জুরাসিক
গ্রহ
গৌতম
গঙ্গোপাধ্যায়
প্ল্যানেটারি
সার্ভে মিশনঃ ক্যাপ্টেন স্তেপিনার লগবুক
ওয়ার্ম
হোল জাম্পের পরে আমরা প্রথমে টাউ সেটি সিস্টেমটাকে সার্ভে করি। পাঁচটা বড়ো গ্রহের মধ্যে দুটো গ্যাস দানব। দ্বিতীয় গ্রহ
ওডিনের মুক্ত অক্সিজেনের অস্তিত্বসংক্রান্ত স্পেকট্রোস্কোপিক পর্যবেক্ষণ ভেরিফাই
করেছি। অক্সিজেন আছে মানে প্রাণের অস্তিত্ব আছে। ডায়রেক্টিভ অনুযায়ী
আমরা ওডিনের থেকে এক লক্ষ কিলোমিটার দূরের কক্ষপথে উদ্দালককে রাখি।
স্তেপিনা
ভিউ স্ক্রিন থেকে চোখ সরালেন। নিচের গ্রহটা সবুজে অনেকটা ঢেকে আছে। মরুভূমিও আছে
কয়েকটা। দুই মেরুরই রঙ সাদা। হঠাৎ করে দেখলে পৃথিবী বলে ভুল হতে পারে। তবে মহাদেশগুলো
একেবারেই অন্যরকম দেখতে। মাত্র দুটো বড়ো মহাদেশ আর বেশ কয়েকটা দ্বীপপুঞ্জ আছে। মহাদেশদুটোর
নাম দেওয়া হয়েছে আলফা ও বিটা। ওডিন গ্রহটা পৃথিবীর থেকে সামান্য ছোটো, ভরও সামান্য
কম। দিনের দৈর্ঘ্য প্রায় তেরো ঘণ্টা।
“রেডিও?”
রেডিও
অপারেটর মুরলী সিটটা ঘুরিয়ে কান থেকে হেড ফোন নামাল। স্তেপিনা হাসি
চাপলেন। কম্পিউটার যেকোনও মানুষের চেয়ে তাড়াতাড়ি নির্ভুলভাবে সিগন্যাল বিশ্লেষণ
করতে পারে, কিন্তু তাঁর চেনা সব রেডিও অপারেটরই সিটে বসে প্রথমেই হেড ফোনটা কানে
লাগায়। মুরলী সম্ভবত হেড ফোন দিয়ে মিউজিক শোনে। ওকে সিটের হাতলে তাল দিতে দেখেছেন। তবে কাজে কোনও ত্রুটি
নেই।
“ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক
স্পেকট্রামে নয়েজ ছাড়া কিছু নেই। গ্যাস দানব সেটি ফোর আর ফাইভ থেকে রেডিও নয়েজ আসছে।”
ফোর
বৃহস্পতির থেকে সামান্য বড়ো। ফাইভ আয়তনে ইউরেনাসের মতো।
“মারিক?”
কম্যান্ডার
মারিক স্তেপিনার ডেপুটি। তিনি রাডারের পর্দায় চোখ রেখেছিলেন।
“ক্লিয়ার।
কোনও কৃত্রিম উপগ্রহ বা স্পেস স্টেশনের চিহ্ন নেই।”
ওডিনের
কোনও চাঁদ যে নেই সেটা আগেই জানা গেছে।
“ডক্টর
এনোবোয়া?”
এক্সোবায়োলজিস্ট
এনোবোয়া সার্ভে মিশনের প্রধান বিজ্ঞানী। তিনিও এতক্ষণ তাঁর সামনের
ভিউ-স্ক্রিন থেকে চোখ সরাচ্ছিলেন না। উদ্দালকের মূল টেলিস্কোপটা
এই মুহূর্তে তাঁর দখলে।
“উন্নত
সভ্যতার চিহ্ন নেই। বড়ো শহর জাতীয় কিছু নেই। বুদ্ধিমান প্রাণী থাকলেও তারা পৃথিবীর প্রস্তরযুগের স্তর পেরোয়নি। এতদূর থেকে আর কিছু বলা সম্ভব নয়।”
“জীবন
আছে তো?”
“নিশ্চয়ই,
সবুজটা ক্লোরোফিলের রঙ, স্পেকট্রাম হুবহু মিলে যাচ্ছে। পৃথিবীর মতো করে ভাবলে উদ্ভিদ আর প্রাণী দুইই নিশ্চয়ই আছে। তবে ক্যাপ্টেন, আগেও বলেছি, খোলা মনে চলতে হবে।”
“আমার
মন যথেষ্টই খোলা।” একটু শীতল গলায় বললেন স্তেপিনা।
“দুঃখিত,
আমি কথাটা ওভাবে বলতে চাইনি। আসলে এক্সোবায়োলজির কোর্সে আমরা প্রথমেই শেখাই পৃথিবীর
জীবজগতের নিয়ম অন্যত্র চলতে নাই পারে। বহুকোষী উদ্ভিদ আর প্রাণীদের ওডিনে হয়তো
আলাদা করা যাবে না।”
স্তেপিনা
ভাবলেন, আমি কি আপনার ছাত্র? মুখে শুধু বললেন, “রেকমেন্ডেশন?”
“ওডিনের
থেকে পাঁচ হাজার কিলোমিটার উপরের কক্ষপথে উদ্দালককে রাখা হোক।”
স্তেপিনা
মনে মনে হাসেন। বিজ্ঞানীদের নিয়ে এই সমস্যা। মিশনের সিকিউরিটি ডায়রেক্টিভে পরিষ্কার
করে বলে দেওয়া আছে ওডিনের কত কাছে উদ্দালককে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। কিন্তু এনোবোয়ার আর তর সইছে না।
“মারিক?”
