মিরাকুলাস
প্রোফেসর শঙ্কু
সৌরভ
চক্রবর্তী
গালের দু’পাশ
বেয়ে ইঞ্চি দুয়েক পুরু সাদা দাড়ি, হাল্কা মোচড় খাওয়া
গোঁফ, ব্রহ্মতালুর সামনে চকচকে টাক আর চোখের পাতলা স্বচ্ছ
চশমা – এগুলি বলে দিলেই বাঙালি পাঠকমন চরিত্রটিকে চিনে নিতে
ভুল করবে না। সঙ্গে
যদি একটি বেড়াল থাকে যার নাম নিউটন
তবে তো আর কথাই নেই। হ্যাঁ, আজকে স্কটিশ চার্চ কলেজের অধ্যাপক ত্রিলোকেশ্বর
শঙ্কুকে নিয়ে গপ্প জমাব।
আমাদের প্রিয় ‘প্রোফেসর শঙ্কু’, যার ডায়েরি খুঁজে পেয়েছিলেন তারকবাবু। পেয়ে দিয়েছিলেন ‘ফেলুদা’ অমর চরিত্রস্রষ্টা সত্যজিৎ রায়কে। সেই শুরু।
রায়বাবুর সেই ডায়েরি এতই ভালো লেগে গেল যে ১৯৬১ সালে ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় তা ধারাবাহিকভাবে ছেপে দিলেন তিনি। নাম ‘ব্যোমযাত্রীর ডায়েরি’ - এক আশ্চর্য মহাকাশ ভ্রমণের কাহিনি। প্রথম শঙ্কু-কাহিনিই জয় করে
ফেলেছিল অগুনতি বাঙালি কিশোর-কিশোরীর মন। এতটাই করে ফেলেছিল যে সেদিনের কিশোর-কিশোরীরা যারা আজ বৃদ্ধ-বৃদ্ধা হয়ে গেছেন, আজও শঙ্কু-ফ্যান হয়ে আছেন।
১৯৬১-এর পর
শঙ্কুর যাত্রা আর থেমে থাকল না। সত্যজিৎ রায় খুঁজে পেলেন আরও ২১টি ডায়েরি যার উল্লেখ রয়েছে একটি গল্পে। কিন্তু জনপ্রিয়তা এতটাই বেড়ে
গেছিল যে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত লিখতে হল মোট আটত্রিশটি সম্পূর্ণ শঙ্কু-কাহিনি। লেখকের মৃত্যুর পরও ‘আনন্দমেলা’ পূজাবার্ষিকীতে বেরোল দুটি অসম্পূর্ণ শঙ্কু-অভিযান। নামগুলি
হল ‘ইন্টেলেক্ট্রন’ এবং ‘ডেক্সেল আইল্যান্ডের ঘটনা’।
প্রত্যেকটি শঙ্কু-কাহিনি তার বিষয় বৈচিত্র্য নিয়ে ছিল অনন্য এবং ছোটো থেকে বড়ো সব্বাইকে জুগিয়েছিল
লাগামছাড়া কল্পনার ইন্ধন। প্রেমেন্দ্র মিত্র পরবর্তী বাংলা কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যে
শঙ্কু শুরু করেছিল অন্যরকম এক যাত্রা যেখানে সায়েন্স ফিকশান কখনও হয়ে উঠেছিল
সায়েন্স ফ্যান্টাসি কখনও বা নৈতিকতার গল্প। কল্পবিজ্ঞান মানেই শুধু
পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিজ্ঞান কপচানো
সাহিত্য হবে সে ধারণা বাংলা সাহিত্যে শঙ্কু ভেঙে দেয়। শুরু
করে কল্পবিজ্ঞানের আরেকটি দিক – কল্পনার বিজ্ঞান, যা সাধারণ পাঠককে আরও ভাবতে
শেখায়, শিশু-কিশোর-কিশোরীদের
মনের বন্ধ জানালাগুলি খুলে দেয়। তাদের
মানবিকতার নৈতিক শিক্ষাও দেয় সত্যজিতের ‘প্রোফেসর’।
‘ব্যাঙের ছাতা সাপের খোলস আর কচ্ছপের ডিম’ দিয়ে মহাকাশযানের কম্পাউন্ড
