কে কথা কয়?
রূপসা ব্যানার্জী
সনাতনের আজ অনেক কাজ। একবার হাটে দৌড়ায়, বেছে বেছে মস্ত
বড়ো রুইমাছ, কচি পাঁঠার মাংস আর টাটকা সব্জি কিনে ব্যাগ বোঝাই করে ঘরে নিয়ে আসে। তারপরেই আবার ছোটে পাশের গ্রামের বড়ো
মিষ্টির দোকানটায়। তুলি-মামণি লাল দই খেতে ভালোবাসে, না আনলে
চলবে? তার সঙ্গে নলেনগুড়ের সন্দেশ, স্পেশাল
রাজভোগও চাই। জামাইবাবুর খুব পছন্দের জিনিস, সে শুনেছে। আর ওদের ছোট্ট সোনা মিঠাই? সে ভালোবাসে ফুলকো
লুচি আর ঝিরি ঝিরি করে কাটা আলুভাজা। সনাতন কাল রাতেই বউদিদিকে বলে রেখেছে,
লুচি-আলুভাজাটা
সে নিজের হাতে করবে, উনি যেন হাত না লাগান।
আজ কতদিন পর বাড়িটা যেন ঘুম
থেকে জেগে উঠেছে। কাজ
না করে করে কেমন হাতে পায়ে বাত ধরে যাচ্ছিল সনাতনের। আজ এতদিন পর ছোটাছুটি করে শরীর-মন
দুইই তাজা হয়ে উঠেছে। থাকার মধ্যে তো দাদাবাবু আর বউদিদি - এই দুই বুড়োবুড়ি। হাটবারে ওই একটুখানি বাজার, অল্পস্বল্প রান্না। খাওয়াবার আর লোক কোথায়? দাদাবাবুর তো ছেলেমেয়ে
কেউ নেই। আত্মীয়স্বজনও
খুব একটা আসে না। তাই
আজ এতদিন পর যখন দাদাবাবুর একমাত্র ভাগ্নি তুলি-মামণি তার বর আর মেয়েকে নিয়ে একবেলার
জন্য মামাবাড়ি এসে পৌঁছল, তখন নিঝুম বাড়িটা যেন মেতে উঠল।
আহা, তুলি-মামণিকে দেখতে একদম
মেমসাহেবের মতো হয়েছে গো! আর জামাইবাবু? বোম্বেতে অত বড়ো চাকরি করে, এতটুকু গুমোর নেই!
সনাতনের হাত ধরে হেসে বলল, “সনাতনকাকু,
কেমন আছ?”
আহা গো, একদম শিব-পার্বতীর
মতো জুড়ি হয়েছে জামাইবাবু আর তুলি-মার। সেই কত্ত ছোটোবেলায়
দেখেছে সে তুলি-মাকে। তার
কাছে ভূতের গল্প শুনতে মামণি বড়ো ভালোবাসত।
এখন সেই জায়গাটা নিয়েছে তাদের
একরত্তি মেয়ে মিঠাইদিদি। একদম ডল-পুতুল গো! আর মুখে তো সারাক্ষণ খই
ফুটছে! দাদাবাবুর হাত ধরে বাগানে ঘুরতে ঘুরতে একটা করে গাছ চেনে
আর তার ইংরিজি নাম বলে দেয়। যেই দাদাবাবু বলেছেন, “এই দেখো, আমগাছ।” অমনি পাকাবুড়িটা বলে
উঠল, “ম্যাঙ্গো ট্রি!”
কুমড়োলতা দেখে বলল, “পাম্পকিন প্লান্ট!”
তাই শুনে দাদাবাবু তো আহ্লাদে
আটখানা! পাশের গ্রামের যে বড়ো ইশকুলটা আছে, ওখানে ইংরিজির মাস্টার
ছিলেন উনি। তাই দাদু নাতনিতে দিব্যি গ্যাঁট-ম্যাট-ফ্যাট
করে ইংরিজি বলতে লাগল। সনাতন বেচারা কিছুই বুঝল না। শুধু কি ইংরিজি? ওইটুকু মেয়ে সারাদিন
মায়ের মোবাইল ফোনটা নিয়ে টুকুর টুকুর করে কীসব করে যাচ্ছে! আর
এদিকে দাদাবাবু তো কোনওমতে নম্বর ধরে ফোন করতে পারেন। আর ফোন রাখার পর মাথা চুলকে
বলেন, “উহ্, বড়ো শক্ত জিনিস! এর চেয়ে ওই ডায়াল করা ল্যান্ড
ফোনই ভালো। এসব
মোবাইল-টোবাইল এই বুড়ো বয়সে পোষায় না।”
দুপুরে খাওয়ার পাট চুকিয়ে
ঠিক সেই ছোটোবেলার মতো আদুরে গলায় তুলি-মামণি বলে উঠল, “ও
সনাতনকাকু, সেই গল্পটা আর একবার বল না গো, সেই যে তুমি কবরখানায়
রাত্রিবেলা একা একা গেছিলে, তারপর কারা যেন হুম হুম করে শব্দ
করছিল মাটির নিচে, বল না প্লীজ!”
