অস্বস্তির
রাত
অরিন্দম
দেবনাথ
ঘুমটা
ভেঙে গেল।
একটা অস্বস্তি হচ্ছে। শুয়ে আছি গঙ্গোত্রীর পর্যটন আবাসের একচিলতে গুদামঘরের
একটা চৌকির ওপর।
কত রাত জানি না। ডাঁই করে রাখা লেপ-বালিশের স্তুপের মাঝে চৌকিটা খালি করে কোনওরকমে রাত কাটানোর উপযোগী করে দিয়েছে
পর্যটন আবাসের চৌকিদার রাম সিং। গঙ্গোত্রীর কোনও হোটেলেই ঘর খালি নেই। তাই
রাম সিংকেই ধরে পড়তে হয়েছিল রাত কাটাবার একটা ঠাই করে দিতে। রাম
সিং আমাকে অনেকদিন ধরে চেনে, তাই এই ভরা মরশুমে না
বলতে পারেনি। কিন্তু গুদামঘরটায় রাতে শুতে যাবার আগে একটা কথা
বলে দিয়েছিল, “একটা কথা তোমায় বলা হয়নি,
যে ঘরটায় তোমাকে রাতের ব্যবস্থা করে দিলাম, গত
বছর ওই ঘরটায় একজন আত্মহত্যা করেছিল। তারপর ওই ঘরটায় আর কেউ থাকেনি। ওই
ঘরটাকে আমরা গুদামঘর বানিয়ে নিয়েছি। একটু হুঁশিয়ার থেকো।”
লেপটার
ভেতরে আরও কুঁকড়ে শুলাম।
সেপ্টেম্বরের
শেষ।
সমুদ্রতল থেকে দশ হাজার ফুট উঁচু গঙ্গোত্রীতে বেদম ঠাণ্ডা। আমি
আসছি চোদ্দো হাজার ফুট তপোবন উপত্যকা থেকে। ওখানে আছি একমাস ধরে। খাবার
শেষ হয়ে এসেছে, তাই আজ ভোরবেলা রওনা হয়ে ঘণ্টাপাঁচেক
হেঁটে গঙ্গোত্রী এসেছি আলু, চাল, ডাল,
ডিম, কেরোসিন তেল এসব সংগ্রহ করব বলে। একটা
দশ সদস্যের ভূতাত্ত্বিক দলের ফটোগ্রাফার হয়ে এসেছি। আরও
একমাস মতো থাকতে হবে। সাতটা তাঁবু খাটিয়ে আমরা আছি। আমাদের
সাথে রান্না করার লোকও আছে। ওই আসবে বলেছিল রেশন কিনতে। কিন্তু
আমি যেচে দায়িত্বটা নিয়েছিলাম। এক মাস ধরে ওই এক জায়গায় বসে বসে বোর হয়ে গেছিলাম।
সমস্ত
মালপত্র কেনা হয়ে গেছে। দুটো মালবাহক আসবে কাল ভোরবেলায়। ওরা
আমার সাথে মাল বয়ে নিয়ে যাবে আমাদের ক্যাম্প পর্যন্ত।
সন্ধেবেলা
খাওয়াটা হয়েছিল জব্বর। আলুপরোটা, আচার আর
অমলেট, তারপর গরম গরম চা। গত
কয়েকদিন ধরে ওই এক খাবার ন্যুডলস আর খিচুড়ি খেতে খেতে মুখটা বিস্বাদ হয়ে গেছিল। খাবারটা
আরও জমেছিল, কারণ হোটেলের কুক প্রেমা আজ খুব
স্ফূর্তিতে ছিল। আর স্ফূর্তিতে থাকলে ওর গল্পের ঝুলি খুলে যায়।
প্রেমার
বাড়ি উত্তরকাশি জেলা সদর উত্তরকাশি শহর থেকে দশ কিলোমিটার দূরে রাথরা গ্রামে। কয়েকদিন
আগেই ও গ্রামের বাড়ি থেকে ঘুরে এসেছে। গঙ্গোত্রী থেকে উত্তরকাশি বাসে ছয় ঘণ্টার পথ। উত্তরকাশি