বানানো ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কু হয়তো বিশেষজ্ঞদের মন ভরাবে না, কিন্তু আমার মতো বিশেষভাবে অজ্ঞ পাঠকদের মন এতটা ভরিয়ে দেয় যে তা উপচে
পড়ে। আমার বিশ্বাস,
তোমাদেরও ভরাবে।
শঙ্কু কাহিনি শুধুমাত্র কল্পবিজ্ঞান সাহিত্য হিসেবেই স্বীকৃতি
পায়নি, এগুলি একেকটি দারুণ ভ্রমণকাহিনিও বটে। শঙ্কুর অভিযান শুধুমাত্র ভারতবর্ষেই সীমাবদ্ধ
থাকেনি, পাড়ি জমিয়েছে জার্মানি, ইজিপ্ট, আফ্রিকা, তিব্বত সহ আরও অনেক দেশে। মানিকবাবুর মানিকঝরা হাতে জায়গাগুলি হয়ে উঠেছিল জীবন্ত। অথচ ভাবলে অবাক
লাগে লেখক কোনওদিন ঐ জায়গাগুলিতে যাননি। সন্দীপ রায় তাঁর বাবা প্রসঙ্গে
বলতে গিয়ে বলেছিলেন যে ফেলুদা ঐ জায়গাগুলিতে রহস্য সমাধান করতে গিয়েছে যেখানে
সত্যজিৎ রায় নিজে গিয়েছিলেন আর শঙ্কুকে তিনি সেখানে পাঠাতেন যেখানে তাঁর যাবার
ইচ্ছে ছিল খুব কিন্তু যাওয়া হয়ে উঠেনি। এ প্রসঙ্গে আরেকটি কথা বলতেই হয়। আজকে ২০১৭-তে এসে ইন্টারনেট সহ বিভিন্ন মাধ্যমের সৌজন্যে যখন
সমস্ত ইনফরমেশন হাতের মুঠোয় তখন লিখতে বসলে লেখকদের তেমন অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয় না, কিন্তু তখন সেরকম সুবিধা ছিল না। সত্যজিৎ
রায় তাঁর প্রবাসী বন্ধুদের বলতেন জায়গাগুলির
ছবি তুলে তাঁকে পাঠাতে। তারপর
যখন ছবিগুলি কলকাতার বিশপ লেফ্রয় রোডস্থিত তাঁর বাড়িতে আসত তখন তিনি সেগুলি হাতে পেয়ে শিশুর মতো আনন্দে আত্মহারা হয়ে যেতেন, জন্ম নিত শঙ্কুর একেকটি
ভ্রমণকাহিনি।
কল্পবিজ্ঞান কাহিনিতে সাধারণত অলৌকিকতা ব্রাত্যই থাকে। স্থান যদি পায়ও তার কপালে জোটে তীব্র লাঞ্ছনাধর্মী লেখনী। কিন্তু এদিক দিয়ে বিচার করলেও শঙ্কু-কাহিনিতে পাওয়া যাবে বিজ্ঞান ও
অলৌকিকতার এক আশ্চর্য মিশেল যেখানে এরা পরস্পরের বিরোধিতায় না গিয়ে হয়ে উঠে
পরিপূরক। সত্যজিৎবাবুর থট রিডিং, প্ল্যান চ্যাট, জাতিস্মরবাদ, পূর্ব ও পশ্চিমী
তন্ত্রশাস্ত্র প্রভৃতি নানা বিষয়ে ছিল প্রবল আগ্রহ। তেমনি ছিল তুখোড় পড়াশোনা। দেশবিদেশের নানা ম্যাগাজিন তিনি সংগ্রহ করতেন। সেসব রসদে সমৃদ্ধ হয়ে উঠত ফেলুদা,
তারিণীখুড়ো হয়ে শঙ্কুর
গল্প-উপন্যাসগুলি যা আজকের ইন্টারনেট সর্বস্ব যুগেও আমাদের তাক লাগায়, হতে হয় গল্পপাঠে আরও মনোযোগী, ছুটতে থাকে গল্পের ঘোড়া। তবে এর সাথে আরেকটি কথাও বলে
রাখা দরকার যে অলৌকিকতা অপবিজ্ঞানের
নামান্তর। শঙ্কু-কাহিনি কোনওভাবেই অপবিজ্ঞানকে তোষামোদ করেনি। বরং ছোটোবড়ো সকলের জন্যে কল্পনার জাল নির্মাণেই তার সার্থকতা।
