ঘরে ফেরা
প্রতিম দাস
ভাঙাচোরা কাঠের প্যাকিং
বাক্সটার মধ্যে গুটিসুটি মেরে ঘুমাচ্ছিল বেলি। ঘুমাচ্ছিল
বললে মিথ্যে বলা হবে। ঘুম আগেই ভেঙেছিল,
ও শুধু শুয়েছিল একটা কোমল হাতের ছোঁয়া পাওয়ার জন্য। শুধুমাত্র
এই জিনিসটার জন্যই ও এখনও এই বাড়িতে টিকে আছে। না
হলে হয়তো কবেই পালিয়ে যেত।
“বেলি! বেলি! এখনো ঘুমাচ্ছিস? ক’টা বাজে জানিস! এগারটা।”
যার মুখ থেকে এই কথাগুলো
শোনা গেল, সে এখনও ঘড়ি দেখতেও শেখেনি। বয়স
পাঁচ বছর।
বেলিরও তাই। তিতলির জন্মের মাসখানেকের মাথায় ও এসেছিল এই বাড়িতে। মাসখানেকের
বাচ্চা।
একসাথে বড়ো হয়ে উঠতে থাকে। ছোট্টো প্রাণদুটোর মধ্যে গড়ে ওঠে এক ভাষাতীত সম্পর্ক।
“কী রে, ডাক শুনতেই পাচ্ছিস না যে? ওঠ, ওঠ।”
ঠিক যেভাবে তিতলিকে ওর মা
ডাকেন ঘুম থেকে ওঠানোর জন্য, সেটারই অবিকল নকল। কচি
হাতে কানটা ধরে গলাটা যতটা সম্ভব গম্ভীর করে এবার, “কী হল, কথা কানে যাচ্ছে না মনে হচ্ছে?”
এই ছোঁয়াটা পাওয়ার জন্যই
তো বেলির গড়িমসি।
নাহ্, এবার উঠে পড়ল। শিরদাঁড়া
উঁচু করে আড়মোড়া ভেঙে বেরিয়ে এল বাক্স থেকে। শোনা গেল একটা বাজখাঁই পুরুষকণ্ঠের
উচ্চকিত আওয়াজ, “তিতলি! তিতলি! আবার কুকুর ঘাঁটছিস সকালবেলাতেই? বারণ করলে কথা কানে ঢোকেই না! আর কুকুরটাও হয়েছে তেমনি। এত
মারি তাও এ-বাড়িতেই পড়ে থাকে।”
ইনি তিতলির বাবা। যিনি
আজ এসব কথা বলছেন তিনিই কোলে করে বেলিকে এনেছিলেন এই বাড়িতে। সাদা
পাটকিলে রঙ মেশানো গা, কপালে একটা কালো বড়ো টিপ। তখন
অবশ্য এ-বাড়ির পরিস্থিতি আলাদা ছিল। তারপর
বিপদ এল প্রবাদ মেনে। একা নয়, সবাইকে
নিয়ে।
পরিবারটার সুখের ছন্দটাই কেটে গেল। প্রথমে
অসুস্থ হয়ে বিছানা নিলেন তিতলির মা। আর তারপরেই এল তিতলির বাবার কারখানায় লক-আউটের খবর।
জমানো পুঁজি ভেঙে চলল কয়েকমাস। সে
আর কদ্দিন।
কেমন যেন ছন্নছাড়া হয়ে পড়ল সব। কেমন আচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন
তিতলির বাবা।
খিটখিটে হয়ে গেলেন হাসিখুশি মানুষটি। কারণে
অকারণে রাগের মাত্রা চড়তে থাকল। যার সিংহভাগ প্রভাব পড়ল বেলির ওপর। কোনওমতে
একবেলা একটু খাবার, তাই সই। বিনা
দোষে যখন তখন লাথি ঝ্যাঁটা। তবুও মানুষের সেরা এই বন্ধু প্রাণীটি বিন্দুমাত্র
ফাঁকি দিল না নিজের আনুগত্যে। ওর ব্যথা উপশমের একমাত্র মলম হল তিতলির আদরের ডাক