“আমারও
মত ওডিনের কাছে যাওয়া। কিন্তু ডায়রেক্টিভ অনুযায়ী
দশ হাজার কিলোমিটারের বেশি কাছে উদ্দালককে কখনওই নিয়ে যাওয়া যাবে না।” মারিকের স্পষ্ট মত।
“কিন্তু
ক্যাপ্টেন, ডায়রেক্টিভ তো বানানো হয়েছিল সম্ভাব্য
বিপদের কথা ভেবে। ওডিনের থেকে উদ্দালকের কোনও
বিপদের সম্ভাবনা নেই।” এনোবোয়ার আপত্তিটা প্রত্যাশিত।
“আপনার
মত রেকর্ডে রইল। অ্যাস্ট্রোগেটর, ওডিনের দশ হাজার কিলোমিটার উপরে কক্ষপথের
জন্য রকেটকে রেডি কর।”
অ্যাস্ট্রোগেটর
পেন লি সামনের কম্পিউটারকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিলেন। এনোবোয়ার মুখ দেখে বোঝা গেল যে
তিনি অখুশি, তবে কথা বাড়ালেন না।
প্ল্যানেটারি
সার্ভে মিশনঃ ক্যাপ্টেন স্তেপিনার লগবুক
দশ
হাজার কিলোমিটার উপরের কক্ষপথ থেকে আটচল্লিশ ঘণ্টা ধরে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করা
হয়। তারপর মিশনের ডায়রেক্টিভ অনুযায়ী প্রথম ধাপে রোবট ল্যান্ডার সঞ্জয়কে ওডিনে নামানো
হয়। এককোষী জীব বা ভাইরাস সংক্রমণ রোধের জন্য সমস্ত সাবধানতা অবলম্বন করা হয়েছিল। প্রথম
ল্যান্ডিংয়ের জন্য আলফা মহাদেশকে বেছে নেয়া হয়েছিল।
উদ্দালকের
কেউই প্রায় ভিউ-স্ক্রিনগুলো থেকে চোখ সরাচ্ছেন না। এতক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে এটুকু
বোঝা গেছে যে ওডিনে বড়ো প্রাণী আছে। বা এনোবোয়ার কথামতো বললে, এমন জীব আছে যারা
চলতে ফিরতে সক্ষম। কিন্তু তাদের চেহারা এতদূর থেকে বোঝা যাচ্ছে না। সঞ্জয়কে
রাত্রিবেলা নামানো হয়েছে যাতে প্রাণীরা ভয় না পায়। অন্ধকারে শুধু রাডারের সাহায্যে
রিমোট ল্যান্ডিং অসম্ভব, তাই অবলোহিত আলো ব্যবহার করতে হয়েছে। টাউ সেটি জি টাইপ নক্ষত্র, তার আলোর
যা রং, প্রাণীদের চোখ ইনফ্রারেড সেনসিটিভ না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। ভোরবেলা
প্রাণীরা জল খেতে আসবে ধরে নিয়ে সঞ্জয়কে একটা বড়ো লেকের কাছে নামানো হয়েছে।
ক্যামেরাগুলোর
ছবিদের ভিউ-স্ক্রিনের বিভিন্ন অংশে দেয়া আছে। আলো ফুটছে। কেউ একজন হঠাৎ বললেন, “উপরের
ডানদিকের কোণে!”
গাছগুলো
নড়ছে, বেশ বড়ো প্রাণী সন্দেহ নেই। জঙ্গল ঠেলে বেরিয়ে এল।
প্রথমে
কারওর মুখে কথা সরছে না। ঘোর কাটিয়ে স্তেপিনা বললেন, “জুম।”
ক্যামেরা
টেকনিশিয়ান সিতারা প্রাণীটার ছবিটাকে পর্দায় বড়ো করে।
“অসম্ভব! এ তো অবিকল মিলে যাচ্ছে!” এনোবোয়া প্রায় চিৎকার করে উঠলেন।
“কী
অসম্ভব? অসম্ভব কেন?” উদ্দালকের সবচেয়ে কমবয়সী ক্রু সিতারা জিজ্ঞাসা করেন।
“এ তো
একটা ডাইনোসর! স্টেগোসরাস! এখানে কেমন করে?”
“পৃথিবীতে
যদি স্টেগোসরাস জন্মাতে পারে তাহলে ওডিনে নয় কেন?”
“এক্সোবায়োলজিতে
একটা কথা বারবার বলা হয়। বিবর্তনের এতরকম পথ আছে
যে আলাদা আলাদা রাস্তায় কখনও একই জীবের জন্ম হবে না। কাছাকাছি
হবে, কিন্তু এক নয়। যেমন হাঙর আর তিমি, জলের মধ্যে দিয়ে সাঁতার কাটার সুবিধার
জন্য একইরকম চেহারা, কিন্তু তাদের কেউ গুলিয়ে ফেলবে না। কিন্তু এ তো স্টেগোসরাসের ফসিল
থেকে পাওয়া চেহারার সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে!” মনে হল এনোবোয়া সিতারাকে নয়, নিজেকেই
বোঝাচ্ছেন।
বিস্ময়ের
সেখানেই শেষ নয়। কারণ, যে সমস্ত প্রাণী ক্যামেরাতে ধরা পড়ল তাদের অনেকগুলোকেই
পৃথিবীর মিউজিয়ামে দেখতে পাওয়া যায়। কেউ একটা কম্পিউটারের এনসাইক্লোপিডিয়া থেকে
জুরাসিকের ডাইনোসরদের ছবিগুলো পরপর পর্দায় ফেলেছিল যাতে তাদের চেনা যায়। এনোবোয়ার
বিরক্তি ও বিস্ময় ক্রমশই বাড়ছিল। শেষকালে জঙ্গল থেকে যখন একদল অ্যালোসরাস বেরিয়ে একটা বিরাট
ব্রাকিওসরাসকে আক্রমণ করল তখন তিনি শুধু মাথার চুল ছিঁড়তে বাকি রাখলেন। মিশনের
জেনেটিসিস্ট ডক্টর হ্যামারস্মিডের সঙ্গে আলোচনা করছিলেন। অন্যদের কাছে অবশ্য সেটা তর্কাতর্কির
মতো শোনাচ্ছিল।
“আপনি
আমাকে বোঝান, দুটো আলাদা সৌরজগতে, দুটো সম্পূর্ণ আলাদা গ্রহে কেমন করে একই প্রাণীর
সৃষ্টি হতে পারে? তাও একটা দুটো নয়, এ যেন মনে হচ্ছে লেট জুরাসিক যুগের উপরে তৈরি
ডকুমেন্টারি থ্রিভি দেখছি।” এনোবোয়া রাগত স্বরে বলেন। “ডারউইন দেখলে আত্মহত্যা করতেন।”
“শান্ত
হন, ডক্টর এনোবোয়া। নিশ্চয়ই এর একটা ব্যাখ্যা আছে। এখন না বুঝলেও আরও তথ্য পেলে
বুঝতে পারব।”
“টিস্যুর
নমুনা দরকার। কোষ জাতীয় কিছু তো
থাকবেই, তার গঠনটা জানতে হবে। আমরা ভাবছিলাম ডিএনএ ছাড়া প্রাণ সম্ভব কি না, আর এখন
দেখছি জুরাসিক যুগে এসে পড়েছি। কে ভেবেছিল যে নতুন গ্রহে অভিযান করতে গিয়ে জীবাশ্মবিদ
লাগবে?”
