পাগল
মৈত্রেয়ী চক্রবর্তী
“কই দাদুভাইরা,
উঠে পড়, দেখো কী এনেছি।” বহু সময়েই রাঙাদাদুর এই ডাকে আমাদের ঘুম ভাঙত, আর
হুড়মুড়িয়ে উঠে পড়তাম আমরা। কারণ, প্রতিবারেই রাঙাদাদুর আগমন
মানেই আমাদের দেদার আনন্দ। একটা কাপড়ের থলে থাকত কাঁধে, আর
কী কী যে আশ্চর্য সব জিনিস বের হত সেই থলে থেকে, সে যেন
প্যান্ডোরার বাক্সের মতোই আকর্ষণীয় ছিল আমাদের কাছে। কাজেই ডাক শুনলে ঘুম চোখে
সোজা দাদুর কাছে চলে যেতাম, মুখটুখ না ধুয়েই।
এই রাঙাদাদু কিন্তু
আমাদের কেউ না হয়েও পরমাত্মীয় ছিলেন। মায়ের গ্রাম সম্পর্কে কাকা নাকি গ্রাম
সম্পর্কে কাকার তুতোভাই এইরকম কিছু একটা সম্পর্ক ছিল। যাই হোক, নিঃসন্তান,
বিপত্নীক মানুষটি এলে মা-বাবাও দেখতাম খুশিই হতেন। আমাদের পড়াশোনা,
সাঁতার কাটা সবকিছুর দায়িত্ব রাঙাদাদু নিয়ে নিতেন। প্রতিবারই দিন
সাতেক থাকার পর যখন বিদায় নিতেন মা অনুরোধ করতেন আর ক’টা দিন থেকে যাওয়ার, আর রাঙাদাদু উত্তর করতেন, “উপায় নেই মা, জানোই তো।”
এইখানেই আমাদের খটকা লাগত। পরিবার-পরিজনহীন একটা মানুষের
থেকে যাওয়ার উপায় নেই কেন?
খুব যে দূরে থাকতেন তা নয়, তবুও আমরা বিশেষ
একটা যেতে পারতাম না ওঁর বাড়ি। আমাদের ছুটি পড়লেই রাঙাদাদু আবির্ভূত হতেন, ফলে যাওয়ার প্রয়োজনও ছিল না।
রাঙাদাদুকে আমার কেমন
একটু ক্ষ্যাপাটে-পাগলাটে লাগত। আমাদের একটা মজার জিনিস
শিখিয়েছিলেন, কোনও ফল খেলে তার বীজটা ধুয়ে রোদে শুকিয়ে সুন্দর করে একটা কৌটোয় ভরে রাখা।
বর্ষাকালে রাঙাদাদু এলে সবার কৌটো নিয়ে বসা হত। মনে করে করে বলতে হত কোনটা কীসের
বীজ রেখেছিলাম। তারপর ছোটোরা গুনত কোন ফলের বীজ ক’টা আছে বা কোন আকারের বীজ ক’টা
আছে। এরপর দাদু হয় আমাদের বাগানে নয়তো নিজের বাড়ির বাগানে আমাদের সবাইকে নিয়ে
গিয়ে, “দাও ছড়িয়ে, দাও ছড়িয়ে” বলতেন আর আমরা ছড়িয়ে দিতাম সেইসব বীজ। আবার রাঙাদাদুর বাড়ি
যেতাম যেই বারগুলোয়, তখন যাওয়ার পথের ধারে, ট্রেন লাইনের ধারে সবখানেই মুঠো মুঠো গাছের বীজ ফেলতে ফেলতে যেতাম। তবে বাজারের
কেনা ফলের থেকে রাখা তো, তাই সব বীজ থেকেই গাছ বেরোত না। তাহলে তো আমাদের বাগান জঙ্গলে
পরিণত হত। যেগুলো বেরোত তার কিছু আবার আমাদের অতি যত্নে বা একেবারে
অযত্নের ফলে দেহ রাখত। তাও এইভাবে আমগাছ, কাঁঠালগাছ, বকুলগাছ,
কালোজামের গাছ, জামরুলের গাছ এরকম বিভিন্ন ফল-ফুলের
গাছ একটা আধটা হয়েই গেছিল আমাদের বাগানে। যেবারে চারাগাছ সংখ্যায় অনেক থাকত, রাঙাদাদুর
সঙ্গে মিলে আমরাও চারা তুলে, শেকড়ে মাটির গোল্লা বানিয়ে সেইসব
চারা বিতরণ করতাম।
শেষবার রাঙাদাদুর সঙ্গে
দেখা হয় আমার বিয়ের সময়। বৌভাতের অনুষ্ঠানের সাথে রাঙাদাদু বৃক্ষরোপণও করিয়েছিলেন
আমার নতুন বৌকে দিয়ে। একটা গোলাপজামের গাছের খুব শখ ছিল আমার। শুধু কিছুতেই বাঁচাতে পারতাম না।
আর তাই রাঙাদাদু বিয়ের উপহার হিসেবে সেটাই দিয়েছিলেন। আর নতুন বৌকে দিয়েই রোপণ
করিয়েছিলেন। বৌয়ের কিন্তু গ্রিন থাম্ব। মানে গাছ ওর হাতে ঠিক বেঁচে যায়। গাছগাছালির কত যত্নই যে
জানে ও।
আমার বিয়ের কয়েক মাসের
