কিচিরমিচির
সুস্মিতা
কুণ্ডু
আজ সেই কোন সক্কাল থেকে ঝিরঝির করে
বৃষ্টি পড়ছে। চারপাশটা কেমন যেন স্যাঁতস্যাঁতে। জানালার বাইরের একফালি আকাশটা গত
দু’দিন ধরে বড্ড ঘোলাটে হয়ে আছে। ধুর! তিতলির একদম ভালো লাগে না এমনধারা বেরঙ আকাশ। এর চে’ ছোটোমাসির গত বছরের জন্মদিনে
দেওয়া আকাশি গাউনটার মতো রঙের আকাশ বেশি পছন্দ ওর।
জামাটায় যেমন সাদা সাদা গোলাপ ফুল বানানো ভেলভেটের,
আকাশের গায়েও অমনি সাদা সাদা ঝুমকো ঝুমকো মেঘ যখন ঘুরে বেড়ায়,
অবাক চোখে চেয়ে থাকে ও। জানালার গ্রিলটায় মাথাটা চেপ্পে ধরে,
মুঠোয় রডগুলো আঁকড়ে বসে থাকে বিছানার ওপর ঘন্টার পর ঘন্টা।
বাবাই খাটটাকে জানালাটার গায়ে সরিয়ে
দিয়েছে একদম, যাতে তিতলি জানালার সামনে বসলেই ওপরে আকাশ
আর নিচে ওদের বাগানটা দেখতে পায়। বাগানে মা নিজের হাতে কতরকম ফুলের চারা লাগিয়েছিল
ক’মাস আগে। নয়নতারা, বেলি, জুঁই, রঙ্গন, দোপাটি, আরও কত কী। তিতলি সবক’টার নাম জানে না। প্রতিবছর
নানারকম মরশুমি ফুল লাগায় মা। শীতকালে গাঁদা,
ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা সব লাগিয়েছিল। সেগুলো
একবার ফুল হয়ে তারপর সব শুকিয়ে মরে গেছে। অন্যান্যবার মা-বাবা, আর রাঙাপিসি মিলে
আগাছা পরিষ্কার করে দেয়। এবারে আর কেউ বাগানের দিকে নজরই করেনি। আগাছায় ভরে গেছে
অনেক, শুকনো গাছগুলোও ফেলা হয়নি। রাঙাপিসি কতরকম সব্জি লাগাত
- বেগুন, টমেটো, ঢ্যাঁড়স, উচ্ছে - এবারে কিচ্ছুটি লাগায়নি। সবাই যে কেন এত মনমরা হয়ে থাকে! একটুও
ভালো লাগে না তিতলির।
দুটো চড়ুইপাখি ক’দিন ধরে খুব তিতলিদের
বাগানে আনাগোনা জুড়েছে। বাইরে যাওয়ার রাস্তাটা বাগানের মধ্যে দিয়েই। নুড়ি বিছানো
পথটা তিতলিদের বাড়ির সদর দরজা থেকে শুরু করে বাগানের ভেতর দিয়ে গেছে রাস্তার ধারের
গেটটায়। ওই সিমেন্টের থামওয়ালা লোহার দরজা লাগানো গেটটার মাথায় চড়ুইদুটো একবার বসে, আবার ফুড়ুৎ করে উড়ে যায়। তিতলি আগে ভাবত ওরা
এমনিই খেলা করে বুঝি, কিন্তু দিন পনেরো আগে ওদের মুখে করে খড়কুটো আনতে দেখে মাকে
জিজ্ঞাসা করেছিল। মা বলেছিল, ওরা নাকি বাসা তৈরি করবে।
গেটের থামটায় তিতলিদেরও এই বাসার
নামটা লেখা আছে, ‘পদ্মালয়’। সাথে বাবার, মায়ের, রাঙাপিসির আর ওর নামও আছে, সাদা শ্বেতপাথরের ওপর কালো কালো অক্ষরে। ঠিক
তার নিচে একটা ছোট্ট খুপরি আছে। লেটার বক্স করার জন্য ছিল, কিন্তু
আর বসানো হয়নি। ওদের বাড়িটায় অনেক কিছুই এরকম অসমাপ্ত, অসম্পূর্ণ পড়ে আছে। তাতেই
খড়কুটো জমা করে বাসা বানাচ্ছে চড়ুইদুটো। ওদের বাসাটাও তিতলিদের বাসাটার মতো,
অসম্পূর্ণ।
তিতলির মায়ের অনেকদিনের স্বপ্ন একটা