সঞ্জয়ের
রোবট আর্ম দিয়ে উদ্ভিদের নমুনা সংগ্রহ করা গেছে, কিন্তু সেখানে অণুবীক্ষণ দিয়ে কোষ
পরীক্ষা করার ব্যবস্থা নেই। নমুনা উদ্দালকে নিয়ে আসতে হবে। ঠিক ছিল আটচল্লিশ ঘণ্টা
ওডিনে থাকবে সঞ্জয়। কিন্তু এনোবোয়া অত দেরি করতে রাজি নন। তাই ঠিক হল যে যত
তাড়াতাড়ি সম্ভব সঞ্জয়কে ফিরিয়ে আনা হবে। সেই মুহূর্তে অবশ্য সঞ্জয়ের সঙ্গে যোগাযোগ
করা সম্ভব ছিল না, কারণ উদ্দালক তখন ওডিনের বিপরীত দিকে। আধঘণ্টা পরে
আবার যোগস্থাপন করে যাবে।
উদ্দালকের
বাকি সমস্ত যন্ত্রপাতি নানারকম তথ্য সংগ্রহে ব্যস্ত। স্তেপিনা
সারাক্ষণ সমস্ত দিকে নজর রাখছেন। আধঘণ্টা পরে দেখলেন মুরলী ভুরু কুঁচকে
কম্পিউটারকে নানারকম নির্দেশ দিচ্ছেন।
“সমস্যা
হল নাকি?”
“বুঝতে
পারছি না। সঞ্জয়ের থেকে কোনও সিগন্যাল পাচ্ছি না।” মুরলী বলেন।
“কোনও
জন্তু হয়তো সঞ্জয়কে ড্যামেজ করেছে।”
“হতে
পারে। সঞ্জয়ের সব ইলেকট্রনিক্সই সলিড স্টেট। কিন্তু...”
“কিন্তু
ব্রন্টোসরাস মাড়িয়ে দিলে কী হবে, সেকথা ভেবে তৈরি নয়।” কথাটা শেষ করেন স্তেপিনা।
“ডক্টর এনোবোয়া, মারিক, আপনারা এদিকে আসবেন?”
প্ল্যানেটারি
সার্ভে মিশনঃ ক্যাপ্টেন স্তেপিনার লগবুক
আর্মস্ট্রং
ল্যান্ডারের সাহায্যে প্রাণীবিশেষজ্ঞ ডক্টর সায়নী, কম্যান্ডার মারিক এবং ক্যাডেট
স্মিথ ও সাইরাস ওডিনে নামেন। প্রাথমিক লক্ষ্য হল উদ্ভিদ ও ছোটো প্রাণীর নমুনা সংগ্রহ, দ্বিতীয়
লক্ষ্য সঞ্জয়ের অবস্থা দেখা। ডক্টর এনোবোয়া ল্যান্ডিং পার্টির সদস্য হতে চেয়েছিলেন,
কিন্তু ডায়রেক্টিভে তার সুযোগ নেই। ল্যান্ডারের দায়িত্বে ছিলেন কম্যান্ডার মারিক।
মারিক আর্মস্ট্রংয়ের এয়ার-লকের হাতলটা ডান হাতে ধরলেন। স্টানার
পিস্তলটা বাঁ হাতে, ম্যাক্সিমাম সেটিংয়ে রাখা।
সায়নী পিস্তল নিতে রাজি হননি। যদিও অ্যালোসরাস বা তার চেয়েও বড়ো টরভোসরাসের জন্য
স্টানার কী কাজে লাগবে মারিকের নিজেরও সন্দেহ আছে। আর্মস্ট্রং
থেকে তাঁদের লেজার ক্যানন দিয়ে অবশ্য কভার করছে সাইরাস ও স্মিথ। প্রায় একঘণ্টা আগে তাঁরা ওডিনে নেমেছেন, নানারকম চেক করতে হচ্ছিল বাইরে পা দেওয়ার আগে। সব পরীক্ষাতে সবুজ সংকেত পাওয়ার পরেই গ্রহের মাটিতে নামার অনুমতি মিলেছে।
সায়নী স্পেস-স্যুট রেডিওতে বললেন, “স্পেস নেভিতে নিশ্চয়ই জঙ্গলে সারভাইভাল কোর্স করানো হয়
না। আমার সামান্য অভিজ্ঞতা আছে। রোয়ান্ডাতে গরিলা আর
সুন্দরবনে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের পিছু নিয়ে দিনের পর দিন কাটিয়েছি। অবশ্য তারা
কেউই দশ মিটার লম্বা নয়।”
বায়ুচাপ
সমান হল, দরজাটা খুলে গেল। মারিক প্রথম মানুষ যিনি সৌরজগতের বাইরে কোনও গ্রহের মাটিতে পা
