দুঃসাহসিক উত্তরমেরু অভিযান
অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়
এক
পৃথিবীর মানচিত্রে বরফ ঢাকা
উত্তরমেরু আর দক্ষিণমেরু দেখে সেখানে পা রাখার ইচ্ছে কার না হয়? কিন্তু ক’জনেরই বা
থাকে সেখানে যাওয়ার উপযুক্ত শারীরিক ক্ষমতা আর মানসিক বল! দুটি মেরুতেই ভ্রমণপথ
অতি দুর্গম, পদে পদে বিপদ লুকিয়ে। তবু অজানা দেশ জানা আর চেনার জন্য মানুষের
দুরন্ত প্রয়াস কোনওদিনই থেমে যায়নি।
এবার দেখা যাক, দুই মেরুর
পার্থক্য কী? দক্ষিণমেরু যে বরফের চাদর মোড়া, আসলে তার পুরুত্ব প্রায় দশ হাজার
ফুটের কাছে। সেই বরফের চাদরের নিচে লুকিয়ে আছে পাথুরে জমি। নিকটবর্তী সমুদ্র-উপকূল
প্রায় ৮৫০ মাইল দূরে। অথচ উত্তরমেরুতে আছে ১০-১২ ফুট পুরু বরফের চাদরে মোড়া
সমুদ্র। সমুদ্রপৃষ্ঠের থেকে তার মেঝে গড়ে ১৪০০০ ফুট নিচে। দুই মেরুতেই বরফ কিন্তু
স্থির নয়, চলমান। দক্ষিণমেরুতে বরফের চাদর বছরে ৩০-৪০ মাইল বেগে প্রবাহিত, আর
উত্তরমেরুতে সেই চাদর দিনে ৩-৪ মাইল বেগে ছোটে।
পৃথিবী সূর্যের চারদিকে যে
সমতলে পাক খায়, তার সাথে তার নিজের ঘূর্ণন অক্ষ বেঁকে আছে প্রায় ২৩ ডিগ্রিতে। সেই
কারণে মেরু অঞ্চলে সূর্যের আলো তেরছাভাবে পড়ে। প্রায় ছয় মাস তাই সেখানে রাত, আর বাকি
ছয় মাস দিন। সমুদ্রপৃষ্ঠে বরফের তাপমাত্রা শূন্যের অনেক নিচে হওয়ায় তার সংলগ্ন
বাতাসের তাপমাত্রাও কম। তাই ঠাণ্ডা ভারী বাতাস বায়ুমণ্ডলে বেশি চাপের সৃষ্টি করে।
আর্কটিক মহাসাগরের উপকূলবর্তী এলাকাগুলিতে তাপমাত্রা অপেক্ষাকৃত বেশি থাকায় সেখানকার
বাতাস হালকা। তাই বায়ুমণ্ডলে বাতাসের চাপ কম। আর্কটিক মহাসাগরের উচ্চচাপ অঞ্চল
থেকে বাতাস উপকূলবর্তী নিম্নচাপ অঞ্চলে প্রবল বেগে বয়ে চলে। এর
সাথে পৃথিবীর আক্ষিকগতির দরুন বাতাস উত্তর-পূর্ব দিকে বইতে
থাকে। তুষারঝড় তাই উত্তরমেরুর নিত্যসঙ্গী।
আর্কটিক মহাসাগরের বুকে সাহস
সঞ্চয় করে আঠারো শতক থেকে বহু রোমাঞ্চ পাগল মানুষ চেষ্টা করেছেন উত্তরমেরুতে প্রথম
পদক্ষেপের ঐতিহাসিক নজির রেখে যেতে। অনেকে মৃত্যু বরণ করেছেন, হার স্বীকার করেননি।
মানুষের সভ্যতার ইতিহাস তাদের চিরকাল স্মরণ করবে। আজকের গল্প উত্তরমেরুতে এক দুঃসাহসিক
অভিযান নিয়ে।
১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে নরওয়েতে এক
অসম সাহসী জীববিজ্ঞানী ফ্রিজফনান্সেন ও তার পাঁচ সঙ্গী স্লেজগাড়ির সাহায্য নিয়ে
দেশ ছেড়ে পাড়ি দেন বরফের দেশ গ্রিনল্যান্ডে। উদ্দেশ্য ছিল তিমি আর সিলমাছ শিকার।
এই অভিযানের আরও একটি উদ্দেশ্য ছিল, প্রাণীবিজ্ঞানের উপর তথ্য সংগ্রহ। নান্সেন সেই
সময়ে অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছিলেন। এই অভিযানে সাইবেরিয়া থেকে ভেসে আসা
কাঠের টুকরো দেখতে পেয়ে তিনি অনুমান করেন, বরফের সাগর নিশ্চয় গতিশীল, আর তার
প্রবাহ পূর্ব থেকে পশ্চিমদিকে। তখনও পর্যন্ত ধারণা ছিল উত্তরমেরুর বরফ স্থির,
গতিশীল নয়। আরও অনেক ভ্রান্ত ধারণার মধ্যে এটিও মনে করা হত, এখানে আছে অচেনা অজানা
দ্বীপ, অজানা মানুষ ও প্রাণী।
১৮৮০ সালে সাইবেরিয়া থেকে
রওনা দেয় ‘জেনেট’ জাহাজ। উদ্দেশ্য, উত্তরমেরু অভিযান। কিন্তু সে অভিযান অসফল হয়। আর্কটিক
মহাসাগরের জমাটবাঁধা বরফের চাপে জাহাজ ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। অভিযাত্রীদের
মৃত্যু হয়। প্রায় চার বছর পর ১৮৮৪ সালে গ্রিনল্যান্ডে জাহাজের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার
হয়। নান্সেনের সিদ্ধান্ত প্রমাণিত হয়।
দুই
নান্সেনের পর্যবেক্ষণ
বৈপ্লবিক ছিল। প্রচলিত ধারণার ভিত্তি নাড়িয়ে দিয়ে তিনি দাবি করেন, উত্তরমেরুর
আর্কটিক মহাসাগরের পূর্ব থেকে পশ্চিম অভিমুখি গতি বরফের চাদরকে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে
নিরন্তর। সিদ্ধান্ত করে দিয়েই থেমে যাবার পাত্র তিনি ছিলেন না। হাতেনাতে প্রমাণ না
পেয়ে নিস্তার নেই। তাই উত্তরমেরু অভিযানে ভাসমান বরফের গতিকে কাজে লাগিয়ে উত্তরমেরু
অভিযানের পরিকল্পনা শুরু করে দিলেন। ঠিক সেই সময়ে জেনেট জাহাজের ক্যাপ্টেনের লেখা
ডায়েরি উদ্ধার হয় নরওয়ের সমুদ্র উপকূলে। নান্সেনের সিদ্ধান্ত আরও জোরালো যুক্তি
পেয়ে বৈজ্ঞানিক মহলে সাড়া ফেলে দেয়।
নান্সেন এমন একটা জাহাজ
বানাবার পরিকল্পনা করেন, যে জাহাজ বরফের চাপে ভেঙে যাবে না। কীভাবে বানানো যায় সে
জাহাজ? নান্সেন তো আর ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন প্রাণীবিদ। কিন্তু তার
মাথাটা ছিল বেজায় উর্বর। খুঁজে বার করলেন জাহাজ বানাবার
ওস্তাদ কারিগর কলিন আর্চারকে। বরফের দেশে