নিজের বাড়ির, আর একটা
বাগানের। শহর থেকে দূরে তাই এই মফস্বলে একটু জায়গা কিনে বাড়ি বানাতে শুরু করেছিল
বাবা। কিন্তু মাঝপথে সব থমকে গেল। দু’দিকের বিশাল খরচ সামলানো
যে খুব শক্ত, সেটা তিতলির মতো ছোট্ট মেয়েও বোঝে। বাড়িটায়
এখনও রঙ হয়নি, প্লাস্টার হয়েই পড়ে আছে ভেতরে বাইরে। পাঁচিল
আর গেটটা অবশ্য আগের জমির মালিকেরই দেওয়া ছিল, ওরা নতুন
নেমপ্লেটটা বসিয়ে নিয়েছে। সিঁড়ির ওপরের ছাদটাও টিন দিয়ে ঢাকা। তিতলি ছোট্ট চিবুকটা
হাতের ওপর রেখে ভাবতে থাকে, কবে যে আবার বাগানটায় যাবে!
নতুন জায়গায় এসে পুরনো স্কুলের, পাড়ার বন্ধুদের জন্য বড্ড মন কেমন করছিল।
এখানের স্কুলটায় সবে যেতে শুরু করেছিল, কিন্তু সেরকম কোনও
বন্ধু হওয়ার আগেই ও ঘরবন্দী হয়ে গেল।
কী পচা একটা অসুখ যে ওর হয়েছে!
কিছুদিন ছাড়া ছাড়াই হসপিটালে যেতে হয় - ডাক্তার কাকু, সিস্টারদিদিরা সব ইঞ্জেকশন দেয়। আরও কীসব কঠিন
কঠিন পরীক্ষা হয়। তিতলির বড়ো কষ্ট হয়। এদিকে নল, ওদিকে পাইপ সব নিয়ে যেন নিজেকে
কেমন ওই এলিয়েনদের মতো দেখতে লাগে। আচ্ছা, সিনেমায় দেখায় এলিয়েনদের কত ক্ষমতা।
একটা অমন এলিয়েন যদি তিতলি পেত, কী ভালোটাই না হত। ওর সব রোগ
এলিয়েন বন্ধু সারিয়ে দিত ম্যাজিক করে।
কিন্তু ওগুলো মনে হয় শুধু সিনেমায়, গল্পেই হয়। সত্যি সত্যি মানুষ মরেই যায়। যেমন
ঠামাই চলে গেল। ঠামাই চলে যেতে ওই বাড়িটায় আর কারোর মন বসত না। রাঙাপিসিও সারাদিন
মন কেমন করে ঘুরত। তাই তো ওরা এখানে চলে এল আরও। কিন্তু
আসার মাসকয়েক পরেই তিতলির এই অসুখ ধরা পড়ল,
সবাইকে এক নিমেষে ভাসিয়ে দিল চিন্তার সাগরে।
দুপুরে আকাশ ভেঙে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি এল।
সে কী জলের ছাঁট! তিতলির বিছানাটা জানালার ধারে,
আরেকটু হলেই ভিজে ঢোল হয়ে যেত। বাবাই এসে শিগগির জানলাগুলো বন্ধ করে
দিল। একটু আলতো করে বকে তিতলিকে বলল, “হ্যাঁ
রে মেয়ে! বৃষ্টির জল আসছে ডাকবি তো গলা তুলে কাউকে!”
আজকাল তিতলিকে কেউ ঠিক করে বকেও না।
কী কাণ্ড দেখো! তিতলি নাকি বকুনিও মিস করছে। সত্যি সত্যি ওর শরীর খারাপ করেছে।
আসলে বৃষ্টির ছাঁট গায়ে এসে পড়লেও ও
তখনও চড়ুইদুটোকে দেখেই চলেছিল। বড্ড ভিজে গেছে পাখিদুটো, তাও ওই সিমেন্টের থামের খোপটার মুখে কী যেন
আড়াল করে বসে আছে। সেটাই উঁকিঝুঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করছিল ও, মানে যতটা ওই দেখা যায় আর কী জানালার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে।
নাহ্! ভালো করে কিছু বুঝতে পারা
যাচ্ছে না এতদূর থেকে।
“অ্যাই তিতলি, দুধ খাবি?”