আর হৃদয় থেকে উঠে আসা খাঁটি সোনার চেয়েও দামি ভালোবাসার ছোঁয়া।
বাবার গজগজানিকে পাত্তা
না দিয়ে বেলির গলায় হাত বোলাতে থাকল তিতলি। আর বেলিও চোখ বুজে নিতে
থাকল তার আমেজ।
কিন্তু বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না এই মুহূর্ত। তিতলির
বাবার সজোরে কষানো লাথি খেয়ে যন্ত্রণায় চেঁচিয়ে উঠে দরজার দিকে ছুটল বেলি।
“ভাগ, ভাগ এখান থেকে! আবার যদি দেখি না, মেরে ঠ্যাং খোঁড়া করে দেব বলে রাখলাম।”
বাবার অমানুষিক চিৎকারে
ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল তিতলি। সেটা শুনেই থমকে দাঁড়াল বেলি। কিন্তু
কিছু করার উপায় নেই ওর। ফিরে গেলে চরম দুর্ভোগ আছে কপালে। এদিকে
খিদেটাও পেয়েছে দারুণ। গতকাল রাতে মাত্র দুটো শুকনো রুটি জুটেছিল। দেখা
যাক এদিক ওদিক ঘুরে কিছু পাওয়া যায় কি না।
দুটো বাড়ির পরে যে বাড়িটা,
ওই বাড়ির ছেলেটা খুব ভালো। যখনই
ওকে দেখে দুটো করে বিস্কুট দেয়। কিন্তু আজ ভাগ্যটাই খারাপ। দরজাটা
বন্ধ।
লাথিটাও বেকায়দায় লেগেছে ভালোই। হাঁটার সময় পাঁজরায় বেশ
লাগছে।
টিউবওয়েলের পাশে জমা জলই আপাতত খেয়ে একটু স্বস্তি পেতে হবে।
সবে জলে মুখ লাগিয়েছে,
কানে এল গরগরানির আওয়াজ। আড়চোখে
দেখল।
নাহ, সকালটা আজ সত্যিই খারাপ। সেই
কেলো দুশমনটা।
পাশের পাড়ায় থাকে। বেলিকে একদম দেখতেই পারে না। আসলে
যে-সমস্ত কুকুর বাড়িতে পোষা থাকে তাদেরকে কোনও রাস্তার কুকুর
ভালো চোখে দেখে না। এটা বেলি ভালোমতোই বোঝে।
এ-ব্যাটা এখন এ-পাড়ায় কেন? ওর কবল
থেকে এখন কে বাঁচাবে আমাকে? ভরপেট না খেয়ে খেয়ে শরীরের যা হাল
তাতে ওই হুমদোর সাথে দৌড়ে পারব কি না সন্দেহ আছে। পালানো
ছাড়া উপায়ও তো নেই।
গোটা শরীর থরথর করে কেঁপে উঠল বেলির।
ঘ্রাউ করে একটা আওয়াজ দিয়ে
তেড়ে এল কেলো দুশমনটা। লেজ গুটিয়ে দৌড় শুরু করল বেলি। নিজেদের
বাড়ির দরজাটা ঠেলা মেরে বুঝল বন্ধ করা। এতে যে সময় গেল তাতেই ব্যবধান কমিয়ে ফেলল কেলো। প্রাণ
বাঁচাতে শরীরের সব জোর একত্র করে দৌড়াতে থাকল বেলি। ওকে
পালাতে দেখে পাড়ারই দুটো নেড়ি শেরু আর বাঘাও পিছু নিল ওর। হায়
রে! একা রামে রক্ষা নেই... আজ আর বাঁচার
আশা নেই।
এই ভাবনায় মনের জোর যখন তলানিতে এসে ঠেকেছে বেলির,
কমছে দৌড়ের গতি, ঠিক তখনই দেবদূতের মতো আবির্ভাব
