জঙ্গলে সমুদা
রণিত ভৌমিক
সময়ের স্রোতে কবে যে বড়ো
হয়ে উঠলাম তার টের পেলাম না। আজও জীবনে অনেক কিছুই অজানা রয়ে গেছে, কিন্তু এই জানা-অজানার খেলায় আমি সমুদাকে সাথে পেয়েছি
বলেই হয়তো এতটা পথ অতিক্রম করতে পেরেছি। সমুদার এই অদ্ভুত দুনিয়ায় শুধু রোমাঞ্চই নেই, তার সাথে আছে
এক ভালো লাগা। যে ভালো লাগা আমায় বারবার তার সাথে জুড়ে দিয়েছে এইসকল বিভিন্ন পরিস্থিতির
মুকাবিলা করতে। তার থেকেই
আমি শিখেছি জীবনে কীভাবে সমস্যার সঙ্গে মোকাবিলা করতে হয়। সমুদাই হল আমার জিয়নকাঠি।
অনেকদিন কোথাও ঘুরতে যাওয়া
হয়নি, তাই মনটা ভীষণ খারাপ। পরীক্ষা শেষ, সব বন্ধুরাই কোথাও না কোথাও
ঘুরতে গেছে, কিন্তু আমি ঘরবন্দি। আমার কষ্ট দেখে সমুদা বাবাকে ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার
জন্য রাজি করাল, কিন্তু কাজের চাপে বাবা
যেতে পারবে না বলেই দিল। ফলে
সমুদার কাঁধেই এই ভার পড়ল। এখন কথা হল,
আমরা যাব কোথায়?
অনেক চিন্তাভাবনা করার পর
সমুদা ঠিক করল, জঙ্গলে বেড়াতে যাব। তার প্রস্তাবেই আমাদের সুন্দরবন
যাওয়া ঠিক হল। ব্যস! আর দেরি নয়, কিছুদিনের মধ্যেই আমরা বেরিয়ে পড়লাম সুন্দরবনের উদ্দেশ্যে।
সমুদার কথামতো খুব ভোরেই
শিয়ালদহ স্টেশন থেকে ট্রেনে রওনা দিলাম ক্যানিং-এর পথে। বাবাকে দেখে একটু চিন্তিত লাগল, তবে এ তো আর প্রথম নয়!
আমি বাবা ছাড়াই সমুদার সাথে
সেবার মালদা এবং পরে পুরুলিয়া গেছি। কিন্তু ট্রেন ছাড়ার পর বুঝলাম, এই চিন্তা একজন বাবার পক্ষে করাটাই স্বাভাবিক কারণ এটা
জঙ্গলে ঘুরতে যাওয়া - এই জঙ্গল আর পাঁচটা ভ্রমণকেন্দ্রর মতো একেবারেই নয়। এখানে যেমন আছে রোমাঞ্চ, প্রাকৃতিক
সৌন্দর্য, ঠিক তেমনি
আছে একটা ভয়ের আশঙ্কা। যেই ভয় হয়তো বাবাকে সেই মুহূর্তে বাধ্য করেছে চিন্তিত
হতে।
ক্যানিং পৌঁছে আমরা এক ধাবায়
দুপুরের খাওয়া সেরে নিলাম। ওই ধাবাতেই এক ব্যক্তির সাথে সাক্ষাৎ হল। তিনিই আমাদের সুন্দরবন যাওয়ার সবচেয়ে ভালো পথ বলে
দিলেন। সেই পথ
অনুসরণ করেই আমরা এগিয়ে চললাম এবং এসে পৌঁছলাম গড়খালি।
সমুদাকে আমি উত্তেজনার সাথে
জিজ্ঞেস করলাম, “সমুদা, এবার কি আমরা মোটর বোটে চড়ব?”
সমুদা ঠাট্টার ছলেই উত্তর
দিল, “সাঁতার কেটেও যাওয়া যায়,
কিন্তু তোকে সেই কষ্ট দেব না। আমরা
মোটর বোটেই বাকিটা পথ যাব।”
আমরা তারপর ফেরিঘাটের দিকে
এগিয়ে গেলাম এবং সেখানে গিয়ে বেশ কিছুক্ষণ মোটর বোটের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হল।
অবশেষে অনেক প্রতীক্ষার
পর ঘাটে আসা এক মোটর বোটে আমরা আরও কিছু
পর্যটকের সঙ্গে উঠে পড়লাম এবং খানিকক্ষণের মধ্যেই শুরু হল মোটর ঘোরার আওয়াজ আর সেই
সঙ্গে বোট চলতে আরম্ভ করল গোসাবার উদ্দেশ্যে। এতটা পথ জলের মধ্যে দিয়ে যাওয়া যেন কোনও রোমাঞ্চকর
পরিস্থিতির থেকে কম নয়।
গোসাবা পৌঁছতে আমাদের সন্ধে
হয়ে গেল। সমুদা
আগেই এক লজ ঠিক করে রেখেছিল, তাই সেখানেই সরাসরি গিয়ে উঠলাম। লজে ঢুকেই আমি ছুটলাম ঘরে
আর সমুদা গেল সামনের বাজারটা একটু ঘুরে দেখতে। সেদিন রাতে আমরা তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, কারণ পরদিন সকালেই শুরু হবে আমাদের আসল সুন্দরবন দেখা।
কথামতোই পরদিন সকালে জলখাবার
সেরে আমরা মোটর বোটে বেরিয়ে পড়লাম সুন্দরবনের সৌন্দর্য উপভোগ করতে। এবারের বোটটা লজের মালিকই
ঠিক করে দিয়েছিল, ফলে এতে ছিলাম শুধু আমি আর সমুদা এবং সঙ্গে অবশ্য সেই বোটের
দু’জন কর্মীও ছিল। বেশ ভালো লাগছিল আমার, এ যেন এক আলাদা
অনুভূতি। দু’ধারে সবুজে ভরা জঙ্গল, মাঝে শুধু জল আর তার উপর দিয়ে এগিয়ে চলছে আমাদের বোট।
সময়ের সাথে অনেকটা পথই অতিক্রম
করে এসেছি, কিন্তু আমাদের মধ্যে
কোনও ক্লান্তিভাব নেই। মনে হচ্ছিল যেন সব ক্লান্তিকেই গ্রাস করেছে প্রকৃতির
এই সৌন্দর্য। দারুণ
কাটছিল সময়, কিন্তু হঠাৎ বোটের মোটর
গেল বিগড়ে। অনেক চেষ্টার
পরেও সেই মোটর আর কিছুতেই সারানো গেল না। আমাদের বোট জলে ভাসতে লাগল, আর তখনই মনের
মধ্যে কেমন যেন একটা ভয় উঁকি দিচ্ছিল। ওই
মুহূর্তে আমার চোখ পড়ল কুমীরের দিকে। পারে উঠে তারা তখন রোদ পোয়াচ্ছেন।
সমুদাকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, “এবার আমরা কী করব, সমুদা? এখানেই কি আটকে থাকব?”
