খুশির দরজা খুলে
মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য
ক’দিন ধরে বেজায় মনখারাপ
শ্বেতার। অজেয়র অবস্থাও তথৈবচ। অফিস ছুটি নিয়ে বাড়ি আর নার্সিং হোমে দৌড়চ্ছে শাটল
ককের মতো। ক্লাস সিক্সে পড়া রিন্টির অসুবিধে শুরু হয়েছিল জ্বর আর গলা ব্যথা দিয়ে।
তিনদিনের অ্যান্টিবায়োটিকে যখন কাজ হল না তখন ডাক্তার এনএসওয়ান পরীক্ষা করালেন।
তাতেই ডেঙ্গির জীবাণু পাওয়া গেল। নার্সিং হোমে ভর্তি করা হল সঙ্গে সঙ্গে। তড়িঘড়ি
ম্যাক এলাইজা টেস্টের জন্য রক্তের নমুনা পাঠালেন ওঁরা।
ভরা বর্ষা। ডুয়ার্সজুড়ে
শুরু হয়েছে ডেঙ্গির উপদ্রব। ক্রমশ মহামারীর আকার ধারণ করছে এই রোগ। কাল রিন্টির
পাশের বেডের এক পেশেন্ট মারা গেছেন ডেঙ্গি শক সিনড্রোমে। মিডিয়ার লোকজন এসেছিল বুম
আর ক্যামেরা নিয়ে। সন্ধেবেলা সেই খবর ফলাও করে দেখিয়েছে টিভিতে।
কাল রিন্টির প্লেটলেট
কাউন্ট ঝপ ঝপ করে নেমে আসছিল। দেড় লাখ থেকে এক লাখ, সেখান থেকে পঞ্চাশ হাজার। ভয়
পেয়ে গিয়েছিল অজেয় আর শ্বেতা। চিন্তিত ছিলেন ডাক্তারবাবুও। তবে শেষ অবধি প্লেটলেট
আর ড্রপ করেনি। বরং আজ সকালের রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে সেটা পঁয়ষট্টি হাজারে উঠেছে।
জ্বরটাও আর নেই। তাতে সামান্য স্বস্তি এসেছে। নির্ঘুম রাত কাটিয়ে সকাল সকাল
নার্সিং হোমে চলে এসেছিল শ্বেতা-অজেয়। সিসিইউ থেকে রিন্টিকে কেবিনে শিফট করা হয়েছে
আজ সকালে।
রিন্টি শুকনো মুখে অনুযোগ
করছিল শ্বেতার কাছে। তাকে দেখতে আত্মীয়স্বজনরাই শুধু এসেছে। কোনও বন্ধু এখনও
আসেনি। শ্বেতা সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিল, “এখনও তো কেউ খবর পায়নি। দেখে নিস, আজকেই
তোর কোনও না কোনও বন্ধু তোকে দেখতে আসবে।”
মেয়ের সঙ্গে গল্প করে
ভিজিটিং আওয়ার ফুরোবার পর অজেয় আর শ্বেতা বেরিয়ে আসছিল কেবিন থেকে। তখনই চোখ পড়েছে
অশীতিপর মানুষটির দিকে।
লাউঞ্জের বাইরে একটা বড়ো
চাতাল। সেখানে ফাইবারের চেয়ার সারি দিয়ে বসানো। চেয়ারে বসে থাকা সাদা বুশ শার্ট আর
খয়েরিরঙা ঢোলা ট্রাউজার পরা প্রবীণ মানুষটিকে দেখে থমকে গেল দু’জনে। ফর্সা ধবধবে
মুখে অজস্র রেখার আঁকিবুঁকি, ছোটো ছোটো চোখ, দাড়িগোঁফবিহীন মঙ্গোলয়েড মুখ, মাথায়
পাহাড়ি টুপি। ক্রিসমাসের ছুটিতে লামাহাটায় এই ভদ্রলোকের হোম স্টেতেই দু’দিনের জন্য
অতিথি হয়েছিল না তারা!