হল ওদের।
চুনিলাল,
সাথে ওর ছেলে আর একটা বাঁদর। ওরা
বাঁদরখেলা দেখায় রাস্তাঘাটে। গলির বাঁকটা ঘুরতেই ওদের সাথে ধাক্কাটা কোনওমতে
সামলাল বেলি।
বাঁদরটা খ্যাঁচম্যাচ শব্দ কর এক লাফে চড়ে বসল চুনিলালের মাথায়। হাতের
লাথিটা তুলে মারতে গিয়েও থেমে গেল চুনিলাল, পেছনের
কুকুরগুলোকে দেখে। হাতের লাঠিটা তুলে
‘হওওই’ করে একটা আওয়াজ দিয়ে এগিয়ে গেল সামনের দিকে। দু’বার ঠুকল লাঠিটাকে রাস্তায়। দেখেশুনে পালাল দুশমনগুলো।
ফিরল চুনিলাল। বেলি
তখন প্রায় শুয়ে পড়েছে, হাঁফাচ্ছে। চোখে
কৃতজ্ঞতার ছাপ।
এ-দৃষ্টি চিনতে ভুল হল না চুনিলালের। পশুপাখিদের
নিয়েই যার রুজিরুটি, ওঠা বসা।
“আরে, এ বচ্চা, আঃ আঃ। কোই
ডর নহি, ইধর আ। পাস মে আ। চুঃ
চুঃ।
এ মোতিয়া, জরা ঝোলি সে পানরোটি নিকাল।”
মোতিয়া চুনিলালের ছেলে। কাঁধের
ঝোলা থেকে বার করল এক টুকরো পাউরুটি। দিল বাবাকে।
“আঃ আঃ, লে লে, খা লে। বহুত
ভুখা আছিস মনে লাগছে।”
বেলি ইতস্তত পায়ে এগিয়ে
এল।
বাঁদরটা দাঁতমুখ খিঁচিয়ে আওয়াজ করল।
“এ তু খ্যাঁচমেচাচ্ছিস
কাঁহে? ও দোস্ত আছে। আঃ
আঃ, লে লে। কোই ডর নেই। মোতিয়া
পেলাস্তিস কে বাটি ভি নিকাল। বোতল সে জরা পানি দে উস মে।”
বেলি পাউরুটিটা খেয়ে চকচক
করে সব জলটা খেল চুনিলাল বাটিটা এগিয়ে দিতেই।
“আরে, এ তো অচ্ছা বচ্চা আছে! ঘরবালা কুত্তা মালুম হোতা হ্যায়। ঘর
কাঁহা হ্যায় তেরা? বাড়ি আছে কাঁহা?”
ভিন্ন ধরনের ভাষা শুনে একটু
আসুবিধা হলেও ‘বাড়ি’ কথাটা
বুঝতে পারল বেলি। মুখ তুলে গলির দিকে তাকাল। না,
দুশমনগুলো নেই। চলল এগিয়ে। পেছন
পেছন বাঁদর কাঁধে চুনিলাল আর ওর ছেলে মোতিয়া।
দরজাটা এখনও বন্ধ। ঠেলা
মারল বেলি, সাথেই ‘অউ, অউ’ করে দু’বার ডাকল। ভেতর
থেকে শোনা গেল তিতলির বাবার গলা, “আবার এসেছিস!
যা ভাগ, মার খেয়েও ভয় নেই? আচ্ছা বেহায়া কুকুর!”
করুণ চোখে চুনিলালের দিকে
তাকাল বেলি।
এবারেও সে দৃষ্টি বুঝতে অসুবিধা হল না অভিজ্ঞ মানুষটির। বলল,
“ক্যায়া রে মোতিয়া, লিয়ে লি ইসকো ভি হামাদের দলে?
বড়িয়া খেল হোগা। এ বচ্চা, যায়েগা
না হামারে সাথ?”
বাঁদরটা আবার খ্যাঁচম্যাচ
করে উঠতেই মোতিয়া বলল, “হাঁ বাবা, সহি বাত বোলা আপনে। এ হেমাসুন্দরী, কোই ফিকর নহি। ও দোস্ত আছে। ক্যায়া
রে দোস্ত, যায়েগা না হামারে সাথ?”
