শোধ
প্রসেনজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
“ড্যাড,
ক্যান আই এক্সপ্লোর দিস প্লেস?”
“ওকে
বেটা। তোমার সেলফোনে চার্জ আছে তো?”
“ইয়াপ।”
“ওটা অন
থাকে যেন। আর, বেশি দূরে যাবে না।”
বিএমডব্লুই
হোক বা মার্সিডিজ বেনজ, টায়ার বার্স্ট করলে সাইকেল ভ্যানের কাছেও লজ্জা পায়। আর সেইজন্যই
বোধহয় এক্ষুনি একটা সাইকেলভ্যানওয়ালা আমার প্রিয় ব্ল্যাক টাটা সাফারিটার দিকে
ঢুলুচোখের কৌতুকপূর্ণ অর্থবহ দৃষ্টি ঠেলে দিয়ে হেলেদুলে চলে গেল।
কলকাতা
থেকে যাচ্ছি চন্দননগর। আমার ছেলে সাবর্ণকে তার মামাবাড়ি পৌঁছে দিতে। তার মধ্যে এই
দিল্লি রোডে আমার গাড়ির পেছনের টায়ারটা বার্স্ট করে চিত্তির। অবশ্য সঙ্গে
স্টেপনি আছে। আমার ড্রাইভার শ্যামল এখন জ্যাক লাগাচ্ছে। শ্যামলটা ফাঁকিবাজ আর
মাথামোটা হলেও বড্ড বিশ্বাসী। একেবারে পুরাতন ভৃত্য টাইপ। বাবার মারুতি ওমনিটাও ওই
চালাত। আমার বন্ধুদের ড্রাইভারগুলো যে হারে তেল চুরি করে আর রোয়াব দেখায়, সেই
তুলনায় আমার শ্যামল গোবরে পদ্মফুল।
কিন্তু
ওই ব্যাটার জন্যই এখন আমাকে এই খা খা রোদ্দুরে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। কোথায় গাড়িতে
বসে এসিটা অন করে রাখব তার উপায় নেই। সাবর্ণর মা, মানে আমার গিন্নি এখন চন্দননগরেই
আছেন। চন্দননগরে লাঞ্চ সেরে চলে যাব বর্ধমান। সেখানে বিকেল পাঁচটায় খুব আর্জেন্ট
একটা মিটিং আছে আমার ফ্যাক্টরির ভবিষ্যতের ব্যাপারে। শ্যামলের উচিত ছিল কালকেই ফুল
ট্যাঙ্ক ভরিয়ে রাখা। কিন্তু তা করেননি মহারাজ। ফুয়েলের কাঁটা এখন ‘ই’ লেটারটাকে
ছোঁয়ার জন্য ব্যাকুল। তাই এসি চালানোরও উপায় নেই।
গাড়ির ভেতরটা
ভীষণ গরম। পাশে এদিক ওদিক কোনও দোকানপাট কিচ্ছু নেই। হেঁটে চলা লোকজনও খুব একটা
বেশি নয়। এই রুটি-স্যাঁকা গরমে খুব দরকার না পড়লে কেউ বেরোচ্ছে না।
একটা
কদমগাছ পেয়ে সেদিকেই ছুটলাম। একটু ছায়ায় দাঁড়াই।
গাছের
গুঁড়িতে কেউ মোটা ব্রাশ দিয়ে বাদামি রংয়ের একটা রাক্ষসের মুখ এঁকে গেছে। দেখে বেশ
হাসি পেল।
কিন্তু
হাসি বেশিক্ষণ টিকল না। এই গাছটা আমার খুব চেনা। মনের গভীর কুয়োয় একটা স্মৃতি পড়ে ছিল।
তার উপরে আরও অনেকরকম স্মৃতির স্তর পড়ে সেটা একেবারে ঢেকে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। আজ
সেই স্মৃতিটাই অন্য সব স্তর ফাটিয়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। এখন খুব ভালোভাবে মনে পড়ছে।
সেদিন ঠিক এই গাছটাই ছিল। কোনও ভুল নেই।
হিসেব
করে দেখলাম যে সেটা পাক্কা দশ বছর আগেকার কথা। সাবর্ণ তখনও জন্মায়নি। সেটাও
ছিল এরকমই গ্রীষ্মকাল। মা তো ছোটোবেলাতেই মারা গিয়েছেন, কিন্তু বাবা তখন বেঁচে
ছিলেন। এখনকার মতো সল্টলেকে বিশাল বড়ো বাড়ি তখন আমার ছিল না। মানিকতলায়
বাবার তিন কামরার একতলা বাড়িটায় থাকতাম। এখনকার মতো কসমেটিক্স কোম্পানির মালিকও
তখন আমি ছিলাম না। ছিলাম কেবিজি ফার্মাসিউটিক্যালসের সেলস ম্যানেজার। এখনকার মতো
কোটিপতি তখন ছিলাম না ঠিকই, তবে রোজগার খুব একটা খারাপ ছিল না। সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটা ছিল সেটার নাম শান্তি। ব্যাবসা করার কী
যে জ্বালা তা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। আজ দেড়মাস হল আমার ফ্যাক্টরি বন্ধ করে
দিতে হয়েছে। লেবার ইউনিয়নের লোকেরা নানারকম দাবিদাওয়ায় জেরবার করে দিচ্ছে। দু’পক্ষকেই
কিছুটা আপোস না করলে কখনও কোনও ভালো সংস্থা চলতে পারে না। কিন্তু ওরা আপোসে
বিন্দুমাত্রও রাজি নয়। টানা একবছর লড়াইয়ের পর বাধ্য হয়ে কারখানা বন্ধ রাখতে হয়েছে
আমায়। দেড়মাস হল কোনওরকম প্রডাকশন নেই। লেবার ইউনিয়নের হেড মিন্টু
ঘোষ নানারকমভাবে আমার পেছনে লেগেছে। খুন করার হুমকিও দিয়েছে দুয়েকবার।
দশ বছর
আগে সেটা ছিল বর্ষাকাল। সেদিন অফিসে কাজের বেশ চাপ ছিল। রাত সাড়ে দশটায়
অফিস থেকে বেরিয়ে দেখি ঝমাঝম বৃষ্টিতে কোনও গাড়িঘোড়া নেই। শেষে একটা অটোরিক্সা
দেখতে পেয়ে তাকে দাঁড় করিয়ে অনেক কষ্টে রাজি করালাম। তারপর পলিথিনের পর্দা সরিয়ে ভেতরে
ঢুকে বসলাম।
কিছুটা
রাস্তা যাবার পর হঠাৎ অটোওয়ালা অটো থামিয়ে নিজে ছাতা নিয়ে নামল। অন্য হাতে একটা
কালো কিছু নড়ে উঠল। সেটার থেকে দুটো কালো চকচকে চোখ বেরিয়ে আমার দিকে কুতকুত করে
চেয়ে থাকল। একটা কালো রঙের নেড়ি কুকুরের বাচ্চা। আমি বললাম, “ওটাকে নিয়ে কোথায়
যাচ্ছ?”