হ্যাঁ, উনিই তো।
লামাহাটায় যে দুটো দিন ওরা ছিল তার মধ্যেই রিন্টির সঙ্গে দিব্যি ভাব হয়ে গিয়েছিল
ভদ্রলোকের। রিন্টিকে উনি ডাকতেন লিটল প্রিন্সেস বলে। রামায়ণ, মহাভারত, ইলিয়াড,
ওডিসির মতো মহাকাব্য থেকে গল্প শোনাতেন। রিন্টি রীতিমতো ভক্ত হয়ে গিয়েছিল ওঁর। কী
যেন নাম ভদ্রলোকের? হ্যাঁ মনে পড়েছে, রিনচেন শেরপা। মোটা ফ্রেমের হাই পাওয়ারের
চশমা পরতেন। সেই চশমাটা চোখে না থাকায় চিনতে একটু অসুবিধে হচ্ছিল। ইনি কী করছেন এই
নার্সিং হোমে?
শ্বেতা প্রশ্নটা করতে
অজেয় বলল, “ভদ্রলোক কথায় কথায় বলেছিলেন, চোখ নিয়ে ওঁর সমস্যা বহুদিনের। রেটিনার ভেতরের
রক্তনালী থেকে চুঁইয়ে জল বের হয় বলে আবছা দেখেন। দৃষ্টি বেশি ঝাপসা হলে ক্লিনিকে
গিয়ে চোখের মধ্যে ইনজেকশন নিতে হয়। ইনজেকশনটাও মহার্ঘ। পাহাড়ে চোখের এই জটিল রোগের
চিকিৎসার সুযোগ নেই। সেজন্য সমতলে নির্দিষ্ট সময় অন্তর যেতে হয় তাঁকে। সেখানকার
চোখের ডাক্তার রেটিনা স্ক্যান করিয়ে বলে দিতে পারেন পরের ইনজেকশনগুলো কোন কোন সময়ে
প্রয়োজন হবে।
শ্বেতা বলল, “তার মানে
উনি চোখ দেখাতেই এসেছেন এই নার্সিং হোমে। চলো, কথা বলে আসি ওঁর সঙ্গে।”
গোলগাল চেহারার মানুষটি
শান্তভাবে বসে আছেন। সম্ভবত অপেক্ষা করছেন চোখের ডাক্তারের। নিবিষ্টমনে তাকিয়ে
আছেন দূরের দেওয়ালটার দিকে। গুটিকয়েক পাখি দেওয়ালের কোণে একটা খাঁজের মধ্যে বাসা
বানাচ্ছে। খড়কুটো নিয়ে আসছে কোথা কোথা থেকে। সেগুলো রেখে আবার উড়ে যাচ্ছে। আবার
আসছে। মহা ব্যস্ত যেন তারা। চশমা ছাড়া ভদ্রলোক আদৌ কিছু দেখতে পাচ্ছেন কি না কে
জানে।
শ্বেতা ওঁর সামনে গিয়ে
মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করল, “ভালো আছেন?”
রিনচেন শেরপা চিনতে
পারেননি। অন্যমনস্ক গলায় বললেন, “পাখিগুলো কেমন বাসা বানাচ্ছে, দেখেছেন? সাধারণ
নৈমিত্তিক ঘটনা। কিন্তু এই সাধারণ দৃশ্যটাই আমার মনটাকে সুস্থির করে দিচ্ছে। এই যে
জগৎসংসার ঠিকঠাক চলছে, পাখিগুলো একমনে নিজেদের কাজ করছে, এতে বেশ একটা ভরসা পাওয়া
যাচ্ছে। কী বলেন?”
ভদ্রলোক একইরকম আছেন।
সবসময় ভাবের ঘোরে থাকেন। একসময় স্কুলে পড়াতেন। একমাত্র মেয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর
ডাক্তার। বছরে একবার বাড়িতে আসে, বাবার সঙ্গে ক’টা দিন কাটিয়ে যায়। রিনচেনের
স্ত্রীবিয়োগ হয়েছে বহুদিন আগে। বাড়িটা ফাঁকা পড়ে থাকে বলে হোম স্টে চালু করেছেন।
একজন পরিচারক আছে। সে ছেলেটিই অতিথির দেখভাল করে। নিজের সংসার বলতে রিনচেনের কিছু
নেই। কিন্তু চারপাশে দিব্যি সংসার তৈরি করে নিয়েছেন। এলাকার সমস্ত ছেলেমেয়ে ওঁর
ভক্ত। বাচ্চাগুলোর সঙ্গে দাবা, লুডো, চাইনিজ চেকারের মতো ইনডোর গেম খেলেন মনের
আনন্দে।
রিনচেনের লামাহাটার
বাড়িটার কথা মনে পড়ল শ্বেতার। অল্প কিছু দৈনন্দিন সামগ্রী নিয়ে পরিতৃপ্ত নিরাভরণ
বাড়িটিতে সবই পুরনো। বৃদ্ধ হেসে বলতেন, “এই বাড়িটা পুরনো, বাড়ির আসবাবপত্র থেকে
সবকিছুই পুরনো। এখানে শুধু আমিই ছেলেমানুষ। লিটল প্রিন্সেসের মতো।”
শ্বেতা জানতে চেয়েছিল,
“এই যে এত বড়ো বাড়িতে একা একা থাকেন, মনখারাপ লাগে না আপনার?”
