বিচিত্র পুরস্কার - ইগ নোবেল
অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়
নোবেল পুরস্কারের
কথা আমাদের সবার জানা। প্রতিবছর মোট পাঁচটি বিষয়ে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। সারা
পৃথিবীর মানুষের গোচরে এসে আলোচ্য বিষয় হয়ে ওঠে এই পুরস্কার। সম্ভ্রমের সাথে আমরা সম্মান জানাই কৃতি নোবেল জয়ী বিজ্ঞানীদের।
নোবেলের
পাশাপাশি আরেকটি চমকপ্রদ পুরস্কারের ব্যবস্থা করেছে ‘অ্যনালস
অফ ইম্প্রবাবল রিসার্চ’ পত্রিকা - তার নাম ‘ইগ নোবেল’। ১৯৯১ সালে মার্ক অ্যাব্রাহাম নামের এক
ভদ্রলোক এই পুরস্কারের ভিত্তিস্থাপন করেন। তিনি ছিলেন ‘অ্যনালস
অফ ইম্প্রবাবল রিসার্চ’ পত্রিকার সম্পাদক। ইম্প্রবাবল
রিসার্চ বা অসম্ভাব্য গবেষণার এই পুরস্কার দেওয়ার আসল উদ্দেশ্য হল, গবেষণার বিষয় নিয়ে প্রথমে কৌতুক বা হাস্যরস উপভোগ করা, তারপরে তার মূল উপাদান আত্মস্থ করা। মূল কথা, পুরস্কৃত বিষয়কে অবশ্যই অভূতপূর্ব হতে
হবে। ইগ নোবেলের ম্যাসকটটিও বড়ো বিচিত্র। পল রঁদার বিখ্যাত ভাস্কর্য - দ্য
থিঙ্কারের উল্টানো মূর্তি। অর্থাৎ যারা প্রচলিত রাস্তায় হাঁটে না, বরং উল্টো পথে চিন্তার স্রোত বইয়ে দিয়ে নতুন কোনওদিকে আলোকপাত করে,
তাদেরই ইগ নোবেল দিয়ে সম্মান জানানো হয়। এই পুরস্কার প্রদানের
উদ্দেশ্য কোনওদিক থেকেই কিন্তু বিজ্ঞান বা বিজ্ঞানীদের ছোটো করে দেখানো নয়।
বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করে তোলাই এর মূল লক্ষ্য।
মোট দশটি ইগ
নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয় প্রতিবছর। বিষয়গুলি হল, পদার্থবিদ্যা,
নভোবস্তুবিদ্যা (Astrophysics), রসায়ন, অঙ্ক, ওষুধ, শান্তি ইত্যাদি।
ইগ নোবেল কমিটি বিষয়গুলো অদলবদল করেও দিয়ে থাকে। Ig Nobel আসলে
ইংরাজি শব্দ ‘ignoble’, অর্থাৎ ‘অর্থহীন’
শব্দের অপভ্রংশ। এই পুরস্কারের উদ্দেশ্য, বিচিত্র
বিষয়ের উপর গবেষণারত কৃতিদের সম্মান জানিয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রতি মানুষকে
সচেতন করে তোলা। প্রতিবছর প্রায় ১২০০ মানুষ এই পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে যোগ দেন,
যাদের মধ্যে অনেক নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানীও থাকেন। এবার তাহলে দেখে
নেওয়া যাক কয়েকটি এমন মজার গবেষণার কথা।
১৯৯১ সালে
ফ্রান্সের রসায়ন বিজ্ঞানী বেনভেন্সাইট দাবী করেন, জলের অণুর স্মৃতি ধরে রাখার
ক্ষমতা আছে। জল এবং অন্য পদার্থের মিশ্রণ যতই লঘু করা হোক না কেন, জলের অণু মিশ্রিত পদার্থের প্রাথমিক উপস্থিতির ঘটনাকে স্মৃতিতে ধরে রাখতে
