১
রুন্টি-ঝুন্টির
বায়না শুনে সরুদা অবাক হয়ে গেল। এমন বাজে জেদ তো ওরা করে না! সরুদাও
বলল, “মাসিমা ঘরে বেগুনি বানাচ্ছে,
সে ছেড়ে তোরা এখন যাবি সেই বাজারের মোড়ে ফুচকা
খেতে? পাগল হয়ে গেছিস নাকি? স্কুল থাকলে ফেরার পথে ফুচকা
খাস, ঠিক আছে? কাল স্কুল থেকে ফেরার পথে খাবি। ফুচকা তো আর পালাচ্ছে না?”
কে শোনে কার কথা! দুই
বোনে মুখটুখ ফুলিয়ে, নাকে কান্না শুরু করল। “নাহাঁহাঁহাঁ, আঁমরাঁ ফুঁচকা খাঁবোঁ।”
মাসিমা আর কী করেন? দু’বোনের
হাতে কুড়িটা টাকা দিয়ে বললেন, “যা বাবা, তোদের আর কান্নাকাটিতে কাজ
নেই। ফুচকা
খেয়ে শান্তিতে থাক। রোজ রোজ
ফুচকা খেয়ে পেট-টেট খারাপ করলে তখন বুঝবি ঠ্যালা। এখন তো মায়ের কথা শুনবি না!”
সরুদা কিছু বলল না। কুড়িটা টাকা নিয়ে দুই বোনের
ফুচকা খেতে যাওয়ার আনন্দ দেখে বেশ আশ্চর্য হল।
সর্বজিৎ, মানে
সরুদা ফি-বছরে দু-তিনবার প্রফুল্লনগরে মাসিমার বাড়ি আসে মাসিমা আর
চার বোনের আদর আর ভালোবাসার টানে। বড়োবোনের অবিশ্যি বিয়ে হয়ে গেছে। এখন আছে মেজ টুম্পি আর ছোটো
দুই যমজ বোন - রুন্টি আর ঝুন্টি, যাদের কথা আগেই বলেছি। সরুদার বাড়ি কলকাতায়, আর
হস্টেলে থেকে লেখাপড়া করে আইআইটি, কানপুরে। ছুটিতে বাড়ি যাবার আগে ক’দিনের
জন্যে এখান থেকে ঘুরে যায়। এছাড়াও রুন্টি-ঝুন্টিদের ছোটোবেলার দুই
বন্ধু আছে, তারাও যমজ ভাই, নাম রুকু-সুকু। দু’জনেই মানুষ
নয় অবশ্য, অশরীরী যাকে চলতি ভাষায় বলে ভূত। এই রুকু-সুকুও
সরুদার খুব ভক্ত। সরুদা
এলেই তারা রোজ সন্ধেবেলা চলে আসে; মাসিমাদের বাইরের বারান্দায় বসে, সবাই
মিলে জমিয়ে আড্ডা হয়।
বিকেলবেলা বারান্দায় বসে
গরম গরম বেগুনি দিয়ে চা খেতে খেতে মাসিমা, মেসোমশাই, সরুদা
আর টুম্পি গল্প করছিল। এইসব আড্ডা সরুদা একাই জমিয়ে রাখে। এমন মজার মজার কথা বলে আর পেছনেও লাগে খুব। কিন্তু আজকে যেন সরুদা ঠিক
মুডে নেই। মাসিমা
সেটা লক্ষ করে বললেন, “কী রে সরু, তোকে এত গম্ভীর গোমড়ামুখো
কোনওদিন তো দেখিনি। হ্যাঁ
রে, শরীর-টরীর ঠিক আছে তো?”
সরুদা চায়ে চুমুক দিতে দিতে
বলল, ‘না গো মাসিমা, শরীর আমার ঠিকই আছে। তোমার কাছে এসে শরীর খারাপ করে বার্লি খাব, এমন
ভুলেও ভেবো না। কিন্তু...”
একথায় মাসিমা-মেসোমশাই
দু’জনেই খুব হাসলেন। টুম্পি হাসল না। সে লক্ষ করল, সরুদা কিছু একটা বলতে গিয়েও
থেমে গেল। টুম্পি
জিজ্ঞেস করল, “কিন্তু কী, সরুদা?”
সরুদা চায়ের কাপ শেষ করে
টুম্পির দিকে তাকাল। তারপর বড়ো একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “ব্যাপারটা আমার সুবিধের
ঠেকছে না রে, টুম্পি!”