থেকে প্রেমার বাড়ি পৌঁছতে পাহাড়ের পাকদণ্ডি বেয়ে, জঙ্গলের ভেতর দিয়ে প্রায় দু’ঘণ্টা হাঁটতে হয়। পথে
কয়েকটা গ্রাম পড়ে।
এ-পথের প্রায় সব গ্রামেতেই প্রেমার
আত্মীয়স্বজন আছে। সবার খোঁজখবর নিয়ে গল্পগুজব খাওয়াদাওয়া করতে করতে
কোনও বারই প্রেমা উত্তরকাশি থেকে ঘণ্টা দশেকের আগে নিজের গ্রামে পৌঁছতে পারে না।
খুব
ভালুকের উপদ্রব এই জঙ্গলপথে। তাই সবাই সাধারণত দলবেঁধে যাতায়াত করে। প্রেমা
এদিক থেকে খুব সাহসী। কোনও কিছুতে ভয় পায় না। এমনকি
একবার ও রাত্রিবেলা বন্ধুদের সাথে এক পূর্ণিমার রাতে বাজি ধরে রাত বারোটার সময় গ্রাম
থেকে একা হাঁটা লাগিয়ে উত্তরকাশি এসে আবার ফেরত গেছিল।
প্রেমার
একটাই সখ।
ও মাছ ধরতে খুব ভালোবাসে। মাছ ধরতে বসলে ওর আর কোনও হুঁশ থাকে না। ওদের
গ্রামের আশেপাশে জঙ্গলের মধ্যে অনেক ঝর্না আর ছোটো ছোটো লেক। মহাশোল
আর ট্রাউট-মাছ প্রচুর এই লেকগুলোতে। ওদের
গ্রামের কেউ মাছ খায় না। প্রেমাও মাছ খায় না। ও
মাছ ধরে আবার জলে ছেড়ে দেয়।
শেষবার
বাড়িতে গিয়ে এক সকালে ও মাছ ধরতে গেছিল ওদের বাড়ি থেকে দুই কিলোমিটার মতো দূরে জঙ্গলের
ভেতর এক ছোট্ট লেকে। এই লেকটা ওর ভারি পছন্দের। অনেকগুলো
বড়ো বড়ো বোল্ডারের মধ্যে দিয়ে একটা ছোটো ঝর্না এসে পড়েছে লেকের জলে। আর
লেকের অন্য এক দিক দিয়ে আর একটা ঝোরা বেরিয়ে গেছে। এই
ঝোরাটা ওদের গ্রামের পাশ দিয়ে গেছে। ওদের গ্রামের সবাই এই ঝোরার জল ব্যবহার করে। এই
ঝোরার জলে চাষবাস করে। এই ঝোরার জল ওরা কখনও নোংরা করে না।
এই
লেকের পাশে একটা খাড়া বোল্ডার আছে, যার মাথাটা
টেবিলের মতো। কবে একটা যেন গাছ ভেঙে পড়েছিল এই বোল্ডারের ওপর। পাথরের
গায়ে হেলান দিয়ে থাকা সেই গাছের গুঁড়িটাকে মইয়ের মতো ব্যবহার করে ওই খাড়া পাথরের মাথায়
বসে আয়েস করে মাছ ধরে প্রেমা। ওই বোল্ডারের মাথা থেকে জল প্রায় কুড়ি ফুট নিচে।
দেরাদুন
থেকে মাছ ধরার সুতো, হুইল, ছিপ
সংগ্রহ করেছে প্রেমা। ওদের গ্রামের আর কারও কাছে মাছ ধরার এত সরঞ্জাম
নেই।
বঁড়শিতে মাছ গাঁথলে যখন তীক্ষ্ণ ‘কিইইই’
শব্দ করে সুতো বেরোয় হুইল থেকে তখন প্রেমার খুব আনন্দ হয়। ছিপটাকে
অনেক কায়দা করে ধরে পাথরের খাঁজ বাঁচিয়ে গাছের গুঁড়ি বেয়ে বোল্ডারের ওপর থেকে লেকের
ধারে নেমে আসে প্রেমা। তারপর মাছকে জল থেকে তুলে একটা খাতায় তারিখ,
মাছের মাপ, কী মাছ এসব লিখে মাছটাকে আবার লেকের