উত্তরে সমুদা বলল, “ভয় পাস না। এখানে এরকম মাঝে মধ্যে হয়, আমি ভেবেছিলাম
লজের মালিক এইসব ব্যাপারে একটু সতর্ক থাকবে। কিন্তু না, তার এই অতি আত্মবিশ্বাসের
কারণেই আমাদের এই অবস্থা।”
সমুদার কথা শুনে বুঝলাম, ব্যাপারটা জটিল না হয়েও যেন জটিল হয়ে উঠেছে। সুতরাং আমাদের এই সমস্যা
থেকে বেরনো এখন সম্পূর্ণভাবে ঈশ্বরের হাতে। এর মাঝেই দেখি,
একটা বড়ো মোটর বোট আমাদের সামনে এসে হাজির। আমি ভাবলাম, লজের মালিক হয়তো পাঠিয়েছেন। কিন্তু না, এই বোটে ছিলেন
অন্য এক ভদ্রলোক এবং ওঁর সঙ্গে রয়েছে ওই বোটের আরও তিনজন কর্মী। আর অবশ্যই তাদের সঙ্গে রয়েছে
একটা ছোটো বোট।
ওঁকে দূর থেকে দেখে বুঝেছিলাম, যে উনিও আমাদের
মতো এখানে ঘুরতে এসেছেন। কিন্তু নিজের মুখে ওঁর কাছে সাহায্য চাওয়ার আগেই
উনি আমাদের উদ্দেশ্যে বললেন, “গুড
আফটারনুন! আপনাদের
বোট কি জলে ‘ড্যামেজ’ হয়ে গেছে? আপনাদের কোনও ‘প্রবলেম’ না থাকলে আমার বোটে ‘কাম’ করতে পারেন।”
আমি ওই অবস্থায় ওঁর কথা
শুনে হাসব কি হাসব না, তা ঠিক
করে উঠতে পারছিলাম না। উনি যে ক’টা শব্দ প্রয়োগ করলেন, তা শুনে যে কারোরই হাসি পাওয়া স্বাভাবিক। সমুদা আমাকে নিয়ে ওঁর আনা বোটে উঠে পড়লেন এবং ওঁর
বোটের কর্মীরা দেখলাম আমাদের বোটের সাহায্যে এগিয়ে এল।
তারপর আমরা ওই ব্যক্তির
সাথে ওঁরই ভাড়া করা বোটে ঘুরতে লাগলাম সুন্দরবন আর অবশ্যই সেই সফরে ছিল সাথী হয়ে ওঁর
ইংরেজি-বাংলা ভাষার মিশ্রণে কথা বলার ধরন।
প্রথম সাক্ষাতেই ওঁকে আমার
বেশ ভালো লেগে গেছিল। সেটা শুধুমাত্র ওঁর কথা বলার ধরনের জন্যই নয়, ওঁর হাসি,
ওঁর খোলা মনের জন্যও। ওঁর চেহারার বর্ণনা দিতে গেলে বলতে হবে, উনি স্থূলদেহ
হলেও খুব একটা লম্বাও নন, আবার বেঁটেও নন। ওঁর গায়ের রঙ মাঝারি, মাথায় অল্প
চুল আর রয়েছে মোটা একটা কালো গোঁফ।
প্রথমদিকে উনি আমাদের সাথে
কথা বলতে একটু দ্বিধাবোধ করলেও পরে আর থাকতে না পেরে সমুদাকে প্রশ্ন করে বসলেন, “আপনারা কোন ‘প্লেস’ থেকে ‘কামিং’ জানতে
পারি?”
উত্তরে সমুদা বলল, “কলকাতা।”
কলকাতা শুনেই ওই ব্যক্তি
বলে উঠলেন, “কলকাতা! আমি ‘ঠু কাম ফ্রম’ কলকাতা। তবে ‘ফ্রম সাউথ’, ওই গড়িয়া থেকে। আর আপনারা?”
এই প্রশ্নের জবাব দিলাম
আমি। “আমরা উত্তর কলকাতা থেকে আসছি।”
আমার কথা শুনে উনি আমার
উদ্দেশ্যে বললেন, “তোমার
‘নেম’ কী?”
আমি নিজের ও সমুদার নাম
বললাম ওঁকে এবং উনি শুনে বললেন, “আমি
বনবিহারী গুপ্তপতি, পেশায় একজন ‘ফটোগ্রাফার’। কলকাতায় আমার তোলা ছবির ‘মেনি এগজিবিশন হ্যাপেনস’।”
শুনেই সমুদা ওঁকে প্রশ্ন
করল, “আপনিই কি সেই আলোকচিত্রকর বনবিহারী
গুপ্তপতি?”
উনি তখন হেসে বললেন, “ইয়েস, ইয়েস! আমিই সেই বনবিহারী গুপ্তপতি।”
আমি ওঁর মুখে সেই নাম শুনে
অবাক হয়ে গেলাম কারণ, যেই বনবিহারী
গুপ্তপতিকে আমি চিনি, তাঁর কোনও গোঁফ নেই আর তিনি সবসময় ধুতি-পাঞ্জাবি পরেই
থাকেন। কিন্তু
এঁকে দেখছি এইসব ব্যাপারে একদমই উলটো।
ওঁকে সেই বিষয় জিজ্ঞেস করতেই
উনি নিজের গোঁফ খুলে বললেন, “সি’
করে বলো তো, এবার ‘আইডেন্টিফাই’ করতে পারছ কি না?”
আমি চমকে উঠলাম, কারণ যাকে দেখলাম, উনিই সেই বিখ্যাত
আলোকচিত্রকর বনবিহারী গুপ্তপতি। হ্যাঁ! যার প্রদর্শনীর কথা কিছুদিন ছাড়া-ছাড়াই খবরের কাগজে বের হয় এবং যার তোলা ছবি এখনকার প্রজন্মের কাছে এই বাংলার
বুকে এক অন্যতম শ্রেষ্ঠ আকর্ষণ আর উনিই কিনা আমাদের সাথে একই বোটে বিরাজ করছেন!
ওঁর নাম অনেক শুনেছি। উনি নাকি খুব কম বয়সে বাপ-মা হারান এবং ছোটোপিসির কাছেই মানুষ। পড়াশোনা খুব বেশি না করতে পারায় উনি আলোকচিত্রকেই পেশা হিসাবে কাছে টেনে
নেন আর সেই থেকে ওঁর এই আলোকচিত্রর জগতে আবির্ভাব।
আমি ওঁকে প্রশ্ন করলাম, “আপনি এত বড়ো মাপের মানুষ হয়েও কেন এরকম ছদ্মবেশ ব্যবহার
করেন?”
বনবিহারীবাবু আবারও হেসে
উত্তর দিলেন, “আসলে আমি কোথাও ঘুরতে
এসে ‘ডোন্ট ওয়ান্ট’ মানুষ আমাকে একজন ‘ফেমাস ফটোগ্রাফার’-এর ‘আই’-তে ‘সি’ করুক। আমি চাই ‘সিম্পল’
পরিবারের ‘নর্মাল’ লোকের মতোই সকলের মাঝে থেকে
ঘুরে বেড়াতে আর তাই আমার এই ছদ্মবেশ।”
ওঁর কথা শুনে সমুদা বলে
উঠল, “সত্যি! আপনার মতো মানুষও এই সমাজে তাহলে রয়েছে।”
সমুদার কথায় আমি সায় দিয়ে
বললাম, “আপনার অনেক ছবিই আমার খুব প্রিয়। বাবার সাথে মধ্য কলকাতায়
আপনার এক প্রদর্শনীতেও গেছিলাম। আপনার তোলা ওই সূর্যের সাথে মেঘের লুকোচুরি খেলার
মুহূর্তের ছবিটা আমার সবচেয়ে প্রিয়।”
উনি দেখলাম শুনে খুব খুশি
হলেন। আমিও সেই
সুযোগে ওঁকে আরেকটা প্রশ্ন করে ফেললাম, “আচ্ছা, আপনি কি সত্যি এইভাবে কথা বলেন, নাকি আমাদের সাথে মজা করছেন?”
উত্তরে উনি বললেন, “আসলে বিলেতের এক ‘এগজিবিশনে’
আমার ছবি ‘সিলেক্ট’, ফলে আমাকেও সেখানে
‘গো’ করতে হয়েছিল। এবার আমি তো আর ইংরেজি জানতাম না, তাই ওখানে
গিয়ে খুব ‘প্রবলেম’ হচ্ছিল। তবে সেখানকার এক কর্মী আমাকে একটু আধটু ইংরেজি ‘টট’ করানোয়, আমি তখনকার মতো সেখানে কাজ চালিয়ে নিয়েছিলাম। আর সেই থেকেই ওই একটু আধটু ‘টট’ করা ইংরেজি, আমি বাংলার সাথে ‘মিক্স’ করে দিব্যি চালিয়ে দিচ্ছি। পরে ইচ্ছা করেই আর ইংরেজি ‘লার্ন’
করিনি, কারণ এভাবে ‘টক’ করতে আমার বেশ ভালোই লাগে। আমার কাছে তাই এই ব্যাপারটা
এখন ‘নর্মাল’ হয়ে গেছে।”
সত্যি! ওঁর মতো সরল মানুষ আর কোনও বিখ্যাত ব্যক্তির পক্ষে হওয়া
সম্ভব কি না জানি না। উনি খুবই আলাদা একজন মানুষ। কথায় কথায় উনি সমুদার কাজের বিষয় জানতে চাইলেন এবং
গোয়েন্দা শুনে উনি বললেন, “তা আপনি
কি এখানে ‘ফরেস্ট সি’ করতে এসেছেন, নাকি কোনও ‘কেস’ নিয়ে?”