চলাফেরা করতে পারে এমন নৌকো বা জাহাজ বানাবার জন্য নরওয়ে ও ইংল্যান্ডে আর্চারের
বেশ নামডাক ছিল। নান্সেন তার সাথে পরামর্শ করে ১২ জন নাবিক, চার বছরের জন্য
প্রয়োজনীয় কয়লা, খাবারদাবার, স্লেজগাড়ি, যন্ত্রপাতিবোঝাই জাহাজের নকশা বানিয়ে
ফেললেন। ওজন স্থির করা হল ১৭০ টন। বরফের সমুদ্রে পাড়ি দিতে হালকা জাহাজই
সুবিধাজনক।
জাহাজের নকশা বানালেই তো হল
না। তার জন্য চাই অর্থ। একটা শক্তিশালী জাহাজ বানাতে খরচ অনেক। জাহাজ বানাবার খরচ
আর অভিযানের জন্য নান্সেন আবেদন করলেন নরওয়ে সরকারের কাছে। যা পাওয়া গেল তার
দ্বিগুণ খরচ হয়ে গেল জাহাজ বানাতে। নরওয়ের রাজার তহবিল থেকে কিছু অর্থ জোগাড় হল।
সাধারণ মানুষ থেকে উচ্চবিত্ত, সবার কাছে আবেদন করে অর্থ জুটিয়ে ফেললেন নান্সেন।
জাহাজের খোল তৈরি হল গোলাকৃতি,
মসৃণ। বরফের হিমশীতল থাবা মসৃণ জাহাজের গায়ে যাতে চেপে বসতে না পারে সেজন্য এমন
আকার দেওয়ার প্রয়োজন ছিল। জাহাজের নিচের অংশ করে দেওয়া হল সমতল যাতে সে বরফের চাপে
একদিকে কাত না হয়ে যায়। চাপ সহ্য করতে পারার ক্ষমতা বাড়াবার জন্য শক্ত কাঠের চারটি
স্তর দিয়ে তৈরি জাহাজের দৈর্ঘ্য হল ১২৮ ফুট। এরপর তাতে
লাগিয়ে দেওয়া হল ২২০ অশ্বশক্তির স্টিম ইঞ্জিন। ছ’টি বাসোপযোগী কেবিন তৈরি হল।
স্লেজগাড়ি রাখবার আর স্লেজ টানবার জন্য ব্যবহৃত কুকুরদের স্থান করে দেওয়া হল
জাহাজে। কিন্তু জাহাজের ওজন গেল বেড়ে। মোট ওজন হল ৩০৭ টন, পরিকল্পিত ওজনের
দ্বিগুণেরও বেশি। আটটি ছোটোবড়ো নৌকা তৈরি করে রাখা হল জাহাজে। জাহাজের নাম দেওয়া
হল ‘ফ্র্যাম’, যার অর্থ - অগ্রগতি।
জাহাজে ডায়নামোচালিত বিদ্যুৎশক্তির
ব্যবস্থা হল। কিন্তু চলমান অবস্থাতেই শুধু ডায়নামো চলতে পারে। তাই
বরফবন্দি স্থানু অবস্থায় ডায়নামো কাজ করা বন্ধ করে দেবে বলে আলোর ব্যবস্থা করবার
জন্য লাগানো হল উইন্ডমিল, যা শুধু বাতাসের গতিকে কাজে লাগিয়ে ডায়নামোকে চালু রাখতে
পারবে। তেরো জনের অভিযাত্রী দলের সদস্যরা যে
শুধু শারীরিক দিক দিয়েই পটু ছিলেন তা নয়, তাঁরা ছিলেন বিভিন্ন বিষয়ে পারদর্শী।
আবেদন পত্রের ভিত্তিতে বেছে বেছে এক অতি শক্তিশালী, গুণসম্পন্ন দল তৈরি করেছিলেন
ডক্টর নান্সেন।
ফ্র্যামের ক্যাপ্টেন হলেন,
অটো সেরড্রাপ। তিনি ছিলেন আর্কটিক মহাসাগরের বহু অভিযানের অভিজ্ঞ নাবিক।
স্কট হ্যানসেন দায়িত্ব নিলেন
আবহাওয়া বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান আর চুম্বকীয় ও তথ্য সংগ্রহে।
হেনরিক ব্লেসিং থাকলেন
ডাক্তারির দায়িত্বে আর উদ্ভিদ সম্পর্কীয় তথ্য সংগ্রহে।
অন্তন আমুন্ডসেন হলেন মুখ্য
ইঞ্জিনিয়ার।
বাকি অভিযাত্রীরা অন্যান্য নানা
বিষয়ে বিশেষ জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন।
তিন
১৮৯৩ সালের জুন মাসের ২৪
তারিখে অনেক মানুষের শুভেচ্ছা, ভালোবাসা সম্বল করে অসীম সাহসিক অভিযাত্রী দল নরওয়ের
বারজেন উপকূল ছেড়ে পাড়ি দিল উত্তরমেরুর উদ্দেশ্যে। পাড়ি দেবার পর প্রথম কাজ হল
জ্বালানির জন্য কয়লা, প্রবল ঠাণ্ডা থেকে বাঁচার জন্য রেইন ডিয়ারের চামড়া আর উল
দিয়ে তৈরি পোশাক সংগ্রহ। বরফের মধ্যে স্লেজগাড়ি টেনে নিয়ে যাবার জন্য শক্তিশালী তিরিশটি
কুকুর তুলে নেওয়া হল জাহাজে।
জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে
আর্কটিক মহাসাগরে পড়ল ফ্র্যাম। প্রথমেই মোকাবেলা করতে হল ঘন কুয়াশার সাথে।
চতুর্দিকে ধূসর কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়ে শুধুমাত্র কম্পাস দেখে এগিয়ে চলল জাহাজ।
কুয়াশা কেটে যেতে সমুদ্রে ভেসে আসা হিমশৈলের দেখা পাওয়া গেল।
বারজেন উপকূল ছেড়ে রওনা দিল ফ্র্যাম
(ছবি ঋণ –Farthest
North by Dr. Fridtjof Nansen, Volume I)
প্রায় তিরিশ মাইল পাড়ি দেওয়ার
পর ফ্র্যামের ইঞ্জিন গেল বিগড়ে। প্রচুর পরিশ্রম করে তাকে চালু করে শুরু হল যাত্রা।
এখানে তারা দেখা পেলেন লম্বা লেজযুক্ত হাঁসের যা কেবলমাত্র আর্কটিক মহাসাগরেই
দেখতে পাওয়া যায়। সুস্বাদু হাঁসের মাংসে বেশ ভালোই
ভুরিভোজ হল। সাইবেরিয়া উপকূলের চোখ জুড়ানো অপূর্ব
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মাতাল হয়ে অভিযাত্রীরা জাহাজ ছেড়ে নৌকাবিহারে বেরিয়ে পড়লেন।
সবুজ ঘাসের কার্পেটজুড়ে অসংখ্য নানারঙের ফুল ফুটে। বলগা হরিণ তার ছানাপোনা নিয়ে উঁকি
দিয়ে অভিযাত্রী দলকে দেখে নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।
সন্ধে নেমে আসতেই ঝাঁকে ঝাঁকে শ্বেত পেঁচারা ঝাড়ের আড়াল থেকে খুদে কালো কালো চোখ
দিয়ে বিস্ময়ে অভিযাত্রীদের দেখতে লাগল। নরম ঘাসের
প্রাকৃতিক গালিচায় আগুন জ্বালিয়ে চলল ক্যাম্প ফায়ার। সে
এক অপার্থিব জগত যেন!
আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে
ঊগর প্রণালী ত্যাগ করে ভয়ংকর কারা সমুদ্রে পড়ল জাহাজ। ঘন
কুয়াশায় ফ্র্যামের চালক-কেবিন থেকে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। জাহাজ সামনে এগিয়ে নিয়ে
যাবার ঝুঁকি আছে দেখে নান্সেন নিজে ফ্র্যামের আগে পথ দেখাতে নৌকা বাইলেন।
কারা সমুদ্রে ভেসে আসা তুষারস্তর জাহাজের অগ্রগতি দুষ্কর করে তুলল। ইয়াল্মাল উপকূলে
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের টানে অভিযাত্রী দল সমুদ্রসৈকতে ক্যাম্প করে রাত কাটাল।
খাওয়াদাওয়া, গল্পগুজব আর গানবাজনায় মেতে উঠল তারা।
নতুন এক দ্বীপ আবিষ্কার হল
এখানে। ক্যাপ্টেন সেরড্রাপই প্রথম দ্বীপটিকে দেখতে পান। তাই নাম রাখা হল সেরড্রাপ
দ্বীপ। সাইবেরিয়ার প্রত্যন্ত উত্তরদিকে এসে তারা বুঝতে পারলেন, কোনওদিনই এখানে
মানুষের পদচিহ্ন পড়েনি। তাই ম্যাপেও সেই তুষারাচ্ছন্ন ভূমি সনাক্ত করা হয়নি।
সেপ্টেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে
ফ্র্যাম পৌঁছল ৭৮ ডিগ্রি উত্তরে। আরও অনেক পথ
বাকি। প্রতিদিন শব্দের প্রতিফলন ব্যবহার করে জলের গভীরতা মাপা হচ্ছে। যত গভীরতা কম,
তত সমুদ্র উপকূলের কাছে অবস্থান। নান্সেন ঠিক করেছিলেন, কিছুতেই জাহাজকে উপকূলের
কাছে নিয়ে যাওয়া চলবে না। তাতে বরফ ও শক্ত পাথরের মধ্যে জাহাজ আটকে যাওয়ার সম্ভাবনা।
২৫শে সেপ্টেম্বর ১৮৯৩। রাতে
বোঝা গেল ফ্র্যাম তুষারবন্দি হয়েছে। বরফের চাপে ফ্র্যাম ভেঙে তো গেলই না এবং
জাহাজের নির্মাণশৈলীর গুণবত্তা প্রথম পরীক্ষা পার হয়ে গেল। ফ্র্যাম
এবার উত্তরমুখী অভিযান চালাল।
অক্টোবর মাসের শীতে আরও ভয়ংকর
হয়ে উঠল যাত্রা। ফ্র্যামের উপর দিনে দু’বার প্রবল চাপ আসতে লাগল। তিন-চার ঘণ্টা সে
চাপ বহাল থাকত। বাকি সময় বরফের চাপ হয়ে যেত শিথিল। এর
কারণ ছিল সমুদ্রের জোয়ারভাটা। জোয়ারের সময় বরফের চাপ বৃদ্ধি হত, আর ভাটার সময়
শিথিল। জোয়ারের সময় বরফের স্তরে চাপ পড়ে বজ্রপাতের মতো শব্দ শুরু হত। প্রথমে
দূর থেকে, তারপর কাছে এসে সেই শব্দ ভীষণভাবে চমকে দিত। পায়ের
তলায় বরফের স্তর ভূমিকম্পের মতো থরথর করে কাঁপত। মনে হতো পাশের বরফের দেওয়াল শব্দ
করে ভেঙে পড়ছে। স্তূপাকৃতি বরফের পনেরো-কুড়ি ফুট উঁচু স্তর আচমকা ভেঙে আছড়ে পড়ত
জাহাজের ডেকে। কখনও কখনও বরফ ফেটে ভেঙে পড়বার শব্দ এত তীব্র হত, অভিযাত্রীরা
নিজেদের কথোপকথন শুনতে পেতেন না। রাতে সেই
ভীষণ শব্দে ঘুম আসত না।
এমনই এক রাতে হঠাৎ বরফের উপর
কুকুরের ক্রমাগত ডাক শুনে সবার ঘুম ভেঙে গেল। টর্চের
আলোয় দেখা গেল, সাদা রঙের এক জন্তু বরফের স্তুপের উপর দিয়ে হেঁটে এসে ফ্র্যামে ওঠার
চেষ্টা করছে। কাছে আসতেই বোঝা গেল, সেটা একটা শ্বেত ভল্লুক। একটু পরে নজরে এল, একটা
নয়, মোট তিনটে ভল্লুক জাহাজ বেয়ে উঠে আসছে। অভিযাত্রীরা
গুলি ছুড়ে একটাকে ধরাশায়ী করে দিলেন। জাহাজ থেকে নামতেই দেখা গেল সে একটা ছোটো
ভল্লুক। ধাড়িদুটো পালিয়েছে। মৃত শ্বেত ভল্লুকটিকে জাহাজে তুলে নিয়ে আসা হল। মা আর
বাবা ভল্লুক পগারপার। মধ্যে থেকে অভিযাত্রীদের দুটি শক্তিশালী কুকুর নিরুদ্দেশ হয়ে
গেল। তাদের আর খুঁজে পাওয়া গেল না। তারা শ্বেত ভল্লুকদের থাবার হাত থেকে বাঁচতে
দৌড় লাগিয়ে আর জাহাজে ফিরে আসতে পারেনি।
বরফে বন্দি ফ্র্যাম
(ছবি ঋণ –Farthest
North by Dr. Fridtjof Nansen, Volume II)
অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে
অভিযাত্রীদের মনে হতে লাগল তাঁরা যেন এক বিশাল বরফঘেরা গর্তে পড়ে গেছেন, যার হাত
থেকে নিস্তার নেই। ফ্র্যাম যেন একই জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছে। জীবন হয়ে উঠল একঘেয়ে,