দিলেন। পেছনে সায়নী। রেডিওতে উদ্দালককে রিপোর্ট
করলেন মারিক। সায়নী ততক্ষণে বিশেষভাবে তৈরি পাত্রে সংগ্রহ করছেন নানা গাছের পাতা। একটা প্রজাপতির মতো
পোকাকে জাল দিয়ে ধরলেন।
সঞ্জয়
সামান্য দূরে। দু’জনে সেদিকে সাবধানে পা বাড়ালেন। চারদিকে নজর। বাইরে থেকে দেখে
সঞ্জয়ের কী হয়েছে বোঝার উপায় নেই। অন্তত ডাইনোসর চাপা পড়েনি। উদ্দালকের ইঞ্জিনিয়ার
এস্টিনের সঙ্গে রেডিওতে কথা বলতে বলতে সঞ্জয়ের সার্কিট পরীক্ষা শুরু করলেন মারিক।
“সমস্ত
সার্কিট পুড়ে গেছে। বাজ পড়েছিল নাকি!” অবাক গলায় বললেন মারিক। “কোর মেমরি তো
আইসোলেটেড। সেটা কেমন করে পুড়ল? এর থেকে আর কিছু পাওয়া যাবে না। একে আবার আকাশে
তুলতে হলে ফুল ইঞ্জিনিয়ারিং ওভারহল লাগবে। ক্যাপ্টেন, আমার রেকমেন্ডেশন সঞ্জয়কে
এখানেই ফেলে যাওয়া হোক।”
“রেকর্ড।” রেডিওতে স্তেপিনা
বললেন।
হঠাৎ
মাটি কাঁপতে শুরু করল। মারিক সার্কিট-বোর্ড থেকে চোখ তুলে তাকালেন। জঙ্গল থেকে
বেরিয়ে হেলে দুলে লেকের দিকে আসছে একটা বিরাট ডাইনোসর। এনোবোয়া রেডিওতে বলেন, “সুপারসরাস। এত বড়ো হয়? ভয় পাবেন
না, মাংসাশী নয়।”
তা
হয়তো নয়, কিন্তু অন্তত চল্লিশ মিটার লম্বা ওই প্রাণীটা তো খেয়াল না করে তাঁদের উপর
পা চাপিয়ে দিতে পারে। ওজন চল্লিশ টনের কম নয় জন্তুটার। গলা আর লেজই
দশ মিটার করে লম্বা। প্রতি পদক্ষেপে মাটি কেঁপে উঠছে। সায়নী আর মারিক পাশাপাশি
দাঁড়িয়ে। তাঁদের দিকে ফিরে তাকাল ওটা। চোখে বুদ্ধিমত্তার চিহ্ন নেই। ধীরেসুস্থে লেকের
ধারে গিয়ে মুখ নামিয়ে জল খেতে লাগল।
মারিক
বললেন, “বারো আলোকবর্ষ দূর থেকে এসেছি, পাত্তাই দিল না। খুশি হব না দুঃখ পাব বুঝতে
পারছি না।”
সায়নী
বললেন, “তৃণভোজী প্রাণীদের মধ্যে বুদ্ধির বিকাশ হওয়া শক্ত। গরু আপনাকে ভাইরে বলে
জড়িয়ে ধরলে আপনি খুশি হবেন?”
সুপারসরাসটা
জঙ্গলের মধ্যে ফিরে যাচ্ছে। সায়নী তার দিকে তাকিয়ে আছেন, এমন সময় মারিক তাঁর হাত ধরে
টানলেন। বড়ো ডাইনোসরটার পিছু নিয়েই বোধহয় হাজির হয়েছিল একটা অ্যালোসরাস। সামনে সহজ
শিকার পেয়ে এদিকেই আসছে। স্পেস-স্যুট পরে দৌড়নোর উপায় নেই, লাভও হত না। খুব বড়ো স্পেসিমেন
নয়, মাত্র পাঁচ মিটার লম্বা। কিন্তু দু’জন মানুষকে মারার পক্ষে যথেষ্ট। মারিক
স্টানার বার করে ঘোড়া টিপলেন। সুপারসনিক সাউন্ডের ধাক্কা এক টন ওজনের প্রাণীটা বোধহয়
টেরও পেল না। আর উপায় নেই। মারিক স্যুট রেডিওতে বললেন, “সাইরাস, অ্যালোসরাসটাকে টার্গেট
করো। প্রথমে লো ইনটেনসিটি, তাতে না পালালে মেরে ফেলতে হবে।”
“কম্যান্ডার,” সাইরাসের ভয়ার্ত
গলা, “সামনের দানবটার জন্য আপনাদের দেখতে পাচ্ছি না। কাকে টার্গেট করব?”