সমুদা রসিকতার সাথে উত্তর
দিল, “না! ভাইপোকে
নিয়ে ঘুরতেই এসেছি। মানে ওই আপনার কথা অনুযায়ী, ফরেস্ট সি করতে। আর আপনি?”
বনবিহারীবাবু বললেন, “আমিও ‘সেম’, ওই ‘ফরেস্ট সি’ করতেই এসেছি।”
আমরা ওঁর বিষয়ে আরও জানতে
পারলাম যে বনবিহারীবাবু ওঁর পিতা ও মাতা উভয়েরই উপনামকে সম্মান জানাতে নামের পাশে দুই
উপনামকে মিশ্রণ করে ব্যবহার করেন। অর্থাৎ পিতার সেনগুপ্তর গুপ্ত আর মাতার সেনাপতির
পতি, এই দুইকে মিলিয়ে উনি গড়ে তুললেন নিজ উপনাম - গুপ্তপতি। ফলে ওঁর পুরো নাম হয়ে দাঁড়াল, বনবিহারী গুপ্তপতি।
সময়ের সাথে আমাদের মধ্যে
কথাবার্তা আরও এগোতে লাগল। আমরা একে অপরের সাথে আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠতে লাগলাম। মন বলছিল, ভাগ্য যেন আমাদের চলার পথে এক নতুন মোড় আনছে আর সেটা হতেই
পারে বনবিহারীবাবুর মাধ্যমে, একজন সাথী রূপে। আর এর মাঝেই আমাদের মোটর বোট এগোতে লাগল তুলি দিয়ে
যেন আঁকা ওই নদীর আঁকাবাঁকা পথে, যার দু’ধারে রয়েছে শুধুই সবুজ ক্যানভাস।
আমরা বোটেই দুপুরের খাওয়া
সেরে নিলাম। সূর্যের তেজ তখন প্রখর। বোটের কর্মীদের মধ্যে একজন এগিয়ে এসে আমাদের জিজ্ঞেস
করল, “বাবুরা, আপনারা কি পাখিরালয় যাবেন?”
উত্তরে সমুদা বলল, “হ্যাঁ,
নিশ্চয়ই। পাখিরালয় যাব না তা কখনও হয় নাকি!”
সমুদা আমার উদ্দেশ্যে তারপর
বলল, “বঙ্কু, পাখিরালয়ের পরিবেশের সঙ্গে
কিন্তু বহরমপুরের মিঃ মিত্রর সেই ঘরের অনেকটাই মিল পাবি।”
আমি শুনেই তাকে জিজ্ঞেস
করলাম, “সেখানে কি মিঃ মিত্রর বাড়ির মতো
বিভিন্ন পাখি দেখা যাবে?”
সমুদা বলল, “তার থেকেও বেশি, অনেক বেশি।”
বনবিহারীবাবুকে দেখলাম, উনি আমাদের কথোপকথন বেশ মন দিয়ে শুনছিলেন। তারপর সেই কর্মীর উদ্দেশ্যে
উনি বলে উঠলেন, “আচ্ছা ভাই
‘বোটম্যান’, সেখানে কি সবধরনের ‘বার্ড’ই দেখা
যাবে?”
সেই প্রশ্ন শুনে ওই কর্মী
হেসে উঠলেন আর সেই সঙ্গে বললেন, “বাবু, ওখানে অনেক পাখিই আসে,
কিন্তু কিছু বছর হল সংখ্যাটা কমে গেছে।”
বনবিহারীবাবুর সাথে ওই কর্মীর
গল্প বেশ জমে উঠল আর সেই রসালো গল্প আমরাও বেশ উপভোগ করতে লাগলাম। ওই কর্মীর সাথে কথা বলে
জানতে পারলাম যে সেও গোসাবারই বাসিন্দা এবং তার নাম সাধন, যাকে সবাই
ভালোবেসে সাধন মাঝি বলে ডাকে। সে এই কাজ বিগত বারো বছর ধরে করে আসছে।
তার গ্রামের বা অঞ্চলের
কথা সমুদা জানতে চাওয়ায় সে বিস্তারিতভাবে বলতে শুরু করল, “আমাদের গ্রাম খুবই গরিব, বাবু। আজও ভাগ্যের জোরেই আমাদের জীবন চলছে বলতে পারেন। জঙ্গলের হিংস্র পশুর হাতে
প্রায় রোজই কেউ না কেউ প্রাণ হারাচ্ছে। তবে
আমাদের মাতা সন্ন্যাসিনী ত্রিভুবনেশ্বরী আছেন বলেই হয়তো হাজার দুঃখের মধ্যেও আমরা একটু
খুশির মুখ দেখতে পাই। উনি তন্ত্রমন্ত্রর দ্বারা আমাদের কিছুটা হলেও আগলে রাখেন বিপদ থেকে।”
সে আরও জানাল, “এই গোসাবা এলাকায় একজন বিরাট প্রভাবশালী ব্যক্তিও রয়েছেন, যার নামে এই এলাকায় বাঘে-গরুতে একই ঘাটে জল খায়। ওঁর নাম মানিকচাঁদ।”
“এই মানিকচাঁদ কি করেন,
জানো কিছু?” সমুদা তাকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করল।
উত্তরে সাধন মাঝি বলল, “আজ্ঞে বাবু, ওঁর পর্যটনের ব্যাবসা
ছাড়াও অনেকগুলো ব্যাবসা রয়েছে, কিন্তু সেইসব বিষয় আমি অতটা ঠিক
জানি না।”
কথা বলতে বলতে আমরা পাখিরালয়
এসে পৌঁছলাম এবং সেই জায়গা ঘুরে আমাদের সবারই বেশ ভালো লাগল। আমি তো সেই আগের পাওয়া স্বাদ আবারও ফিরে পেলাম, তবে পরিমাণে
দ্বিগুণ। বনবিহারীবাবুকেও
দেখলাম, সেই পরিবেশের সাক্ষী থাকতে পেরে উনি খুবই আনন্দিত।
পাখিরালয়ের ওই মনোরম পরিবেশ
ছেড়ে আমাদের বোট এগিয়ে চলল সেই সুন্দরবন ন্যাশনাল পার্কের উদ্দেশ্যে। সেখান থেকে আমরা গেলাম সজনেখালির
ওয়াচ টাওয়ারে। ওই ওয়াচ
টাওয়ার থেকে আমরা পুরো সুন্দরবনটাই দেখতে পাচ্ছিলাম। সত্যি! এখানে না এলে প্রকৃতির এই সৌন্দর্য
দেখা থেকে নিশ্চিত বঞ্চিত হতাম। আমাদের সাথে আসা বনবিহারীবাবু ব্যস্ত হয়ে পড়লেন
ছবি তুলতে। ওই ওয়াচ
টাওয়ার থেকে উনি সূর্যাস্তের মুহূর্তটা ক্যামেরাবন্দি করে রাখলেন।
আমাদের কথা ছিল সেদিন রাতটা
কাটাব বোটেই। কিন্তু
প্রায় সব দেখা হয়ে যাওয়ায় সমুদার কথামতো
আমরা সাধন মাঝির গ্রামের দিকেই এগোলাম। সুন্দরবন এলাকার কোনও গ্রামে রাত কাটানো মানেই
রোমাঞ্চ। তাই সেই স্বাদ পেতে কার না ভালো লাগে! আমাদের সেই গ্রামে পৌঁছতে সন্ধ্যা প্রায় সাতটা বাজতে পারে। আর ওইসব গ্রামে সাতটা বাজা
মানেই অনেক রাত। সুতরাং
বোটেই রাতের খাওয়া সেরে নিলাম।
বনবিহারীবাবু আগেই ঠিক করে
ফেললেন, পরদিন সকালে উনি ওই সন্ন্যাসিনী
মাতার কাছে যাবেন ওঁর ভাগ্য বিচার করাতে। আমারও সেই একই ইচ্ছা হল, কিন্তু সমুদার ওইসব বিষয়ে বিশ্বাস না থাকায় আমি আর সেই ইচ্ছার কথা প্রকাশ করলাম না। তখনই ঠিক হল, আমরা সাধন মাঝির বাড়িতেই থাকব এবং পরদিন সকালে পুরো গ্রামটা
ঘুরে দেখব আর অবশ্যই বনবিহারীবাবুর ইচ্ছা পূরণ করতে যাব সেই সন্ন্যাসিনী মাতার আশ্রমে।
অবশেষে আমরা সাধন মাঝির
বাড়ি এসে ঢুকলাম। তার স্ত্রী আমাদের ভিতরে নিয়ে গিয়ে ঘর দেখিয়ে দিলেন। সাধন মাঝির বাড়িতে কেবল
দুটি মানুষের বাস। ফলে আমাদের আসাতে তারা দু’জনেই খুব খুশি হলেন। সেই রাতে আমরা আর ঘর থেকে বের হলাম না। কিন্তু স্ত্রীর কাছে গ্রামের
মোড়লের ডেকে পাঠানোর সংবাদ পেয়ে সাধন মাঝিকে
বেরোতেই হল ওই আজ্ঞা পালন করতে। সে অবশ্য কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে এল। তবে সেই বিষয়ে আমরা আর তার থেকে কিছু জানতে চাইলাম
না। সেদিন
রাতে আমরা ক্লান্তির কারণে আর দেরি না করে ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরেরদিন সকালে আমরা চললাম
গ্রাম ঘুরতে। কিছুটা পথ যেতেই আমরা ওই সন্ন্যাসিনী মাতার আশ্রমে
পৌঁছে গেলাম। আশ্রমটা
সেই গ্রামের আর পাঁচটা বাড়ির মতোই মাটির তৈরি। বনবিহারীবাবু দেরি না করে সোজা ঢুকে পড়লেন আশ্রমে
এবং সরাসরি গিয়ে বসে পড়লেন ওই মাতার সামনে। আমরাও আর দেরি না করে গিয়ে বসে পড়লাম, তবে পিছনে।
সাধন মাঝি মাতাকে আমাদের
বিষয় জানাল এবং বনবিহারীবাবু সেই সুযোগে মাতাকে বললেন, “মা, আমার প্রণাম ‘টেক’ করবেন। আপনি দয়া করে আপনার মন্ত্র ‘ইউজ’ করে একটু বলুন আমার ভাগ্যে কী
কী ‘রাইট’ করা আছে। আমার সামনেই এক ‘এগজিবিশন’। ওটা ‘সাকসেস’ হবে তো?”