সনাতন তো লজ্জায় জড়সড়। কিন্তু যখন জামাইবাবুও গল্পটা বলার
জন্য জোর করলেন তখন তো না বলে পারা গেল না। ছোট্ট মিঠাইদিদি বলল, “সনাতনদাদু ইজ আ ভেরি
ব্রেভ ম্যান।”
কথার মানে না বুঝলেও সনাতন এটুকু বুঝল, যে তার প্রশংসা করা হচ্ছে। বীরের মতো মুখ করে একগাল হাসল সে।
সন্ধেবেলা ওরা চলে যাওয়ার
পর বাড়িটা আবার কেমন ফাঁকা হয়ে গেল। আটকে রাখার উপায় নেই। কারণ, রাতে ওদের নেমন্তন্ন
আছে পাশের গ্রাম বৈকুন্ঠপুরে। ওখানে থাকেন তুলি-মার ছোটোমামা,
মানে দাদাবাবুর ভাই। আজ তাঁদের বাড়িতে একরাত থেকে ওরা কাল
সকালেই কোলকাতা ফিরে যাবে।
গোলমালটা বাধল রাত সাড়ে আটটার
পর। ও-বাড়ি থেকে তুলি-মা ফোন করে বলল, সে ভুল করে তার মোবাইল ফেলে চলে গেছে এই বাড়িতে। মিঠাই নাকি ওটা বের করে গেম খেলছিল, তারপর মায়ের ব্যাগে
ভরতে ভুলে গেছে। সোফার এককোণে পাওয়া গেল
ফোনটা। দাদাবাবু
সনাতনকে ডেকে বললেন, “যা তো সনা, সাইকেলটা নিয়ে একবার তোর ছোড়দাবাবুর বাড়ি গিয়ে এটা তুলিকে দিয়ে
আয়। কাল
ভোরেই ওদের ট্রেন। এখন
না দিলে আর সময় হবে না।”
সনাতন ফোনটা জামার পকেটে ভরে
সাইকেল বের করতে গিয়ে দেখে, এই যাহ্! পেছনের চাকায় একফোঁটা হাওয়া নেই যে! সকাল থেকে অত হাটবাজার ঘুরে বেচারা নেতিয়ে পড়েছে। সে ভাবল, তাহলে রাস্তা দিয়ে না গিয়ে
মাঝখানে যে বড়ো মাঠটা আছে,
ওর ভেতর দিয়েই চলে যাবে সে। শর্টকাট হবে অনেকটা।
এমনিতেই এদিকে সবাই তাড়াতাড়ি
খেয়ে শুয়ে পড়ে। তার
উপর এখন আবার শীতকাল,
বেশ ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে। চারদিক পুরো শুনশান। এখন পৌনে ন’টা বাজে। ও-বাড়ি পৌঁছতে দশটা তো বেজেই যাবে। দাদাবাবু
বলে দিয়েছেন,
অত রাতে আজ আর ফেরার দরকার নেই। ছোড়দাবাবুর ওখানেই সে যেন থেকে যায়।
মাঠের মাঝামাঝি একটা মস্ত
উঁচু তালগাছ। কেউ
কেউ নাকি অনেক রাতে এই গাছের কাছে খোনা গলায় কার কান্না শুনেছে! তাই একা একা রাতের
দিকে কেউ এই মাঠে আসে না। কীরকম যেন গা ছমছম করে সনাতনের। একটা দমকা হাওয়ায় তার গায়ের চাদর সরে
যায়। সে
সেটা ভালো করে জড়িয়ে নেয় গায়ে। তারপর আপন মনেই বলে ওঠে, “উহ্! কী ঠাণ্ডা হাওয়া!”
ঠিক তখনি তাকে চমকে দিয়ে কেউ
তার কাছাকাছি কেমন এক অদ্ভুত সরু খোনা গলায় বলে উঠল, “উহ্! কী ঠাণ্ডা হাওয়া!”
বলার ভঙ্গী একদম সনাতনের মতোই! ভয়ে আঁতকে উঠল সনাতন। চেঁচিয়ে বলল, “কে? কে কথা কয়?”
সঙ্গে সঙ্গে সেই ভূতুড়ে গলাও
বলে ওঠে, “কে? কে কথা কয়?”