অসহ্য। হঠাৎ একদিন পশ্চিম আকাশের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে নীল রঙের আগুনের
গোলা ছুটে গেল। আলোয় আলো হয়ে গেল চারদিক। যেন স্বর্গীয় আলোর ছটা। জাহাজের রেলিংয়ে
ভর করে সবাই দেখতে লাগল উল্কাপাত। কিছুটা হলেও
একঘেয়েমি কেটে গেল।
নভেম্বর মাস। ফ্র্যামের
অবস্থানের পরিবর্তন নেই। বিনোদনের মধ্যে জাহাজের ডেক থেকে অরোরা বরিওয়লিস দেখা। অপূর্ব সেই আলোর ছটা দেখতে দেখতে কেটে যেত
ঘণ্টার পর ঘণ্টা। আকাশের একদিক থেকে আর একদিকে বর্ণময় চোখ ধাঁধানো আলোর দ্যুতি। উত্তরমেরুতে
পৃথিবীর চুম্বক রেখা সরাসরি লম্ব বরাবর প্রবেশ করে। সূর্য থেকে ধেয়ে আসা কসমিক কণা
সেই চুম্বকীয় ক্ষেত্রে প্রবেশ করে বৃত্তাকারে ঘুরতে থাকে। বাতাসে উপস্থিত
অক্সিজেন, নাইট্রোজেন আর অন্য গ্যাসের সাথে কসমিক কণার ঘর্ষণে উৎপন্ন হয় নানা
বর্ণের আলোকছটা। সেই আলোর রেখা বরফের উপর প্রতিফলিত হয়ে অপূর্ব দৃশ্যপট তৈরি করে। এই
বর্ণময় আলোর খেলা অরোরা বরিওয়লিস নামে পরিচিত।
আরেক বিচিত্র আলোর দৃশ্য তাঁরা দেখতে পান। বাতাসে ভাসমান বরফের ক্রিস্টালে সূর্য
আর চাঁদের আলো পড়ে রঙিন বলয়ের সৃষ্টি, যা তখনও পর্যন্ত ছিল মানুষের অজানা। ইতিমধ্যে
একদিন সূর্যগ্রহণ হল। অভিযাত্রী দল তুষারভূমিতে সূর্যগ্রহণের বৈজ্ঞানিক তথ্য
সংগ্রহ করলেন।
সূর্যগ্রহণের পর্যবেক্ষণে জোহান্সেন,
নান্সেন ও হ্যান্সেন (বাম দিক থেকে)
(ছবি ঋণ –Farthest
North by Dr. Fridtjof Nansen, Volume I)
ডিসেম্বর মাসে তাপমাত্রা
শূন্যের ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে গেল। চারদিকে কুয়াশা, ঘন মেঘে ঢাকা আকাশ, দিনের
বেলাতেও অন্ধকার। একদিন রাতের অন্ধকারে কুকুরেরা খুব জোরে জোরে ডাকতে সবাই
সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল। বাইরে গাঢ় অন্ধকারে দেখা গেল না কিছুই। কিন্তু কুকুরের ডাক
বেড়ে চলল। আবার শ্বেত ভল্লুকের আক্রমণ। দুটি কুকুর মারা গেল। অতিকষ্টে
গুলি চালিয়ে ভল্লুক যাও বা মারা গেল, অভিযাত্রীদের একজন ভল্লুকের আক্রমণে ভয়াবহভাবে
জখম হলেন।
জানুয়ারি মাসে তাপমাত্রা নেমে
গেল ৪০ ডিগ্রির নিচে। হাওয়ার বেগ বেড়ে গেল। আবহাওয়ার তথ্য সংগ্রহ করতে জোহান্সেনকে
বরফের উপর যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করতে হত। তাঁর হাতে
বরফের থাবা বসল, ফ্রস্ট বাইটে আক্রান্ত হলেন তিনি। ইতিমধ্যে অন্ধকারে একদিন সবাই
যখন জাহাজ ছেড়ে বরফে পায়চারি করছেন, অন্ধকারে তাদের সামনে বরফের ফাটল দিয়ে মাথা
বার করল এক অতিকায় সিন্ধুঘোটক। এদিকে
সেদিনই পরীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে বরফের চাদরের তলায় কয়েকশো মিটারের ভেতরে সমুদ্রপৃষ্ঠ
নেই। হতে পারে তার তলদেশ হাজার মিটার নিচে বা তার চাইতে বেশি। প্রাণ
বাঁচাতে সবাই মিলে জাহাজের দিকে দৌড়তে লাগলেন। কোনও ফাটলে পড়ে গিয়ে তৎক্ষণাৎ
সমুদ্রের নিচে সলিলসমাধি হয়ে যেতে পারে। সিন্ধুঘোটক তাড়া করে আসছে, কখনও তার মাথা
দেখা যায়, আবার পরমুহূর্তে সে অদৃশ্য। যাই হোক, প্রাণ নিয়ে সে যাত্রা সবাই নিরাপদে
জাহাজে ফিরে আসতে পেরেছিলেন এই যা রক্ষে।
চার
বরফের উপর দলবেঁধে ঘুরতে
যাওয়া, শিকার করা, যন্ত্রপাতির সাহায্যে বৈজ্ঞানিক তথ্য সংগ্রহ করা, বই পড়া, গান
গাওয়া, তাস খেলা সবই একসময় অসহ্য হয়ে উঠল। নান্সেন তাঁর ডায়েরিতে লিখলেন, “এমন
একটা কিছু ঘটতে পারে না, যাতে এই ভয়ংকর একঘেয়েমি কেটে যায়? একটা হারিকেন
(সামুদ্রিক ঝড়) এসে সামনের এই বরফের দেওয়ালকে ভেঙে দিয়ে আমাদের রাস্তা করে দিতে
পারে না?”