কিছুক্ষণ সেই সন্ন্যাসিনী
মাতা ওঁর হাত দেখে নিজের মনে কিছু মন্ত্র
পাঠ করে নিলেন এবং তারপর উনি বনবিহারীবাবুকে জানালেন যে ওঁর প্রদর্শনী একেবারে সফল
হবে এবং ওঁর জীবনে এই মুহূর্তে এক পরিবর্তন ঘটবে, যার ফলে উনি জীবনে এক নতুন
দিশা খুঁজে পাবেন।
সমুদাকে দেখে মনে হল, সে মাতার একটি কথাও বিশ্বাস করেনি। তবে বনবিহারীবাবু ওঁর ভাগ্য
গণনার পর ভীষণ আনন্দিত এবং উত্তেজিত। আর এর মাঝেই সেখানে এসে উপস্থিত হলেন সাদা ধুতি
ও পাঞ্জাবী পরা এক সুদর্শন পুরুষ, যাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল যে
তিনি অত্যন্ত এক ধনী ব্যক্তি। সাধন মাঝি আমাদের জানাল যে তিনিই হলেন মানিকচাঁদ। তার সাথে আরও দু’জন লোক মাতার নিকট
থালায় করে ফল ও মিষ্টি নিয়ে এল। তবে মানিকচাঁদকে লক্ষ করলাম, তিনি মাতার
ঘরে সোজা ঢুকে গেলেন এবং মাতাও কিছুক্ষণের জন্য সেই স্থান ছেড়ে ওই ঘরে গিয়ে ঢুকলেন।
বনবিহারীবাবু সেই দৃশ্য
দেখে সমুদার কানের কাছে এসে তাকে ফিসফিস করে বললেন,
“সমুবাবু, কিছু কি ‘আন্ডারস্ট্যান্ড’ করতে পারছেন, ওই ‘রিচ ম্যান’টা সোজা মাতার ‘রুম’এ গিয়ে কেন ‘ইন’ করল? নিশ্চয়ই কোনও গোপন ‘টক’ আছে।”
আমারও মাথায় ওই একই প্রশ্ন
এল। সমুদাকেও দেখলাম, পুরো বিষয়টার উপর সে নজর রাখছে। আশ্রম থেকে বেরিয়ে আসার
পথে আমরা একটা চায়ের দোকানে ঢুকলাম আর সেখানেই জানতে পারলাম যে মানিকচাঁদ বরাবরই এই
আশ্রমে আসেন মাতার আশীর্বাদ নিতে। কিন্তু সমুদার মনে তখন জাগল এক প্রশ্ন। এটা কি শুধুই আশীর্বাদ নিতে আসা? নাকি এর পিছনে
রয়েছে অন্য কোনও রহস্য?
আমরা ওই চায়ের দোকান থেকে
বেরিয়ে সেই পথ ধরেই এগিয়ে চললাম এক কালীমন্দির দেখতে, যেটা ওই গ্রামের
বহু পুরনো এবং খুবই জাগ্রত। সেই মন্দিরের সামনে সাক্ষাৎ হল শঙ্কর নামে এক ব্যক্তির
সাথে। তার পরিচয়, সে হল মানিকচাঁদের ম্যানেজার। কথা বলে আরও জানতে পারলাম যে সে প্রত্যেক সপ্তাহে
এই মন্দিরে পুজো দিতে আসে।
তারপর আমরা মন্দিরে গিয়ে
ঢুকলাম এবং সেখানে ঢুকতেই অবাক হয়ে গেলাম দেখে যে মন্দিরের ভিতরে না আছে কোনও জ্বলতে
থাকা ধূপ-মোমবাতি, না রয়েছে কোনও তাজা পুজোর
ফুলের চিহ্ন। ওখানে যা পড়ে রয়েছে তা হল, চারদিকে ছড়ানো কিছু চার-পাঁচদিনের পুরনো ফুল আর আধা জ্বলা ধূপের কিছু ছাই।
এইসব দেখে সমুদাকে আমি প্রশ্ন
করলাম, “সমুদা, শঙ্করবাবু যে বলল এখানে সে
পুজো দিতে এসেছিল, তাহলে সেই প্রমাণ কৈ?”
উত্তরে সমুদা একটু গম্ভীর
স্বরে বলল, “আমাদের আসার আগে যদি
এখানে পুজো দেওয়া হয়ে থাকে তাহলে তার নিশ্চয়ই
কোনও চিহ্ন থাকত রে, বঙ্কু। তবে পুজো নিয়ে কেনই বা সে মিথ্যে বলবে আমাদের? এই খটকাটা
তো রয়েই যাচ্ছে।”
সমুদার কথা শুনে বনবিহারীবাবুও
বলে উঠলেন, “সমুবাবু, এই ‘ভিলেজ’ দেখছি
‘হাইলি সাসপিশাস’! আপনি কি কোনও রহস্যের ‘স্মেল’ পাচ্ছেন?”