অটোওয়ালা
আবার ভেতরে ঢুকে বসে বলল, “আজকে আমার অটোর সামনে এসে পড়েছিল। একটুর জন্য বেঁচে
গেছে। ওই পাড়ার লোকেরা বলল, এর মা নেই। অন্য বাচ্চাগুলোও মরে গেছে। ওখানে থাকলে
গাড়িচাপা পড়ে যাবে। তাই নিয়ে এখানে ছেড়ে দিচ্ছি।”
“মানে!
এখানে ছাড়লে গাড়িচাপা পড়বে না?”
“এখানে
তো ভাতের হোটেল আছে। খেতে পেয়ে বেঁচে যাবে।”
“বলিহারি
তোমার বুদ্ধি!”
আমি
বলার সঙ্গে সঙ্গেই দেখলাম কুকুরের বাচ্চাটাও ‘হৌ হৌ’ করে অটোওয়ালাটাকে দু’বার বকে
দিয়ে আমার দিকে তাকাল। এতে আমি হেসেও ফেললাম, আর বাচ্চাটার ওপরে মায়াও পড়ে গেল।
এক হাতে
সুটকেস, আর এক হাতে কুকুরের বাচ্চা হাতে বাড়ি পৌঁছলাম।
দুনিয়ায়
কিছু কিছু মানুষ আছে যারা কুকুর, ইঁদুর, টিকটিকি আর আরশোলাকে সমানভাবে ঘেন্না করে
ও ভয় পায়। এই মানুষগুলোর দলপ্রধান হলেন আমার স্ত্রী। বাড়িতে কুকুরের বাচ্চা দেখার
সঙ্গে সঙ্গেই চরম সংঘাত ঘটল স্ত্রীয়ের সঙ্গে। তিনি কোনওমতেই বাড়িতে কুকুর মেনে
নেবেন না। অনেক অশান্তি সহ্য করে কুকুরটাকে ঠাঁই দিলাম বাড়ির ছাদে। ছাদে আমার
স্ত্রী ফুলের টব সাজিয়ে বাগান করেছিলেন। নানা রঙের গাঁদা,
চন্দ্রমল্লিকা, গোলাপ ইত্যাদি অনেক গাছ। তাদের মাঝে খেলে বেড়াতে লাগল ছোট্ট বাচ্চাটা।
কুচকুচে
গায়ের রং আর টলটলে চোখ। কুকুরটার নাম দিলাম দিঘি। সারাক্ষণ বাড়ির ছাদে খেলে বেড়ায়।
ওর মিষ্টি মুখটা দেখে অফিসে বেরোই। বাড়ি ফিরেই সোজা চলে যাই ছাদে। যতই নিঃশব্দে
বাড়ি ঢুকি না কেন, কী করে যেন ঠিক টের পায় সে। আমাকে দেখেই ঝাঁপিয়ে পড়ে আমার
হাঁটুর একটু নিচে। ওর সামনের নরম থাবাদুটোয় ভর দিয়ে, কান মুড়ে প্রাণপণে লেজ
নাড়ায় আর ‘হোউউউউউ’ করে গলা দিয়ে একটা আওয়াজ বের করে যার মর্মার্থ হল, “এতক্ষণ
কোথায় ছিলে? জানো না সারাদিন আমি কত একা ছিলাম? একা একটা ছাদে ঘুরে কাঁহাতক আর
কাক-চড়ুই তাড়িয়ে কাটানো যায় বলো তো?”