পারে। ধরা যাক, জল ও লবণের মিশ্রণ তৈরি করা হল। এবার সেই মিশ্রণকে আরও জল মিশিয়ে
লঘু করা হল। বেশ কয়েকবার এই মিশ্রণ লঘু করা হলে, সাধারণত মনে
হতে পারে সেই মিশ্রণে লবণের অণুকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। বেনভেন্সাইট বললেন,
জলের অণুর বিশেষ ধর্ম এই যে, সে প্রথমে মেশানো
লবণের উপস্থিতি স্মৃতিতে ধরে রেখে দিতে পারে এবং তার রাসায়নিক ধর্মে সেটা বোঝা
যায়। তরলের এই বিশেষ ধর্ম হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার মূল তত্ত্বে উপস্থিত ছিল অনেক আগে
থেকেই। বিখ্যাত বিজ্ঞান পত্রিকা, ‘নেচার’-এ এই গবেষণা পত্রটি প্রকাশিত হলে বিজ্ঞানীমহলে বেজায় হৈচৈ পড়ে যায়। অনেক
বিজ্ঞানী জলের অণুর এই ধর্ম মানতে অস্বীকার করেন। কিন্তু বেনভেন্সাইটকে ইগ নোবেল
পুরস্কার দেওয়া হয়। ১৯৯৮ সালে বেনভেন্সাইট আবার এক গবেষণাপত্র প্রকাশ করে জানান,
জলের অণুর এই স্মৃতি বা মেমারির তথ্য টেলিফোন এবং আন্তর্জালের
মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন পাঠিয়ে দেওয়াও সম্ভব।
১৯৯৭ সালে
ইউরোপিয়ান জার্নাল অফ ফিজিক্সে বিজ্ঞানী এন্ডার জেইম একটি গবেষণাপত্র জমা করেন। বিষয় ছিল, ‘উড়ন্ত
ব্যাঙ এবং উড্ডীয়ন যন্ত্র’। এই নতুন
উদ্ভূত যন্ত্রে তড়িৎচুম্বকীয় শক্তিকে কাজে লাগিয়ে এক অভাবনীয় বাতাসে ভেসে থাকার
যন্ত্র আবিষ্কারের কথা বলা হয়। বিশাল চুম্বক-কুণ্ডলী ব্যবহার করে দেখিয়ে দেওয়া হয়, উপযুক্ত তড়িতের সাহায্যে কুণ্ডলীর ফাঁকা জায়গায় চুম্বকক্ষেত্র তৈরি করে
একটা শরীরকে ভাসিয়ে রাখা সম্ভব। এই যন্ত্রে উদ্ভূত চুম্বকীয় বল মাধ্যাকর্ষণজনিত
বলের সমান ও বিপরীত হয় বলে ব্যাঙের শরীর শূন্যে ভেসে থাকা সম্ভব। তাদের মত অনুযায়ী,
যেকোনও প্রাণীর শরীরকে এইভাবে শূন্যে ভাসিয়ে রাখা যায়। ইগ নোবেল
পুরস্কার পাওয়ার ১০ বছর পর জেইম পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার পান। তার বিষয় অবশ্য
সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল। সেটি ছিল কার্বনের একটি রূপ, গ্রাফিনের
দ্বিমাত্রিকতা নিয়ে।
২০০১ সালে
পাপুয়া নিউ গিনি দেশের এক হাসপাতালে চার বছরের গবেষণায় জানা যায়, ভর্তি হওয়া রুগীদের ২.৫% মাথায় নারকোলগাছ থেকে খসে পড়া নারকোলের আঘাতের
শিকার। ঘাড়ে, মাথায় ও মেরুদণ্ডে আঘাতপ্রাপ্ত এই রুগীদের চারজনের
চিকিৎসার বিশদ তথ্য সম্বলিত এক গবেষণাপত্র লেখেন পি বারস নামক এক চিকিৎসক। তিনি
জানান, ২৫ থেকে ৩৪ ফুট উঁচু নারকোলগাছ থেকে খসে পড়া ১ থেকে ৪