এই কথা শুনে সমুদা ওঁকে
বলল, “রহস্য খোঁজা আমার কাজ নয় বনবিহারীবাবু, আমার কাজ হল রহস্যের সমাধান
করা। তাই যদি
এখানে কোনও রহস্য থেকে থাকে তাহলে এর সমাধান
আমি নিশ্চয়ই করব।”
আমরা মা কালীর দর্শন করে
বেরিয়ে এলাম এবং ফিরে গেলাম সাধন মাঝির বাড়ি। দুপুরে টাটকা মাছের ঝোল দিয়ে ভাত, সঙ্গে গন্ধরাজ লেবু। একেবারে
যেন গ্রামের স্বাদ পেলাম সেই খাবারে। খাওয়ার পর সাধন মাঝির কাছে আমি আর বনবিহারীবাবু
সুন্দরবনের বাঘের গল্প শুনতে বসলাম। কিন্তু সমুদাকে দেখলাম কোনও এক বিষয় নিয়ে যেন সে
গভীর চিন্তায় মগ্ন। বুঝতে
পারলাম, জঙ্গলে এসেও সমুদার নিস্তার নেই। এখানেও হয়তো তাকে কোনও এক রহস্যের সমাধান করতে
হতে পারে।
রহস্যের জন্য আর বেশি অপেক্ষা
করতে হল না। মানিকচাঁদ
এক সমস্যায় পড়ে সমুদাকে ডেকে পাঠালেন তার বাড়িতে। সমুদার সাথে আমরাও, অর্থাৎ আমি ও বনবিহারীবাবু বেরিয়ে পড়লাম সাধন মাঝি সহিত
তার বাড়ির উদ্দেশ্যে। তাঁর বাড়ি পৌঁছে জানতে পারলাম যে সাধন মাঝির দ্বারাই
তিনি সমুদার পেশা সম্বন্ধে জানতে পারেন এবং তারপরই এই জরুরি তলব।
সাধন মাঝিকে তিনি নিচে বসিয়ে আমাদের উপরের ঘরে নিয়ে যাওয়ার সময় সমুদাকে
বললেন, “বাবামশাই মারা যাওয়ার পর নানা
ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছি, আর এর মধ্যেই রয়েছে এক অদ্ভুত সমস্যা। আমি সেই সমস্যার সমাধানের জন্যই আপনাকে এখানে ডেকে
পাঠিয়েছি, সমরেশবাবু।”
মানিকচাঁদের বাড়ির অবস্থা, তাদের বেশভূষা
এবং তাঁর ব্যাপারে যা শুনেছি, সব বিবেচনা করে দেখার পর আমার বিশ্বাস
হচ্ছিল না যে এরকম প্রভাবশালী একজন ব্যক্তি সমুদাকে ডেকে পাঠিয়েছেন তাঁকে সমস্যা থেকে বের করতে। আমার মনে সন্দেহ জাগল, এটা কোনও চক্রান্ত
নয়তো? কিন্তু জানতাম,
সমুদা থাকতে কোনও চক্রান্তই সফল হবে না।
মানিকচাঁদ তাঁর ঘরের সোফাতে
আমাদের বসিয়ে তার সমস্যার কথা খুলে বললেন। “আমার স্বর্গীয়
পিতা শ্রী হেমেন্দ্রচাঁদ লাহিড়ি বহুকাল আগে এক জিনিস নিলামে কিনেছিলেন। কিন্তু বাড়িতে আনার বদলে উনি সেই জিনিস কোথাও একটা
লুকিয়ে রাখলেন। বাড়িতে
আমরা বাবামশাইকে খুবই ভয় পেতাম, তাই ওই বিষয়ে জানতে চাওয়ার
স্পর্ধা কোনওদিন দেখাইনি। ফলে
অপেক্ষাই করতে হয়েছে। উনি অসুস্থ হওয়ার পর আমি সাহস
করে ওঁকে অনেকবারই সে সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করেছি, কিন্তু উনি শুধুই বলে গেছেন সঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে। একবছর হল উনি মারা গেছেন। কিন্তু সেই জিনিস আজও আমাদের
নাগালের বাইরে।”
তিনি সামনে রাখা জলের গ্লাস
হাতে নিয়ে বললেন, “হ্যাঁ,
তবে মারা যাওয়ার আগে উনি আমাকে একটা চিঠি দিয়ে বলেছিলেন যে ওই চিঠিতে
লেখা কথাগুলোই নাকি আমাকে সেই জিনিসটি পেতে সাহায্য করবে। কিন্তু মাসের পর মাস পেরিয়ে
গেলেও ওই চিঠির কোনও মানেই আমি খুঁজে বার
করতে পারিনি। তাই আপনার
সন্ধান পেয়ে আপনার শরণাপন্ন হতে বাধ্য হলাম। আপনাকেই সাহায্য করতে হবে, সমরেশবাবু।”
সমুদা তার প্রত্যেক কথাই
মন দিয়ে শুনছিল এবং তার কথা শেষ হতেই সমুদা বলল,
“সেই চিঠি কি একবার দেখা যেতে পারে, মিঃ লাহিড়ি?”
সমুদার কথা শেষ হতেই তিনি
জলের গ্লাসটা টেবিলে রেখে আলমারি থেকে
ওই চিঠি বের করে সমুদার হাতে তুলে দিলেন। ওই চিঠি সমুদা খুলতেই দেখলাম কীসব অদ্ভুত লেখা
রয়েছে তাতে।
জিম হুস হাস খুস, বাঘেরা হবে
ফুস
দেশে তুই বিখ্যাত, তোর কাছেই
থাকবে পশুরা অক্ষত
পুরনো দেবতার কাছে পাবি
তুই বর, শিকারি প্রাণ দিয়ে লড়।
আমি কিছু বলার আগেই সমুদার
হাত থেকে ওই চিঠি নিয়ে বনবিহারীবাবু দেখলেন বটে, তবে কিছু বুঝতে না পেরে উনি
আবার চিঠিটা সমুদাকে ফেরত দিয়ে বললেন, “এ তো দেখছি ‘হরেন্ডাস’ ব্যাপার মশাই! তা মন্ত্র ‘রাইট’ করা আছে নাকি, ওই হুস-হাস-ফুস?”
সমুদা হেসে বনবিহারীবাবুর
কথার জবাব দিল, “এত সহজে এই চিঠির অর্থ
বোঝা সম্ভব নয়, বনবিহারীবাবু। মন্ত্র না অন্য কিছু তা বুঝতে একটু সময় লাগবে।”
সমুদার কথা শেষ হতেই মানিকচাঁদ
বলে উঠললেন, “এই চিঠির অর্থ আপনাকেই
বার করতে হবে সমরেশবাবু, এর জন্য আপনার যা দরকার হবে আপনি আমায় বলতে পারেন।”
সমুদা তাকে বলল, “আপাতত এই চিঠি আমি নিজের কাছেই কিছু সময়ের জন্য রাখলাম। আচ্ছা, আপনার পরিচিত কেউ কি এই বিষয়ে জানে?”
উত্তরে মানিকচাঁদ বলল, “না। শুধু আমার ম্যানেজার শঙ্কর ছাড়া আর কেউ জানে না।”
তারপর আরও কিছু তথ্য তাঁর
থেকে সংগ্রহ করে আমরা ফিরে এলাম সাধন মাঝির বাড়ি। মানিকচাঁদের দেওয়া এই নতুন কেস নিয়ে সমুদা আবার
লেগে পড়ল এর সমাধান সূত্র খুঁজতে। কিন্তু এটা বাকি ঘটনাগুলোর থেকে বড়োই আলাদা। এই গল্পের নাম তাই দেওয়া
যায়, চিঠির মধ্যে লুকিয়ে থাকা সূত্র খুঁজতে এবারে, ‘জঙ্গলে
সমুদা’।
সেই রাতে আমাদের কারোরই
চোখে ঘুম আসছিল না। বনবিহারীবাবু
সমুদাকে এক নিঃশ্বাসে বলে গেলেন, “আচ্ছা
সমুবাবু, আপনি কি
ওই ‘লেটার’-এর বিষয় কিছু ‘থিঙ্ক’ করতে
পারলেন? আমি অনেকক্ষণ
‘থট’ করেও কিছু ‘আন্ডারস্ট্যান্ড’ করতে পারছি না যে ওঁর
‘ফাদার’ কেন জিনিসটা নিলামে ‘বাই’ করেও বাড়িতে নিয়ে
‘নট গোয়িং’? উনি কেন জিনিসটা সবার থেকে ‘হাইড’ করে ‘কিপিং’, সেটাও কিন্তু একটা ‘বিগ কোশ্চেন’। এই পুরো ব্যাপারটাই আমার
কেমন যেন ‘পাজল পাজল’ লাগছে।”
সমুদা ওঁর কথা শুনে বলল, “কথাটা আপনি ভুল কিছু বলেননি, তবে এই চিঠি ছাড়াও এই কেসে
বেশ কিছু রহস্য রয়েছে। চিঠির মানে বুঝতে গেলে আগে এই মানিকচাঁদ ও তাঁর
চারপাশের সব খবর সংগ্রহ করতে হবে।”
আমি সমুদাকে তার কথা শুনে
বললাম, “সমুদা, আমরা যদি একটু ভেবে দেখি তাহলে
বুঝতে পারব আমাদের এখানে আসার পর থেকে অনেক
কিছুই রহস্য মনে হচ্ছে। প্রথমে সেই মাতার আশ্রমের ঘটনা, দ্বিতীয় শঙ্করের
সেই পুজো দেওয়ার গল্প এবং তৃতীয়, মানিকচাঁদ একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি হয়েও তোমাকে ডেকে পাঠাল ওই চিঠির মানে জানতে।”
সমুদা আমার কথায় সায় দিয়ে
বলল, “ঠিক ধরেছিস, বঙ্কু। তোর দেখছি অবজারভেশন ক্ষমতা আগের থেকে অনেকটাই বেড়েছে। আমার অনুমান যদি সঠিক হয় তাহলে এই সূত্র ধরে এগোলেই মূল লক্ষ্যে পৌঁছতে
পারব।”
সমুদার কথা শেষ হতেই বনবিহারীবাবু
উত্তেজনায় বলে উঠলেন, ‘ব্রাভো!