সময় কাটানোর জন্য জাহাজে
খবরের কাগজ চালু করা হল। নাম দেওয়া হল ফ্র্যামসজ। অভিযাত্রীরা নিজেরাই লিখতেন,
নিজেরাই পড়তেন। সেই কাগজে তারা রোজনামচা, ব্যঙ্গচিত্র, কবিতা, রম্যরচনা লিখতে
থাকলেন। কিছুদিন পর সেটাও একঘেয়ে হয়ে উঠল। নিজেদের মধ্যে ছোটোখাটো ঝগড়া লেগেই
থাকত। অবসাদ গ্রাস করল সবাইকে। এমনকি যে কুকুরগুলো শিকল দিয়ে বরফের উপর বাঁধা
থাকত, তারাও একঘেয়েমির শিকার হয়ে ঝগড়া করতে লাগল নিজেদের মধ্যে। একদিন অপেক্ষাকৃত
নিরীহ কুকুরটিকে বলশালী তিনটে কুকুর ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলল। সেদিন
ছিল অভিযাত্রীদের জন্য বড়ো দুঃখের।
ফেব্রুয়ারি মাসে কম্পাসে দেখা
গেল ফ্র্যাম ৮০ ডিগ্রি উত্তরে চলে এসেছে। সবাই খুব উৎফুল্ল। এদিকে শুরু হল ঠাণ্ডার
ভয়ংকর দাপট। তাপমাত্রা মাইনাস ৫০ ডিগ্রির আশেপাশে ঘোরাফেরা করছে। ঠাণ্ডায় বাইরে
বেরনো দায়। বেশিরভাগ সময় জাহাজের সেলুনে শুয়ে বসে কাটে সময়।
মার্চ মাস আসতেই একদিন আলোর
আভা দেখা গেল দিগন্তে, তাও মাত্র কিছুক্ষণের জন্য। সূর্যদেব কিন্তু উঁকি দেননি
তখনও। শুধু তার আগমনের পূর্বাভাস পাওয়া
যাচ্ছে তখন। একটানা রাতের অবসান হতে চলেছে। আগত বসন্তকাল। জাহাজের ডেকে দাঁড়ালেই
অভূতপূর্ব গাঢ় নীল আকাশ দেখা যায়। সে আকাশের ছায়া পড়ে বরফের উপর। নানাবর্ণের রঙে
ভরে যায় চতুর্দিক।
এমন অপূর্ব প্রকৃতির শোভা
দেখে কি আর জাহাজের খোলে বন্দি থাকা যায়? তাই নান্সেন একদিন বেরিয়ে পড়লেন স্লেজগাড়িতে
চেপে। চার কুকুরে টানা সেই স্লেজগাড়ি প্রকৃতির রসাস্বাদনের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিল। আর
তিনি তো শুধু প্রকৃতিপ্রেমী ছিলেন না, একজন বৈজ্ঞানিকও বটে। তাই এই আর্কটিক
মহাসাগরে ভেসে চলা তুষারস্তরে ড্রিলিং মেশিন দিয়ে ফুটো করে দেখলেন সেখানে জমাটবাঁধা
তুষারস্তরের গভীরতা পাঁচ থেকে ছয় ফুট। এবার প্রশ্ন উঠল ফ্র্যামের নিচে কত গভীরতা
পর্যন্ত বরফ আছে জানতে হবে। তাই তার চারপাশে ড্রিল করে দেখা গেল প্রায় কুড়ি-তিরিশ
ফুট শক্ত বরফের আস্তরণের ভিতে দাঁড়িয়ে আছে সে। শুধু ড্রিল করেই বৈজ্ঞানিকরা
ক্ষান্ত হলেন না। বরফের বিভিন্ন স্তরে তাপমাত্রাও মাপা হল।
মার্চ-এপ্রিল মাস আসতেই শীতের
দাপট কমতে লাগল। দিনের আলো আগের দিনগুলোর তুলনায়
বেশীক্ষণ থাকে। বসন্ত ঋতু এসে গেলেও বরফের সমুদ্রে তার আগমনবার্তা তেমনভাবে বোঝা
গেল না। কারণ, বসন্তের পশুপাখি কোথায় আসবে সেই তুষার রাজ্যে! কেবল তাপমাত্রা জানান
দেয়, শীতের শেষ, বসন্ত অস্তগামী, গ্রীষ্মের আগমন ঘটতে চলেছে। রান্নাঘরের ছাদ থেকে
যখন বরফের পুরু স্তর গলতে শুরু করল তখন বোঝা গেল, গ্রীষ্মকাল এসে গেছে। হাতে
দস্তানা না পড়েই বন্দুক তুলে নেওয়া যাচ্ছে। ইতিমধ্যে পরীক্ষানিরীক্ষা করে জানা
গেছে, উত্তরমেরুর ধারে কাছে কোথাও জমি নেই। আছে শুধু
বরফ আর বরফ। আর সমুদ্রতল প্রায় দুই থেকে তিন কিলোমিটার নিচে। এই পর্যবেক্ষণটাই ছিল
ফ্রাম অভিযাত্রীদের সবচাইতে বড়ো কৃতিত্ব।
স্লেজ ভ্রমণের প্রস্তুতি
(ছবি ঋণ –Farthest
North by Dr. Fridtjof Nansen, Volume I)
পাখি দেখা গেল হঠাৎ একদিন।
একটা দুটো করে সংখ্যায় তারা বাড়তে লাগল। অভিযাত্রীরা
বিস্মিত। আটটা পাখি মারা হল বন্দুক দিয়ে। তাদের ভালো করে পরীক্ষা করেও বোঝা গেল না
কোথা থেকেই বা তারা এসেছিল, কোথায় বা যেতে চেয়েছিল। জীববিজ্ঞানী নান্সেন তাদের গতিবিধি
সম্পর্কে নানারকম বৈজ্ঞানিক তথ্য সংগ্রহ করে ফেললেন।
গ্রীষ্মকালে আরও একটা চমকপ্রদ
ব্যাপার দেখা গেল। বরফের চাপের উপস্থিতি থাকলেও তার আওয়াজ থেমে গেল
প্রায়। এর কারণ খতিয়ে দেখে নান্সেন সিদ্ধান্তে এলেন যে, কম তাপমাত্রার বরফ
স্থিতিস্থাপক হয়ে যায়, কিন্তু বেশি তাপমাত্রার বরফ হয় ভঙ্গুর। স্থিতিস্থাপক হওয়ায়
চাপ বৃদ্ধি হলেও বরফ ভেঙে যায় না শব্দ করে। জায়গায় জায়গায় ভাসমান বরফের স্তরের উপর