রাঙাপিসির ডাকে মুখ ফিরিয়ে চাইল
তিতলি। হাতে দুধের গ্লাসটা নিয়ে দাঁড়িয়ে।
তিতলি একগাল হেসে বলে, “অ্যাই রাঙাপিসি! এদিকে
আয়, শোন শোন। দ্যাখ, ওই থামে দুটো চড়ুইপাখি। কদ্দিন ধরে আসছে
ওরা। দেখেছিস ওদের তুই?”
“হ্যাঁ তো, দেখেছি তো। ওরা তো বাসা গড়েছে ওই
থামের ফোকরটায়। তুই জানিস না তিতলি? ঐ যে রে, যেখানটায় দাদা
বলেছিল লাল একটা লেটার বক্স লাগাবে।”
“তাআআআই, রাঙাপিসি? কী
মজা! বাসার ভেতর বাসা। কী দারুণ না?”
“তাই তো! আমাদের বাসার ভেতর ওদের বাসা! অ্যাই
জানিস জানিস, ওরা আবার ডিম পেড়েছে।”
“চড়ুইপাখির ডিম! কেমন দেখতে রে রাঙাপিসি?
আমায় বাগানে একবারটি নিয়ে যাবি দেখাতে রে?”
“তোকে নিয়েই যাব তো। তিনটে কেমন ছাই ছাই রঙের
ডিম। এই ছোট্ট ছোট্ট ঠিক মার্বেল গুলির মতো। অ্যাই
তিতলি, কদ্দিন মার্বেল খেলিসনি আমার সাথে? হ্যাঁ রে, তুই কবে ঠিক হবি রে? এবছর দেখ, আমি একা একা একটাও গাছ লাগাতে
পারিনি। দাদা-বৌদিও সবসময় মন খারাপ করে থাকে। আমার মোট্টে ভাল্লাগে না রে তিতলি। তুই শিগ্গির সেরে যা তো, আমরা ফের এক্কা দোক্কা খেলব বাগানে।”
তিতলির খুব মায়া হয় রাঙাপিসির জন্য।
আহা রে, সত্যিই তো বড্ড একা হয়ে পড়েছে ওর সঙ্গীটা। সবাই বলে রাঙাপিসি আর পাঁচজনের
মতো স্বাভাবিক নয়। নামেই রাঙাপিসির বয়স অনেক,
আসলে রাঙাপিসি ওরই মতো বাচ্চা। এই কারণেই নাকি রাঙাপিসির বে’থা হয়নি। ঠাকুমা বলত আর দুঃখ করত।
কিন্তু তিতলি রাঙাপিসিকে খুব
ভালোবাসে। বড়ো হতে তিতলির একদম ভালো লাগে না। বাবার অফিস, মায়ের সংসারের কাজ, কত্তরকমের
কঠিন কঠিন সমস্যা! নাহ্, নেহাতই যদি বড়ো হতে হয় তিতলি মোটেও ডাক্তার, অ্যাস্ট্রোনট
কিচ্ছু হতে চায় না। ও বড়ো হয়ে রাঙাপিসি হতে চায়, ওরকম
বাচ্চাই থাকতে চায়।
“অ্যাই তিতলি, যাবি যাবি? চড়ুইপাখির
বাসা দেখতে? কী ভাবছিস অ্যাত্ত তখন থেকে?”
“কিছু না রে রাঙাপিসি! কাল তো আমার ডাক্তারখানা
যাওয়া। কীসব রিপোর্ট আসবে। তাই দেখে ডাক্তারকাকু বলবেন আমি সেরে যাব না মরে যাব।”
“অ্যাই তিতলি, তুই সত্যি সত্যি মরে যাবি রে?