“কোন ব্যাপারটা?”
“এই যে রুন্টু আর ঝুন্টুসোনা জেদ করে ফুচকা খেতে গেল, আমার
কেমন যেন খটকা লাগছে। ওরা কি রোজই এই সময় ফুচকা খায়, মাসিমা?”
মাসিমা বললেন, “হ্যাঁ, রোজই। মাস খানেক হল। রোজ ওদের ফুচকা খাওয়া চাইই
চাই। ফুচকায়
কী যে পায়, বুঝি না বাপু! আমি তো দুয়েকদিন খেয়েছি, চূড়ান্ত
অখাদ্য!”
সরুদা খুব চিন্তিত মুখে
তাকিয়ে রইল বিকেলের আলো শেষ হওয়া আকাশের দিকে। বলল,
“হুম। সেটাই তো খটকার। রুন্টু-ঝুন্টু এত অবাধ্য আর জেদি
মেয়ে তো নয়! ব্যাপারটা কী?”
“ছাড় না, ও নিয়ে এত চিন্তা করিস না। ছেলেমানুষ, এখন
হুজুগ চেপেছে, ক’দিন পরেই ফুচকার দিকে আর ফিরেও তাকাবে না!” মেসোমশাই
বললেন।
সরুদা একটু হেসে বলল, “ঠিকই
আমিই হয়তো বাজে চিন্তা করছি।”
বারান্দায় বসে চারজনের মধ্যে
নানান কথাবার্তা চলতে লাগল, কিন্তু আড্ডা জমে উঠল না। প্রায় আধঘন্টা পর যখন সন্ধে নেমে এসেছে, রুন্টু-ঝুন্টু
ফিরল। ওদের সঙ্গে
এল রুকু-সুকুও। সরুদা
জিগ্যেস করল, ‘রুন্টু-ঝুন্টু, ফুচকা
খাওয়া হল? এখানে দশ টাকায় ক’টা দেয় রে?”
রুন্টু হাসতে হাসতে বলল, “খুব
সস্তা গো, সরুদা। দশটাকায় সাতটা দেয়। সেই জন্যেই তো আমরা দৌড়োই! হি-হি-হি-হি।”
“দশটাকায় সাতটা! বলিস কী? কলকাতায় দুটো তিনটের বেশি
দেয় না তো!”
ঝুন্টু মিচকি হেসে বলল, “তোমরা
বড়োলোকদের জায়গায় থাকো, সেখানে তো দাম বেশি হবেই!”
“হুম। তাই তো
দেখছি। দাঁড়িয়ে
রইলি কেন? বস না, তোরা না থাকায় আড্ডাটা জমছিল
না। রুকু-সুকুও
চলে এসেছে।”
রুন্টু ঘরে যেতে যেতে বলল, “না
গো, একটু শুই। খুব টায়ার্ড লাগছে।”
ঝুন্টুও রুন্টুর সঙ্গে ঘরে
চলে গেল। ওরা চলে
যেতে সরুদা রুকু-সুকুকে জিগ্যেস করল, “হ্যাঁ রে, রুকু
তোরা জানিস, রুন্টি-ঝুন্টি কোথায় ফুচকা খায়?”
রুকু হাসতে হাসতে বলল, “জানব
না? ওই তো বাজারের মুখে বসে রাম অবতার মিশির, বিহারের লোক। বহুদিন ধরেই বসে, কিন্তু
এই মাস কয়েক হল দারুণ নাম করেছে। প্রচুর খদ্দের, বিশেষ করে রুন্টু-ঝুন্টুদের
মতো মেয়েরা! এই সময়টাতেই এত্ত ভিড় যে লাইন পড়ে যায়। কুড়ি মিনিট আধঘন্টা অপেক্ষা
না করলে হাতে শালপাতার বাটি পাওয়া যায় না।”
“আর কী জানিস, লোকটার সম্বন্ধে?”
“আর কী জানব? ফুচকা বানায়, গন্ধরাজ লেবু দিয়ে মশলাদার
আলুচোখা বানায়, হাঁড়ির তেঁতুলজলে ধনেপাতার কুচি ভাসায়। আমরা কোনওদিন খাইনি, কিন্তু
শুনেছি সবমিলিয়ে সে এক লোভনীয় ব্যাপার!”