পরিষ্কার জলের হ্রদ দেখা গেল। আসলে
পরিস্রুত জল লবণাক্ত জলের চাইতে হালকা হওয়ায় আর্কটিক মহাসাগরে সেই জল উপরের দিকে
থাকে। ভারী লবণাক্ত জল নিচের দিকে জমাট বেঁধে যায়। হালকা পরিস্রুত জল বরফের ফাটল
দিয়ে উপরে উঠে এসে হ্রদের সৃষ্টি করে। এই জল অভিযাত্রীরা রান্না ও খাবার জল হিসাবে
ব্যবহার করলেন।
পাঁচ
প্রকৃতির ঋতুচক্র সম্পূর্ণ হল। একবছর
কেটে গেল অভিযাত্রী দলের। শরৎকাল এসে যেতেই আবার ঠাণ্ডা বাড়তে লাগল। দিনের
আলো কম সময়ের জন্য থাকে। সামনে আগত অন্ধকার, শীতের একটানা রাত। ফ্র্যাম
গুটি গুটি মাত্র ৮২ ডিগ্রি উত্তর পর্যন্ত পৌঁছেছে। এবার নান্সেন অঙ্ক কষে দেখলেন
যে তাঁরা উত্তরমেরুর সমান্তরালে চলেছেন। হাওয়া অনুকূল হলে হয়তো নরওয়ে পৌঁছানো
যাবে, কিন্তু অধরা রয়ে যাবে উত্তরমেরু জয়ের স্বপ্ন। তাই আলোচনার মাধ্যমে স্থির করা
হল, শীত এসে যাওয়ার আগেই দুইজনের অভিযাত্রী দল জাহাজ ছেড়ে পাড়ি দেবে। আরও
৪৯০ মাইল বাকি উত্তরমেরুতে পৌঁছতে। আটাশটি
কুকুর আর পঞ্চাশ দিনের উপযুক্ত খাবারদাবার আর নিরীক্ষণের যন্ত্রপাতি থাকবে সঙ্গে। বাকি
অভিযাত্রী দলের সদস্যরা ফ্র্যামে থেকেই বৈজ্ঞানিক তথ্য সংগ্রহে চালিয়ে যাবেন। যাত্রা
হবে কুকুরে টানা স্লেজে চেপে।
যাত্রা শুরু হল নির্ধারিত
দিনে। নান্সেনের সাথে জোহান্সন সেই বিপদসংকুল যাত্রার সঙ্গী হলেন। কিন্তু পরপর দু’বার
বিভিন্ন কারণে খানিকদূর এগিয়েও যাত্রা স্থগিত রেখে ফিরে আসতে হল জাহাজে। অবশেষে
১৪ই মার্চ ১৮৯৪ সালে পাকাপাকিভাবে স্লেজে চেপে দুই অভিযাত্রী তুষারাচ্ছন্ন দুর্গম
যাত্রা শুরু করলেন।
তাপমাত্রা ক্রমশ শূন্যের নিচে
নেমে গেল। একটানা দশ ঘণ্টা যাত্রার পর বিশ্রাম
নিতেন নান্সেন আর জোহান্সেন। রাতের ভয়াবহ
শীতে স্লিপিং ব্যাগের মধ্যে শরীর প্রবেশ করিয়ে মনে হত, ফ্র্যামের ভেতরের আরামের
জীবন এর চাইতে ঢের বেশি ভালো ছিল। প্রতিদিন মারাত্মক ফ্রস্ট বাইটের থেকে নিজেকে
বাঁচিয়ে চলা বরফের মরুভূমিতে এক অতি দুষ্কর কাজ। তুষারপর্বত, অসমতল তুষারভূমি দিয়ে
কখনও কখনও স্লেজ ঠেলতে হত নান্সেন আর জোহান্সেনকে। ক্লান্ত শরীর দিনান্তে ঢলে পড়ত
খাবার প্লেটের উপর। আর খাবার বলতে সিদ্ধ আলু ও মাংস।
এপ্রিল মাসে সূর্যদেব তাপ
ছড়াতে শুরু করলেন। দিনের তাপমাত্রা বাড়ার সাথে সাথে বরফ গলে গিয়ে পথ আরও অমসৃণ আর
দুর্গম হয়ে উঠল। হঠাৎ বরফ গলে কোথাও খোলা সমুদ্রের জল দেখা যায়, তো কোথাও আবার
বরফের চাঁই পথ অবরোধ করে দেয়। ৮ই এপ্রিল কম্পাস দেখাল অভিযাত্রীদের অবস্থান ৮৫
ডিগ্রি উত্তর। কিন্তু কিছুদিন পর দেখা গেল তাঁরা আবার ৮২ ডিগ্রি উত্তরে। এর অর্থ,
পরিকল্পনা অনুযায়ী এগোনো যায়নি। তাদের পায়ের নিচে ভাসমান বরফের স্তর দক্ষিণে পাড়ি
জমিয়েছে। আর্কটিক মহাসাগরের দুর্বোধ্য স্রোত বরফের সাথে তাদেরও ভাসিয়ে নিয়ে গেছে
উত্তরমেরু থেকে দূরে।
এবার অভিযাত্রীরা বুঝে গেলেন,
উত্তরমেরু পৌঁছানোর আশা ত্যাগ করতে তাঁরা বাধ্য। হঠাৎ একদিন এক শেয়াল বরফের ঢিপির
পেছনে উঁকি দিতেই তাঁরা অনুমান করলেন সমুদ্র-উপকূল অনতিদূরেই। অবসন্ন শরীর নিয়ে
তাঁরা যেন একটু বেশিই উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন। মাথার উপর সিগাল পাখিদের দেখা গেলেও
তাদের বন্দুক চালিয়ে শিকার করতে গিয়ে গুলির অপচয় হল, পাখি মারা গেল না। কিন্তু
খাবার ভাণ্ডার ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে। পঞ্চাশ দিনের খাবারের মজুত ভাণ্ডার, একশো দিনের
উপর ব্যবহার করতে হয়েছে কম করে খেয়ে। নান্সেন ও জোহান্সেন দু’জনেরই অল্পাহারে শরীর
অবসন্ন। ইতিমধ্যে একে একে কুকুরেরা ঠাণ্ডায় ও পথশ্রমে মারা গেছে। কুকুরদের জন্য
মজুত খাবারের ভাণ্ডারে টান পড়েছে। মাত্র গুটিকতক কুকুর বেঁচে আছে।
জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে বহু
ঈপ্সিত ফ্র্যাঞ্জ জোসেফ ল্যান্ডের দেখা পাওয়া গেল। কিন্তু