তুই মরে গেলে আমিও না মরে যাব। আমার একা একা বড়ো কষ্ট হয়। আমার তো
তোর মতো ইস্কুল নেই যে নতুন বন্ধু হবে। মাও আমায় না বলে দুম করে মরে গেল। এখন তুইও
যদি মরে যাস...”
“আহ্ ঠাকুরঝি, ফের এসব উল্টোপাল্টা কথা বলছ তুমি!
তোমার দাদা না মানা করেছে তোমায়? যাও দেখি, টেবিলে মুড়িমাখা
আছে কাঁসিতে, ঝটপট খেয়ে নাও গিয়ে। নইলে একটু বোসো, আমি তিতলিকে ওষুধটা খাইয়ে তারপর তোমায় তরকারি মেখে ডেলা ডেলা করে খাইয়ে
দেবখ’ন মুড়ি।”
“মা! কাল আমার রিপোর্ট আসবে, না গো? মা আমি আবার আগের মতো হব? স্কুলে যাব, বাগানে খেলব, সবরকম
খাওয়ার খাব?”
“হ্যাঁ রে মা! হবিই তো! এই দিনটার আশাতেই তো বসে
আছি কবে থেকে রে মা। আমি যাই এখন, রাজ্যের কাজ পড়ে।”
চোখের জল লুকোতে রান্নাঘরের দিকে
ছুটলেন অনুমিতা। কত মিথ্যে প্রবোধ দেবেন নিজেদের আর ওই একরত্তি মেয়েটাকে? ডাক্তারবাবু
কথাটা যে কানে ভাসছে। “এধরনের রোগ লাখে একটা সারে। তিতলি সেরে উঠলে সেটা মিরাক্যল হবে চিকিৎসাশাস্ত্রের
মতে।”
মিরাক্যল কি হবে কাল? রিপোর্টগুলো কি মিথ্যে করে দেবে সেই অমোঘ
ভবিতব্যকে? হতাশ দুই মা-বাবা ছলনাময়ী আশার প্রলোভনে বুক
বাঁধে নতুন করে।
“বড্ড ঝড় গেল কাল রাত্তিরে, তাই না? উফ্, এতদিন পর জানো ঝড়-বৃষ্টি-রোদ এসব নিয়ে চিন্তা করার কথা মাথায় এল।
নাহলে তিতলির চিন্তাতেই চব্বিশ ঘন্টা...”
“আর ও-কথা ভেব না, অনু।
বিপদের দিন কেটে গেছে। আজ যেমন ঝড় হয়ে মেঘ কেটে গেল, তেমনি আমাদের জীবনের কালো
মেঘও কেটে গিয়ে রোদ ঝলমলে সূর্য উঠেছে।”
“জানো তো, আমার মনে হয়
ভগবানই বুঝি কাল থেকে আমাদের মনের অবস্থা বুঝে প্রকৃতিকে এঁকেছেন। কাল থেকে মেঘের
মতোই আঁধার গুমোট হয়েছিল মনটা। তারপর সারাদিন বুকের মাঝে ঝড়। কী বলবেন
ডাক্তারবাবু! আমাদের তিতলি সেরে যাবে তো?”
“ঠিক বলেছ, অনু। আজ বিকেলে যখন ডাক্তারবাবু আমার
কাঁধে হাত রেখে বললেন, বিক্রমবাবু, মিরাক্যল
ঘটেছে। আমি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। তারপর হসপিটাল থেরে বাইরে
বেরিয়ে দেখি মেঘ কেটে গোধূলির আলো ফুটেছে। আমাদের তিতলি বিপদ মুক্ত।”
বহুদিন পর সন্ধেবেলায় চায়ের কাপ হাতে
এভাবে গল্প করতে বসল মনে হয় বিক্রম আর অনুমিতা,
তিতলির বাবা-মা।
তিতলির ঘর থেকে কচি গলার আওয়াজ আসে, “বাবাই, মা, আজ রাঙাপিসি আমার কাছে শোবে প্লিজ প্লিজ। আজ যে তোমরা বললে সব ঠিক হয়ে
গেছে...”