“উঁহু, ওটুকুতে আমার কাজ হবে না, রুকু-সুকু! রাম
অবতার কোথায় থাকে, সকাল থেকে সারাদিন কী করে, ওর
সঙ্গে বউ-বাচ্চা, সঙ্গীসাথী, বন্ধুবান্ধব কে কে থাকে - সব
খবর আমার চাই।”
“কাল থেকেই আমরা দু’জন লেগে পড়ছি, সরুদা।”
“একদম। এধরনের
লোকরা খুব ভোরে উঠে কাজে লেগে পড়ে। তোদেরও কাজ ভোর থেকেই শুরু হবে।”
মেসোমশাই এতক্ষণ কিছু বলেননি। সব শুনছিলেন। এখন বললেন, “কী
ব্যাপার বল তো? কোনও রহস্যের গন্ধ পাচ্ছিস?”
চিন্তিত মুখে সরুদা উত্তর
দিল, “গন্ধ একটা পাচ্ছি। সেটা সত্যিই রহস্যের কি না সেটাই এখন দেখার।”
২
বোনেরা সবাই স্কুলে চলে
গেল; মেসোমশাই অফিসে বেরোলেন। সাড়ে দশটা নাগাদ জলখাবার সেরে সরুদা বারান্দায়
মাদুর পেতে শুয়ে পড়ল হাতে দুটো গল্পের বই নিয়ে – ‘তিন এক্কে তিন হেমকান্ত
মীন’ আর ‘আলোকতরু’। প্রথমটা
ছোটোদের জন্যে লেখা রহস্য গল্প-উপন্যাসের একটা সংকলন। প্রথমবার এক নিঃশ্বাসে শেষ করার পর আবার ধীরেসুস্থে
পড়ছে, এত ভালো লেগেছে বইটা! প্রথমটা শেষ হলেই ‘আলোকতরু’টা ধরবে - একান্নটা
ছোটো গল্পের সংকলন। প্রথম
বইয়ে সরুদা যখন ডুবে আছে, পাশ থেকে কে যেন হাঁফাতে হাঁফাতে ডাকল, “সরুদা, খবর
আছে!”
চমকে উঠে বসল সরুদা। তাকিয়ে দেখল রুকু এসেছে। সরুদা জিজ্ঞেস করল, “কী
হয়েছে? কী খবর? সুকু কোথায়?”
“সুকু রাম অবতারের বাড়িতেই আছে। আমাকে বলল, চট করে যা, সরুদাকে
খবরটা দিয়ে আয়।”
“কী ব্যাপার বল তো?” সরুদা রুকুর আরও কাছে সরে গেল। তারপর দু’জনে কিছুক্ষণ
কথা বলল। কী বলল
শোনা গেল না। সরুদাকে
খুব চিন্তিত দেখাচ্ছিল।
রুকুর থেকে সব জেনে নিয়ে
সরুদা বলল, “তুই ফিরে যা, সুকুর সঙ্গেই থাক। আমি দেখছি কী করা যায়। তেলিপাড়া মোড়ে গিয়ে বাঁদিকে
মোহন সাউয়ের বস্তি বললে সবাই দেখিয়ে দেবে তো?”
“হ্যাঁ, সরুদা। আর আমরা তো ওখানে থাকছিই।”
“ঠিক আছে।”
সরুদা বই তুলে, মাদুর
গুটিয়ে ঘরে গেল। চট করে
জামাপ্যান্ট বদলে নিল। মাসিমা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “এই অবেলায় তুই আবার কোথায়
চললি?”
সরুদা গম্ভীরভাবে বলল, “বাজার
থেকে ঘুরে আসি একটু। মেসোমশাইয়ের সাইকেলটা একটু নিয়ে যাব, মাসিমা। চাবিটা দাও তো।”
সত্যি কথাটা মাসিমাকে বলতে
পারল না। বললে মাসিমা
বেরোতে দিতেন?
মেসোমশাই আজকাল স্কুটার
ব্যবহার করেন বলে সাইকেলটা তেমন চলে না। সাইকেলটা চালাতে একটু অসুবিধে হচ্ছিল, কিন্তু
তাও লোককে জিজ্ঞেস করে করে থানায় পৌঁছে গেল মিনিট পনেরোর মধ্যে। থানায় কোনও ব্যস্ততা নেই, একজন
হাবিলদার বারান্দার চেয়ারে বসে খৈনি টিপছিল পিটছিল আর গুনগুন রামভজন সাধছিল। সাইকেল লক করে সরুদা হাবিলদারকে
জিজ্ঞেস করল, “ছোটোবাবু ভেতরে আছেন? কথা বলা যাবে?”