আর্মস্ট্রং আর সঞ্জয়ের
মাঝখানে এসে পড়েছে সুপারসরাসের বিশাল দেহ। মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিলেন মারিক। সায়নীর
হাত ধরে দৌড়লেন একটা বিশাল মহীরুহের দিকে। রেডিওতে
বললেন, “ম্যাক্সিমাম বার্ন, সামনের জন্তুটার বডিতে। আবার
বলছি, মাথায় নয়, বডিতে।”
অ্যালোসরাস তাঁদের পিছু
নিয়েছে। সায়নীকে মারিক টেনে নিলেন গাছের পেছনে। তারপরেই জায়গাটায় দক্ষযজ্ঞ বেঁধে
গেল। লেজার ক্যাননে সুপারসরাসের ছেঁকার বেশি কিছু লাগেনি। কিন্তু তাতেই সে ধড়মড়
করে উঠল। দশ মিটার লম্বা লেজটা এদিক ওদিক চাবুকের মতো যাচ্ছে। বিশাল গাছটার আড়ালে
থাকায় মারিকরা বেঁচে গেলেন, কিন্তু লেজের ধাক্কায় অ্যালোসরাসটা ছিটকে পড়ল অন্তত
তিরিশ মিটার দূরে। আর উঠল না।
সুপারসরাসটা শেষপর্যন্ত
জঙ্গলে ঢুকে গেল। দু’জনে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে সাবধানে পা বাড়ালেন পড়ে থাকা অ্যালোসরাসের
দিকে। ঘাড়টা এমন কোণে মুচড়েছে যে মনে হয় না
আর ওঠার ক্ষমতা আছে। কিন্তু প্রাণ তখনও বেরোয়নি, ছটফট করছে। সায়নী স্ক্যালপেল হাতে
এগিয়ে যাচ্ছিলেন। মারিক টেনে ধরলেন, “নখের আঁচড় লাগলে স্পেস-স্যুটের তো দফারফা
হবেই, মেজর ইনজুরিও হতে পারে। অপেক্ষা করুন। লেজার ক্যানন
দিয়ে ওকে আগে শেষ করে দিতে বলি।”
“মাথাটা বাঁচিয়ে রাখতে বলুন।
ব্রেন ডেভলপমেন্টটা দেখব।”
প্ল্যানেটারি সার্ভে মিশনঃ
ক্যাপ্টেন স্তেপিনার লগবুক
আলোচনার পরে সিদ্ধান্ত হয় যে
ওডিনের ডাইনোসরদের সম্বন্ধে আরও তথ্য জোগাড় করা প্রাথমিক কাজ। চিফ
ইঞ্জিনিয়ার এস্টিন কয়েকটা লাইট ওয়েট হাইক্যালিবার প্রজেক্টাইল ওয়েপন তৈরি করেছেন।
এছাড়া ড্রোন ক্যামেরাতে মাউন্টের জন্য একটা ছোটো লেজার গানও তৈরি করেছেন। সম্ভাব্য
বিপদের কথা মনে রেখে ল্যান্ডিং পার্টিতে সদস্য সংখ্যা বাড়িয়ে করা হয় সাত।
বিটা
আলফার থেকে ছোটো। দুটোর মধ্যে দূরত্ব প্রায় এগারো হাজার কিলোমিটার। আর্মস্ট্রং
এবারে সকালবেলা নেমেছে। আর্মস্ট্রঙের প্রচণ্ড
আওয়াজে আশপাশ থেকে সব জন্তু পালিয়ে গেছে। ল্যান্ডারে দু’জনকে ডিউটিতে রেখে বাকিরা
বেরোলেন। দলে আছেন কম্যান্ডার মারিক, ডক্টর সায়নী ও ডক্টর হ্যামারস্মিড। সঙ্গে আছে
সিতারা ও সাইরাস। সকলের হাতেই কোনও না কোনওরকম অস্ত্র, এমনকি সায়নীকেও একটা বন্দুক
নিতে হয়েছে।
মারিক
লোকাল সার্কিটে রেডিওতে হ্যামারস্মিডকে বললেন, “আমার এই জায়গাটাকে কী মনে হচ্ছে
জানেন? ঠিক যেন একটা সাফারি পার্ক। আমরা অনধিকার প্রবেশ করেছি। জানি না বোকার মতো
কথা বলছি কি না।”
হ্যামারস্মিড
হাসলেন না। গম্ভীরভাবেই বললেন, “কিংবা চিড়িয়াখানা। শিকারের জন্যও ডাইনোসরদের পৃথিবী
থেকে কেউ ধরে এনে রাখতে পারে।”
“কিন্তু
কারা ধরে এনেছে? তারা গেল কোথায়?” সিতারা অবাক হয়ে জানতে চায়।
“জানি
না। আমার কাছে তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটা হল, বিবর্তনটা থমকে গেছে কেন। এত কোটি
বছর পরেও ডাইনোসরগুলো একইরকম রয়ে গেছে, একটুও পাল্টায়নি। এটা কেমনভাবে সম্ভব হল?
ফিরে গিয়ে ভালো করে অ্যালোসরাসের কোষগুলো দেখতে হবে।”
মারিক
অবাক হয়ে ভাবলেন, ভিনগ্রহের উন্নত বুদ্ধিমান প্রাণীদের সন্ধান পাওয়ার থেকেও
ডাইনোসররা কেন বিবর্তিত হয়নি তা নিয়ে হ্যামারস্মিড বেশি চিন্তিত।
অল্প
থেমে হ্যামারস্মিড যোগ করেন, “তাছাড়া একটা জিনিস চুরি করতে হবে।”
“কী
জিনিস?” সিতারা জানতে চায়।
“ডাইনোসরের
ডিম।”
“ওরে
বাবা! আমার ছোটোবেলা কেটেছে গ্রামে। তা দিচ্ছে এরকম একটা মুরগির থেকে
ডিম চুরি করতে গিয়েছিলাম। আমায় যা ঠুকরে দিয়েছিল, এখনও হাতে দাগ আছে। একবার একটা বহু পুরনো সিনেমা দেখেছিলাম, এত পুরনো যে থ্রি-ডায়মেনশনালও
নয়। নাম ছিল বোধহয় জুরাসিক প্লেস। সেখানে একটা টাইরানোসরাসের বাচ্চা
চুরি গিয়েছিল বলে সে তুলকালাম বাঁধিয়েছিল।”
হ্যামারস্মিড এবার হেসে
ফেলেন, “সে তো গল্প। ডাইনোসররা ডিমে তা দিত কি না তাই ঠিক জানি না। কুমির বা কচ্ছপ
দেয় না। এবার সঙ্গে যেরকম গোটা একটা অস্ত্রাগার নিয়ে যাচ্ছি, টরভোসরাস তাড়া করলেও
ভয়ের কিছু নেই।” কাঁধের প্রজেক্টাইল ওয়েপনটাতে চাপড় মেরে হ্যামারস্মিড বলে চললেন, “আমি
একটা মিউজিয়ামে এস্টিনের ডিজাইন করা এই বন্দুকটার মতো একটা অস্ত্র দেখেছিলাম।
সেটার নাম ছিল অ্যাসল্ট রাইফেল। আমারটায় কিন্তু এক্সপ্লোসিভ বুলেট নেই। ঘুমপাড়ানি
গুলি আছে। মাঝারি সাইজের ডাইনোসরের পক্ষে যথেষ্ট। ঠিকঠাক চললে মা কিছু বোঝার আগেই
আমরা কাজ সেরে ফেলব। কয়েকটা ডিম আর মায়ের টিস্যুর নমুনা, ব্যস, আমাদের কাজ শেষ।”
সাইরাস এতক্ষণ চুপ করে ছিলেন।
এবার বললেন, “আমরা তো ইচ্ছা করলে যেকোনও জন্তুকেই মেরে ফেলতে পারি। এত কষ্ট করে
বিপদের ঝুঁকি নিয়ে ডিম চুরি করতে যাচ্ছি কেন?”