মাথায় একদিন খবর পেয়ে আমরা দৌড়লাম রাঙাদাদুর বাড়ি। রাঙাদাদুর বিশাল জমিজমা ছিল আর
এককোণে ছিল ছোট্ট একটা বাড়ি। অত বড়ো জমি ভরে ছিল বড়ো বড়ো সব গাছে। তার কিছু হয়তো
আমার ফেলা বীজ থেকেও হয়েছিল। আমরা পৌঁছে দেখলাম, চারদিকে অনেক গাছ কাটা আর রাঙাদাদু
অসহায়ের মতো মাটিতে বসে কাঁদছেন আর বলছেন, “হেরে গেলাম, হেরে গেলাম।”
কারণ, ওই অত জমি আর
দামি কাঠের গাছ দুইই দুষ্কৃতিদের নজরে পড়েছিল। আর রাঙাদাদু মোটেও বিক্রি করে বাগান
সাফ করে বাড়ি তোলবার পক্ষে ছিলেন না। তাই সোজা কথায় শুনছেন না বলে ব্যাঁকা পথ ধরে
ওরা। সেই সময়ে বুঝেছিলাম রাঙাদাদুর সেই ‘থাকার উপায় নেই’-এর মানে। রাঙাদাদু না
থাকলেই সুযোগসন্ধানীরা কিছু না কিছু ঘটাতই। এরপর যে কত বছর চাপানউতোর চলেছে ওই জমি
নিয়ে, ঠিক খবরও রাখতে পারিনি ব্যস্ত জীবনের ব্যস্ততার ফলে।
রাঙাদাদু হারিয়েই গেলেন যেন আমাদের জীবন থেকে।
তারপর আমি চাকরির সুবাদে
বিদেশে চলে আসি। এখানে
বেশ বড়সড় একটা ফার্ম-হাউস কিনি। বিভিন্ন সবজি ফলানো শুরু করে আমার স্ত্রী। আজও বীজ
রোপণের সময়ে মন্ত্রোচ্চারণের মতো বলতে থাকে রাঙাদাদুর সেই, ‘দাও ছড়িয়ে,
দাও ছড়িয়ে’। আর আমাদের ফার্মের জমির পশ্চিম কোণের
সীমানা নির্দেশক হিসেবে একটা বিশাল ওকগাছ আছে। তার ডালে পাখিদের খাবার দেওয়া
বার্ড ফিডার টাঙানো। কত পাখি বাসা বানায়, কোটরে কাঠবেড়ালি থাকে, জমিতে পশ্চিমের রোদ পড়া ঠেকায় সেই গাছ। আমার স্ত্রী সেই গাছটার নাম দিয়েছে
‘রাঙাদাদু’। হারিয়েও যেন রয়ে গেলেন রাঙাদাদু।
এবারে যখন দেশে বেড়াতে
গেলাম, খুঁজে খুঁজে গেছিলাম রাঙাদাদুর বাড়ি। হ্যাঁ,
ভেবেছিলাম অনেক খুঁজতে হবে, কারণ, সেই
বিশাল জমি, গাছের জঙ্গল তো নিশ্চয়ই এতদিনে ঢাকা পড়ে গেছে
বহুতলের জঙ্গলে। কাজেই অপরিচিত হয়ে গেছে সব কিছুই। কিন্তু সেখানে পৌঁছে অবাক
হয়ে দেখি সব প্রায় আগের মতোই রয়েছে। বাগানসহ রাঙাদাদুর বাড়িটা খুঁজে পেলাম। সেখানে
এখন এক অপরিচিত বয়স্ক মানুষ থাকেন। শুনলাম, ইনি সেই টালমাটাল অবস্থার সময়ে রাঙাদাদুর
পাশে দাঁড়ান এবং নিজের ক্ষমতা, বুদ্ধি ও জনসংযোগের
সদ্ব্যবহার করে জমি-হাঙরদের হাঁ থেকে বাঁচান ওই বাগান। স্বাভাবিকভাবেই রাঙাদাদু
তাঁর বাড়ি-বাগান সব নিশ্চিন্তে দিয়ে যান এঁরই হাতে। স্থানীয় ছেলেমেয়েদের মুখে ওঁর
নাম ‘পাগলা দাদু’। উনি ওই বাগানে যত্ত রাজ্যের মা মরা বাপে খেদানো ছেলেমেয়েদের
জুটিয়ে লেখাপড়া শেখান প্রকৃতির মধ্যে বসে। তাদের বিভিন্ন কাজ শেখান, সাথে গাছের চারা
করেন আর যাকে পারেন বিলোন। আমরা রাঙাদাদুকে চিনতাম শুনে বেশ খাতির করলেন। চা-জলখাবার
খাওয়ার অনুরোধ করলেন। আর আমি যতক্ষণ চা জলখাবার না আসে ততক্ষণ গিয়ে বসলাম রাঙাদাদুর
বাগানে, যা এখন রীতিমতো জঙ্গলে পরিণত। যদিও খুব পরিচ্ছন্ন
এবং সুসংরক্ষিত। সেই বাগানে বসে স্বপ্ন
দেখতে শুরু করলাম - এমনই পাগলের সংখ্যা বাড়ছে দুনিয়ায়, চারদিকে
গাছ লাগিয়ে প্রকৃতির ভারসাম্য ফেরানোর জন্যই যাঁদের জন্ম।
_____
অলঙ্করণঃ সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী
No comments:
Post a Comment