হাবিলদার মুখ তুলে তাকাল। কোনও কথা বলল না। ঘাড় নেড়ে ইশারায় বলল, ‘আছেন, ভিতরে
চলিয়ে যান’। সরুদা ভেতরের ঘরে গিয়ে দেখল, ছোটোবাবুর
চেয়ারে কেউ বসে আছেন সামনের অন্য একটা চেয়ারে পা তুলে দিয়ে, মুখের
সামনে খোলা খবরের কাগজ। সরুদা গলা ঝেড়ে বলল, “এক্সকিউজ মি, স্যার। একটা জরুরি কথা বলতে এসেছিলাম।”
সরুদার গলা পেয়ে কাগজ সরিয়ে
ছোটোবাবু তাকালেন। বললেন, “কী
ব্যাপার? মোবাইল হারিয়েছে? নাকি কোনও সার্টিফিকেট?”
সরুদা মৃদু হেসে বলল, “আজ্ঞে
না স্যার, সেসব নয়, অন্য একটা ব্যাপার আপনাকে
রিপোর্ট করতে এসেছি। যদি আমার সঙ্গে এখনই একবার আসেন তাহলে খুব ভালো হয়। অনেকগুলো ছেলেমেয়ে বেঁচে
যায়।”
ছোটোবাবু মুচকি হেসে বললেন, “তার
মানে? আপনি কে? অ বুঝেছি, শখের
গোয়েন্দা? দু-চারখানা বই পড়েই টিকটিকি? ফেলুদা, না
ব্যোমকেশ?”
“আজ্ঞে না স্যার, গোয়েন্দা নই। আপনাকে মোহন সাউয়ের বস্তির একটা ঘরে এখনই নিয়ে
যেতে চাই, খুব জরুরি ব্যাপার!”
“আপনি বললেই যেতে হবে নাকি?
আপনি কি ওই বস্তিতে থাকেন? চেহারা
দেখে তো মনে হচ্ছে না। ওই বস্তির কেউ আপনাকে মারধোর করেছে? কিছু চুরিচামারি করেছে? প্রফুল্লনগরে
ওসব হয় না মশাই, দেড় বছরের ওপর হয়ে গেল, এই
থানায় একটাও ক্রাইম রেকর্ড হয়নি। দুটো সাইকেল চুরি আর বাগানের পেয়ারা চুরি ছাড়া।”
ছোটোবাবু সরুদার কথার কোনও
গুরুত্বই দিলেন না।
সরুদা খুব হতাশ হলেও হাল
ছাড়ল না। গতকাল
বিকেলে রুন্টু-ঝুন্টুর ফুচকা খাওয়া নিয়ে প্রচণ্ড বায়না থেকে একটু আগে পাওয়া রুকুর খবর
পর্যন্ত পুরো ব্যাপারটাই ছোটোবাবুকে বলল। ছোটোবাবু মন দিয়েই শুনলেন। তারপর ভুরু কুঁচকে অনেকক্ষণ
তাকিয়ে রইলেন সরুদার দিকে।
“আপনি আইআইটি কানপুরে পড়েন বললেন? এখানে মাসির বাড়ি, মাঝে
মাঝে বেড়াতে আসেন, তাই তো? মুকুন্দবাবু আপনার মেসোমশাই? মুকুন্দবাবুর
সঙ্গে কিছু ভূতুড়ে ব্যাপার জড়িয়ে আছে,
এমন কথাও আমার কানে এসেছে। অনেকগুলি ঘটনা অদ্ভুতভাবে
সমাধান হয়ে যেতে দেখেছি এবং শুনেছি। হুম,
চলুন তো দেখি, আপনার খবরটা পাকা কি না। এমনিতে আমাদের প্রফুল্লনগর
ভীষণ শান্তির জায়গা। বসে থেকে থেকে আমাদেরও শরীরে জং ধরে যাচ্ছে। আপনার কথামতো না হয় খামোখা একটু ঘুরেই আসি, চলুন।”
সরুদা স্বস্তির নিঃশ্বাস
ফেলে বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ, স্যার।”
বাইরে এসে ছোটোবাবু বাইকে
উঠলেন। সরুদাকে