জলে ছেড়ে দেয়। হোটেলে খেতে আসা ট্যুরিস্টদের কাছ থেকে প্রেমা
শুনেছে মাছ ধরাও নাকি একটা খেলা। আর খাতায় মাছের বিবরণ লেখাটাও ও শিখেছে সাহেব টুরিস্টদের
থেকে।
অনেক সাহেব ওর সাথে ওদের গ্রামে আসতে চেয়েছে,
কিন্তু প্রেমা কাউকে ওদের গ্রামে আনেনি। ও
এই লেকটা কাউকে দেখাতে চায় না। কিন্তু এই লেকের গল্প বলতেও ছাড়েনি।
খাড়া
পাথরের মাথাটার যেখানটা টেবিলের মতো, সেখানে
আয়েশ করে বসে, বঁড়শিতে টোপ লাগিয়ে লেকের জলে ফেলে, সঙ্গের ব্যাগ থেকে একটা পকেট রেডিও বের করে গান চালিয়ে ফাতনার দিকে তাকিয়ে
ছিল প্রেমা।
অনেকক্ষণ
ফাতনায় মাছের কোনও সাড়া নেই। গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছিল প্রেমা। হঠাৎ
‘কিইইই’ শব্দ। ঘুম
ছুটে গেছিল প্রেমার। দেখল হুইল থেকে হু হু করে সুতো বেরিয়ে যাচ্ছে। আঁকড়ে
ধরল প্রেমা ছিপটাকে। তারপরই দেখল সুতোটা যাচ্ছে আকাশপানে। পায়ে
মাছ আঁকড়ে একটা পাখি উড়ে যাচ্ছে জলের ওপর দিয়ে আর সুতোটা ওই মাছের মুখে। অনেক
কষ্টে ছিপটাকে রক্ষা করেছিল প্রেমা। মাছটাকে পা থেকে ফেলে উড়ে গেছিল মাছখেকো পাখিটা। তবে
অনেক ওপর থেকে মাটিতে আছড়ে পড়ে মাছটা আর বাঁচেনি।
এত
জমিয়ে গল্পটা বলেছিল প্রেমা, যে কখন যে মোটা মোটা
পাঁচটা পরোটা খেয়ে ফেলেছিলাম, বুঝতে পারিনি। বিছানাতে
শুতে শুতেই ঘুম।
পাশ
ফিরে শুলাম।
আর কোনও অস্বস্তি হচ্ছে না। সন্ধেবেলার শোনা প্রেমার কাহিনিটা মনে পড়ছিল। পায়ে
বঁড়শি গাঁথা মাছ নিয়ে উড়ে যাচ্ছে একটা পাখি। ‘কেমন পাখি গেঁথেছি বঁড়শিতে’ - ছবিটা
তুলতে পারলে এই ক্যাপশান দিতাম, দারুণ হত। এসব
ভাবতে ভাবতে খানিক পর ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আবার।
ঘুমটা
আবার ভেঙে গেল।
গলার কাছটা খুব ভারী ভারী লাগছে। কেউ যেন গলাটা চেপে ধরতে
চাইছে।
আমি একটু নড়ে উঠতে গলার কাছ থেকে ভারী জিনিসটা সরে গেল। চুপ
করে লেপের তলায় শুয়ে রইলাম।
কিছুক্ষণ
পর আবার অস্বস্তিটা শুরু হল। একটা হালকা কিছু লেপে ঢাকা আমার পায়ের ওপর যেন
হাত বুলিয়ে যাচ্ছে।
শোয়ার সময় ঘরের দরজাটা ভালো করে বন্ধ করে শুয়েছি। ঘরের
কাঁচের জানালাগুলো এমনিতেই বন্ধ। কাজেই চোর ঢুকবে এমন সম্ভবনা নেই। তাছাড়া
এত বছর ধরে এই অঞ্চলে ঘুরে বেড়াচ্ছি, চুরি ডাকাতির
কথা কখনও শুনিনি। তবে কি অন্যকিছু?