ব্রাভো! ক্লু’ যখন একবার ‘ফাইন্ড’ হয়ে গেছে, তখন ‘স্টোরি’র ‘রুট’-এ আমরা ঠিকই পৌঁছে যাব।”
সত্যি! ওঁর কথা শুনে আমার আত্মবিশ্বাস যেন আরও বেড়ে গেল। এদিকে রাত বাড়তে থাকায় আমরা তিনজন গেলাম ঘুমাতে
এবং রইলাম আগামীদিনের অপেক্ষায়।
সকাল হতেই সমুদার সাথে আমরা
হাজির হয়ে গেলাম মানিকচাঁদের বাড়ি। আমাদের অত সকালে দেখে মানিকচাঁদ একটু অবাক হলেও
পরে তদন্তের স্বার্থে তিনি আমাদের বেশ ভালো মতোই আপ্যায়ন করলেন। সেখানে শঙ্করকে উপস্থিত থাকতে দেখে বনবিহারীবাবু
তাকে বললেন, “কী ব্যাপার মশাই, আজ আপনি ‘টেম্পল’-এ পুজো দিতে ‘নট গোয়িং’?”
শঙ্করকে দেখলাম কথাটা শুনে
উত্তর না দেওয়ার মতো করেই বলল, “রোজ
সেখানে যাওয়া সম্ভব হয় না, তাই মায়ের পুজো মনে মনেই সেরে ফেলি।”
কথাটা শুনে আমাদের একটা
খটকা লাগল। বনবিহারীবাবু সুযোগ বুঝে আমার কানের কাছে এসে ফিসফিস
করে বললেন, “দেখলে বঙ্কু, ব্যাটা ‘আনসার’টা কেমনভাবে দিল। ও নাকি আবার
‘হার্ট’-এর মধ্যেই পুজো সেরে ফেলে।”
আমি শুধু ওঁর কথা শুনে ঘাড়
নাড়লাম। সমুদা
বাড়ির চারপাশটা ঘুরে দেখতে চাইলেন এবং মানিকচাঁদের সম্মতি পাওয়ার পর শঙ্কর আমাদের ঘুরে
দেখাল।
বাড়িটা ঘুরে দেখার থেকেও
সমুদার আসল উদ্দেশ্য ছিল শঙ্করের সাথে আলাদাভাবে কথা বলা। তার
এই চাল ওখানে উপস্থিত আমি ছাড়া কেউই ধরতে পারেনি, এমনকি বনবিহারীবাবুও নন।
হাঁটতে হাঁটতে সমুদা শঙ্করকে
নিয়ে আমাদের থেকে একটু এগিয়ে গেলেন। আমি সমুদার এই আচরণের কারণ বুঝতে পারলেও বনবিহারীবাবু
কিন্তু বুঝতে পারলেন না। উনি সেই দেখে ওঁর ভুরুদুটো কুঁচকে আমায় বললেন, “তোমার দাদাকে ‘সি’ করছ, কেমন শঙ্করকে নিয়ে এগিয়ে এগিয়ে
‘ওয়াক’ করছেন।”
আমি তখন ওঁকে বোঝালাম যে
এটা হতে পারে তদন্তের স্বার্থে সমুদার কোনও এক পদক্ষেপ। উনি হেসে আমাকে বললেন, “সত্যি! সমুবাবুর থেকে বুদ্ধি
‘ইউজ’ করার পদ্ধতিটা ‘লার্ন করতে হবে।”
হ্যাঁ, সমুদার বুদ্ধির কোনও তুলনা নেই। তার মগজাস্ত্রই হল প্রধান
অস্ত্র। ফলে বারবার বিপদে পড়েও শেষ হাসি তিনিই হাসেন।
আমরা মানিকচাঁদের বাড়ি ঘুরে
দেখার পর তাঁর ঘরে গিয়ে বসলাম। তিনি
এলেন কিছুক্ষণ পর এবং এসেই সমুদার উদ্দেশ্যে বললেন,
“তা ঘুরে কি কিছু বুঝতে পারলেন, সমরেশবাবু? কোনও সূত্র পেলেন?”
সমুদা তার কথার উত্তরে বলল, “আপনার বাড়ি ঘুরে দেখলেই যে সূত্র পেয়ে যাব, সেটা আসা করি আপনিও মনে করেন
না। তাই আপনার আপত্তি না থাকলে একবার কি শঙ্করের ঘরটা
দেখা যাবে?”
সমুদার মুখে তাঁর ম্যানেজারের
ঘর দেখতে চাওয়ার কথা শুনে তিনি বললেন, “আপনি কি কোনওভাবে শঙ্করকে সন্দেহ করছেন?”
সমুদা উত্তর দিল, “সন্দেহ শব্দটা অনেকভাবেই ব্যবহার করা যায়, মিঃ লাহিড়ী। কিন্তু এক্ষেত্রে আমার কাজ শুধু চিঠির মানে জানাই
নয়, চিঠির সাথে আমায় আরও অনেক কিছুই জানতে হবে। তাই আপনি অনুমতি না দিলে এই কাজ এগোবে না।”
সমুদার কথা শোনার পর তিনি
রাজি হলেন এবং আমরা গেলাম শঙ্করের ঘরে।
শঙ্করের ঘর ছিল দোতলার দক্ষিণের
বারান্দার দিকে। আমরা তার
অনুপস্থিতিতেই ঘরে ঢুকে পড়লাম এবং বড়োই অবাক হলাম দেখে যে বিদ্যাপতি থেকে শুরু করে
মাইকেল মধুসূদন দত্ত, কাজী নজরুল সবারই লেখা কবিতার বই ছড়িয়ে আছে ওই ঘরে। আর অবশ্যই আছে রবীন্দ্রনাথের
গীতাঞ্জলী। সমুদার
নজর গেল টেবিলে রাখা এক খাতার উপর। সে সেই খাতা হাতে নিয়ে খুলতেই
শঙ্করের আরেক প্রতিভার কথা আমরা জানতে পারলাম।
ম্যানেজার হওয়া ছাড়াও সে
ভালো কবিতা লিখতে পারত। তার লেখার ধরন দেখলেই বোঝা যায়
যে সে সাধু এবং চলিত, দুই ভাষাতেই সমানভাবে দক্ষ। তার এক কবিতায় নদীকে নিয়ে
দেওয়া বর্ণনা সত্যি অসাধারণ!
আমার দিকে চেয়ে বনবিহারীবাবু
বললেন, “তুমি কি এখনও শঙ্করকে
‘সাসপেক্ট’ করছ? আমি
কিন্তু ওর ‘পোয়েম’গুলো ‘রিড’ করার
পর ওকে আর সেই ‘আই’তে ‘সি’
করতে পারছি না।”
ওঁর কথা শেষ হতেই সমুদা
বলল, “সূত্র আরেকটা পাওয়া গেছে রে বঙ্কু, তবে বনবিহারীবাবু,
সময়ই বলবে কাকে সন্দেহ করা ঠিক বা ভুল হয়েছে।”
বনবিহারীবাবু উত্তেজিত হয়ে
বলে উঠলেন, ‘ফাইন্ড’ করতে পেরেছেন ‘ক্লু’? বলুন
না সমুবাবু, কী ‘ফাইন্ড’ করলেন?”
