ্বিতীয় টেরোসরটা তাদের উপর
দিয়ে ডাইভ মেরে চলে গেল। দাঁড়িয়ে থাকলে কারোর না কারোর নিশ্চয়ই বিপদ হত।
টেরোসরটা
উপরে উঠে আবার ডাইভ দিতে শুরু করল। এবার মারিক প্রস্তুত ছিলেন। হাঁটু গেড়ে উঠে বন্দুকটা ফেলে
দিয়ে কোমর থেকে স্টানার পিস্তল বার করলেন। জন্তুটা যখন মিটার পাঁচেক দূরে,
স্টানারটা ফায়ার করলেন। সুপারসনিক ওয়েভের ধাক্কায় বাঁদিকের ডানাটা মুচড়ে গেল।
টেরোসরটা ছিটকে পড়ল। মরেনি, কিন্তু প্রায় অচেতন হয়ে গেছে।
সবাই
উঠে দাঁড়ালেন। সায়নী প্রথম টেরোসরটার দিকে গেলেন। কিন্তু সেটা ঘ্যাঁক করে উঠল।
“এ
তো আর উড়তে পারবে না। একে নিয়ে যাই সঙ্গে করে?”
উদ্দালকে
থেকে অনুমতি সহজেই মিলল। এনোবোয়া তো খুব খুশি। ওডিনে নামতে পারছেন না বলে কোনও জন্তুকে
পরীক্ষা করতে পারছিলেন না। তিনি তাড়াতাড়ি একটা এনক্লোজার বানিয়ে ফেললেন জন্তুটার
জন্য। কিন্তু তাকে নিয়ে যাওয়ার কাজটা মোটেই সোজা হল না। প্রথমে অজ্ঞান করতে হল,
তারপর আর্মস্ট্রং থেকে লাইট ওয়েট রোপ নিয়ে এসে বাঁধা হল। চারজনে মিলে অনেক কষ্ট
করে তাকে ল্যান্ডারে তুললেন।
সিতারা
হাঁপ ছেড়ে বললেন, “এবার শুনি তাহলে এটা ডাইনোসর নয় কেন।”
প্ল্যানেটারি
সার্ভে মিশনঃ সায়েন্টিফিক রিপোর্ট
ওডিনের
ডাইনোসর বা তার কাছাকাছি প্রাণীদের কোষের গঠন পৃথিবীর জীবকোষের মতো, কিন্তু কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য আছে। এরা জন্ম নেয় পার্থেনোজেনেসিসের মাধ্যমে। জীবন ডিএনএ-ভিত্তিক, কিন্তু ডিএনএ রিপেয়ার পদ্ধতি অনেক শক্তিশালী। কোষে দুটি নিউক্লিয়াস আছে। প্রত্যেকটাতে একই ক্রোমোজোমের দু’কপি
থাকে। তার মধ্যে একটা কপি প্রোটিন
সংশ্লেষে কোনও সাহায্য করে না, কিন্তু ডিএনএ
রিপেয়ারিংয়ে টেমপ্লেটের কাজ করে। তার ফলে জেনেটিক মেটিরিয়াল
কপি করার সময় ভুলের সম্ভাবনা খুব কম। এই সমস্ত কারণে মিউটেশনের
হার খুব কম। বিবর্তন প্রক্রিয়া পৃথিবীর থেকে অনেকগুণ ধীরে চলছে। জিন বিশ্লেষণ থেকে আমরা নিশ্চিত যে এই কোষের উৎস পৃথিবী। কিন্তু
মেজর বায়োইঞ্জিনিয়ারিং ছাড়া এ তৈরি হতে পারে না। ওডিনের গাছ বা
কীটপতঙ্গের কোষের সঙ্গে ডাইনোসরদের কোষের গঠনে কোনও মিল নেই।
মিশন
শেষে ফেরার পথে উদ্দালক। কন্ট্রোল রুমে প্রায় সবাই জমা হয়েছেন।
এনোবোয়া
সকলের উদগ্রীব মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমরা যা জেনেছি আর যা ভেবেছি সংক্ষেপে
বলছি। প্রথমত, এই গ্রহে ডাইনোসরগুলোর উৎস নিঃসন্দেহে বারও থেকে চোদ্দ কোটি বছর
আগের পৃথিবী। এদের কোষের এমন পরিবর্তন করা হয়েছে যে বিবর্তন স্তব্ধ হয়ে
গেছে, প্রাণীগুলো ঠিক আগের মতোই রয়ে গেছে। আমরা এই সৌরজগতে সভ্যতার কোনও চিহ্ন
পাইনি। তাই আমরা অনুমান করছি যে যারা এই গ্রহে ডাইনোসর ধরে এনেছিল তাদের জন্ম টাউ
সেটি সিস্টেমে নয়, অন্য কোনও নক্ষত্রজগতে।”
“কোথায়
এখন তারা? কোথা থেকে এসেছিল?’ সিতারা জিজ্ঞাসা করলেও এটা সকলের প্রশ্ন।
“আমরা
জানি না। বারো কোটি বছর অনেক সময়। হয়তো তারা লুপ্ত হয়ে গেছে, হয়তো এই গ্রহ তাদের
আর পছন্দ নয়। কিংবা তারা হয়তো কাছেই আছে, আমাদের উপর লক্ষ্য রাখছে কিন্তু তাদের
প্রযুক্তি এতই এগিয়ে যে আমরা টের পাচ্ছি না। খেয়াল রাখবেন, সঞ্জয়ের কোর মেমরি
কেমনভাবে পুড়ল আমরা জানি না।”
“তাহলে
আমাদের এই অভিযান থেকে কি কিছু লাভ হল?” মারিক জানতে চাইলেন।
“আমরা
কিছু প্রশ্নের উত্তর জানতে এসেছিলাম। জেনেছি অনেক, কিন্তু প্রশ্ন খুঁজে পেয়েছি আরও
অনেক বেশি। যারা বারো কোটি বছর আগে পৃথিবীতে এসেছিল, পরের অভিযান নিশ্চয়ই তাদের
সন্ধানে বেরোবে। সে তো ভবিষ্যতের কথা। এখান থেকে পাওয়া একটা জ্ঞানই আমাদের
সমস্ত পরিশ্রম, সব অর্থব্যয়কে সার্থক করে দিয়েছে।”
সামান্য
সময় চুপ করে এনোবোয়া বলেন, “কোষের রিপেয়ার পদ্ধতি সবসময় কাজ করে না। তাই যতদিন
বাঁচি, আমাদের কোষের ডিএনএ ক্রমশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেজন্য সময়ের সঙ্গে আমরা বুড়ো হই
এবং অবশেষে মারা যাই। ওডিনের কোনও ডাইনোসর হয়তো বুড়ো হয় না। জেনেটিক রিপেয়ারের এই
পদ্ধতিটা যদি আমরা আয়ত্ত করতে পারি তাহলে মানুষও আর কখনও বৃদ্ধ হবে না।”
এক মুহূর্ত
থেমে তিনি যোগ করলেন, “সেটা ভালো হবে না খারাপ, তা আমি জানি না।”
_____
অলঙ্করণঃ
মানস পাল
Subscribe to:
Posts (Atom)