সাইকেলে হাত রাখতে দেখে ছোটোবাবু বললেন,
“ধুর মশাই, পেছনে চেপে পড়ুন তো, সাইকেল
যেমন আছে থাক। এই তো
যাব আর আসব।”
৩
খবরটা ছড়িয়ে যাওয়াতে বিকেলের
পর থেকেই প্রফুল্লনগরে হৈচৈ পড়ে গেল। আর সন্ধের থেকে যত ভিড় সরুদার মাসিমার বাড়িতে। সকলের মুখেই এক কথা। সর্বজিৎ না থাকলে কী সাংঘাতিক
কাণ্ডই না হতে যাচ্ছিল! স্কুলের ছোটো ছোটো মেয়েগুলো মজা করে ফুচকা খায়, চুরমুর
খায় - সেই খাবারেও এভাবে কেউ ছাইপাঁশ মেশায়? ছি ছি ছি! এই
একই আলোচনা সবার মুখে। আজকের এই ঘটনায় টুম্পি এবং রুন্টি-ঝুন্টিদের কোচিং ক্লাসেও
ছুটি দিয়েছে। কিন্তু
বাড়িতে থেকে চা করতে করতে টুম্পির প্রাণ বেরিয়ে যাওয়ার যোগাড়! পাড়ার
যত কাকিমা, মাসিমা, বৌদিরা, স্কুলের
বন্ধুদের মায়েরা সবাই আসছেন দলে দলে,
আর টুম্পিকে বারবার রান্নাঘরে দৌড়তে হচ্ছিল চা
করে আনতে। সরুদাকে
সবাই যত ধন্য ধন্য করছিল, সরুদা ততই লজ্জা পাচ্ছিল। মুখে অস্বস্তির হাসি নিয়ে বারবার বলছিল, “না
না, তেমন আর কী করেছি? সবই ভগবানের দয়া আর মাসিমার আশীর্বাদ। যা করার থানার ছোটোবাবুই
করেছেন।”
রাত মোটামুটি সাড়ে ন’টা নাগাদ
লোকজন আসা যখন বন্ধ হল তখন সবাই এসে বারান্দাতে বসল। ভিড় কমতে রুকু-সুকু দুই ভাইও এসে উপস্থিত
সামনের পেয়ারাগাছের তলায়। সকলেই খুব ক্লান্ত, আবার খুব আনন্দও হচ্ছে। সত্যি সরুদার কোনও জবাব নেই। কী করে যে ওর মাথায় আসে
কে জানে? মেসোমশাই লম্বা একটা শ্বাস ছেড়ে বললেন, “ওফ্, বিকেল
থেকে যা চলছে! তা হ্যাঁ রে সরু, কী দেখে তুই বুঝলি যে এমন
কিছু একটা কাণ্ড ঘটছে?”
সরুদা হাসল। বলল, “কাল
রুন্টিসোনা, ঝুন্টিসোনার ফুচকা খেতে যাওয়ার ঝোঁক দেখেই আমার
খুব সন্দেহ হচ্ছিল। স্কুল
থেকে ফেরার সময়েই ওরা রোজ ফুচকা খায়। গতকাল ছিল রোববার, স্কুল ছুটি। মোটামুটি একই সময়ে ওদের
ফুচকা খেতে যেতেই হবে! রুন্টি-ঝুন্টিকে এমন অদ্ভুত জেদ
আর বায়না করতে আমি অন্তত কোনওদিন দেখিনি। তারপর ওরা ফুচকা খেয়ে সন্ধেবেলা ফিরে এসে বলল, একটু
শুই, খুব টায়ার্ড লাগছে। অন্যদিন তাও সকাল থেকে স্কুল থাকে, ক্লান্ত
হতে পারে, কিন্তু রোববার সারাদিন বাড়িতে বসে থেকেও শুধু ফুচকা
খেয়ে ক্লান্ত হয়ে গেল কেন?”
সরুদা একটু থামল দেখে মেসোমশাই
বললেন, “কাল তুই ওদের ফুচকা খাওয়া নিয়ে খুব চিন্তা করছিলি
দেখে আমি ভেবেছিলাম, তোর যত বাড়াবাড়ি। কিন্তু এখন দেখছি, তুই সত্যিই গ্রেট! তোর
মাসিমা ঠিকই বলে, তুই হিরের টুকরো!”