শঙ্কুর ডায়েরি এরকমভাবে লেখা, যদি তোমার একটা জিনিস ভালো না লাগে তো তুমি পেয়ে যাবে
অন্য এক ভালো লাগা। সেটা না লাগলে হয়তো তোমার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে
তোমার মনমাতানো অন্য এক টুইস্ট। সত্যজিৎ রায় খুব ভেবেচিন্তেই এতসব আকর্ষণ
রেখেছিলেন। আর সেই আকর্ষণগুলির অন্যতম হল
শঙ্কুর আবিষ্কৃত বৈজ্ঞানিক অস্ত্র
বা গ্যাজেটগুলি। অ্যানাইহিলিন, মিরাকিউরল, নার্ভিগার, অমনিস্কোপ, স্নাফগান, ক্যামেরাপিড, লিঙ্গুয়াগ্রাফ - আরও কত শত ক্রিয়েটিভ নাম সেইগুলির। যেমন নাম, ঠিক তেমনই কাজকম্ম। এই যেমন অ্যানাইহিলিন পিস্তল
যেটা শঙ্কু সবসময় তার সাথে রাখত,
সেটা দিয়ে গুলি করলে যে কেউ
অদৃশ্য হয়ে যায়। মিরাকিউরল যার পুরো নাম ‘মিরাকল
কিউর ফর অল কমপ্লেন্টস’ হল সর্বরোগ হন্তারক। স্নাফ গান বা নস্যাস্ত্র দিয়ে
কাউকে গুলি করলে সে পুরো চব্বিশ
ঘণ্টা হেঁচে মরবে। অমনিস্কোপ যন্ত্র একাই টেলিস্কোপ, মাইক্রোস্কোপ এবং এক্স-রে এই তিন জিনিসের কাজ
করে। এরকম রয়েছে আরও কত গ্যাজেট। কিছু বললাম, বাকিগুলো তোমরা পড়ে দেখবে আর
আশ্চর্য হবে।
যদি তুমি ভ্রমণপিপাসী না হও, কিম্বা এসব কল্পবিজ্ঞানের যন্ত্রাদিও ভালো না
লাগে, শুধু ইতিহাস জানতে চাও বিভিন্ন শহরের তাহলেও শঙ্কু-কাহিনি তোমার কাজে লেগে যাবে। এই ধরো, মেসোপটেমিয়া সভ্যতা। যেকোনও ক্লাসের ইতিহাস বইয়ের মাস্ট রিড। এবার পাঠ্যবইয়ের ভাষায় সেটা পড়ে বুঝতে যদি
অসুবিধে হয় তবে চটপট ‘প্রোফেসর শঙ্কু ও বাগদাদের
বাক্স’ বড়োগল্পটি নিয়ে বসে পরতে পার। গল্পের শুরুতে মেসোপটেমিয়া
সভ্যতার যে সামারি রায়বাবু দিয়েছেন তাতে আর কিছু না হোক তোমাদের ইতিহাস বইয়ে এক অন্য আগ্রহ চলে আসবে। এরকম অসংখ্য ঐতিহাসিক
প্রেক্ষাপটের আলোচনা আছে গল্পের
আকারে যা শঙ্কুর আরেকটি ইউএসপি। ঐ যে
শুরুতে বললাম, একটি বিশিষ্ট ভালো না লাগলে
কুছ পরোয়া নহি – রয়েছে অনেক।
এবার আসি কমিক রিলিফে। আর এটাতেও ১০০তে ২০০।
শঙ্কু নিজেই এরকম সব অনুসন্ধান চালিয়েছে যে মাঝে মাঝে পড়তে পড়তে মুচকি হাসি ঠোঁট
ছেড়ে যেতে চায় না, তায় আবার দোসর হলেন শঙ্কুর গিরিডির প্রতিবেশী
অবিনাশবাবু। এই অবিনাশবাবুই একমাত্র ব্যক্তি
যিনি ‘সুইডিশ অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্স’ কর্তৃক সম্মানিত বিজ্ঞানী
শঙ্কুকে বৈজ্ঞানিক মানতেই প্রায় রাজি নন। তাঁর কাছে শঙ্কুর সকল অনুসন্ধানই ছাইপাঁশ ঘাটার সামিল। এরা দু’জনের কথোপকথনে মাঝে মাঝেই