ডাইনিং টেবল থেকে হেঁকে বিক্রম বলে, “তাই হবে মা, তাই হবে।
রাঙা আজ তোর কাছেই শোবে।”
“তাহলে তো সারারাত গপ্পোই বেশি হবে ঘুমের চেয়ে।”
ছদ্মরাগে বলে অনুমিতা। যদিও গলার সুরে প্রচ্ছন্ন সম্মতিরই লক্ষণ।
“অ্যাই তিতলি, আমার না ভারি আনন্দ হচ্ছে আজ। তুই
আর আমায় ছেড়ে কোত্থাও যাবি না।” আনন্দে তিতলিকে জড়িয়ে ধরে
রাঙাপিসি।
তিতলিও পিসিকে জড়িয়ে ধরে বলে, “না রে, রাঙাপিসি। আমরা আবার আগের মতো থাকব। খেলব,
গাইব, গাছ লাগাব। এই রাঙাপিসি, আমাকে কাল
সকালে চড়ুইপাখির বাসাটা আর ডিম দেখাতে নিয়ে যাবি রে?”
চড়ুইপাখিদের কথা শুনে নিমেষে মুখে
আঁধার নেমে আসে রাঙাপিসির। কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে,
“এ যাআআআহ্, তিতলি! তোকে তো বলাই হয়নি। আজ তো দুপুরে আমি তোদের জন্য
কতক্ষণ অপেক্ষা করলাম। তারপর বাগানে একা একা গিয়ে বসে রইলাম। কী কাণ্ড দেখি জানিস?
চড়ুইদুটো খুব কাঁদছে। ঝড়ে ওদের বাসা পড়ে গিয়ে তিনটে ডিমের একটা ভেঙে
গেছে। মোটে আর দুটো গোটা রয়েছে। আমি আবার ডিমসুদ্ধু বাসাটা ওই খোপটায় তুলে দিয়ে
এলাম।”
রাঙাপিসির মুখে এ-কথা শুনে তিতলি তো থ। মনটা ভারি খারাপ হয়ে যায় তিতলির। মাথা
নেড়ে বলে, “কী বলছিস, রাঙাপিসি! ইসসস্, চড়ুই মা-বাবাটার কত কষ্ট হচ্ছে রে। আমায় যখন
ইঞ্জেকশন দেয়, ডাক্তারকাকু মাথা নেড়ে নেড়ে কীসব বলে, তখন মা-বাবাইও কত কষ্ট পেত। চড়ুইরাও তো মা-বাবা বল? ওদের
না জানি মনে কত ব্যথা লেগেছে। আমি কাল সকালেই বাবাইকে বলব ওই দুটো ডিমসহ বাসাকে
আমাদের বারান্দাটায় তুলে আনতে। তাহলে ওই ডিমগুলোর আর কিচ্ছু হবে না।”
“চড়ুই-বৌ, লক্ষ্মীটি আর
কেঁদো না অমন করে।”
“কাঁদব না গো? আমার অমন
সুন্দর ছানাটা অকালে চলে গেল! ভগবান কী নেই? ঝড় পাঠিয়ে
আমাদের খড়কুটোর বাসা ভেঙে কী পেলেন উনি? আমার বাছার পেরাণটা
নিয়ে কী লাভটা হল ওঁর!”
“এভাবে বোলো না চড়ুই-বৌ! ভগবান অত নিষ্ঠুর নয়।”
“তুমি এখনও এই কথা বলবে, চড়ুই?”
“হ্যাঁ গো, বলব। তুমি তিতলির খবরটা শোনোনি বুঝি?”
“না তো! আবার কোনও খারাপ খবর দিও না তুমি। আমি
সইতে পারব না।”
“তিতলি সুস্থ হয়ে উঠেছে। আর এ নাকি জাদু,
নইলে মানুষের ক্ষমতা ছিল না তিতলিকে সারানোর।”
“জাদু!”
“হ্যাঁ গো চড়ুই-বৌ, হ্যাঁ।
জাদু! স্বয়ং ঈশ্বর করেছেন। আমাদের যে ছানাটা অকালে চলে গেল, সে
তো সত্যি সত্যি যায়নি। তার প্রাণটা ঈশ্বর তিতলির ভেতরে ভরে দিয়েছেন যে। এখন এই
বাকি দুই ছানা, কিচির আর মিচির-এর মতো তিতলিও আমাদেরই সন্তান
গো।”
“এমনটাও হয় গো? তুমি সত্যি
বলছ?”