আমার
গিন্নি দিঘিকে খেতে দিতেন না। ওর মুখ দেখবেন না বলে ছাদে ওঠাও কমিয়ে দিলেন। বৃদ্ধ বাবা দুপুরে একবার ছাদে উঠে ওকে খাবার দিয়ে যেতেন।
একদিন
এক মহা বিপদ উপস্থিত হল। অফিসে কাজ করছিলাম। বাবা ফোন করে বাড়িতে ডাকলেন। গিয়ে
দেখি বিস্তর চেঁচামেচি চলছে। কী ব্যাপার? না, ছাদে উঠে দেখি তিনটে গাঁদাগাছ আর একটা
চন্দ্রমল্লিকার চারা ছিঁড়ে কুটি কুটি হয়ে মাটিতে গড়াচ্ছে। চারদিকে ছড়িয়ে রয়েছে বড়ো
বড়ো দুটো গোলাপের পাপড়িগুলো। চেঁচামেচি শুনে নিজের অন্যায় বুঝতে
পেরেই বোধহয় দিঘি ছাদের এককোণে লেজ গুটিয়ে বসে রয়েছে।
গিন্নির
প্রধান দাবি কুকুরটাকে বাড়ি থেকে তাড়াতে হবে। ফুলগাছগুলোর
দশা দেখে আমারই চোখে জল চলে এল, গিন্নির আর কী দোষ।
একটা
নাইলনের দড়ি রাখা ছিল কাপড়-চোপড় টাঙাবার জন্য। সেটাকে ভাঁজ করে বেশ করে পেটালাম
কুকুরটাকে। ওইটুকু বাচ্চা মার খেয়ে তারস্বরে চেঁচাতে লাগল। মনে হল সে যেন বলছে,
“আর করব না গো, এবারের মতো ছেড়ে দাও। জীবনের প্রথম ভুল। ক্ষমা করে দাও গো।”
দড়িটা
নিয়ে একবার নিজেরই হাতের ওপর কষিয়ে দিলাম আমি। সঙ্গে সঙ্গে লাল দাগ ফুটে উঠল আমার
চামড়ায়। বেশ যন্ত্রণা করল। ওইটুকু বাচ্চা কুকুরটাকে এইভাবে অন্তত কুড়ি ঘা তো
মেরেইছি। গায়ে লোম থাকার জন্য হয়ত ওর গায়ের লাল দাগগুলো আমি দেখতে পাইনি। এবার ওর
দিকে তাকিয়ে আমি কেঁদে ফেললাম।
পার্কস্ট্রিটে
থাকতেন আমার এক বন্ধুর দাদা রমাপদ দে। তাঁর খুব জীবজন্তুর শখ। প্রধানত কুকুরের। বিশাল
বাড়িতে ষোলটা নানা জাতের কুকুর রয়েছে। আর আছে দুটো খরগোশ, কুড়িটা পায়রা, একটা
শিম্পাঞ্জি। আমি রমাপদবাবুর কাছে ছুটলাম।
ভদ্রলোককে
ফোন করেই গেলাম। কলিং বেল বাজাবার পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যেই দরজা খুলে গেল। খুলে গেল
বলছি কারণ, সামনে কেউই ছিল না। ভেতরে ঢুকে দেখলাম দরজার পাশে আড়ালে একটা
শিম্পাঞ্জি ঘাপটি মেরে বসে। এবার সে দরজাটা বন্ধ করে লক লাগিয়ে একটু দূরে সোফায়
রমাপদবাবুর পাশে বসে কোকের টিনে চুমুক দিয়ে কোক খেতে লাগল।
রমাপদবাবুর
বাড়িতে ষোলটা কুকুর, কিন্তু আমাকে দেখে একটাও চেঁচাল না। ভদ্রলোক দুর্দান্ত
ট্রেনার। তাঁর নির্দেশেই সবাই চুপ করে আছে। বিশাল বসবার ঘরটার এদিক ওদিকে ছড়িয়ে
ছিটিয়ে বসে আছে কুকুরগুলো। তার মধ্যে ছ’টা নেড়ি। আমি যে কুকুরে ভয় পাই না সেটা
রমাপদবাবু জানেন। তা না হলে বাড়িতে কেউ এলে তাঁর নির্দেশে কুকুরগুলো আলাদা একটা ঘরে
চলে যায়। সেই ঘরের দরজা বন্ধ করার দরকার পড়ে না। রমাপদবাবুর নির্দেশ না পেলে তারা
কেউ ঘর থেকে বেরিয়ে আসে না।
আমি
রমাপদবাবুকে প্রণাম করে পাশের সিঙ্গল সোফাটায় বসে, “ভালো আছেন?” বলতেই দেখি তাঁর
জামার পকেট থেকে একটা ছোট্ট কুকুর মুখ বের করে আমাকে জুলজুল করে দেখছে। সাদা
রঙের কুকুর, চোখদুটো গোল গোল। ভীষণ মিষ্টি
মুখের সঙ্গে মিরক্যাটের মুখের কিছুটা মিল রয়েছে। কুকুরটাকে দেখলেই খুব হাসি
পায় আর আদর করতে ইচ্ছে করে। বললাম, “কোনও কুকুরের বাচ্চা হল বুঝি? কী নাম ওর?”
বললেন,
“আরে, বাচ্চা কী বলছ হে! দু’বছর বয়স ওর। যৌবনের তাজা রক্ত বইছে শরীরে। ভাগ্যিস
তোমার কথা বোঝেনি, বুঝলে চেঁচামেচি শুরু করে দিত। এ হল আমার কুকুরের দলে সতের
নম্বর সংযোজন। ওর জাতের নাম চিহুয়াহুয়া। দুনিয়ার সবচেয়ে ছোটো কুকুর হিসেবে রেকর্ড
করা জাত। তাই নিজের সম্মান বজায় রাখতে পকেটে ঢুকে বসে থাকে। ওর নামি দিয়েছি,
মলিকিউল।”
“আচ্ছা,
শিম্পাঞ্জিটা দরজা খুলে দিয়ে আড়ালে ঘাপটি মারছিল কেন?”
“কে,
চ্যাম্পিয়ন? আরে আর বোলো না। ভাবো একবার ব্যাপারটা। কোনও গেস্ট বাড়িতে এল আর দেখল
দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছে মূর্তিমান একটা শিম্পাঞ্জি। তার অবস্থাটা কী হবে? সেলস
পার্সন এবাড়িতে ঢুকতে পারে না ঠিকই, কিন্তু কত দরকারি লোকও ভয় পেয়ে পালিয়েছে। তাই
চ্যাম্পিয়নকে বলেছি দরজা খুলেই লুকিয়ে পড়বি। হা হা হা হা!”