সনাতন চারদিকে তাকায়। ধু ধু করছে মাঠ। কেউ কোথাও নেই। আবার সে জোর গলায় বলে ওঠে, “কে রে ভেঙাচ্ছিস আমায়?”
আবার সেই খোনা গলায় ভেসে আসে
তার মুখের কথাটাই, “কে রে ভেঙাচ্ছিস আমায়?”
নাহ্, কোনও সন্দেহ নেই। সে নির্ঘাত ভূতের পাল্লায় পড়েছে। ‘রাম রাম রাম’ বিড়বিড় করতে থাকে সে। কিন্তু কী আশ্চর্য! এ কীরকম ভূত রে বাবা!
রামনাম শুনে পালাবার বদলে সে দিব্যি বলে উঠল, “রাম রাম রাম।”
আর কোনও কথা বলতে পারে না
সনাতন। সমস্ত
শক্তি এক করে ছুটতে থাকে। ঐ যে দূরে আলো দেখা যাচ্ছে! আর কিছুটা ছুটলেই বৈকুন্ঠপুরের সীমানা
শুরু হয়ে যাবে। আর একটু... ভগবান, আর একটু! কিন্তু সনাতন আর পারে না। হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়। ক্লান্ত শরীরে হাঁপাতে
থাকে সে, “আহ্ আহ্ আহ্!”
শুনতে পায় সেই অদ্ভুত স্বরে
কেউ তার মতোই কাতরাচ্ছে, “আহ্ আহ্ আহ্!”
আর কিছু মনে নেই সনাতনের।
জ্ঞান ফিরলে সে দেখল হাসপাতালের
বেডে শুয়ে আছে সে। তার চারপাশে অনেক লোক। দাদাবাবু, ছোড়দাবাবু ও তাঁর
দুই ছেলে, তুলি-মা আর জামাইবাবু, মিঠাইদিদি সব্বাই। আবার একজন ডাক্তারবাবুও রয়েছেন। সবার একই জিজ্ঞাসা—কী হয়েছিল?
সে নাকি অজ্ঞান হবার আগে খুব জোরে চিৎকার করে উঠেছিল। ওই সময় তাদের গ্রামের কয়েকজন
ছেলে ওদিক দিয়ে ফিরছিল। তারা তাকে দেখে চিনতে পারে।
আস্তে আস্তে সবকথাই খুলে বলে
সনাতন। শুনতে
শুনতে হঠাৎ চিৎকার করে ওঠে তুলিমা, “কাকু, তুমি মিথ্যে
ভয় পেয়েছ! ওটা তো একটা গেম ছিল, ‘মাই টকিং টম’। আমাদের মিঠাই সারাদিন খেলে।”
তারপর সেই মোবাইলটা দেখিয়ে
বলল, “তুমি তো এটাই সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছিলে, তাই না কাকু?
কোনওভাবে চাপ লেগে গেমটা খুলে যায়। সেখানে একটা বেড়াল আছে। তাকে নিয়ে বাচ্চারা একরকম
পুতুল খেলে বলতে পার। বেড়ালকে চান করানো, খাওয়ানো, নতুন নতুন জামা
পরানো এসব নিয়ে মশগুল হয়ে থেকে ওরা। আর এই বেড়াল আরও একটা কাজ করতে পারে। তুমি ওর কানের কাছে কোনও কথা বললে
ও সেটা রেকর্ড করে নেয়। তারপর ওর নিজস্ব খোনা সুরে তোমাকে বলে শুনিয়ে দেয়। কাল রাতে তোমার বলা কথাগুলোই ও তোমাকে
বলে শুনিয়েছে। বুঝতে
পারছ, কাকু? ভূত বলে কিছু নেই। সব আমাদের মনের ভয় আর ভুল বোঝার ব্যাপার।”
জামাইবাবু মিঠাইয়ের হাতে মোবাইলটা
দিয়ে তার কানে ফিসফিস করে কীসব বলে দিলেন। মিঠাই কাছে এগিয়ে এল। সনাতন দেখল, মোবাইলের স্ক্রীনের ওপারে
নড়াচড়া করছে জামাকাপড় পরা একটা খুব মিষ্টি সাদা বেড়াল। মিঠাই বেশ জোর গলায় বলে ওঠে, “আমি টম, সনাতনদাদু!
কাল রাতের জন্য ভেরি সরি।”
ঠিক তখনই সেই বেড়াল মুখ নাড়িয়ে
সেই কালকের মতো খোনাসুরে বলল, “আমি টম, সনাতনদাদু! কাল রাতের জন্য
ভেরি সরি।”
সনাতন ভয় ভুলে ফিক করে হেসে
ফেলল।
-----
অলঙ্করণঃ বিশ্বদীপ পাল
No comments:
Post a Comment