হ্যামারস্মিড বললেন, “সাবধান
থাকা ভালো।”
“কীসের ভয় আমাদের?” উপরের
দিকে ড্রোনটার দিকে ইঙ্গিত করে সাইরাস বললেন, “এই গ্রহের কোনও জন্তুর ক্ষমতা আছে
ওই লেজার গান থেকে বাঁচার?”
সায়নী বললেন, “এখনও পর্যন্ত
যা দেখেছি, তাতে আপনার কথা ঠিক হতেও পারে। কিন্তু আমরা
এই গ্রহটার কতটুকু চিনেছি? সাহারা মরুভূমির মাঝখানে বা অ্যান্টার্কটিকাতে কয়েক ঘণ্টা
কাটালে কি বলা যায় পৃথিবী
সম্পর্কে আমরা সব জেনে গেছি? একটা কথা মনে রাখবেন সবসময়, কয়েক কোটি বছর আগে যাদের
অন্য নক্ষত্রে যাওয়ার মতো সামর্থ্য ছিল তাদের ক্ষমতা এখন কোথায় পৌঁছোতে পারে
আমাদের পক্ষে ধারণা করাই সম্ভব নয়। তাদের চিড়িয়াখানাতে ঢুকে জন্তুজানোয়ারকে মারতে
হলে তার জন্য খুব জোরালো কারণ থাকা উচিত।”
“ডাইনোসরদের ডিম যা ভারী হবে,
আমরা তুলে আনতে পারব তো?” সিতারা জানতে চাইলেন।
“পাখিদের হিসাব থেকে আমরা
দেখেছি যে দেহের ভর একশো গুণ বাড়লে ডিমের ভর বাড়ে কুড়িগুণ। তাই এক টন ওজনের
প্রাণীর ডিম পাঁচ-সাত কিলোগ্রামের বেশি হওয়ার কথা নয়। চিন্তার কিছু নেই, একটা
ছোটোখাটো তৃণভোজী ডাইনোসরকে টার্গেট করব।” হ্যামারস্মিড বললেন।
গভীর
জঙ্গলে ঢোকার ঝুঁকি নেওয়া যাবে না, সেখানে ড্রোনও যেতে পারবে না, গাছে আটকে যেতে
পারে। তাছাড়া কোথা থেকে বিপদ আসবে দেখা যাবে না। তাই তাঁরা জঙ্গলের ধার ধরে
নিঃশব্দে এগোলেন। সৌভাগ্যক্রমে কোনও বিপজ্জনক প্রাণীর সঙ্গে দেখা হয়নি। কয়েকটা বড়ো
ডাইনোসর দেখা গেল, কিন্তু ডিমের কোনও চিহ্ন পাওয়া গেল না।
কিলোমিটার
দেড়েক যাওয়ার পরে সায়নী হাত তুলে সবাইকে দাঁড়াতে বললেন। হেলমেটের সঙ্গে লাগানো
ক্যামেরাটার ছবি অটোমেটিকালি জুম করল প্রায় পঞ্চাশ মিটার সামনে একটা ঝোপের উপর।
সিতারা
ফিসফিস করে বললেন, “এটা ছোটোখাটো? ওর একটা ডিমেই তো আমাদের সকলের ব্রেকফাস্ট,
লাঞ্চ, ডিনার হয়ে যাবে।”
সত্যিই
প্রাণীটা লম্বায় হাতির চেয়েও বড়ো। ঝোপটা খুব ঘন নয়, ভেতর দেখা যাচ্ছে। প্রায়
জিরাফের মতো লম্বা গলাটা ঝোপের উপরে উঠে এসেছে, মাথাটা এদিক ওদিক ঘুরছে।
সায়নী
বললেন, “এর চেয়ে ছোটো স্পেসিমেন পেতে গেলে কতদূর যেতে হবে কে জানে। ট্রাঙ্কুইলাইজারের
যা ডোজ, একে অজ্ঞান করা যাবে। সিতারা, আস্তে কথা বলার কোনও দরকার নেই। আমাদের
কথাবার্তার শব্দ স্যুটের বাইরে বেরোচ্ছে না। ডক্টর হ্যামারস্মিড, দেখা যাচ্ছে ডাইনোসররা
কেউ কেউ অন্তত ডিমে তা দিত।”
সত্যিই
প্রাণীটা ডিমের উপর বসে আছে।
“ডক্টর
এনোবোয়া?”
