পাদুকা বৃত্তান্ত
সুজিতকুমার নাহা
নতুন জুতোশোভিত হয়ে চলাচলের শুরুটা
যে স্বস্তিকর হয় না, সেটা সকলেরই জানা। পায়ের
স্থানবিশেষের ওপর চাপ, ঘষাঘষিতে ত্বকের ক্ষতি, ফোসকার আর্বিভাব ইত্যাদি নানাবিধ উপসর্গ জুতোর মালিককে
মোটেই খুশি করে না! আশ্চর্যের কথা, মাসকয়েক ব্যবহারের পরেই কষ্ট উধাও হয়, অনুভব করা
যায় জুতো পায়ে দিব্যি ফিট করেছে - যেন পায়ের
মাপজোখ নিয়েই নিপুণ চর্মকার তৈরি করেছে সেটা!
ব্যবহারের মাসকয়েক পরেই জুতোর আচরণে এই অদ্ভুত পরিবর্তনের কারণ
কী? জানতে পারলে মন্দ হয় না! এই বিষয়ে আলোচনার সুযোগ হয়েছিল কিছুদিন আগে। প্রদীপ জ্বালানোর আগে সলতে পাকানোর মতো এই
জুতোচর্চারও আছে একটি ইতিবৃত্তান্ত। বছর দেড়েক
পূর্বের সেই ঘটনা দিয়েই শুরু করা যাক জুতো-কাহিনি।
কৃষ্ণনগরে কাকুর বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। হাতারপাড়ার বেশ খোলামেলা একটা দোতলা বাড়িতে
কাকু, কাকিমা, খুড়তুতো দাদা পিকলু, ভ্রাতৃবধূ গোপা ও ভাইঝি টুম্পা থাকে। কাকু ছিলেন ডিভিসির ইঞ্জিনিয়ার। বছর দশেক হল অবসর নিয়েছেন। পিকলু কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক। গোপাবৌদি পড়ায় এখানকার সরকারি মহিলা মহাবিদ্যালয়ে।
টুম্পা তখন দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী। স্কুলের পোষাকবিধি অনুসারে পুরো পা-ঢাকা স্ট্রাপ-শু পরতে হয় টুম্পাদের। আমি যেদিন কৃষ্ণনগরে
গেলাম, ঘটনাচক্রে সেদিনই নতুন জুতো পরে আনন্দে প্রায় নাচতে নাচতে স্কুলে যেতে দেখলাম
ওকে। বিকেলে টুম্পা কিন্তু
ফিরল রীতিমতো খোঁড়াতে খোঁড়াতে। জানা
গেল, দু’পায়ের কড়ে আঙুলের ওপর প্রবল
চাপ-জনিত অসহ্য যন্ত্রণার কারণেই গমনের সাপেক্ষে প্রত্যাগমনের এই নাটকীয় পরিবর্তন।
পা থেকে জুতো খুলে টুম্পা ঘোষণা করল,
“এই ভয়ংকর জুতো আর কক্ষনও পরব না। পুরনো ছেঁড়া জুতোই সুখরামকে দিয়ে সারিয়ে
নিয়ে ব্যবহার করব। টেস্ট
পরীক্ষার পরই তো ছুটি পড়ে যাবে। এই সাত-আট
মাস এভাবেই চালিয়ে নেব।”
জেদি মেয়ের এই প্রজ্ঞাপনে গোপাবৌদি
দৃশ্যতই বিচলিত। অনুচ্চ
কন্ঠে বলল, “কিন্তু মামণি, সেটা
আর তো সম্ভব নয়। আমি বাতিল
ভেবে ওগুলো ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছি।”
পরবর্তী ঘটনাক্রমের বিস্তারিত বিবরণ
নিষ্প্রয়োজন। শুধু
জানাব, পরিস্থিতি ক্রমেই উত্তপ্ত হচ্ছে দেখে পারিবারিক শান্তি বজায় রাখার খাতিরে মা
ও মেয়ের আলাপচারিতায় অনুপ্রবেশ করতে হল। বিস্তর
চেষ্টার পর টুম্পাকে কিঞ্চিৎ ঠান্ডা করতে সক্ষম হলাম। নানাভাবে যুক্তিজাল বিস্তার করে ওকে বোঝালাম, নতুন জুতো বর্জন