“হয় না আবার? এই মাত্র তো
তিতলির ঘরের জানলায় বসে শুনে এলুম, তিতলি ওর রাঙাপিসিকে বলছে,
আমাদের বাসাটা ওদের ঘরের বারান্দায় তুলে নিয়ে গিয়ে রাখবে।”
“ভগবান মঙ্গল করুক ওদের। কিচির-মিচির আর তিতলি,
তিন ভাইবোন একসাথেই বড়ো হোক তবে। হ্যাঁ গো, আমায় একবার নিয়ে যাবে ঐ
জানলাটায়, যেখান থেকে তিতলির কথা শোনো তুমি?”
“কেন নিয়ে যাব না? চলো না,
চলো।”
“এই রাঙাপিসি, ওঠ ওঠ, ওঠ
না। সুয্যিমামা মাথায় উঠল যে! জানিস, কাল রাত্রে কী অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছি?”
“উমমম্ তিতলি, এই জন্য
তোর কাছে শুই না। হাবিজাবি স্বপ্ন দেখবি আর আমায় তুলে দিবি।”
“তুই শোন না। কাল স্বপ্নে দুটো চড়ুইপাখি,
ওই যে রে যারা ওই বাগানের গেটটার থামের ফোকরে বাসা করেছে, তারা এই জানালাটায় এসেছিল।”
তিতলির কথা শুনে রাঙাপিসি বিছানায় উঠে
বসল চোখ রগড়ে। “স্বপ্ন... চড়ুই...”
“হ্যাঁ রে! তুই বললি না যে ঝড়ে ওদের ডিম নষ্ট
হয়ে গেছে? আসল তা হয়নি। ওই ডিমের ছানাটার প্রাণটা ঠাকুর আমার মধ্যে ভরে দিয়েছেন।
তাই তো আমার রোগ সেরে গেছে। ডাক্তারকাকু বললেন না মিরাক্যল!”
“মিরাক্যল মানে কী রে, তিতলি?”
ঢুলুঢুলু রাঙাপিসির গালটা টিপে দিয়ে
তিতলি বলে, “তুই না,
কিচ্ছু জানিস না! মিরাক্যল মানে ম্যাজিক, জাদু। ওই জাদু করেই ঠাকুর আমায় চড়ুইপাখির ছানার প্রাণটা দিয়ে
দিয়েছেন। তাই তো চড়ুই-মা আর চড়ুই-বাবা আমার কাছে এসেছিল স্বপ্নে।”
খিলখিল করে হেসে রাঙাপিসি বলে ওঠে, “ওই দেখো, আমায় বোকা বলিস, আসলে
তুই-ই একটা বোকা। স্বপ্ন হবে কেন? সত্যি সত্যি এসেছিল তো ওরা
কাল রাত্রে। বলল, ওদের আরও দুটো ছানা, কিচির
আর মিচির-এর মতো তিতলি, তুইও ওদের ছানা।”
তিতলি অবাক হয়ে চিৎকার করে ওঠে, “হ্যাঁ হ্যাঁ, কিচির-মিচির, এই নামদুটোই তো বলেছিল। আমরা দু’জন কি তবে একই
স্বপ্ন দেখলুম? নাকি সত্যি সত্যিই এসেছিল ওরা?”
এমন সময় মা-বাবা ঘরে ঢোকে। অনুমিতা
বলে ওঠে, “দুই মূর্তিতে সক্কাল
সক্কাল কী কিচিরমিচির করছিস পাখির মতো?”
বিক্রম বলে, “আমাদেরও বল দেখি তোদের সব রহস্য গল্প।”
তিতলি আর রাঙাপিসি একে অপরের মুখ চেয়ে
হেসে ওঠে। ঈশারায় বুঝি বা কিছু কথা হয়। শ্-শ্-শ্... সবকথা বড়োদের জানতে নেই!
_____
অলঙ্করণঃ
রাখি পুরকায়স্থ
khub bhalo galpa
ReplyDeleteখুব সুন্দর গল্প।
ReplyDelete