একচোট
হাসি আর খোশগল্পের মধ্যে চা চলে এল। কিচেন থেকে একটা চাকা লাগানো সার্ভিং
টেবল ঠেলে চ্যাম্পিয়নই নিয়ে এল। তাতে চায়ের সঙ্গে দু’প্লেট ফিশ ফিঙ্গারের ধোঁয়া
ওঠা সত্ত্বেও চ্যাম্পিয়নের নির্লোভ ভাবমূর্তি দেখে বেশ অবাক লাগল। কারণ, এ যে মাংস
আর মাছ দুটোরই অত্যন্ত ভক্ত সেটা আমাকে রমাপদবাবু বলেছিলেন।
একটা
ফিশ ফিঙ্গারে ভিজে কামড় বসিয়ে এবার আমি প্রয়োজনীয় কথাটা তুললাম। দিঘিকে নিয়ে
বাড়িতে যে সমস্যা হচ্ছে সেটা জানালাম। দিঘি নিজেও বাড়িতে যে বেশ অনিষ্ট করছে সেটাও
বললাম।
“অনিষ্ট
করছে! হোয়াট ডু ইউ মিন?” হাঁ হাঁ করে উঠলেন রমাপদবাবু।
“না,
মানে এই তো সবে টবের গাছপালা ছেঁড়া দিয়ে শুরু করল। এরপরে আর কী করবে না করবে...”
“দূর
করে দাও!” আমাকে আশ্চর্য করে গলার পারদ সামান্য চড়ালেন ভদ্রলোক, “অনিষ্ট করলে
সিম্পলি দূর করে দাও। রাস্তা থেকে কুড়িয়ে আনা একটা ফালতু নেড়ি কুত্তা। তার
জন্য বাড়িতে অনিষ্ট সহ্য করবে কেন?”
“রমাপদবাবু,
আপনি এই কথা বলছেন!”
“হ্যাঁ,
বলছি। তোমার নিজের একটা সন্তান হোক, লক্ষ করে দেখবে সে তার ছোটোবেলায় একটা কুকুরের
চেয়ে অন্তত কুড়িগুণ বেশি অনিষ্ট করে। সুন্দর পেন্ট করা দেওয়ালে পেন্সিল দিয়ে
হিজিবিজি কেটে, রং বুলিয়ে নষ্ট করে না? দামি দামি খেলনা ছুড়ে ছুড়ে ভেঙে ফেলে না?
বইখাতা ছিঁড়ে কুটিকুটি করে না? ল্যাপটপে দুধ ঢেলে দেয় না? বারান্দার রেলিং থেকে সেলফোন
ছুড়ে ফেলে দেয় না? যেখানে সেখানে যখন তখন কুকর্ম করে ভোগায় না? খাবার সময় জ্বালায়
না? রাস্তায় বেরোলেই হাজাররকম বায়না করে না? রাতে ঘুমোতে না দিয়ে জাগিয়ে রাখে না?”
“কী
বলছেন রমাপদবাবু, সে তো মানুষ—” আমি মৃদু প্রতিবাদ করে উঠলাম।
“সেটাই
হচ্ছে আসল কথা। মানুষ। মানুষ বলে শতদোষ মাফ। আর জানোয়ার বলে একটা হাফ দোষও বিরাট
অপরাধ বলে মনে হয়। তাই তো?”
এ কথায়
সম্মতি না জানিয়ে উপায় নেই। সত্যিই মানুষের হাজার অপরাধ আমরা ক্ষমা করি কিন্তু
জানোয়ার একটা ছোটো কিছু করলেই আমরা অতিষ্ট হয়ে উঠি। নির্বিচারে তাদেরকে অপমান করি।
অথচ তারা মানুষের চেয়ে অনেক বেশি আত্মনির্ভরশীল। খাওয়া, ঘুমোনো ইত্যাদি কোনও কিছুই
তাদের বলে দিতে হয় না। তাছাড়া, অতি অল্পেই সন্তুষ্ট তারা।
আমি
মাথা নিচে নামাতে বাধ্য হলাম। আশেপাশের কুকুরগুলো কিছু বুঝতে পারছে কি না জানি না।
তবে তাদের অনেকেই আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
“শোনো
বিরূপাক্ষ,” রমাপদবাবুর গলা মোলায়েম, “তুমি তো ছোটোবেলায় রচনা বইতে পড়েছ যে কুকুর
প্রভুভক্ত প্রাণী?”
“হ্যাঁ,
সে তো সবাই পড়েছে।”
“তাহলে
জেনে রাখো যে, পৃথিবীতে যত প্রাণী আছে তাদের মধ্যে কুকুরই মানুষকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে।”
“তাই?”
“কেন
বাসে বলতে পারো?”