চুনিলালদের নির্দিষ্ট থাকার
কোনও জায়গা নেই।
জাতে ওরা মাদারি। মোতিয়ার মাকে নিয়ে দল থেকে পালিয়ে শাদি করেছিল
চুনিলাল।
বাঁদরটা ছিল চুনিলালের বাবার। যদিও খেলা দেখানোর সূত্রে
ওটা ছিল চুনিলালের ন্যাওটা। জুনিয়াকে নিয়ে পালানর সময় ওটাও এসেছিল পিছু পিছু। তারপর
থেকে ওর খেলা, চুনিলালের হাতসাফাই, গান, ঢোল বাজানো আর জুনিয়ার দেশীয় ঢংয়ের জিমনাস্টিক দেখিয়ে
ভালোই কেটে যাচ্ছিল দিনগুলো।
মোতিয়ার জন্মের দু’বছর বাদে এক শীতের রাতের বৃষ্টিতে ভিজে ঠাণ্ডা লেগে অসুখ হয়ে মারা যায় জুনিয়া। তারপর
থেকে চুনিলালের জীবনটা একটা খুঁটোতেই বাঁধা। সেটা ওর ছেলে। দিন
এরপরেও বেশ কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু সময়ের সাথে বদলেছে আনন্দ উপভোগের রসদ। মানুষ
এসব আর দেখতে চায় না। নতুন কিছু দেখাতে যে পুঁজি দরকার তা নেই চুনিলালের। ভাগ্যক্রমে
কুকুরটা জুটে যেতেই আবার একটা নতুন স্বপ্ন দেখায় মশগুল চুনিলাল।
বেশি দেরি না করে শুরু করে
ট্রেনিং দেওয়া।
ভাঙা ভাঙা বাংলা মেশানো হিন্দি কথা বেলির বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হয় না। অবশ্য
ইদানিং ওর নাম হয়েছে বাহাদুর। সেটাও বুঝে গেছে ও। দিন
বয়ে চলে।
এই ভবঘুরে জীবনে এখন বেশ অভ্যস্ত হয়ে গেছে বেলি। তবুও
মাঝে মাঝেই সেই কোমল হাতের ছোঁয়া আর আধো স্বরের কথাগুলো শোনার জন্য ওর প্রাণটা আকুলিবিকুলি
করে।
ইচ্ছে হয় একছুটে চলে যায় তিতলির কাছে। কিন্তু
উপায় নেই।
সে-শহর ছেড়ে ওরা আজ চলে এসেছে অনেক
অনেক দূরে।
এটাই তো মাদারিদের জীবন। ওরা ঘুরে বেড়ায় এ-শহর সে-শহর। হেমাসুন্দরী
এখন ওর প্রাণের বন্ধু। ওকেই অবরে-সবরে শোনায়
ওর জীবনের কাহিনি।
সময়ের চাকায় ঘুরে যায় তিন-তিনটে বছর। এ-পথ সে-পথ ঘুরে চুনিলালরা আবার ফিরে আসে বেলির শহরে। এ-গলি সে-গলি হতে হতে একদিন খেলা শুরু হয় বেলিরই পাড়ায়। চেনা
এলাকা, চেনা গন্ধ। বেলি
নিজেকে সামলাতে পারছিল না। খেলার ফাঁকে ফাঁকে সে ভিড়ে খুঁজছিল একটা মুখকে। নাহ্,
সে আসেনি।
আর এতে তাল কাটছিল খেলার। অবাক
হয় চুনিলাল।
বাহাদুর তো এরকম করে না কখনও! এদিক ওদিক
তাকাতেই বুঝে যায় আসল ব্যাপারটা। তাড়াতাড়ি শেষ করে খেলা। বেলিকে
নিয়ে যায় ওদের বাড়ির সামনে। দরজাটা দেখেই ছুটে যায় বেলি
‘কুই কুই’ শব্দ করে। আঁচড়াতে
থাকে দরজায়।
দেখে, না, একটা
বড়ো তালা ঝুলছে ওপরে।
মোতিয়ার চোখে পড়ে তালাটা। বলে,
“বাহাদুর, ঘর মে কোই না আছে রে। ও
দেখ, লক কিয়া হুয়া উপর।”
বেলি দেখে মুখ তুলে। থেমে
যায় ওর আওয়াজ।
চোখটা ঝাপসা হয়ে আসে জলে। হতাশায় ভেঙে যাওয়া মন নিয়ে ফিরে আসে চুনিলালের
কাছে।
ওর মাথায় হাত দিয়ে চুনিলাল বলে, “ও লোগ
বহুত বদনসিব হ্যায় যো তেরে জ্যায়সে অচ্ছে বচ্চেকো ঘর সে নিকাল দিয়া।”
এদিকে ঘটনা হল,
তিতলিরা এখনও এ-পাড়াতে ওই বাড়িতেই থাকে। অবস্থা
বদলেছে ওদেরও।
অন্য একটা কারখানায় চাকরি পেয়েছেন তিতলির বাবা। বদলেছে
বাড়ির পরিবেশ।
ফিরে এসেছে সেই আনন্দের দিনগুলো। মাঝে মাঝে আবার একটা কুকুর
পোষার জন্য তিতলি বায়না ধরলেও সে আবদার অবশ্য মেটেনি। তিতলির
বাবা আসলে বেলির ওপর নিজের করা খারাপ আচরণের অনুশোচনায় ভোগেন। ফলে
আর কোনও কারণে আবার একই আচরণ ঘটুক, এটা উনি
চান না।
আর একটা ভালো খবর, তিতলির মাও ইদানিং অনেকটাই
সুস্থ হয়ে উঠেছেন।
বড়ো রাস্তার পথে আস্তে আস্তে
বের হয়ে আসে বেলিরা। ঠিক তখনই একটা রিক্সা এসে থামে গলির মুখে। চেনা
একটা গন্ধ হাওয়ায় ভেসে নাকে আসে বেলির। দ্যাখে, রিক্সা
থেকে নামছেন তিতলির বাবা। ওর ঘাড়ের লোম খাড়া হয়ে যায়। দাঁড়িয়ে
পড়ে।
মোতিয়ার ডাকে ফিরে তাকায় চুনিলাল। তিতলি
লাফিয়ে নামে রিক্সা থেকে। ওর মাকে ধরে নামান তিতলির বাবা। ওরা
গিয়েছিল তিতলির মামার বাড়িতে। আর সেজন্যই দরজায় তালা ছিল।
আনন্দের গোঙানি বেরিয়ে আসে
বেলির গলা থেকে।
তারপর চেঁচিয়ে ওঠে, ‘ভউ উ উ...’