আমরা পাই ফেলুদা আর লালমোহনবাবুর টাচ। ঠিক
সেভাবেই দুয়েকটি গল্প যেমন ‘প্রোফেসর শঙ্কু ও গরিলা’-তে শঙ্কুর প্রাণ বাঁচাতে মুখ্য ভূমিকায় এই অবিনাশবাবুই। অনেকটা ‘বাক্স রহস্য’-এর লালমোহনবাবুর ভূমিকায়।
মাঝে মাঝে ভাবি, মানে তোমরাও ভাবতে পার যে
যেসব আবিষ্কারের কথা শঙ্কু-কাহিনিতে আছে সেরকম আবিষ্কার যদি সত্যি সম্ভব হয় (জানি না এতদিনে এর মধ্যে দুয়েকটিও হয়েছে কি না) তবে জীবনে আর কিছু না হোক রোমাঞ্চকতা কিন্তু এক লাফে কয়েক যোজন এগিয়ে যাবে। চাইব কোনওদিন এই স্বপ্ন পূরণ হোক।
ইলাস্ট্রেশন সত্যজিৎ রায় নিজেই করেছেন শঙ্কুর
কাহিনিতে। তাই
স্বাভাবিকভাবেই আছে সেই পরিচিত মানিক
টাচ। এক-আধবার শ্যুটিংয়ে ব্যস্ত থাকায় তিনি যদিও সে-কাজ করে উঠতে পারেননি।
স্বল্প পরিসরে ত্রিপুরেশ্বর শঙ্কুপুত্র
ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কুকে ধরা চাট্টিখানি কথা নয়
আবার যেখানে সব পাঠকই বাঙালি, যার সাথে শঙ্কুর নাড়ির টান স্পষ্ট। তাই না চাইলেও শেষ করতেই হচ্ছে। একটা ঘটনা বলে শেষ
করছি।
তখন শঙ্কু-কাহিনির সংখ্যা ত্রিশ ছাড়িয়ে গেছে। প্রতিবছর আনন্দমেলা, সন্দেশ দুটো পত্রিকার জন্যেই সত্যজিৎবাবুকে লিখতে
হচ্ছে শঙ্কু-অ্যাডভেঞ্চার। সঙ্গে চলছে ফেলুদার
কাণ্ডকারখানার জমাটি উপন্যাস। ছোটোগল্পও লিখতে হচ্ছে ফাঁকফোকরে। পাশাপাশি বহুমুখী প্রতিভাধর লেখককে করতে হচ্ছে ইলাস্ট্রেশন, চলচ্চিত্রকার হিসেবেও চলছে তাঁর মূল পেশা। এই করে করে তিনি
ক্লান্ত। বয়সও তখন অনেক। কিন্তু
এত অনুরোধ আসছে যে সবকিছুর পাশাপাশি
লেখা চালিয়ে যেতেই হচ্ছে। তিনি সত্যজিৎ রায়। লেখার মান নিয়ে কোনওপ্রকার কম্প্রমাইজে যিনি একদমই রাজি নন। সেরকম একদিনে পুত্র সন্দীপ রায়কে
ডেকে বললেন, “ভাবছি, শঙ্কুটাকে মেরে ফেলব।”
সন্দীপবাবু তাঁর বাবার ক্লান্ত মুখটার দিকে
কিছুক্ষণ হতবাক হয়ে চেয়ে রইলেন। তারপর বললেন, “শঙ্কু তো অমর,
মিরাকিউরল আছে না।”
সম্বিৎ ফিরল
লেখকের। “ঠিক ঠিক, শঙ্কু তো অমর।”
সত্যি, বাংলা
সাহিত্যে শঙ্কু আজও অমর। ভবিষ্যতেও থাকবে। চলবে এরকম আরও লেখালিখি। উঠবে আরও গুঞ্জন। বইমেলায়
বাড়বে শঙ্কুর কাটতি। নতুন প্রজন্ম সামিল হবে কল্পনায় ‘ব্যোমযাত্রী’র
সঙ্গী হতে। আর আমি, আমরা যারা ছিলাম, হাত বাড়াব তাদের দিকে।
_____
ছবিঃ আন্তর্জাল
bah..shonku amar priyo..feluda chotobelay bhalo lage.baro hoe take sobjanta jethai lage.kintu shonkur abedon alada..shonku jindabad
ReplyDelete