স্লেজ আর টেনে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হল না। জায়গায় জায়গায় বরফের ফাটল, নরম পাতলা
আস্তরণ ভেদ করে কোথাও জল দেখা যায়, কোথাও আবার শক্ত পুরনো বরফের চাঁই পথ অবরুদ্ধ
করে দেয়। এদিকে এমন খোলা জলপথ পাওয়া যাচ্ছে না, যাতে কায়াক নামিয়ে উপকূলে পৌঁছানো
যায়। সঙ্গী কুকুরদের মধ্যে মাত্র দুটি তখন বেঁচে। কায়াকের উপর স্লেজ, খাবারের
ভাণ্ডার আর যন্ত্রপাতি চাপিয়ে দেখা গেল ওজন বেশি হয়ে কায়াক ডুবে বা উলটে যাওয়ার
সম্ভাবনা আছে। খাদ্য পরিত্যাগ করা যাবে না। তাই পরিত্যাগ করতে হল বেঁচে থাকা দুটি
কুকুরকেই। দুটি কায়াকে মালপত্র চাপিয়ে তাঁরা তীরে নামার চেষ্টা করলেন। সেটা খুব
সহজ কাজ ছিল না।
প্রায় সপ্তাহ খানেক কেটে
যাবার পর নান্সেন ও জোহান্সেন সমুদ্রের তীরে নামতে পারলেন। কোনওরকমে তীরে পৌঁছতে
না পৌঁছতেই সামনে পড়ল সিন্ধুঘোটক। বরফের পাতলা
আস্তরণ ফাটিয়ে সে সোজা এসে কায়াকে ধাক্কা দিল। কায়াক উল্টে যায় আর কি! জোরে কায়াক
চালিয়ে সিন্ধুঘোটকের হাত থেকে প্রাণ বাঁচিয়ে সমুদ্র-তীরে পৌঁছে পাথুরে জমিতে তাঁবু
খাটানো হল। বেজায় হাওয়ায় তাঁবু উড়ে যায় যায়। হঠাৎ চারদিক থেকে সমুদ্রে আরও বরফ এসে
জমা হতে লাগল। উপকূল আর সমুদ্রে পার্থক্য বোঝা দায়।
যে সমুদ্র বেয়ে তাঁরা তীরে পৌঁছেছিলেন সেই জলপথ তুষারে বন্ধ হয়ে গেল।
ক্রমশ প্রতিকূল আবহাওয়ায়
নান্সেন ও জোহান্সন বুঝে গেলেন, বিশ্রাম নিয়ে কায়াকে চেপে নরওয়ে ফেরার রাস্তা
বন্ধ। এদিকে শীতকাল আগত। প্রকৃতি আরও দুর্গম হয়ে উঠবে। তাই সশরীরে বাড়ি ফিরতে গেলে
শীতকাল পর্যন্ত এই সমুদ্র উপকূলেই আস্তানা না গেড়ে উপায় নেই।
ফ্র্যাঞ্জ জোসেফ ল্যান্ডে ক্যাম্পের
প্রস্তুতি
(ছবি ঋণ –Farthest
North by Dr. Fridtjof Nansen, Volume II)
এবার সমস্যা হল খাবারের জোগাড়
করা। মজুত ভাঁড়ার শূন্য প্রায়। কিছু শুকনো রুটি ছাড়া কিছুই প্রায় অবশিষ্ট নেই।
শ্বেত ভল্লুক মেরে কিছুদিনের খাবার আর তেলের রসদ জুটে গেল। শ্বেত
ভল্লুকের শরীরের চর্বি রান্না আর আলো জ্বালানোর কাজে খুব ভালো কাজে আসে। ইতিমধ্যে
ভয়ানক লড়াইয়ের পর দুটি সিন্ধুঘোটক মারতে পারলেন তাঁরা। চামড়া
ছাড়িয়ে বিশালকায় সিন্ধুঘোটকের মাংস আর চর্বি আলাদা করা দু’জন মাত্র মানুষের কাছে
বেশ সমস্যার ছিল।
সামুদ্রিক ঝড়ো হাওয়ায় তাঁবুতে
থাকা অসম্ভব হয়ে উঠল। নান্সেন গ্রিনল্যান্ডে এস্কিমোদের ইগলু দেখেছিলেন। পাথরের চাঁই
সংগ্রহ করে ইগলুদের বাড়ির আদলে তাই দিয়ে ঘর বানিয়ে ফেললেন। মাটির নিচে তিন ফুট জমি
খুঁড়ে ঘরের আয়তন বাড়ানো হল। ফাটল বন্ধ করা হয়ে গেল তুষারের আস্তরণে। ঘরের
ছাদ তৈরি হল সিল্কের তাঁবু দিয়ে। দরজা বানানো হল গায়ের কোট দিয়ে। কিন্তু
দুয়েকদিনে বোঝা গেল হাওয়ায় ঘরের ছাদ উড়ে যাবে। তাই ঠিক হল সিন্ধুঘোটকের চামড়া দিয়ে
বানানো হবে ঘরের ছাদ। যেমন ভাবনা, তেমন কাজ। উপকূলে অনেক পরিশ্রমে তিন-তিনটে
জলহস্তি মারা হল। তাদের চামড়া ছাড়িয়ে নিয়ে ছাদ তৈরি হল। শীতকালীন খাবারের ভাণ্ডার
উপচে পড়ল। একদিন সিন্ধুঘোটকের মাংসের গন্ধে ভল্লুক এসে অর্ধেক মাংস আর চর্বি সাবাড়
করে দিয়ে গেল। কিন্তু সেও কুপোকাত হল বন্দুকের
গুলিতে।
ছয়
শীতকাল এসে যেতেই জীবজন্তুদের
চলাফেরা বন্ধ হয়ে গেল। তারা উপকূল ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে
আস্তানায় চলে যেতে নান্সেন আর জোহান্সেনের কাজ হল রান্না করা, খাওয়া, আর শুয়ে
ঘুমানো। শিকার করা জন্তুদের গায়ের চামড়া ছাড়িয়ে, মাসের পর মাস স্নান না করে,
তাঁদের শরীর ও পোশাক তখন চর্বি আর তেলে জুবজুবে। জামাকাপড়ের দৈন্য দশা দেখে কম্বল
কেটে বানানো হল পোশাক। ভল্লুক আর সিন্ধুঘোটকের চামড়া দিয়ে বানানো হল জুতো। গায়ে
দিয়ে মন্দ লাগল না। জলপথে নরওয়ে ফিরতে গেলে ভদ্রস্থ পোশাকের বেজায় প্রয়োজন ছিল যে!
