কাপাস গোড়ের ভূত
ফাল্গুনী ঘোষ
আহা করেন কী মশাই, এই ভিড়ে ভূত খোঁজেন! সে মনের দুঃখে কবেই এখান থেকে সরে
পড়েছে। এই ধূলো,
ভিড়, ঠেলাঠেলি, চাপাচাপি,
হৈ-হল্লা, বাস, ট্রাক, ন্যানো-ভ্যানো, অটো-টোটোর দাপাদাপিতে বেজায় কাঁচুমাচু অবস্থায় নিজের ঘর ছাড়ে।
নিদেনপক্ষে একটা ইট বের করা, শ্যাওলা ধরা, পাঁচিলের গায়ে ঝোপ গজানো ভাঙা বাড়িও নেই
গো! যেখানে গেলে দু’দন্ড প্রাণ জুড়ায়।
রাতদিনের তফাত বোঝা দায়। এখেনে
কি ভূতে থাকে? ছি! ছি!
বহু কষ্ট, যন্ত্রণা বুকে
বয়ে ভূত বাসা বেঁধেছে কাপাস গোড়েতে। কাপাস
গোড়ে চেনেন না? তা দোষ নেই আপনাদের।
শহরের পিচঢালা কালো আঁকাবাঁকা রাস্তা চলতে চলতে হঠাৎ সবুজ মাঠের
বুক চিরে বাঁক ফিরেছে। আগে ছিল লাল রঙ রাস্তা,
এখন ঢালাই। সেই
বাঁকে পায়ে পায়ে বুড়ির পুকুর, মধু পুকুর
পাশে রেখে উই তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে যেতে হয় সেখানে। কাপাস
গোড়ে হল সমঝে চলার মতো জায়গা। এখানে
খালে, বিলে, জলে, জঙ্গলে ভূতেদের
আখড়া। দিনেদুপুরেও পা পড়ে না এলাকাতে।
শ্মশান-কবরখানার গা ঘেঁষাঘেঁষি অনুর্বর এবড়োখেবড়ো জমিগুলোর দীর্ঘশ্বাস
শোনা যায় মাটিতে কান পাতলে। গাছপালারা
এখানে সব থম মেরে থাকে। ফিসফাস করে কথাও কয় না।
মাঝে মাঝে দমকা হাওয়ায় ভূতের চাপা হাসি শরীরে ঠান্ডা স্রোত বইয়ে
দেয়। জমাট কালো ও ঘোলাটে রঙের পুকুর
আর খাল-বিল যেন এই এলাকার স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করে চলেছে। কচ্বিৎ
কোথাও সরু পায়ে চলা পথ। পথের পাশের ঝোপগুলো কেমন ঝিম
ধরে ছায়া করে রাখে। পুকুর, খাল-বিলের জলে রোদের
আঁচ পড়ে না। সেই ছায়া ছায়া কালো জলে কখনও
ভেসে থাকতে দেখা যায় ডাকিনির জমাট বাঁধা কালো লম্বা চুল। কখনও
বা শাঁকচুন্নির লম্বা সাদা কালো চুল মাটি পর্যন্ত দুলে দুলে গায়ে শিরশিরানি ধরায়।
নিম, শ্যাওড়াগাছের ঝোপে লাল
গনগনে চোখের সঙ্গে চোখাচোখি হয়। এহেন
থমকানো চমকানো জমজমাট জায়গাই তো ভূতেদের আদর্শ বাসস্থান।
এলাকায় জনশ্রুতি, এখানে নাকি দিনের বেলাতেও তেনার দেখা মেলে।
হাত-পা-মুন্ডুহীন হয়ে স্রেফ সাদা একখানা কাপড় ছায়া ছায়া হয়ে উড়ে উড়ে বেড়ায়।
তাই ছেলেছোকরা তো কোন ছার ছেলের বাপ-মা, দাদু-ঠাকুমা, নানা-দাদি, পিসে-পিসি, চাচা-চাচি কারোরই বিশেষ সাহস
হয় না এলাকায় দিনের বেলাতেও পা বাড়ানোর। চেষ্টাও
করে না। কারণ, পাশের মাঠের আল ধরে কোথায়
একটা যাওয়ার সময় কার মাথার ঝুড়ি থেকে নাকি সব নারকেল উধাও হয়ে গিয়েছিল।
অথচ আশেপাশে কোনও জনপ্রাণীর ছোঁয়া নেই। তাও
সে ঘটনা দিনের বেলার। তাছাড়াও কে নাকি কবে কোন কাজে
এই এলাকার পাশ দিয়ে যেতে যেতে গরু ও মহিষের মিলিত রূপের একটি প্রাণী দেখতে পেয়ে কৌতূহলবশে
পেছন পেছন কিছুদূর গিয়েছিল। কিন্তু
সেই প্রাণী চোখের সামনে মিলিয়ে তো গেলই, উল্টে ফিরে আসার সময় ভিজে কাদামাটিতে ঐ প্রাণীর একটিও পায়ের ছাপ পাওয়া গেল
না। এসবের পরে কেউ কি ওদিক পানে
যায়?
কিন্তু দুয়েকটা বেয়াড়া মানুষ গাঁ-গঞ্জেও জন্মায়।
যখন তাদের যুবক রক্ত টগবগ করে তখন টক্কর দেয় ভূতের সঙ্গে।
ভাবখানা এমন—‘দেখবি প্রমাণ
করে দেব কাপাস গোড়েতে ভূত নেই।’
এ ঘটনা তেমনই এক মানুষের।
“তু পারবি রেতের বেলাংঙে কাপাস গোড়েতে যেতে?”