“সম্ভবত
ইউরোপাসরাস, নিঃসন্দেহে তৃণভোজী।”
হ্যামারস্মিড
বললেন, “ওকে বাইরে আনতে পারলে ভালো হয়। না হলে গুলি খেয়ে ছটফট করলে ডিমগুলো ভেঙে
যেতে পারে।”
মারিক
কিছুটা এগিয়ে গিয়ে জন্তুটার দৃষ্টির আওতায় গেলেন। তারপর স্যুটের বাইরের মাইক অন
করে নানারকম আওয়াজ করে ইউরোপাসরাসটাকে বিরক্ত করতে লাগলেন। তাতেও যখন কাজ হল না
তখন পাথর তুলে ছুড়তে শুরু করলেন। বেচারা ডাইনোসরাসটা বোধহয় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে
গেছে। শেষে বিরক্ত হয়েই নিশ্চয়ই মারিককে তাড়াতে উঠল। ঝোপের বাইরে আসার পরেই
হ্যামারস্মিড বন্দুকটা তুললেন। একটা জোর আওয়াজ, জন্তুটা ছটফট করে উঠল। আরও কয়েক পা
এদিক ওদিক টলতে টলতে গেল। তারপরেই দড়াম করে মাটিতে পড়ল।
হ্যামারস্মিড
বললেন, “পাঁচ মিনিট সময়, তারপরেই কিন্তু জ্ঞান ফিরে আসবে।”
অভিযাত্রীরা
কাজে নেমে পড়লেন। সাইরাস পিঠের ব্যাগে তিনটে
ডিম তুলে নিলেন। তার চেয়ে বেশি নেওয়া সম্ভব
নয়। সায়নী দেহের বিভিন্ন অংশ
থেকে টিস্যুর নমুনা নিয়ে নিলেন।
তাঁরা
যখন একশো মিটার দূরে সরে গেছেন তখনই জন্তুটা উঠে বসছে। টলতে টলতে আবার ঝোপের মধ্যে ঢুকে গেল।
“এখনও
পর্যন্ত একটাও পুরুষ ডাইনোসর দেখিনি, তাই না?” সায়নী হ্যামারস্মিডকে বললেন।
“ঠিক। সব ডাইনোসরগুলোই মেয়ে। আমাদের সন্দেহটা আরও জোরদার হচ্ছে।”
সিতারা
অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “তাহলে বাচ্চা জন্মায়
কেমন করে?”
হ্যামারস্মিড
বললেন, “পৃথিবীতেও এমন সরীসৃপ, পতঙ্গ আছে যাদের শিশু জন্মানোর জন্য বাবার প্রয়োজন হয় না। একে বলে পার্থেনোজেনেসিস।”
“কী
সন্দেহ করছেন?” সিতারা নাছোড়বান্দা।
“সেটা
কোষ বিশ্লেষণের পরেই বোঝা যাবে। আগে থেকে বলতে চাই না।”
কথা
বলতে বলতে অনেকটা চলে এসেছেন। এমন সময় হঠাৎ সিতারা চিৎকার করে উঠলেন, “সাবধান!
উপরে।”
খেয়াল
করেননি যে স্যুট মাইকে কথা বলছেন। বাকিরা প্রচণ্ড জোর আওয়াজে চমকে গিয়ে বুঝতেই
পারেননি কে কী বলল। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলেন সিতারা উপর দিকে বন্দুকটা তাক করে
আছেন। সবাই উপরে তাকালেন। ড্রোনটাকে জীবন্ত ভেবে আক্রমণ করেছে একটা উড়ন্ত প্রাণী।
উপর থেকে এসেছে বলে ড্রোনের ক্যামেরাতে দেখা যায়নি। জন্তুটার ডানার এপাশ থেকে ওপাশ
হবে অন্তত দশ মিটার, একটা প্রথম যুগের
প্লেনের মতো বড়ো। তার উপরে পাক খাচ্ছে আরও একটা।
“টেরোসর।” সায়নী বললেন।
“উড়ন্ত
ডাইনোসর!” সাইরাসও বন্দুক উপর দিকে তুলে রেখেছেন। মারিকের অর্ডার না পেলে কেউই
অবশ্য কেউই ফায়ার করবেন না।
“টেরোসররা
সরীসৃপ বটে, কিন্তু ডাইনোসর নয়। কারণ...” এনোবোয়ার গলা ভেসে এল।
“ওসব
কথা পরে হবে। দাঁড়ান, আগে এ দুটোকে সামলাই।” মারিক বিজ্ঞানীকে
থামিয়ে দেন।
ড্রোনটা
বিপজ্জনকভাবে এদিক ওদিক দুলছে। তাই লেজার গান থেকে ফায়ার করা যাচ্ছে না, কার গায়ে
লেগে যাবে।
ড্রোনটা
শেষপর্যন্ত নিচে ক্র্যাশ করল। কিন্তু টেরোসরের পাতলা চামড়ার ডানাটাও ড্রোনের প্রপেলারে
ছিঁড়েখুঁড়ে গেছে। আর উড়তে পারছে না, কষ্ট করে সোজা হল। প্রাণীটার ডানাটা বিরাট বড়ো
হলেও দেহটা একটা বড়ো কুকুরের সাইজের। সামনের মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে বিশাল সূচালো
মুখটা হাঁ করল। সারি সারি দাঁত দেখা গেল।
বাকিরা
প্রায় মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেদিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ ‘ডাউন’ বলেই মারিক সায়নী আর
সিতারাকে ধরে মাটিতে শুয়ে পড়লেন। সাইরাসও প্রায় সঙ্গে সঙ্গে হ্যামারস্মিডকে ধাক্কা
মেরে ফেলে দিয়ে তার পাশে ঝাঁপ দিলেন। পরের মুহূর্তেই দ্বিতীয় টেরোসরটা তাদের উপর
দিয়ে ডাইভ মেরে চলে গেল। দাঁড়িয়ে থাকলে কারোর না কারোর নিশ্চয়ই বিপদ হত।
টেরোসরটা
উপরে উঠে আবার ডাইভ দিতে শুরু করল। এবার মারিক প্রস্তুত ছিলেন। হাঁটু গেড়ে উঠে বন্দুকটা ফেলে
দিয়ে কোমর থেকে স্টানার পিস্তল বার করলেন। জন্তুটা যখন মিটার পাঁচেক দূরে,
স্টানারটা ফায়ার করলেন। সুপারসনিক ওয়েভের ধাক্কায় বাঁদিকের ডানাটা মুচড়ে গেল।
টেরোসরটা ছিটকে পড়ল। মরেনি, কিন্তু প্রায় অচেতন হয়ে গেছে।
সবাই
উঠে দাঁড়ালেন। সায়নী প্রথম টেরোসরটার দিকে গেলেন। কিন্তু সেটা ঘ্যাঁক করে উঠল।
“এ
তো আর উড়তে পারবে না। একে নিয়ে যাই সঙ্গে করে?”