এই
উত্তরটাও খুবই সোজা। তাই বললাম, “সিম্পল, খাবার খেতে পাবে বলে।”
“দশে
চার পেলে, বিরূপাক্ষ।” রমাপদবাবু তাঁর গম্ভীর মুখে এক মিলিমিটার হাসির হসন্ত লাগিয়ে
বললেন, “খাবার তো আছেই। কিন্তু তার অনেক ওপরে আছে ভালোবাসা। তুমি কিচ্ছুটি খেতে না
দিয়ে একটা কুকুরকে আদর করো, দ্বিতীয়দিনও সে লেজ নাড়িয়ে তোমার কাছে আসবে। মলিকিউলকে
দিয়েই ফার্স্ট ট্রাই করতে পার।”
আমি
সম্মতি জানালাম।
রমাপদবাবু
বললেন, “এখন কথা হচ্ছে মানুষ তো আর স্বার্থ ছাড়া চলে না। সে কুকুর পুষবে তার
স্বার্থেই। কুকুরের উপকারিতা মানবজাতি কী করে ভুলতে পারে বলো? সবচেয়ে ভীতু কুকুরটা
ভয় পেয়েও যেটুকু চেঁচামেচি করে তাতেও চোর-ডাকাত বাড়িতে ঘেঁষে না। অন্ধ প্রভুকে
গাইড করা, অপরাধমূলক কাজে সাহায্য করা, মহাকাশযাত্রায় প্রতিনিধিত্ব করা এসব তো
সকলেই জানে। তুমি জানো, সুন্দরবনে বাঘের উপদ্রবে তটস্থ গ্রামবাসীরা কুকুর পুষছে
পাহারা দেবার জন্যে? আমি তো বলব আমাদের শহরেও প্রত্যেক বাড়িতে যেমন একটা করে
বাগানের জন্য জায়গা রাখা উচিত তেমনি অন্তত একটা করে কুকুরও পোষা উচিত। পৃথিবীতে এত
জানোয়ার থাকতে মহাভারতে মহাপ্রয়াণের পথে পাণ্ডবদের সঙ্গ একটা কুকুরেই নিল কেন বলতে
পার?”
রমাপদবাবুর
কথা শোনার পরে তাঁর বাড়ির সতেরটা কুকুরের দিকে তাকিয়ে তাদেরকে যেন অনেক আপন বলে
মনে হতে লাগল। খাবারও নয়, শুধু একটু ভালোবাসার বিনিময়ে তারা তাদের প্রাণ পর্যন্ত
উৎসর্গ করতে পারে। কী আশ্চর্য মানুষভক্ত জীব!
আমার যা
জানার ছিল জানা হয়ে গিয়েছে। এখন বাড়ি গিয়ে স্ত্রীকে যে করেই হোক বুঝিয়ে রাজি করাতে
হবে।
বেরোবার
সময় রমাপদবাবু বললেন, “আমার কী বিশ্বাস জানো? তোমার কুকুর নিজেই তার জায়গা করে
নেবে।”
বাড়ি
ফিরে স্ত্রীকে অনেক বোঝানোর পরে তিনি রাজি হলেন। কিন্তু একটা শর্তে, দিঘিকে বেঁধে
রাখতে হবে। ছাদে খুব ছোটো একটা ঘর ছিল। ছোটোবেলায় সেটাই ছিল আমার পড়ার ঘর, আর বড়ো
হয়েও অনেক সময় খুব মনোযোগের কাজ হলে আমি সেই ঘরে চলে যেতাম। বড্ড প্রিয় সেই ঘরে
দরকারি কাগজ বোঝাই দুটো আলমারি, টেবিল-চেয়ার আর ছোটো একটা খাট ছিল। সেই ঘরেরই
গোড়ায় চেন দিয়ে বাঁধলাম দিঘিকে। সে প্রথমে আশ্চর্য হল, তারপরে একটু মনমরা। কিন্তু
প্রতিবাদ জানাল না।
দশ বছর
বয়সে একজন মানুষের মধ্যে যেরকম শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ঘটে, কুকুরে মধ্যে প্রথম এক
বছরেই ততটা ঘটে যায়। দিঘির যখন প্রায় এক বছর বয়স তখন সে একটা কাণ্ড করে বসল। এক
রবিবারের দুপুরে ওর চিৎকার শুনে ছাদে গিয়ে দেখি ও প্রাণপণে চেন ছিঁড়ে বেরিয়ে আসার
চেষ্টা করছে আর আমার একটা আলমারির কাছে যেতে চাইছে। আমি ওকে খুলে দিতেই ও
আলমারিটায় ঝাঁপিয়ে পড়ে দরজাটা আঁচড়াতে লাগল। আলমারিটা খুলে ফেললাম। ওই
আলমারিতে আমার অনেক ফাইল ছিল। কয়েকটা ফাইলের গায়ে কাগজের কুচির পাহাড় জমে থাকতে
দেখেই বুঝলাম নেংটি ইঁদুর বাসা করেছে। সর্বনাশের মাথায় টাক! ওখানে যে আমার অনেক
পরীক্ষার সার্টিফিকেট রয়েছে, অফিসের খুব দরকারি কাগজপত্রও রয়েছে। আর
রয়েছে আমার আর গিন্নি ভোটার আইডি, পাসপোর্ট। দেড় মাস এই ঘরে ঢুকিনি, আলমারিটাও
খুলিনি, আর এই অবস্থা!