এদিকে বাইরে অন্ধকার থাবা
গেড়ে বসেছে। সূর্যদেবের দেখা নেই ছয় মাস। ঘরের মধ্যে চর্বি পুড়িয়ে আলো জ্বালানোর
ফলে সবসময় ধোঁয়ায় ভরে থাকে। চোখ জ্বালা করে। বই সাথে আছে, পড়বার উপায় নেই।
প্রদীপের অনুজ্জ্বল আলোয় চোখ ব্যাথা হয়ে যায়। ডায়েরিতে কিছু লিখতে গেলে জামার
আস্তিনে জমে থাকা কালি সাদা পাতাকে নোংরা করে দেয়। মাঝে মধ্যে হাওয়ার প্রকোপ কম
হলে একটু আধটু কাছেপিঠে ঘুরে আসা ছাড়া আর কোনও কাজ না থাকায় জীবন একসময় অসহ্য হয়ে
উঠল। প্রতীক্ষা, কবে আলো ফুটবে, কবে
সামনের তুষার প্রান্তরে দেখা যাবে নীল সমুদ্রের জল।
মার্চ মাসের শেষে দিগন্তে
সূর্যের আভা নান্সেন ও জহান্সেনকে চাঙ্গা করে তুলল। একঘেয়ে বিরক্তিকর শীতের শেষ
হয়ে বসন্ত এসে গেল। বাইরে শেয়াল, শ্বেত ভল্লুক, সিন্ধুঘোটক আর পাখিদের আনাগোনা।
এবার তুষার ঝড় শুরু হল। কখনও হাওয়ার দাপটে সামনের বিস্তীর্ণ ধবল প্রান্তরে জলের
দেখা পাওয়া যায়, আবার কিছুদিন পর আবার সব সমান হয়ে চারদিকে শুধু সাদা আর সাদা।
পরবর্তী প্রস্তুতি খাবারের
ভাণ্ডার বাড়িয়ে নেওয়া। মাটি খুঁড়ে ভাঁড়ার বানিয়ে তার মধ্যে দুর্দিনের জন্য জমিয়ে
রাখা ছিল এক বস্তা ময়দা, কিছু রুটি, চকলেট আর অন্য শুকনো খাবার। বার করে দ্যাখা
গেল, সেসব খাবার ছত্রাক জমে নষ্ট হয়ে গেছে। তাই আবার শিকার করতে নামতে হল। যতটা
সম্ভব খাবারদাবার সংগ্রহ করে স্লেজে চাপানো হল। স্লেজের উপর কায়াক আর খাদ্যের
সম্ভার। স্লেজ টেনে তুষার আচ্ছন্ন উঁচুনিচু প্রান্তরে প্রবল হাওয়াকে উপেক্ষা করে
খোলা জলের সন্ধানে এগিয়ে চললেন দুই অভিযাত্রী। যে করেই হোক ফ্র্যাঞ্জ জোসেফ ল্যান্ড
ছেড়ে বেরোতে হবে।
একদিন সন্ধে ঘনিয়ে এসেছে। নান্সেন
কিছুদূরে যেন কুকুরের ডাক শুনতে পেলেন। কিন্তু বরফের রাজত্বে কুকুর আসবে কোত্থেকে?
জোহান্সনকে মালপত্রের তদারকিতে রেখে অনুসন্ধান করতে এগিয়ে গেলেন নান্সেন। মানুষের
গলাও শোনা গেল না? কিন্তু সেই তুষারভূমিতে মানুষের উপস্থিতি একবারে অসম্ভব। আর
একটু এগোতে দেখলেন চেন দিয়ে বাঁধা কুকুরের সাথে দাঁড়িয়ে সুদর্শন এক পুরুষ। নান্সেন
ভাবলেন, হয় তার মাথা খারাপ হয়ে গেছে, না হয় তিনি ভূত দেখছেন। কিন্তু না, সত্যি
সত্যি এক অভিযাত্রী দলের নেতা ছিলেন সেই মানুষটি। তাঁর নাম জ্যাকসন।
তিনি ফ্রাঞ্জ জোসেফ ল্যান্ডে কিছু বিশেষ বৈজ্ঞানিক তথ্য সংগ্রহ করবার জন্য ঘাঁটি
গেড়েছিলেন। কিছুটা দুরেই ছিল জ্যাকসনের শিবির। জ্যাকসনও নান্সেনকে
দেখে খুশিতে জড়িয়ে ধরে আপ্লুত হয়ে জানলেন, সারা পৃথিবী নান্সেন ও তাঁর অভিযানের
কথা জানবার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে। জোহান্সেনকে জ্যাকসনের দলবল সসম্মানে নিয়ে এল
তাঁদের শিবিরে।
কিছুদিন জ্যাকসনের আতিথেয়তায়
শরীর সুস্থ হতে জাহাজে চেপে নরওয়ে ফিরে এলেন নান্সেন। বিপুল
সম্বর্ধনা পেলেন দুই উত্তরমেরু অভিযাত্রী। এর কিছুদিন পর ফ্র্যাম জাহাজ নরওয়ে
উপকূলে ফিরে এল। ফ্র্যামের এগারো জন যাত্রী অক্ষত
অবস্থায় ফিরে এসেছেন জানতে পেরে নান্সেন ও জোহান্সেনের সেদিন আনন্দ ধরে রাখবার
জায়গা ছিল না।
উত্তরমেরুতে পা রাখতে না
পারলেও ৮৬ ডিগ্রি ১৪ মিনিট উত্তরে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছিলেন নান্সেন ও তাঁর সাথী।
এরপর বহু মানুষ উত্তর মেরু অভিযানের চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। তাঁরা যে নান্সেনের
অভিযান থেকে অনেক শিক্ষা ও উৎসাহ পেয়েছিলেন এ বিষয়ে কোনও সন্দেহই নেই।
পরবর্তীকালে উত্তরমেরুতে সফল
অভিযানের কৃতিত্ব দাবী করেন অনেকেই। সে নিয়ে প্রচুর বিতর্কের সৃষ্টি হয়। ১৯২৬
সালে উত্তরমেরুতে প্রথম পদক্ষেপের স্বীকৃতি দেওয়া হয় রোয়াল্ড আমুন্ডসেনকে। তিনি
অবশ্য উড়োজাহাজে যাত্রা করেন।
সোভিয়েত নৌবাহিনী পরিচালিত
আর্কটিকা জাহাজ সর্বপ্রথম জলপথে উত্তরমেরু পৌঁছতে সক্ষম হয়। সে
জাহাজ ছিল আনবিক শক্তিচালিত।
প্রযুক্তির উন্নতির ফলে আধুনিক
দুনিয়ায় উত্তরমেরু অভিযান অনেক সহজ হয়ে গেছে। বর্তমানে সেখানে নিয়মিত ভ্রমণ
ব্যবস্থার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। কিন্তু দুঃসাহসিক উত্তরমেরু অভিযানের জন্য ইতিহাসের
পাতায় নান্সেনের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
এই অভিযানের পরেও ফ্র্যাম
জাহাজকে আরও বিভিন্ন মেরু অভিযানে ব্যবহার করা হয়।
প্রথম দক্ষিণমেরু অভিযান তার মধ্যে অন্যতম। ১৯২০ সালে নরওয়ের রাজধানী অসলোতে
ফ্র্যাম মিউজিয়াম স্থাপন করে সেখানে ফ্র্যামকে সসম্মানে স্থান দেওয়া হয়। অসলোতে ফ্র্যাম
মিউজিয়াম একটি দর্শনীয় সংগ্রহশালা। দুঃসাহসিক অভিযানের অনেক স্মৃতি-স্মারক হিসাবে
সেখানে সংরক্ষিত।
তথ্যসূত্রঃ ১) Farthest North by Dr.
Fridtjof Nansen, Volume I and Volume II
গ্রেট স্টোরি। এই নানসেন ই প্রচলন করেছিলেন শরণার্থীদের জন্য বিশেষ পাসপোর্টের যা বাঁচিয়েছিল লক্ষ লক্ষ মানুষকে
ReplyDelete