সমস্যার সমাধান হতে পারে না। আমার
বক্তব্যের সারকথা ছিল এইরকমঃ
পুরনো জুতো জঞ্জালের স্তূপে নিক্ষিপ্ত না হলেও
সমস্যার স্থায়ী সমাধান হত না। সব জিনিসেরই
কার্যকর আয়ু (সার্ভিস লাইফ) মোটামুটিভাবে নির্দ্দিষ্ট। রবারের মতো সেটাকে টেনে লম্বা করা যায় না। নতুন জুতো পরার পর সমস্যা হতেই পারে। আসলে, প্রত্যেক মানুষের পা অন্যদের পা থেকে
আকারগত বিচারে কিছুটা হলেও আলাদা। নিখুঁতভাবে ফিট করবে এমন জুতো প্রত্যেকের জন্য আলাদাভাবে
তৈরি করা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। তাই বাজারে
কয়েকটি নির্দ্দিষ্ট সাইজেই জুতো পাওয়া যায়। অগত্যা ট্রায়াল দিয়ে যে জুতোজোড়াকে মোটের ওপর ঠিকঠাক
লাগে, সেটা নিয়েই বাড়ি ফিরতে হয়। পরতে
শুরু করলে দেখা দেয় কিছু সমস্যা। কিছুদিন
পরার পরেই আশ্চর্যভাবে সব সমস্যা মিটে যায়। তখন মালুম
হয়, জুতোজোড়া পায়ে দিব্যি ফিট করেছে।
সব শুনে টুম্পা আমাকে প্রশ্ন করে,
“আচ্ছা কাকু, তুমি ঠিক জানো যে নিয়মিত পরলে মাসকয়েক বাদে এই জুতো আমার পায়ে পারফেক্টলি
ফিট করবে?”
“অবশ্যই! গ্যারান্টি দিচ্ছি।” আমি উত্তর দিই।
মেয়ের রাগ পড়ে। গোপাবৌদি স্বস্তির শ্বাস ফেলে আমায় ধন্যবাদ
জানায়।
উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পর টুম্পা
কলকাতায় আমাদের কাছে বেড়াতে এল। দেখা
হতেই বলল, “কাকু, ইউ আর পারফেক্টলি রাইট! সেই ভয়ংকর জুতোটা এখন খুবই ভদ্র ব্যবহার করছে!
পরলে অসুবিধে তো হয়ই না, বরং বেশ আরাম লাগে।”
“যা হওয়ার ছিল, ঠিক সেটাই হয়েছে।” সহাস্যে উত্তর দিলাম
আমি।
এবার আমার ভাইঝি প্রত্যাশিত প্রশ্নটাই
করল, “জুতোর ভোলবদলের পেছনে কী কারণ আছে তা জানতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে। ব্যাপারটা সহজ করে বুঝিয়ে দাও না, কাকু।”
প্রশ্নের সরাসরি উত্তর না দিয়ে বললাম,
“যে কারণে প্রাচীন গ্রিসে সন্ধেবেলা রথের চাকা খুলে ফেলা হত, অথবা যে জন্য ধনুকে সবসময় ছিলা পরিয়ে রাখতে নেই, ঠিক সেই কারণেই কিছুদিন
পরার পর নতুন জুতোর অসুবিধেগুলোও দূর হয়ে যায়!”
টুম্পা অনুযোগের সুরে বলল, “হেঁয়ালি
ছেড়ে সহজ করে বলো না, কাকু। কতদিন
থেকে ভেবে রেখেছি দেখা হলেই তোমায় জিজ্ঞেস করে জেনে নেব। আর তুমি এখন শুধু মজা করছ!”
আমি রক্ষণাত্মক ভঙ্গিতে বলি, “মজা নয় রে টুম্পা, রথের চাকাই আমাদের ঠিক
দিকে নিয়ে যাবে। মানে,
জুতোর চরিত্র বদলের কারণ বুঝতে সাহায্য করবে। লেকচারের স্টাইলে বৈজ্ঞানিক কচকচির বদলে গল্পের ঢংয়ে মোদ্দা কথাটা বুঝিয়ে
বলার মজাই আলাদা, তাই না!”