“হুউউউ, তুরা সব ভূতের জুজু দ্যাখগা যেয়ে।
অ আমাকে বুলিস না! ভূত হি হি হি! কই আসুক কেনি ভূত—চা খ্যাঙয়ে আসব। ভূতের
সাথে বসি কথা বলি আসব।”
“তু পেরমাণ কর কেনি। ঐখানকে
মাঝরেতে যেয়েই দেখ্যা।”
তিন-চারটে বাইশ-তেইশ বছরের যুবকের এই তর্কাতর্কি আর গা ঠেলাঠেলির পর ঠিক হয় রাজু সামনের অমাবস্যায়
কাপাস গোড়ের ঠিক মাঝামাঝি যে বড়ো গভীর পুকুরটি আছে, সেখানে যাবে।
আর প্রমাণ চিহ্ন স্বরূপ একটি আধহাত পরিমাণ বাঁশের লাঠি (গোঁজ) পুঁতে দিয়ে আসবে পুকুরের পাড়ে।
দেখতে দেখতে আসে সেই নির্ধারিত দিন। রাজু
মনে মনে হাসে, এবার প্রমাণ হবে যে ভূত
বলে আসলে কিছু নেই। ওদিকে
সঙ্গীসাথীরা বেজায় চিন্তায় গেছে কুঁকড়ে।
“ঐ গোঁয়ারগোবিন্দ রাজুকে তো আটকানোই গেল না! হে ভগবান,
কী জি হবে! ভালোয় ভালোয় যেন পেরাণটো লিংয়ে ফেরত আসে ছেল্যাটো!”
কিন্তু তাদেরকে তো চুপ করে বসে থাকলে চলবে না।
টর্চ, মোবাইল, লাঠি সব প্রস্তুত করে তারা গোঁয়ার রাজুকে নজরবন্দী করবে।
তারা তো তিনজন, ‘রাম রাম’ বলতে বলতে হাত ধরাধরি করে থাকলেই ভূতের ছোঁয়া
থেকে বাঁচা যাবে।
ঘোর কালো অমাবস্যার নিশুতি রাত। এক
হাত দূরের জিনিস ঠাওর করা যায় না। রাজু
হাঁটছে। সরসর করে কী সরে গেল!
বুকের ভেতর কে যেন দমাদম হাতুড়ি পিটতে লাগল।
কিন্তু হেরে গেলে তো চলবে না। আরও
দ্রুত হাঁটতে শুরু করে সে। ব্যাঙ
আর ঝিঁঝিঁর ডাককেও যেন বিরক্ত লাগে রাজুর। হঠাৎ
আল ছেড়ে মাটিতে পা পড়ে পা কাদায় বসে যেতে শুরু করে। কেউ
কি তার পা ধরে টানছে! রাম! রাম! কেন যে সে এত্ত জেদ ধরল! মনে
মনে সে রক্ষাকালীর কাছে পঞ্চাশ টাকার পুজো মানত করে। আন্দাজে
আন্দাজে তো অনেক দূর এল সে। এই
যে পা বসে যাচ্ছে। এখানেই হবে বোধহয় পুকুর।
মাথার ঝিমঝিমানিতে সে সময়ের খেই হারিয়ে ফেলে।
মাটিতে উবু হয়ে বসে একটু দম ফেলে। কোমরে
টর্চটাও গুঁজে না আনার জন্য আফশোস হয় রাজুর। দু’হাত দিয়ে গোঁজটাকে
ধরে নরম পাঁকাল মাটিতে পুঁতে ফেলে। উফ্,
হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। এবার যত তাড়াতাড়ি পার এখান
থেকে পালাও। কিন্তু পা টান করে ছাড়িয়ে উঠে
দাঁড়াতে গিয়ে যে আটকে যায়! কী হল! ‘পা দুট্যা তো সে বুঝতে পারছে কিছুতে ধরে নাই! তবে এখ্যান
থেকি কেনে উটতে পারে ন্যাখো?’
সমস্ত শক্তি দিয়ে নিজের পা ধরে টানতে থাকে।
গলা, জিভ সব শুকিয়ে এসেছে।
শক্তি তার নিঃশেষ, অন্ধকারের অতলে সে তলিয়ে যাচ্ছে! ঐ সামনে ছায়া ছায়া ওরা
কারা! মুহূর্তের মধ্যে চোখের সামনে লাল, হলুদ, নীল আলোর ফুলকি ছোটে! মাথায়
কে যেন একমণ পাথর চেপে ধরেছে। কালো
কালো আঁকাবাঁকা হাতগুলো তার গলা লক্ষ্য করে এগিয়ে আসছে। মরণ
নিশ্চিত জেনে তার মাথাটা লুটিয়ে পড়ে!
“উঠ কেনি, এই রাজু! চোখ মেলি তাকা!” সমবেত বন্ধুদের কন্ঠস্বরে রাজু চোখ মেলে চায়।
“হ্যা হ্যা হ্যা... লুঙিতে গুঁজ (গোঁজ) টোকে ধরে লিয়্যাছিল, তাই তু লুঙিটো ছাড়্যাত পাচ্ছিলি
না। টানাটানি করতে যেয়্যে তুর দাঁতি
(অজ্ঞান) লেগ জ্যালো।
হ্যা হ্যা হ্যা। তবে
তু বিশ্বেস যা, এয়া কুনো বাইরের লোককে
বলবনি।”
এই ঘটনার পর এলাকার লোক কাপাস গোড়ের পানে মুখই ঘোরায় না।
_____
অলঙ্করণঃ সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী
No comments:
Post a Comment