কেজি ওজনের নারকোল মানুষের মাথায় প্রায় ১০০০ কেজি বলে আঘাত করতে পারে, যার ফলে মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত হওয়া সম্ভব। গবেষক ডাক্তার বারসকে ইগ
নোবেল পুরস্কারে সেই বছর সম্মানিত করা হয়।
ক্যালিফোর্নিয়া
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইভান স্কোয়াব (২০০২ সাল) একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন, যার শিরোনাম ছিল, ‘মাথা ধরার থেকে আরোগ্য লাভের উপায়’। গাছ থেকে ঠুকরে ঠুকরে পোকা খেলেও
কাঠঠোকরাদের মাথা ধরে না কেন, সেই বিষয়ে গবেষণা করেন ইভান। গবেষণায়
জানা যায়, মাথার খুলির এবং মস্তিষ্কের বিশেষ গঠনের জন্য
কাঠঠোকরা সেকেন্ডে ২০ বার এবং দিনের মধ্যে ২০০০০ বার মাথা ঠুকলেও তাদের মাথায় আঘাত
লাগে না বা তাদের মাথাও ধরে না। ২০০৬ সালে ইভানকে পক্ষীবিজ্ঞানে ইগ নোবেল দেওয়া
হয়।
১৯৪৯ সালে
প্রযুক্তিবিদ এডওয়ার্ড মারফি বিভিন্ন যন্ত্র বানানোর প্রচেষ্টায় বারংবার ব্যর্থ
হয়ে একটি অত্যাশ্চর্য সূত্র প্রস্তাব করেন। সেই সূত্র অনুযায়ী, যেকোনও যন্ত্র যদি বিগড়ে যাবার হয়, তাহলে তার
বিগড়ানো কেউ প্রতিহত করতে পারবে না। মারফির প্রস্তাবিত সূত্রের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা
পাওয়া না গেলেও অবিশ্বাস্যভাবে অনেক ক্ষেত্রেই যন্ত্রবিদেরা ঘটনাচক্রের মিল খুঁজে
পান। ২০০৩ সালে প্রযুক্তিতে মরণোত্তর ইগ নোবেল দেওয়া হয় এডওয়ার্ড মারফিকে তার
প্রস্তাবিত মারফির সূত্রের জন্য।
সেই বছরেই ইগ
নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয় উত্তরপ্রদেশের লালবিহারীবাবুকে। দিব্যি বেঁচে থাকা
সত্ত্বেও দুষ্ট আত্মীয়স্বজনের চক্রান্তে ‘মৃত’ বলে ঘোষিত হন। বিশেষ তিনটি কারণের
জন্য তাকে ইগ নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়ঃ
(১) মারা গেছেন
ঘোষিত হওয়া সত্ত্বেও তিনি দিব্যি বেঁচে ছিলেন
(২) সরকারিভাবে
তাকে জীবিত ঘোষণা না করায় সরকারের বিরুদ্ধে তিনি একটানা লেখালেখি করে অবশেষে সরকারিভাবে
নিজেকে জীবিত স্বীকৃতি দিতে বাধ্য করান
(৩) তিনি একটি
সংস্থা স্থাপনা করেন, যার নাম দেন ‘মৃত ব্যক্তিদের সংস্থা’। তার বেঁচে থাকার বিষয়টি ভারত সরকার মেনে
নিলেও আমেরিকা সরকার তাকে ‘মৃত ব্যক্তি’ আখ্যা দিয়ে ইগ নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করবার
জন্য আমেরিকা যাবার সম্মতি দিতে অস্বীকার করে।
২০০৯ সালে
মেক্সিকোর তিন রসায়ন বিজ্ঞানী টাকিলা (একজাতীয় মাদক পানীয়) থেকে হিরে তৈরির পদ্ধতি
প্রস্তাব করার জন্য ইগ নোবেল পুরস্কার পান। ৮৫০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায়