ঝটপট
ফাইলগুলো খুলে দেখলাম বেশ কিছু কাগজ নষ্ট হয়েছে বটে, একটা সার্টিফিকেটের কোনাটাও
খেয়েছে ইঁদুরে। তবে খুব দরকারি কাগজগুলো এখনও দৈবক্রমে বেঁচে রয়েছে। হাঁফ ছেড়ে
বাঁচলাম। দিঘির ওপরে কৃতজ্ঞতায় মনটা ভরে গেল। ও দেখি মাথা নিচু করে আছে। বড্ড
লজ্জা পেয়েছে বোধহয়। হাঁটু গেড়ে বসে ওর মুখটা তুলে একটা চুমু খেতে যাব, দেখি ওর মুখ
থেকে একটা নেংটি ইঁদুর ঝুলছে।
এই
কুকুরকে আর বেঁধে রাখা চলে না। বাবা বললেন, “ও কিন্তু বেশ কয়েকদিন ধরেই ছাদের ঘরের
দরজার ফাঁকে নাক ঢুকিয়ে শোঁকাশুঁকি করছিল।”
গিন্নিও
মানলেন দিঘি আমাদের একটা বড়ো ক্ষতির হাত থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। কোনও ট্রেনিং ছাড়াই
ও একটা স্নিফার ডগের কাজ করেছে। ওকে ছেড়ে রাখা যেতে পারে তবে গিন্নির কাছে যেন না
ঘেঁষে। আমি সুযোগ পেয়ে শুনিয়ে দিলাম, “ওরা বোঝে কে ওদেরকে ভালোবাসে
আর কে বাসে না।”
এর কয়েক
মাস পরে গিন্নি চললেন মাস কয়েকের জন্য তাঁর বাপের বাড়ি চন্দননগরে থাকতে। তিনি
সন্তানসম্ভবা হয়েছিলেন। মুশকিল হল আমাকেও কম্পানি ছ’মাসের জন্য দিল্লিতে পাঠিয়ে
দিল। বাবাকে দেখাশোনার জন্য আয়া রেখে দিলাম। কিন্তু দিঘির কী হবে? তাকে আমাদের
পাড়ায় ছেড়ে দিলাম। সারাদিন টো টো করে বেড়াত আর রাতের সময়ে আমাদের বাড়ির রকে এসে
শুত। কাজের লোককে বলে রেখেছিলাম রকের ধারে গামলায় খাবার নিয়ে দু’বেলা যেন রেখে
দেয়। তাই দিত।
তিন মাসের
মাথায় শ্বশুরবাড়ি থেকে দিল্লিতে ফোন এল। আমার গিন্নির একটা মিষ্টি ছেলে হয়েছে। আনন্দে
পাগল হয়ে গেলাম। কিন্তু কোম্পানি কিছুতেই কাজ ফেলে কলকাতা আসতে দেবে না। রাগের
চোটে দিলাম চাকরি ছেড়ে।
চন্দননগরে
গিয়ে ছেলের মুখ দেখলাম। নাম রাখলাম সাবর্ণ। গিন্নি আরও কয়েকমাসের জন্য তাঁর বাপের
বাড়িতে রয়ে গেলেন। আমি ফিরে এলাম আমার বাড়ি।
এসে
দেখি সাংঘাতিক কাণ্ড ঘটিয়েছে আমার প্রিয় কুকুর দিঘি। ছাদে যাবার সিঁড়ির নিচে সে
তিনটে বাচ্চা পেড়ে বসে আছে। জীবজন্তুরা মা হলে সাধারণত কাউকে কাছে ঘেঁষতে দেয় না। কিন্তু
দিঘি অন্যরকম। ও এমনভাবে আহ্লাদে আটখানা হয়ে বাচ্চাগুলোকে আর আমাকে দেখতে লাগল যেন
মনে হল পুজোর নতুন জামা বের করে দেখাচ্ছে। বাবা বললেন, যেদিন সাবর্ণ জন্মেছে
সেইদিনই নাকি দিঘির বাচ্চা তিনটে হয়েছে।
ফোন করে
ব্যাপারটা গিন্নিকে বলার সাহস হল না।
যেকোনও
শিশুকেই ভগবান খুব সুন্দর করে তৈরি করেন। তা সে মানুষেরই হোক বা কুকুরের। তাই
তিনদিনে একবার চন্দননগরে ছুটে যেতাম সাবর্ণকে আদর করতে আর বাড়িতে যতক্ষণ থাকতাম
দিঘির বাচ্চা তিনটেকে খুব চটকাতাম।
দিঘির
দুই ছেলে, এক মেয়ে। তিনটের তিনধরনের রং। মেয়ে বাচ্চাটা খুব আদুরে। গায়ে তার সাদা
আর ব্রাউন ছোপ আর কপালে বড়ো ব্রাউন রঙের ফুটকি। দেখতে অনেকটা তাসের হার্ট সাইনের
মতো। আমি মেয়েটার নাম দিলাম লাল পান বিবি। সংক্ষেপে বিবি। একটা সাদার রঙের ছেলে
বাচ্চা সারাক্ষণ বিবির সঙ্গে খুনসুটি করছে। তার নাম দিলাম সাহেব। অন্যটা কালো
রঙের, খুব শান্ত আর বিবির অনুগত। সে হয়ে গেল গোলাম। তাহলে দাঁড়াল
সাহেব-বিবি-গোলাম।
মাস দুয়েক
পরে আমার স্ত্রী সাবর্ণকে নিয়ে বাড়িতে ঢুকে রণক্ষেত্রে বাধিয়ে দিলেন। বললেন, “এ-বাড়িতে
হয় তোমার কুকুর থাকবে নয় আমি আর তোমার ছেলে।” এই বলে তিনি আবার চন্দননগরে ফিরে
গেলেন।
অনেক
বোঝালাম গিন্নিকে। ঝগড়াও করলাম। কাকুতি-মিনতিও করলাম। কিন্তু তিনি তাঁর সিদ্ধান্তে
অনড়। তাই শেষে বাধ্য হয়ে বললাম, “চৈত্র মাস সবে পড়েছে। শুধু এই মাসটা যেতে দাও।
বৈশাখ এলেই দেখছি কী করা যায়।”
বৈশাখ
মাস পড়ল। আমিও টালবাহানা করতে লাগলাম। কিন্তু শেষরক্ষা করতে পারলাম না। আমার
গিন্নি খুব ভালো রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন। প্রতি পঁচিশে বৈশাখ চন্দননগরে তাঁদের
বাড়িতে খুব বড়ো করে রবীন্দ্রজয়ন্তী হয়। সেইদিন আমি গিন্নি আর সাবর্ণকে আনতে যাব
বলে বাবার মারুতি ওমনিতে উঠলাম। দিঘি আর তার তিন বাচ্চাকেও তুলে নিলাম। দিঘির তো ভারি আনন্দ। তার হয়তো শৈশবে দেখা গাড়িঘোড়া আর পিচঢালা
রাস্তার কথা মনে পড়ে গেল। সে কান মুড়ে হাওয়া খেতে খেতে যেন তার বাচ্চাদের বলতে
লাগল, দেখেছিস, তোদের নিয়ে কেমন ঘুরতে বেরিয়েছি?