বৃদ্ধ বিমনা স্বরে
বলেছিলেন, “কোনও-কোনওদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে মনটা একটু ভারী ভারী লাগে ঠিকই। তখন
কাছেপিঠের বাচ্চাগুলোকে ডেকে ওদের সঙ্গে দুয়েক রাউন্ড গুলি খেলে নিই। ওরা আমার সব
গুলি জিতে নেয়। কিন্তু আমার মনটা ফুরফুরে হয়ে যায়।”
পাশের ফাঁকা চেয়ারদুটোতে
বসল অজেয় আর শ্বেতা। কৌতূহলী স্বরে অজেয় বলল, “পাহাড়ে লাগাতার হরতাল ডেকেছে
অ্যাক্টিভিস্টরা। গাড়িঘোড়া চলছে না। দোকানপাট-অফিসকাছারি সব বন্ধ। আপনি এর মধ্যে এলেন
কী করে?”
রিনচেন মৃদু গলায় বললেন,
“আমাকে আসতেই হত। ড্রাইভার ছেলেটিকে আগের দিন রাত্তিরে আমার বাড়িতে ডেকে
নিয়েছিলাম। ভোররাতে দু’জনে আমার গাড়িটায় চেপে সমতলের দিকে নেমে আসছিলাম। লামাহাটা
থেকে পেশক অবধি এসেছি নির্বিঘ্নে। কিন্তু পেশক ছাড়াবার পর একটা জায়গায় কিছু লোক
আমাদের বাধা দিল। ড্রাইভারকে ধাক্কা দিয়ে নামিয়ে দিল গাড়ি থেকে। আমার চশমাটা কেড়ে
নিয়ে ফেলে দিল খাদে। আমার গাড়িটাও আটকে রেখে দিল গায়ের জোরে। ড্রাইভার থেকে গেল
গাড়ির সঙ্গে। আমি হেঁটেই রওনা দিলাম শিলিগুড়ির দিকে।”
রিনচেনের বয়স আশির ওপাশে।
তবুও শারীরিক অসুবিধে অগ্রাহ্য করে এতটা পথ হেঁটেছেন রাস্তা দিয়ে। ক্লান্ত হলে
বিশ্রাম নিয়েছেন। একটু ভালো লাগলে আবার নতুন করে হাঁটা শুরু করেছেন। বনধে গাড়িঘোড়া
চলছে না পাহাড়ি পথে। রাস্তায় মানুষজনও অপ্রতুল। দোকানপাট বন্ধ থাকায় জল অবধি খেতে
পারেননি। ভাগ্য ভালো রাস্তায় একটা পুলিশের জীপ পেট্রোলিং করছিল। ডিউটি অফিসার
বয়স্ক মানুষটিকে ক্লান্ত-বিধ্বস্ত অবস্থায় নেমে আসতে দেখে গাড়ি দাঁড় করান। পুরো
ঘটনা শুনে তিনি নিজেই ওঁকে গাড়িতে তুলে নিয়ে পৌঁছে দিয়ে গেছেন এখানে।
অজেয় বলল, “পাহাড়ে এই
গণ্ডগোলের মধ্যে রাস্তায় নেমেছিলেন কেন? চোখের ডাক্তার কি আজকেই ডেট দিয়েছেন
আপনাকে?”
রিনচেন কি অজেয়কে চিনতে
পেরেছেন? পরিচিত মানুষকে দেখলে শরীরী ভাষায় যে প্রতিফলন হয় সেটা দেখা গেল না।
বৃদ্ধ বললেন, “চোখ দেখাতে
আসিনি এখানে। আমি তো কলকাতার একটা ক্লিনিকে চোখ দেখাই।”
অজেয় বলল, “ও, আচ্ছা।
তাহলে কি আপনার কোনও আত্মীয়স্বজন ভর্তি আছেন এখানে?”