টুম্পা বলল, “সরি কাকু, বুঝতে পারিনি। চাকা দিয়েই শুরু করো তাহলে।”
আমি ব্যাখ্যান শুরু করলাম। খুঁটিনাটি বাদ দিলে যা বলেছিলাম তা এইরকমঃ
প্রাচীন গ্রিসে রথই ছিল একমাত্র যান। অমসৃণ, পাথুরে পথে চলার জন্য দরকার হত বিশেষ ধরনের চাকা। শক্তপোক্ত, দৃঢ় (রিজিড) চাকা লাগালে এবড়োখেবড়ো রাস্তায় প্রচন্ড ঝাঁকুনিতে রথ ও আরোহী উভয়েরই ক্ষতি
হত। তাই রথে উইলো,
এলম বা সাইপ্রেস কাঠের নমনীয়, হাল্কা চাকা লাগানোই ছিল দস্তুর। ওজন পড়লে চাকাগুলো ধনুকের মতো সামান্য বেঁকে স্প্রিং-এর ন্যায় আচরণ করে ঝাঁকুনি দিত অনেকটাই কমিয়ে। তবে এই চাকার কিছু অসুবিধেও ছিল। স্প্রিং-সুলভ ভালো গুণের পাশাপাশি ছিল স্থায়ীভাবে বাঁকবার মন্দ প্রবণতা। একভাবে দীর্ঘক্ষণ বেঁকে থাকলেই চাকা গোলত্ব খুইয়ে ডিমের মতো আকার নিতে চাইত। রথ স্থির থাকলে চাকা একভাবেই বেঁকে থাকে। তাই দিনের শেষে চাকার ওপর রথের ভার লাঘব করতে খুলে ফেলা হত রথচক্র।
ধনুকের ক্ষেত্রে ছিলা সর্বক্ষণ পরিয়ে রাখলে অনুরূপ কারণে কমে যায় ধনুকের কার্যকারিতা। তাই শুধুমাত্র ব্যবহারের সময়ই ধনুকে ছিলা পরানো উচিত।
এবার পুরো বিষয়টা তলিয়ে ভাবা যাক। আমরা জানি, বলপ্রয়োগে পদার্থের আকারগত পরিবর্তন
হয়, আবার বল হটালে পদার্থ আগের আকারে ফিরে আসে। অবশ্য বল একটি বিশেষ মান অতিক্রম করলে আকারে স্থায়ী পরিবর্তন
আসে, এমনকি পদার্থ ভেঙেও যেতে পারে। কাঠ, চামড়া, কাপড়, দড়ি ইত্যাদির ক্ষেত্রে
এই নিয়মের ব্যত্যয় হতে দেখা যায়। বিশেষ
মানের চেয়ে অনেক কম বলপ্রয়োগেও
স্থায়ী আকারগত পরিবর্তন আসতে পারে এসব জিনিসে। তবে এটা চটজলদি হয় না, এর জন্য লাগে অনেক সময়। বহুদিন ব্যবহারের পর ট্রাউজারের হাঁটুর কাছের
কাপড়টা বেড়ে গিয়ে বেঢপ
দেখায় এই কারণেই।
পুরনো জুতো আরামপ্রদ হয়ে ওঠার পেছনেও
আছে অনুরূপ কারণ। নতুন জুতো পায়ের কোনও স্থানে আঁট হলে জুতোর
চামড়ার সেই অংশে টান পড়ে
এবং এর প্রভাবে সেই জায়গার চামড়া ধীরে ধীরে প্রসারিত হতে শুরু করে। এভাবে
জুতোর চামড়ার আকারগত পরিবর্তনের কারণে নতুন জুতোর অসুবিধেগুলো দূর হয়ে যায়। কষ্টদায়ক নতুন জুতো সময়ের হাত ধরে কালক্রমে হয়ে ওঠে আরামপ্রদ পাদুকা!
টুম্পা প্রবল আগ্রহ নিয়ে আমার কথা শুনছিল। আমি থামতেই বলে উঠল, “কী আজব
ব্যাপার! মা সেদিন পুরনো জুতো ফেলে না দিলে বিজ্ঞানের এতসব ইন্টারেস্টিং খবর অজানাই
থেকে যেত আমার!”
উত্তরে কিছু না বলে শুধুই হাসলাম। কথায় কথায় বেলা গড়িয়েছে বেশ। এবার ওঠা দরকার।
_____
No comments:
Post a Comment