সমুদা সেই বিষয়ে কিছুই বলল
না সেখানে, বরং আমাদের সঙ্গে নিয়ে ওই ঘর থেকে বেরিয়ে এল।
মানিকচাঁদকে ধন্যবাদ জানিয়ে
তাঁর বাড়ি থেকে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। তবে ফেরার আগে সমুদা মানিকচাঁদকে বলে এল যে চিঠির মানে বের হতে এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।
সমুদার কথায় আমি বুঝতে পারলাম, এই তদন্ত প্রায়
শেষের পথে। কিন্তু
কী হবে তার পরিণাম? সেই প্রশ্ন মনের মধ্যে নিয়েই আমরা ফিরে এলাম সাধন মাঝির
বাড়ি।
দুপুরে খেয়ে উঠে আমরা আর
না ঘুমিয়ে গেলাম গোসাবা বাজারে সাধন মাঝি ও তার স্ত্রীর জন্য কিছু উপহার কিনতে। সমুদা বাজারে ঢুকেই আগে
বাবাকে ফোন মারফত আমাদের ফিরতে দেরি হওয়ার কারণ সহ তার নতুন কেসের কথা জানাল, যাতে বাবা
কোনও দুশ্চিন্তা না করেন। তারপর সেখানকার ইন্সপেক্টর কাশীরাম মিত্রর সাথে আমাদের ওখানেই আলাপ হল।
সমুদার পরিচয় পেয়ে উনি বললেন, “সমরেশবাবু, এতদিন ধরে আপনি এই এলাকায় রয়েছেন আর আমি কিছু জানতে পারলাম
না! তা আপনি কি সুন্দরবনে কোনও তদন্তের স্বার্থে, নাকি শুধু ঘুরতেই এসেছেন?”
উত্তরে সমুদা বলল, “না, ঘুরতেই এসেছিলাম। কিন্তু এখন এক তদন্তের কাজে
ব্যস্ত হয়ে পড়েছি।”
শুনেই ইন্সপেক্টর হেসে উঠলেন, “হা-হা-হা!
সমরেশ দত্ত কি আর তদন্ত না করে থাকতে পারে? যেখানেই
আপনি যাবেন, কোনও
না কোনও কেস ঠিকই আপনার পিছু ধাওয়া করে সেখানে পৌঁছে যাবে। তা এবারে কী তদন্ত করছেন?”
সমুদা তাকে পুরো বিষয়টা
খুলে না জানালেও সংক্ষেপে বলল। সব শুনে উনি বললেন, “সমরেশবাবু, আমি যতদূর শুনেছি বা জানি তা থেকে বলতে পারি, মানিকচাঁদের মতো প্রভাবশালী
ব্যক্তি এই এলাকায় আর দুটো নেই। সুতরাং তার পক্ষে সেই চিঠির মানে খুঁজে বার করা
খুব একটা কঠিন ব্যাপার নয়, কারণ আজ
এই দুনিয়ায় টাকা ছড়ালে সবকিছুই সম্ভব। কিন্তু এখানেই আমার একটা খটকা লাগছে, এতদিন মানিকচাঁদ
এই ব্যাপারে কোনও গোয়েন্দারই সাহায্য নিল না এবং হঠাৎ আপনি ঘুরতে আসায় আপনার শরণাপন্ন
হল!”
সমুদা তাঁকে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা, এই মানিকচাঁদের বাবামশাই
মানে হেমেন্দ্রচাঁদের ব্যাপারে কিছু জানেন?”
উত্তরে উনি বললেন, “হ্যাঁ, যেটুকু শুনেছি তা হল যে ওঁর
নাকি নিলামে প্রাচীন জিনিস কেনার একটা নেশা ছিল। এই নেশার চক্করে উনি অনেক পৈত্রিক সম্পত্তিও বিক্রি
করেছেন। তবে উনি একজন পরোপকারী ব্যক্তিও ছিলেন বটে। এই এলাকার অনেকেই জীবনে
নানাভাবে ওঁর কাছে উপকার পেয়েছে। কিন্তু মানিকচাঁদ তার পিতার মতো একেবারেই হতে পারেনি। তার কাছে নিজের সুখই হল আগে। তবে আপনাকে বলে রাখি, এই মানিকচাঁদ
কিন্তু বিলেত থেকে ওকালতি পাশ করে এসেছে। ফলে
ওর বুদ্ধি নেই ভাবলে আপনি ভুল করবেন।”
সমুদার সাথে আরও কিছু কথা
বলে উনি বিদায় নিলেন এবং আমরাও আমাদের কাজ সেরে ফিরে এলাম। বাজারে ইন্সপেক্টর কাশীরাম মিত্রর সাথে কথা বলে
অনেক কিছুই আমাদের সামনে উঠে এল। সমুদার মনের মধ্যে কী যে চলছে তা আমার পক্ষে জানা অসম্ভব। সুতরাং অপেক্ষায় থাকতে হবে। কিন্তু পুরো বিষয়টা নিয়েই
বনবিহারীবাবুর মনে এক প্রশ্ন জন্মেছে এবং সেটি উনি সমুদাকে বাজারেই করেছিলেন। “সমুবাবু,
মানিকচাঁদ যদি ‘ব্রেনি’ হয় তাহলে নিজেই তো
‘লেটার’-এর মানে ‘ফাইন্ড’ করতে পারে। কিন্তু সে তা না করে ‘হুয়াই’ আপনাকেই
‘ফাইন্ড’ করত বলল, বলুন তো?”
সমুদা সেই প্রশ্নের উত্তরে
বলেছিল, “সময়ের সাথেই এই প্রশ্নের উত্তর
আপনি পেয়ে যাবেন, বনবিহারীবাবু। তবে
তার আগে আমাদের কাজ হবে নিলামে কেনা ওই জিনিসটা উদ্ধার করে তার হাতে তুলে দেওয়া।”
সাধন মাঝি ও তার স্ত্রীর
জন্য আনা উপহার আমরা তাদের হাতে তুলে দিলাম। প্রথমে
তারা একটু লজ্জা পাচ্ছিলেন বটে, কিন্তু
পরে তাদের মুখে ছিল উপহার পাওয়ার এক আলাদা আনন্দ। সত্যি! এই গ্রামের গরিব মানুষেরা কত অল্পতেই সন্তুষ্ট হয়ে যায়। আর আমরা যারা নিজেদের সমাজের
উঁচু মাথা বা বুদ্ধিজীবী বলে মনে করি, তারা কি হই এত সহজে? এই প্রশ্নের উত্তর হয়তো আমরা
কেউ দিতে পারব না।
সেদিন সন্ধ্যাবেলা সমুদা
আমাদের কিছু না বলেই কোথায় যেন বেরিয়ে গেল। আমি ও বনবিহারীবাবু দু’জনেই চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। তারপর বনবিহারীবাবুর কথায় রাজি হয়ে সাধন মাঝি সমুদাকে
খুঁজতে গেলেন। কিছুক্ষণের
মধ্যেই দু’জনে বাড়ি ফিরল আর সমুদা
তখন সবার সামনে জানাল যে সে একটা কাজেই
বাজারে গেছিল।
আমার কিন্তু সেই কথা শুনে
বিশ্বাস হল না। কারণ, বাজারে যাওয়ার হলে সমুদা আমাদের জানিয়েই যেতে পারত, এর মধ্যে সে কোনও গোপনীয়তা
রাখত না। সেই বিশ্বাস
না হওয়ার কারণকে আমি আমার মনেই রেখে দিলাম। তবে আমি জানতাম,
সমুদা নিশ্চয়ই সেই কথা পরে হলেও আমাদের জানাবে। সেই বিশ্বাস আমার তার প্রতি ছিলই।
সেই রাতে খাওয়ার পর ঘরের
দরজা বন্ধ হতেই বনবিহারীবাবু সমুদাকে বললেন, “আপনি কোথায় ‘গো’ করেছিলেন মশাই? আমাদের ‘হার্ট’ হাতে চলে এসেছিল।”
সমুদা মুচকি হেসে বলল, “আমি না গেলে সেই জিনিস উদ্ধার হত কীভাবে, বনবিহারীবাবু? এই কেসের রহস্য সমাধান করতেই আমি পুরনো কালীমন্দির গেছিলাম।”
কথাটা শুনেই আমরা অবাক হয়ে
গেলাম। বনবিহারীবাবু
ওঁর ভুরুদুটো যতটা সম্ভব তুলে সমুদাকে জিজ্ঞেস করলেন, “সলভ’ করতে ‘ওল্ড’ কালীর ‘টেম্পল’ কেন?”
সমুদা বলল, “ওখানেই তো রাখা ছিল সেই নিলামে কেনা বন্দুক।”
এবার আরও অবাক হয়ে গেলাম
আমরা। আমি সমুদাকে
জিজ্ঞেস করলাম, “বন্দুক মানে,
কীসের বন্দুক? চিঠির পুরো মানে কি তুমি বুঝতে পেরেছ?”