টাকিলার বাস্প স্টেইনলেস স্টিলের পাতের উপর বিশেষ পদ্ধতিতে জমিয়ে হিরের স্ফটিক
বানাতে সক্ষম হন তারা।
ইংল্যান্ডের
পদার্থবিদ লেন ফিসারকে ২০১২ সালে তার ১৯৯৯ সালের একটি চমকপ্রদ কাজের স্বীকৃতি
হিসাবে বিশেষ ইগ নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। বিজ্ঞানী ফিসারের গবেষণার বিষয় ছিল, চা বা কফির কাপে বিস্কুট ডুবিয়ে দিলে সেই বিস্কুট ভিজে নেতিয়ে যাওয়ার পেছনে
লুকিয়ে থাকা বিজ্ঞান। বিস্কুটের ভেতরের চিনি ও স্টার্চ কফি বা চায়ের সংস্পর্শে গলে
যায়, আর নিজের ভারেই কাপের ভেতরে খসে পড়ে যায়। কতটা দৈর্ঘ্য
পর্যন্ত বিস্কুট ডুবালে সেটা খসে পড়ে যাবে না, তার একটি
অভূতপূর্ব গাণিতিক সমাধান আবিষ্কার করেন ফিসার।
২০১৫ সালে
নেদারল্যান্ডের মার্ক ডিগ্নেমান্সে এবং আরও দু’জনকে সাহিত্যে যৌথ ইগ নোবেল
পুরস্কার দেওয়া হয়। তাদের গবেষণা অনুযায়ী, ‘হু’ শব্দটি পৃথিবীর সব ভাষাতেই পাওয়া যায়। সেবছর রসায়নে পুরস্কারপ্রাপ্ত বিষয়
ছিল, সিদ্ধ ডিম থেকে আবার অসিদ্ধ ডিম, অর্থাৎ
কাঁচা ডিম ফিরে পাবার রাসায়নিক প্রক্রিয়া। আর জীববিদ্যায় যে পুরস্কার দেওয়া হয়
সেটি আরও মজার। একটি সঠিক ওজনের কাঠি যদি কোনও মুরগীর পিছনে বেঁধে দেওয়া হয়,
তবে তার হাঁটার চাল ডাইনোসরের চলার সাথে হুবহু মিলে যাবে।
শারীরবিদ্যায়
২০১৭ সালে ইগ নোবেল দেওয়া হয় জেমস হিতকোটকে। তিনি আজ থেকে কুড়ি বছর আগে
গবেষণাপত্রে প্রমাণ করে দেখান, বয়সের সাথে সাথে মানুষের কানের
দৈর্ঘ্য বছরে ০.২২ মিমি বেড়ে যায়। এই গবেষণায় ৩০ থেকে ৯৩ বছরের ২০৬ জন মানুষের উপর
পরীক্ষা করা হয়। এই বছরেই রিওলজির উপর গবেষণা করে ইগ নোবেল পান মার্ক এন্টনি ফারদিন।
রিওলজ তত্ত্ব অনুযায়ী, যেকোনও বস্তু সর্বাবস্থাতেই প্রবাহিত
হয়। তিনি প্রমাণ করেন, এই তত্ত্ব মেনেই একটি বিড়াল, কঠিন ও তরল দুই অবস্থায় থাকতে পারে। গবেষণাপত্রটিতে দেখিয়ে দেওয়া হয়,
বিভিন্ন পাত্রে সেই বিড়াল তরলের ধর্ম অনুযায়ী পাত্রের আকার ধারণ
করতে সক্ষম।
ইগ নোবেলে দেয়
অর্থ যৎকিঞ্চিত হলেও, বিজ্ঞান ও অন্য বিষয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন
চিন্তার বিকাশ ঘটানোর কাজকে স্বীকৃতি দেওয়ায় এই পুরস্কারের অবদান কোনওদিক থেকেই
তুচ্ছ করবার মতো বিষয় নয়। বিজ্ঞানের জটিল বিষয়গুলো কৌতুকরসে সিঞ্চিত করে উপভোগ্য
করে তুলে বিজ্ঞানকে জনমুখী করে তোলাই ইগ নোবেল পুরস্কারের আসল উদ্দেশ্য।
_____
অসম্ভবকে সম্ভব করার বা অভাবনীয় কে বাস্তবিক করে ফেলার এমন ভাবনাই কুর্নিশ যোগ্য।
ReplyDeleteএকদম। ঠিক
Delete