সে
দিনটাতেও ছিল আজকের মতো চড়া রোদ। দিল্লি রোড দিয়ে যেতে যেতে ড্রাইভার শ্যামলকে
থামতে বলেছিলাম ঠিক এই জায়গাটায়। এই কদমগাছের নিচে একটু ছায়া দেখতে
পেয়ে গাড়ি থেকে নেমেছিলাম। দিঘি আর সাহেব-বিবি-গোলামদেরও নামিয়েছিলাম। গাছের
গুঁড়িটায় গিয়ে বসেছিলাম। আমার দেখাদেখি দিঘিও বসেছিল, আর তার বাচ্চাগুলোও। দিঘিকে
ঘিরে বাচ্চাগুলো খেলা করছিল আর দিঘি তাদের দিকে স্নেহভরা দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল। মাঝে
মাঝে আমার দিকে তাকিয়ে যেন বলছিল, “হি হি, বাচ্চাগুলো কী দুষ্টু, না?”
হঠাৎ
আমি গাড়িতে উঠে পড়লাম। শ্যামলকে বলাই ছিল, সে ইঞ্জিন চালু রেখেছিল। গাড়িতে উঠেই
সপাটে দরজা বন্ধ করে দিলাম। তখনও দিঘি ব্যাপারটা বোঝেনি। মানুষের বিশ্বাসঘাতকতা
বোঝা তার কম্ম নয়। বুঝল যখন গাড়ি চলতে শুরু করল। সেই মুহূর্তে নজরে এল সেই কদমগাছের
গুঁড়িতে আঁকা রাক্ষসের মুখটা।
গাড়ি
ফুল পিক-আপে চলতে শুরু করেছে। আমার পেছন ঘুরে দেখার ক্ষমতা নেই। তবে ড্রাইভারের
লুকিং গ্লাসে দেখতে পেয়ে গেলাম ভয়াবহ দৃশ্য। দিঘি প্রাণপণে ছুটে আসছে আমাদের গাড়ির
দিকে। তার পেছনে তার বাচ্চা তিনটেও ছুটে চলেছে। তাদের সঙ্গে গাড়ির দূরত্ব ক্রমশ
বেড়ে চলেছে। আস্তে আস্তে তারা বিন্দুতে পরিণত হচ্ছে কিন্তু ছোটা থামায়নি। থামাল
যখন ঘটনাটা ঘটল। একটা বাচ্চা কোনও কারণে পড়ে গেল আর একটা ম্যাটাডর এসে দিল তাকে
সম্পূর্ণ পিষে। কোন বাচ্চাটা বুঝতে পারলাম না। অঝোরে কেঁদে ফেললেও গাড়ি থামাতে
পারলাম না। লুকিং গ্লাস দিয়ে শুধু দেখলাম, দেওয়ালে মশা মারলে যেমন তার রক্ত ছিটকে
যায়, ঠিক তেমন দূরে রাস্তায় থেবড়ে আছে চাপ চাপ রক্ত।
“স্যার
হয়ে গেছে, আপনি ছোটোবাবুকে ডাকুন, আমি একটু আসছি।” আমাকে দশ বছর আগের স্মৃতির
কুয়ো থেকে তুলে এক ঝটকায় বাইরে এনে ফেলল আমার ড্রাইভার শ্যামল। গাড়ির চাকা লাগানো
হয়ে গিয়েছে। এবারে সাবর্ণকে ডাকতে হবে। কিন্তু রাস্তায় একটা গাড়িতে চোখ পড়তেই আমার
বুকটা কেঁপে উঠল। ওটা মিন্টু ঘোষের টাটা সুমোটা না?
একেবারে
ঠিক দেখেছি। ওতে মিন্টু ঘোষ আর তার দলবল রয়েছে। ক’দিন ধরেই সন্দেহ হচ্ছিল আমার
ফ্যাক্টরির লেবার ইউনিয়নের হেড মিন্টু ঘোষ আমাকে ফলো করছে। আমার উপরে ওর অনেক রাগ
জমে আছে। আমার ক্ষতি করতে চায় ও।
ঝটপট
মোবাইলটা বের করে সাবর্ণর নাম্বারে ডায়াল করলাম। কিন্তু রিং বেজেই চলেছে। সাবর্ণ
ধরছে না। সর্বনাশ! গাড়ি চালিয়েও যাবার উপায় নেই কারণ, গাড়ির চাবি শ্যামলের কাছে আর
শ্যামল টয়লেট করতে গেল।
মিন্টু ঘোষের
গাড়িটা প্রায় দুশো মিটার দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। ওখানে কী হচ্ছে বুঝতে পারছি না।
প্রাণপণে ছুটলাম।
এই গরমে
এভাবে ছোটা অসম্ভব। কিন্তু ছুটতে আমাকে হবেই। দূরে মিন্টু ঘোষের টাটা সুমোটা
দাঁড়িয়ে আছে দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু ও কী! টাটা সুমো যে আবার চলতে শুরু করল! দূরে
মিলিয়ে যাচ্ছে যে! ওরা আমার সাবর্ণকে কিডন্যাপ করল!