উদ্দালকে
থেকে অনুমতি সহজেই মিলল। এনোবোয়া তো খুব খুশি। ওডিনে নামতে পারছেন না বলে কোনও জন্তুকে
পরীক্ষা করতে পারছিলেন না। তিনি তাড়াতাড়ি একটা এনক্লোজার বানিয়ে ফেললেন জন্তুটার
জন্য। কিন্তু তাকে নিয়ে যাওয়ার কাজটা মোটেই সোজা হল না। প্রথমে অজ্ঞান করতে হল,
তারপর আর্মস্ট্রং থেকে লাইট ওয়েট রোপ নিয়ে এসে বাঁধা হল। চারজনে মিলে অনেক কষ্ট
করে তাকে ল্যান্ডারে তুললেন।
সিতারা
হাঁপ ছেড়ে বললেন, “এবার শুনি তাহলে এটা ডাইনোসর নয় কেন।”
প্ল্যানেটারি
সার্ভে মিশনঃ সায়েন্টিফিক রিপোর্ট
ওডিনের
ডাইনোসর বা তার কাছাকাছি প্রাণীদের কোষের গঠন পৃথিবীর জীবকোষের মতো, কিন্তু কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য আছে। এরা জন্ম নেয় পার্থেনোজেনেসিসের মাধ্যমে। জীবন ডিএনএ-ভিত্তিক, কিন্তু ডিএনএ রিপেয়ার পদ্ধতি অনেক শক্তিশালী। কোষে দুটি নিউক্লিয়াস আছে। প্রত্যেকটাতে একই ক্রোমোজোমের দু’কপি
থাকে। তার মধ্যে একটা কপি প্রোটিন
সংশ্লেষে কোনও সাহায্য করে না, কিন্তু ডিএনএ
রিপেয়ারিংয়ে টেমপ্লেটের কাজ করে। তার ফলে জেনেটিক মেটিরিয়াল
কপি করার সময় ভুলের সম্ভাবনা খুব কম। এই সমস্ত কারণে মিউটেশনের
হার খুব কম। বিবর্তন প্রক্রিয়া পৃথিবীর থেকে অনেকগুণ ধীরে চলছে। জিন বিশ্লেষণ থেকে আমরা নিশ্চিত যে এই কোষের উৎস পৃথিবী। কিন্তু
মেজর বায়োইঞ্জিনিয়ারিং ছাড়া এ তৈরি হতে পারে না। ওডিনের গাছ বা
কীটপতঙ্গের কোষের সঙ্গে ডাইনোসরদের কোষের গঠনে কোনও মিল নেই।
মিশন
শেষে ফেরার পথে উদ্দালক। কন্ট্রোল রুমে প্রায় সবাই জমা হয়েছেন।
এনোবোয়া
সকলের উদগ্রীব মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমরা যা জেনেছি আর যা ভেবেছি সংক্ষেপে
বলছি। প্রথমত, এই গ্রহে ডাইনোসরগুলোর উৎস নিঃসন্দেহে বারও থেকে চোদ্দ কোটি বছর
আগের পৃথিবী। এদের কোষের এমন পরিবর্তন করা হয়েছে যে বিবর্তন স্তব্ধ হয়ে
গেছে, প্রাণীগুলো ঠিক আগের মতোই রয়ে গেছে। আমরা এই সৌরজগতে সভ্যতার কোনও চিহ্ন
পাইনি। তাই আমরা অনুমান করছি যে যারা এই গ্রহে ডাইনোসর ধরে এনেছিল তাদের জন্ম টাউ
সেটি সিস্টেমে নয়, অন্য কোনও নক্ষত্রজগতে।”
“কোথায়
এখন তারা? কোথা থেকে এসেছিল?’ সিতারা জিজ্ঞাসা করলেও এটা সকলের প্রশ্ন।
“আমরা
জানি না। বারো কোটি বছর অনেক সময়। হয়তো তারা লুপ্ত হয়ে গেছে, হয়তো এই গ্রহ তাদের
আর পছন্দ নয়। কিংবা তারা হয়তো কাছেই আছে, আমাদের উপর লক্ষ্য রাখছে কিন্তু তাদের
প্রযুক্তি এতই এগিয়ে যে আমরা টের পাচ্ছি না। খেয়াল রাখবেন, সঞ্জয়ের কোর মেমরি
কেমনভাবে পুড়ল আমরা জানি না।”
“তাহলে
আমাদের এই অভিযান থেকে কি কিছু লাভ হল?” মারিক জানতে চাইলেন।
“আমরা
কিছু প্রশ্নের উত্তর জানতে এসেছিলাম। জেনেছি অনেক, কিন্তু প্রশ্ন খুঁজে পেয়েছি আরও
অনেক বেশি। যারা বারো কোটি বছর আগে পৃথিবীতে এসেছিল, পরের অভিযান নিশ্চয়ই তাদের
সন্ধানে বেরোবে। সে তো ভবিষ্যতের কথা। এখান থেকে পাওয়া একটা জ্ঞানই আমাদের
সমস্ত পরিশ্রম, সব অর্থব্যয়কে সার্থক করে দিয়েছে।”
সামান্য
সময় চুপ করে এনোবোয়া বলেন, “কোষের রিপেয়ার পদ্ধতি সবসময় কাজ করে না। তাই যতদিন
বাঁচি, আমাদের কোষের ডিএনএ ক্রমশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেজন্য সময়ের সঙ্গে আমরা বুড়ো হই
এবং অবশেষে মারা যাই। ওডিনের কোনও ডাইনোসর হয়তো বুড়ো হয় না। জেনেটিক রিপেয়ারের এই
পদ্ধতিটা যদি আমরা আয়ত্ত করতে পারি তাহলে মানুষও আর কখনও বৃদ্ধ হবে না।”
এক মুহূর্ত
থেমে তিনি যোগ করলেন, “সেটা ভালো হবে না খারাপ, তা আমি জানি না।”
_____
অলঙ্করণঃ
মানস পাল
No comments:
Post a Comment