মাসিমা এই সুযোগ ছাড়লেন
না। বললেন, “দেখলে
তো? আমি সরুকে হিরের ছেলে বলি বলে তুমি আর তোমার মেয়েরা আমাকে খুব ঠাট্টা করতে। এখন নিজেই স্বীকার করলে
তো?”
সরুদা মুখে লজ্জা লজ্জা
হাসি নিয়ে বলল, “কী যে বলো না, মাসিমা!”
মেসোমশাই তাড়াতাড়ি কথাটা
চাপা দিতে বললেন, “আচ্ছা আচ্ছা, সরু হিরে কি চুনি সে আলোচনা
পরে হবে। আগে কীভাবে
কী করে ফেলল, সেটা শুনি।”
সরুদা বলল, “এর
পরেরটা যা করেছে, সে রুকু-সুকু। আজ ভোর থেকেই রুকু-সুকু রাম
অবতারের ঘরে গিয়ে ওর সঙ্গে সঙ্গেই সারাক্ষণ ছিল। রাম অবতার এখানে একলাই থাকে, ওর
বউ-বাচ্চা থাকে ভাগলপুরের কোনও গ্রামে। ওর ঘরের পাশের ঘরগুলোতেও আরও অনেক ফুচকাওয়ালা থাকে। ওরা কেউই কিন্তু নিজেরা
ফুচকা বানায় না। ফুচকার
কারিগর এসে, প্লাস্টিকের ব্যাগে রেডিমেড ফুচকা সাপ্লাই দিয়ে
যায়। যার যেমন
বিক্রি, কেউ পাঁচশ কেনে, কেউ হাজার - এরকম
আর কী! সকালবেলা রাম অবতারদের প্রধান কাজ বড়ো বড়ো সস্তার
আলু সেদ্ধ করে ফেলা, আর মশলা বানানো। মশলা বলতে লঙ্কার গুঁড়ো, ধনে
আর জিরে ভেজে গুঁড়ো করা।”
সরুদা একটু থামল। সবাই সরুদার কথা মনে দিয়ে
শুনছিল। হঠাৎ থেমে
যাওয়াতে সকলেই অধৈর্য হয়ে উঠল। টুম্পি বলল, “থামলে কেন? বলো।”
সরুদা মুখে ফচকে হাসি নিয়ে
বলল, “দাঁড়া, মশলা বানানো হোক।”
সরুদার কথায় রুকু-সুকু হো
হো করে হেসে উঠল। টুম্পি
রেগে উঠে মুখ ভ্যাঙাল রুকু-সুকুকে। বলল,
“হ্যা-হ্যা-হ্যা। খুব হাসি, না? যেমন
হয়েছে সরুদা, তেমনি তার দুই চ্যালা। হিরের টুকরো না হাতি, লোহার টুকরো, তাও
জং ধরা।”
টুম্পির কথায় সরুদাও হাসল
খুব। তারপর
বলতে লাগল, “ফুচকাওয়ালাদের পাশাপাশি ঘরগুলো খুবই ছোট্ট। মশলা বানানো, আলু
সেদ্ধ – ওরা যা কিছু করে, সবই ঘরের সামনের টানা লম্বা
বারান্দায়। ওই মশলা
বানিয়ে ফুচকাওয়ালারা একটা ডাব্বায় ভরে রাখে। ফুচকা বিক্রি করার সময় ডাব্বার থেকে মশলা নিয়ে
সেদ্ধ আলু মাখে ফুচকার পুর বানানোর জন্যে। অন্য ফুচকাওয়ালারা বারান্দায় বসে নিজেদের মধ্যে
গল্প করতে করতে ডাব্বায় মশলা ভরে ফেলল। কিন্তু রাম অবতার বানানো মশলা নিয়ে ঘরে গেল। সেখানে তালা দেওয়া ট্রাঙ্ক
খুলে বের করল ছোট্ট একটা প্লাস্টিকের প্যাকেট। প্যাকেটে ছিল সাদা কিছু একটা গুঁড়ো। সেই সাদা গুঁড়ো দু’চামচ নিয়ে
ঢেলে দিল মশলাতে। তারপর
ভালো করে মিশিয়ে ভরে নিল ডাব্বা।”
“ওই সাদা গুঁড়োটাই তার মানে নেশার জিনিস, সরুদা?” টুম্পি
ভীষণ উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করল।