নাহ্। এই
তো সাবর্ণ। এই তো আমার সোনামণি। রাস্তার ধারে ঝুঁকে পড়ে ওর সেলফোনটা কুড়োচ্ছে।
একটা নয়, এতটা পথ দৌড়ে আমি একটার পর একটা হাঁফ ছেড়েই যাচ্ছি। তাই দেখে সাবর্ণ বলল,
“ড্যাড, হোয়াই ওয়্যার ইউ রানিং?”
“বেটা,
তোমাকে ওরা কিডন্যাপ করতে এসেছিল?”
“কিডন্যাপ?
আমাকে? হাউ সিলি! বেনটেনের রিস্টে আল্টিম্যাট্রিক্স থাকতে সে কখনও কিডন্যাপড হতে
পারে?” এই বলে সাবর্ণ তার বাঁহাতের সবুজ ভজকটমার্কা ঘড়িটা তুলে দেখাল।
আমি
হাঁটু গেড়ে বসে সাবর্ণকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললাম, “একটা আল্টিম্যাট্রিক্স দিয়েই তুমি
শত্রুদের মোকাবিলা করে ফেললে?”
“না,
না। আরও আছে না? গুয়েন অ্যান্ড ক্যাভিন।”
“তারা
আবার কে?”
“বাহ্
রে! তাও জানো না? আরে বাবা, গুয়েন হল বেনটেনের কাজিন আর ক্যাভিন হল বেনটেনের
ফ্রেন্ড।”
“ও ব্বাবা!
তিনজনে মিলে কিডন্যাপারদের ঘায়েল করে ফেললে?”
“না, আর
একজনও ছিল। ওয়ান হান্ড্রেড ওয়ান ডালমিশিয়ানের একটা। বাকি হান্ড্রেডখানা খুঁজেই
পাচ্ছি না কিছুতেই।”
ছেলের
কথা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। বললাম, “কোথায় তারা?”
“ওই
যে।” সাবর্ণ আঙুল তুলে সামনের দিখে দেখাল। একটা বড়ো কুকুর আর তার দুটো বড়ো সাইজের বাচ্চা
দূর থেকে এদিকে এগিয়ে আসছে।
কী
হয়েছিল জিজ্ঞাসা করতে সাবর্ণ বলল, “আমি তো গুয়েন আর ক্যাভিনকে পেয়ে খেলছিলাম আর
ডালমিশিয়ন তাকিয়ে তাকিয়ে হাসছিল। তখন একটা গাড়ি এসে থামল। তার থেকে চারটে কালো
কালো বড়ো বড়ো লোক নেমে আমাকে ধরতে এল। আমি তো দেখেই বুঝেছি ওরা এলিয়েন। আমার
কাছে তো আল্টিম্যাট্রিকস আছে। সেটা ঘুরিয়ে ঠিক পাওয়ারটা চুজ করতে না করতেই ওরা
আমার হাত ধরে ফেলল। আমি সেলফোন দিয়ে গুয়েন-ক্যাভিনের ছবি তুলছিলাম তো, সেলফোনটাও
হাত থেকে পড়ে গেল। এই সময়ে ডালমিশিয়ন ঝাঁপিয়ে পড়ে লোকটার হাতে জোরসে কামড়ে দিল।
সেই দেখে গুয়েন আর ক্যাভিনও ওদের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তারপর আমি একটা ঝটকা দিতেই ওরা
আমাকে ফেলে গাড়িতে উঠে পালাল। আর গুয়েন-ক্যাভিন-ডালমিশিয়ানরা ওদের গাড়িটা তাড়া করে
ছুটে গেল। হি হি হি।”
তিনটে
কুকুর এতক্ষণে আমার একেবারে কাছে চলে এসে লেজ নাড়াচ্ছে। মা-কুকুরটা একটু বেশিই
খুশি মনে হল। ও কি আমাকে চিনতে পেরেছে? এতদিন পরে চিনতে না পারারই কথা। পারুক বা
না পারুক, সাবর্ণর কাছে যে ভালোবাসা ওরা এইটুকু সময়ে পেয়েছে সেটুকুরই প্রতিদান ওরা
দিতে পারে নিজেদের প্রাণ দিয়েও। ওরা জানোয়ার। শোধ নিতে ওরা জানে না। জানে শুধু ভালোবাসতে।
আমার
গাড়ি অবধি হেঁটৈ এল তিনটে কুকুর। কৃতজ্ঞতায় আমার চোখ ভিজে গেল। মা-কুকুরটার গলা না
জড়িয়ে থাকতে পারলাম না। গায়ে তার সাদা-ব্রাউন ছোপ আর কপালে বড়ো ব্রাউন রঙের ফুটকি।
দেখতে অনেকটা তাসের হার্ট সাইনের মতো। এ হল সেই লাল-পান-বিবি। দিঘির মেয়ে। এই দশ বছরে
দিঘি হয়ত মরে গিয়েছে। কিন্তু তার ভালোবাসা রয়ে গিয়েছে তার বংশের রক্তে।
_____
অলঙ্করণঃ মানস
পাল
খুব সুন্দর গল্প।যতবার পড়ি ভালো লাগে।
ReplyDeleteএখানে বেরোচ্ছে বুঝি? অসাধারণ লাগল।
ReplyDeletekhub sundor..tobe..posha kukur ar tar chanader highway te fele chole jawa ta obastob..kukur guloke paray/bajare chere dilei holo..sahaj solution..
ReplyDelete