মনে পড়ল চৌকিদার রাম সিংয়ের কথা। একটা
লোক বছর খানেক আগে এই ঘরে আত্মহত্যা করেছিল!
এত
ঠাণ্ডাতেও লেপের তলায় আমার হাত-পায়ের তালু ঘামতে লাগল। একটা
অজানা ভয় চেপে বসল আমার মনে। আমার পুরো শরীরটা আড়ষ্ট হয়ে রয়েছে। হাত-পাগুলো শক্ত হয়ে গেছে। অনেক চেষ্টা করেও নাড়াতে পারছি না শরীরটাকে। গলা
শুকিয়ে পাথর।
একটু জল না খেতে পেলে মরে যাব। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। পা-টা কোনওরকমে একটু নাড়ালাম। পায়ের ওপর থেকে একটা কিছু
সরে গেল।
আর
কোনও সাড়াশব্দ নেই।
কিছুতেই ঘুম আসছে না। কত রাত বুঝতে পারছি না। ঘড়িটা
রয়েছে মাথার ধারে লেপের বাইরে। লেপের বাইরে হাত বাড়িয়ে রেডিয়াম দেওয়া ঘড়িটা দেখার
সাহস পাচ্ছি না।
কোনওদিন এরকম হয়নি। ভূতের ভয় আমার কোনওদিন ছিল না। জঙ্গলে
একা গাছের ওপর বসে রাত কাটিয়েছি ভোরবেলা জীবজন্তুর ছবি তুলব বলে।
মাথার
মধ্যে উদ্ভট সব চিন্তা আসছে। ছোটোবেলায় শোনা অনেক ভূতের কাহিনি চোখের সামনে
ভেসে উঠছে।
মনে হচ্ছে এই বুঝি একটা কঙ্কাল আমার গলা চেপে ধরবে। অনেক
চেষ্টা করছি অন্যকিছু ভাবার, কিন্তু কিছুতেই কঙ্কাল
আর মরা ছাড়া আর কিছু মাথায় আসছে না। অপেক্ষা করছি কখন পোর্টার
দু’জন এসে ঘরের দরজায় নক করবে।
আবার
একটা হালকা আওয়াজ হচ্ছে। কেউ যেন পা টেনে টেনে ঘরের কাঠের মেঝেতে হেঁটে
বেড়াচ্ছে ঘরের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। খসখস
করতে করতে আওয়াজটা চৌকির মাঝামাঝি এসে থেমে গেল। টের
পেলাম একটা কিছু আমার পেটের ওপর চেপে বসল। ভারটা লেপের ওপর দিয়ে এগোচ্ছে
আমার গলার দিকে।
তবে
কি এবার আমার শেষ? আমার গলা টিপে ধরবে! প্রাণপণে চেষ্টা করছি চিৎকার করতে। গলা
দিয়ে কোনও শব্দ বের হচ্ছে না। আরও কুঁকড়ে যেতে চাইছি লেপের ভেতরে। আচমকা
হাতে কিছু একটার ছোঁয়া পেলাম। হাত বুলিয়ে টের পেলাম ওটা আমার টর্চ। বালিশের
পাশে লেপের ভেতর রেখে শুয়েছিলাম যাতে ব্যাটারিটা গরম থাকে। মনে
জোর পেলাম।
বোতামটা টিপতে আলোটা জ্বলে উঠল লেপের ভেতর। এক
ঝটকায় লেপটা সরিয়ে ফেললাম শরীরের ওপর থেকে। টর্চের হলদে আলোতে ঘরের
মধ্যে কিছু নজরে পড়ল না। শুধু দেখলাম ঘরের কোনার একটা গর্তে ঢুকে যাচ্ছে
বিশাল মোটা এক ধেড়ে ইঁদুর।
_____
অলঙ্করণঃ
দীপিকা মজুমদার
No comments:
Post a Comment