রিনচেন শেরপা ঘাড় নেড়ে
বললেন, “আমার এক ছোট্ট বন্ধু অসুস্থ হয়ে ভর্তি আছে এখানে। তাকে দেখতেই এসেছি। তাকে
আমি ডাকতাম লিটল প্রিন্সেস বলে। কিন্তু সেই নাম বলায় রিসেপশনিস্টরা আমাকে হেল্প
করতে পারছেন না। ওঁদেরকেও দোষ দেওয়া যায় না। এদিকে ভিজিটিং আওয়ারও শেষ হয়ে গেছে।
বাধ্য হয়ে বসে আছি এখানে। কী করব বুঝতে পারছি না।”
অজেয় হাঁ করে ভদ্রলোককে
দেখছে। শ্বেতার দিকে তাকাল একবার। অস্ফুটে বলল, “কী আশ্চর্য! আপনি রিন্টিকে দেখতে
এসেছেন অত দূর থেকে? কে আপনাকে খবর দিল?”
বৃদ্ধ বললেন, “কাল
ক্রিকেট দেখছিলাম। চ্যানেল সার্ফ করতে করতে হঠাৎ একটা নিউজ চ্যানেলে চোখ আটকে
গিয়েছিল। এই নার্সিং হোমে দেখলাম একজন ডেঙ্গিতে মারা গেছে। মৃত পেশেন্টের পাশের
বেডে দেখলাম লিটল প্রিন্সেস শুয়ে আছে। মনটা দুলে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে ডেকে নিলাম
ড্রাইভারকে।”
প্রবীণ মানুষটির কপালে বয়সজনিত
রেখার কাটাকুটি। কপালে বাড়তি কিছু ভাঁজ ফেলে বৃদ্ধ চোখ কুঁচকে দেখলেন অজেয়কে। মৃদু
স্বরে বললেন, “চশমা ছাড়া ঝাপসা দেখি সব। এতক্ষণ পারিনি, এবার গলার আওয়াজ শুনে
চিনতে পেরেছি আপনাদের। এখন কেমন আছে লিটল প্রিন্সেস?”
অজেয় বলল, “কাল অবস্থা
একটু ক্রিটিক্যাল ছিল। আজ রিন্টি একটু ভালো আছে। ডাক্তার বলেছেন, বিপদ খানিকটা
কেটেছে। সিসিইউ থেকে কেবিনে শিফট করা হয়েছে আজ সকালে।”
রিনচেন উঠে দাঁড়ালেন।
শশব্যস্ত হয়ে বললেন, “চলুন, প্লিজ আমাকে নিয়ে চলুন। যার জন্য এতটা পথ আসা সেই লিটল
প্রিন্সেসকে দেখে আসি একবার।”
হ্যান্ডব্যাগ থেকে রুমাল
বের করল শ্বেতা। দু’চোখে কোণে জমে থাকা জলের বিন্দুদুটো মুছে নিল সন্তর্পণে। এই
অশ্রু বুকচাপা কষ্টের নয়। অপার আনন্দের। সকালেই মনখারাপ করা মেয়েকে সান্ত্বনা দিয়ে
শ্বেতা বলেছিল, আজকেই তার কোনও না কোনও বন্ধু তাকে দেখতে আসবে। সেই কথাটা যে এভাবে
ফলে যাবে কে জানত!
মনখারাপ দূরে সরিয়ে খুশির
দরজা খুলে পাহাড় থেকে নেমে এসেছেন এই ঈশ্বরের দূত। হ্যাঁ, ঈশ্বরের দূতই তো। নইলে
সম্পূর্ণ অপরিচিত অনাত্মীয় একটি মেয়ের জন্য এমন কষ্ট কেউ স্বীকার করে কখনও! এমন
দু-চারজন দেবতুল্য মানুষ আছেন বলেই পৃথিবীটা বাসযোগ্য আছে এখনও।
শ্বেতা বড়ো করে একটা শ্বাস
ফেলল। অজেয়র দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, “ভিজিটিং আওয়ার শেষ হল এইমাত্র। কিন্তু অনুরোধ
করলে কি ওঁকে দু’মিনিটের জন্য ভেতরে যাওয়ার অনুমতি দেবে না ওঁরা? তুমি বলেই দ্যাখো
না একবার।”
_____
অলঙ্করণঃ মানস পাল
oshadharon golpo
ReplyDelete