“তখন ঠিক বুঝিনি। তবে এটুকু বুঝেছিলাম, ওই গুঁড়োটা মেশানোর জন্যেই
রাম অবতারের খদ্দের বেড়ে যাচ্ছে দিন দিন। টানা চার-পাঁচদিন কেউ যদি ওর ফুচকা
খায়, সে আর অন্য কোথাও ফুচকা খেতে যাবে না। আর নির্দিষ্ট সময়ে ফুচকা না খেয়ে থাকতেও পারবে
না। তাছাড়া
ওর কাছে লোকেরা রোজ ফুচকা খাবে নাই বা কেন? অন্যদের থেকে ওর দাম যে
সব থেকে সস্তা! পরে থানার ছোটোবাবু ট্রাঙ্ক খুলে বললেন, প্যাকেটের
ওই সাদা গুঁড়োটা হেরোইন, যাকে ব্রাউন সুগারও বলে। নিয়মিত সামান্য পরিমাণে খেলেও একধরনের নেশা তৈরি
হয়ে যায়।”
“কী সর্বনাশ! রুন্ট-ঝুন্টু তার মানে নেশায় পড়ে
গেছিল?” মাসিমা আঁতকে উঠলেন।
“ঠিক তাই, মাসিমা। এখনও তেমন ভয়ংকর কিছু হয়নি, কিন্তু
আরও কিছুদিন এমন চললে ভয়ংকর হতে পারত।”
সরুদা রুন্টু-ঝুন্টুর
দিকে তাকাল। বলল, “কী
রে রুন্টিসোনা, ঝুন্টিসোনা, আজকে ফুচকা না খেয়ে কেমন
মনে হচ্ছে? কয়েকদিন অস্বস্তি থাকবে, ধীরে
ধীরে ভালো হয়ে যাবি, চিন্তা করিস না।”
ওরা দু’বোনে কোনও
কথা বলল না, মাথা নিচু করে রইল। মাসিমা কিছু বলতে যাচ্ছিলেন ওদের। সরুদা হাতের ইশারায় মানা
করল। বলল, “একটু
সময় দাও। ওরা ভুল
বুঝতে পেরেছে।”
তারপর সরুদা আবার বলতে শুরু
করল, “ওই সাদা গুঁড়োটা দেখে রুকু-সুকুর মনেও সন্দেহ হয়েছিল। সুকু তাই সঙ্গে সঙ্গে রুকুকে
পাঠিয়েছিল আমায় খবর দিতে। আমিও আপনার সাইকেলটা নিয়ে দৌড়লাম থানায়। ওই যাহ্, সাইকেলটা থানাতেই রয়ে গেছে। কী হবে? এখন
যাই, গিয়ে নিয়ে আসি।”
মেসোমশাই বাধা দিয়ে বললেন, “থাক, এই
রাত্তিরে আর থানায় গিয়ে কাজ নেই, কাল সকালে আমি গিয়ে নিয়ে আসব।”
সেই সময়েই একটা বাইক এসে
দাঁড়াল বাগানের গেটের বাইরে। আধো অন্ধকারে চেনা যাচ্ছিল না। বাইরে থেকেই কেউ একজন ডাকল, “মুকুন্দবাবু, বাড়ি
আছেন নাকি?”
মেসোমশাই বেশ অবাক হলেন। কিন্তু সরুদা ঠিক চিনতে
পেরেছে। উত্তর
দিল, “সুনন্দকাকু? আসুন আসুন, মেসোমশাই বাড়িতেই আছেন। মেসোমশাই, থানার
ছোটোবাবু সুনন্দ হাজরা এসেছেন।”
সরুদা শেষ কথাটা মেসোমশাইকে
বলেই দৌড়ে গেল। গেট খুলে
সুনন্দবাবুকে ভেতরে আনল। সকলেই উঠে দাঁড়ালেন সুনন্দবাবুকে দেখে। সুনন্দবাবুও বারান্দায় উঠে এসে একধারে বসলেন। বললেন, “আপনাদের
ছেলে, এই সর্বজিৎ, জুয়েল ছেলে মশাই। আমাদের চোখের সামনে এমন
একটা কাণ্ড হচ্ছিল, কেউ জানতেই পারিনি, আর ওই ছেলে কিনা দু’দিন এসেই
ধরে ফেলল!” তারপর টুম্পির দিকে তাকিয়ে বললেন, “একগ্লাস
জল খাওয়াতে পারবে, মা?