মেয়েটি তাকায়। চোখ
পড়ে বেলির কপালের কালো টিপটার ওপর। বাবার হাতটা চেপে ধরে তিতলি বলে ওঠে,
“বাবা! ও বাবা, ওটা বেলি
না?”
ওর বাবা বলেন,
“দূর পাগলি! সে কোথা থেকে আসবে এতদিন পর?”
“তুমি দ্যাখোই না একবার!”
“তুই তো যাকেই দেখিস,
তাকেই বেলি বলে ভাবিস।”
তিতলি চেঁচিয়ে ডাকে,
“বেলি! এই বেলি!”
বেলি আর থাকতে পারে না। বিদ্যুৎগতিতে
ছুটে যায় ওদের দিকে। আলতো করে দু’পায়ের
ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ায় ওর প্রাণের সখার কাঁধে।
“বেলি, তুই বেলিই তো! বাবা, আমি ঠিক চিনেছি,
দেখলে?” দু’হাতে জড়িয়ে ধরে
বেলিকে।
অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন তিতলির
বাবা-মা। পায়ে পায়ে এগিয়ে আসে চুনিলালরা।
“বাবুসাব, এ আপ লোগোকে কুকুর আছে না?”
তিতলি উত্তর দেয়,
“হ্যাঁ, এটা আমার বেলি।”
“হাঁ খোকি, তমহার বেলি, হামার বাহাদুর। বাবুসাব,
আপ বহুত নসিববালা হো কে অ্যায়সা প্রাণী আপ লোগোকো মিলা। যান,
ঘর লিয়ে যান।”
গলাটা কেঁপে যায় চুনিলালের।
মোতিয়া বলে,
“লেকিন বাবা, হমলোগো কে খেল কা ক্যায়া হোগা?”
“অ্যায়সা খেল কভি দেখা
হ্যায় বেটা? ইয়ে উপরবালে কে নিরালে খেল হ্যায়। মিলানেবালা
খেল।
উসে উসকা ঘরবালা মিল গয়া, ঘর মিল
গয়া।
হামাদের কোনো ঘর না আছে। জিসকে ঘর হ্যায়, উসে ঘর মে রহনে দেনা আসলি খেল হ্যায়।”
এবার বেলি ফিরে আসে এদিকে। চেটে
দেয় চুনিলালের হাত।
চুনিলাল হাঁটু গেড়ে বসে জড়িয়ে ধরে বেলিকে। না,
ওর বাহাদুরকে।
“যা বচ্চে, তু ঘর লউট যা। উপরবালা তেরা ভলা করে।” উঠে দাঁড়ায়। “চল রে,
মোতিয়া।”
বাঁদরটা এক লাফে নেমে আসে
মোতিয়ার কাঁধ থেকে।
শেষবারের মতো চড়ে বসে বেলির পিঠে। কানের
কাছে ঝুঁকে পড়ে।
বোধহয় বলে, বিদায় বন্ধু, ভালো থাকিস।
এসব দেখে অজান্তেই কয়েক
ফোঁটা জল কখন যেন জমে যায় তিতলির মা-বাবার চোখের
কোলে।
জল বেলির চোখেও। একই সাথে বন্ধুবিচ্ছেদের আর ঘরে ফেরার।
ওদিকে চুনিলালের গলায় ধ্বনিত
হয় এক গান, ‘জিন্দগি, ক্যায়সি ইয়ে পহেলি হায়,
কভি ইয়ে হঁসায়ে কভি ইয়ে রুলায়ে...’
_____
অলঙ্করণঃ সপ্তর্ষি
চ্যাটার্জী
No comments:
Post a Comment