খুব তেষ্টা পেয়েছে। আপনারা বসুন না, দাঁড়ালেন কেন? বেশ
আড্ডা চলছিল, বাইরে থেকে দেখছিলাম। ও সর্বজিৎ, তোমার সাইকেলটা আমাদের হাবিলদার
দুলিরাম নিয়ে আসছে। এসে যাবে
এখনই। রাম অবতারকে
জিজ্ঞাসাবাদ করে অনেক খবর পেয়ে গেছি,
ভাই। যাদের থেকে ওই মাদক ও যোগাড় করত তাদের পুরো খবর। আশা করি দুয়েকদিনের মধ্যেই
সব মাছ জালে ধরা পড়বে।”
সুনন্দবাবু একটু থেমে থেকে
বললেন, “আজকাল দুটো পয়সার লোভে মানুষ কী না করতে পারে, অ্যাঁ? বাচ্চা
বাচ্চা মেয়েগুলোকে সস্তায় ফুচকা খাওয়াচ্ছে মাদক মিশিয়ে? চিন্তা করা যায়?”
টুম্পি কাচের গ্লাসে জল
এনে সুনন্দবাবুকে দিল। এক চুমুকে খালি করে গেলাসটা টুম্পিকে ফেরত দিলেন সুনন্দবাবু। টুম্পি জিজ্ঞেস করল, “চা
খাবেন তো?”
হাসতে হাসতে সুনন্দবাবু
বললেন, “ধুর পাগলি, এত রাত্রে কেউ চা খায়? চা
খেতে আরেকদিন আসব সময় করে। আমি এখন উঠি। আর যে কথা বলার জন্যে এসেছিলাম, মুকুন্দবাবু, আপনি
সর্বজিৎকে নিয়ে কাল সকালের দিকে থানায় একবার আসবেন তো, কিছু সই-সাবুদ
করার ব্যাপার আছে। সাড়ে ন’টা দশটা
নাগাদ গেলেই হবে।”
মেসোমশাই বললেন, “আচ্ছা।”
কিন্তু মাসিমা খুব উদ্বিগ্ন
হয়ে বললেন, “সুনন্দবাবু, একটা কথা ছিল। ওদের ওইসব সই-সাবুদের
মধ্যে না জড়ালে হয় না?”
সুনন্দবাবু ভুরু কুঁচকে
কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন মাসিমার দিকে। তারপর বললেন, “ভয় লাগছে? তা
লাগারই কথা। কথায় বলে, পুলিশে
ছুঁলে ছত্রিশ ঘা। ঝামেলাও
তো কম পোয়াতে হবে না! এই কেস কতদিন গড়াবে কে জানে। মাঝে মাঝেই কোর্টে উঠতে
হবে সাক্ষ্য দিতে। সেখানে
উকিলের জেরা-টেরা - অনেক ঝক্কি, অনেক সময় বরবাদ। অফিস কামাই, কলেজ
কামাই। না না, সেই
ভালো, আমি আমাদের তরফ থেকেই কেস সাজাব। আপনাদের কথা উল্লেখই করব
না। ঠিক আছে, ম্যাডাম? তবে
সর্বজিৎকে আমার অনুরোধ, তোমার সেই দুইভাই, যাদের রাত্রে নাকি নাম নিতে
নেই তাদের থেকে বদমাশদের কিছু কিছু খবর আমিও যদি পাই, তাহলে আমারও কাজ করতে সুবিধে
হবে। ওই তো, দুলিরাম
এসে গেছে সর্বজিতের সাইকেল নিয়ে। থানার দিকে তোমাদের আর গিয়ে কাজ নেই। কেমন? আসি?”
সরুদা দুলিরামের থেকে সাইকেলটা
নিল। সুনন্দবাবু
গেটের বাইরে গিয়ে বাইকে উঠে স্টার্ট দিলেন। বললেন, “গুড নাইট, মুকুন্দবাবু। আমি কিন্তু ফোন করব। উঠে পড় দুলিরাম, সারারাত
এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবি নাকি?”
দুলিরাম বাইকের পেছনে চড়তেই
সুনন্দবাবু বেরিয়ে গেলেন বাইক নিয়ে।
_____
অলঙ্করণঃ পুণ্ডরীক গুপ্ত
No comments:
Post a Comment