সমুদাকে কিছু বলতে যাওয়ার
আগেই বনবিহারীবাবু তাকে আরও একটি প্রশ্ন করে বসলেন,
“আচ্ছা মশাই, আপনি কীভাবে ‘আন্ডারস্ট্যান্ড’ করলেন যে ওটা একটা
‘গান’?”
সমুদা তারপর আমাদের ধীরেসুস্থে
বলল, “ওই তিন লাইন এক দু’বার পড়ে কখনওই বোঝা সম্ভব ছিল না যে ওটা আসলে একটা বন্দুক, তাও আবার একজন বিখ্যাত শিকারির।”
আমরা তার কথা কিছুই বুঝতে
পারছিলাম না। সমুদা
ওই চিঠির তিনটি লাইন সম্বন্ধে আমাদের জানাল, “প্রথম লাইন পড়ে বুঝতে পারলাম যে এটা কোনও মন্ত্র নয়। জিম শব্দের অর্থ হল মানুষের নাম এবং বাঘেরা হবে
ফুস বোঝায় যে এমন কোনও জিনিস বা ব্যক্তি যার কাছে বাঘেরা বশ মানে। দ্বিতীয় লাইন দেশে তুই বিখ্যাত, তোর কাছেই
থাকবে পশুরা অক্ষত - এটা পড়ে মাথায় এল শুধুই জিম করবেটের নাম। কারণ, এই দেশে উনিই হলেন সেই ব্যক্তি যিনি প্রথমে একজন শিকারি এবং পরে পশুদের রক্ষক
হিসাবে বিখ্যাত হয়েছেন। পশুরক্ষা করার জন্য যেসব জাতীয় উদ্যান তৈরি হয়েছে
তার মধ্যে একটির নামকরণ ওঁর স্মরণেই করা হয়েছে অর্থাৎ সেই জিম করবেট ন্যাশনাল পার্ক। প্রথম দুটি লাইন থেকে তাই
ধরে ফেললাম, এটা নিশ্চয়ই জিম করবেটের কোনও এক কাছের জিনিস এবং সেটা
আরও স্পষ্ট হয়ে গেল তৃতীয় লাইন থেকে। কারণ, শিকারি বন্দুক ছাড়া লড়তে পারে না আর ‘পুরনো দেবতার কাছে
পাবি তুই বর’ কথাটির
অর্থ হল সেই বন্দুক রাখা রয়েছে পুরনো দেবতা অর্থাৎ ওই পুরনো কালীমন্দিরে।”
সমুদা আরও বলল, “এই তিন লাইন এক করে যা মানে দাঁড়ায় তা হল, মানিকচাঁদের বাবামশাইয়ের নিলামে কেনা সেই জিনিস আসলে বিখ্যাত শিকারি জিম করবেটের
একটি বন্দুক, যে
বন্দুক পুরনো কালীমন্দিরে লুকিয়ে রাখা আছে। আজ তাই সন্ধেবেলা আমি সেখানে গিয়ে ওই বন্দুকটি
উদ্ধার করে রেখে আসি আরেক গোপন স্থানে, যাতে আগামীকাল মানিকচাঁদের
হাতে ওটা আমি তুলে দিতে পারি।”
সব শুনে সমুদাকে জড়িয়ে ধরে
বনবিহারীবাবু বললেন, “আপনার
‘নো’ তুলনা, সমুবাবু! একজন খাঁটি গোয়েন্দা
কী ‘ডু’ করতে পারে ‘টুডে’ আপনি তা ‘সি’ করালেন।”
বনবিহারীবাবুর কথা শুনে
আমিও বলে উঠলাম, “সমুদার কোনও জবাব নেই,
বনবিহারীবাবু। এর
আগে অনেকবারই সে তার মগজাস্ত্রের প্রমাণ দিয়েছে। সুতরাং এটা আমার কাছে নতুন কিছু নয়।”
আমার কথা শেষ হতেই সমুদা
একটু হাসল বটে, তবে সেই সাথে বলল,
“এখানেই শেষ নয় রে বঙ্কু, গল্প এখনও বাকি। তবে সেই শেষভাগটা জানাব আগামীকাল মানিকচাঁদের বাড়ি
পৌঁছে।”
সমুদার কথা শুনে মনে হল, এই গল্পে ওই চিঠি ছাড়াও রয়েছে আরও অনেক রহস্য। তাই সেই বিষয় জানতে আমাদের এখন থাকতে হবে তদন্তের
শেষদিনের অপেক্ষায়।
পরদিন সকালে উঠে বনবিহারীবাবুর
সাথে আমি গেলাম মানিকচাঁদের বাড়ি আর সমুদা গেল সেই বন্দুকটি গোপন স্থান থেকে সংগ্রহ
করতে। তারপর সেও অবশ্য মানিকচাঁদের বাড়ি এসে ঢুকল।
সমুদার হাতে ওই বন্দুক দেখে
আমরা আর নিজেদের ঠিক রাখতে পারলাম না। ইচ্ছে
হল বন্দুকটা একবার স্পর্শ করতে। কিন্তু সমুদা সেই বন্দুক নিয়ে এগিয়ে গেল মানিকচাঁদের
কাছে এবং তাঁর হাতে ওই বন্দুক তুলে দিয়ে বলল, “দেখুন তো মিঃ লাহিড়ি, এটাই সেই আপনার বাবামশাইয়ের নিলামে কেনা জিম করবেটের বন্দুক কি না?”
মানিকচাঁদ বন্দুকটা হাতে
নিয়ে বললেন, “আপনি এটা পেলেন কীভাবে,
সমরেশবাবু?”
সমুদা এই প্রশ্নের উত্তরে
যা বলল তা শুনে আমরা অবাক হয়ে গেলাম। “মিঃ লাহিড়ি, আপনিই তো শঙ্করের মাধ্যমে
বন্দুকটা পুরনো কালীমন্দিরে লুকিয়ে রেখেছিলেন। আমি
ওখান থেকেই উদ্ধার করে আনলাম।”
সমুদার কথা শেষ হতেই মানিকচাঁদকে
দেখি লজ্জায় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। বনবিহারীবাবু সমুদাকে পুরো ব্যাপারটা খুলে বলার
জন্য অনুরোধ করলেন এবং সমুদা সেই অনুরধে সাড়া দিয়ে বলল, “মিঃ লাহিড়ি আমার এখানে আসার খবর পান যখন ওই রাতে সাধন
মাঝিকে গ্রামের মোড়ল ডেকে পাঠায়। তিনি তৎক্ষণাৎ একটা প্ল্যান করে এই সুন্দর গল্পটা শঙ্করের দ্বারা সাজিয়ে
ফেললেন। প্রথমে মিঃ লাহিড়ি শঙ্করকে পাঠিয়ে দিলেন ওই মন্দিরে
বন্দুকটা লুকিয়ে রাখতে। পরে আবার তাকেই বললেন ছন্দ
মিলিয়ে এক হেঁয়ালি তৈরি করতে। শেষে তিনি এই হেঁয়ালির মানে এবং তার মধ্যে লুকিয়ে
থাকা বন্দুকটার উদ্ধারের কাজ, দুটোই আমাকে দিলেন। এই পুরো বিষয়টা মিঃ লাহিড়ি
ঘটালেন শুধুমাত্র আমার বুদ্ধির পরীক্ষা নিতে এবং এটাও দেখতে যে তিনি বেশি বুদ্ধিমান
নাকি আমি।”
সমুদার কথা শেষ হতেই মানিকচাঁদ
হেসে বললেন, “আপনি জিতে গেলেন,
সমরেশবাবু। আপনার
বুদ্ধির কাছে আমি হার স্বীকার করে নিলাম। কিন্তু চিঠির কথা বাদ দিলে বাকিগুলো আপনি ধরলেন কীভাবে?”
এর উত্তর সমুদা হেসেই দিল। “আমি যে একাই বুদ্ধিমান সেটা কখনওই আমি মনে করি না, মিঃ লাহিড়ি। তাই যদি প্রথম থেকে বলি
তাহলে আমার প্রথম সন্দেহ হয় শঙ্করকে। কারণ, মন্দিরে পুজো যদি কেউ দেয় তাহলে তার কিছু চিহ্ন নিশ্চয়ই
সেখানে থাকবে। কিন্তু মন্দিরে সেদিন ঢুকে তেমন কোনও চিহ্নই আমরা দেখতে পেলাম না।”
তারপর সমুদা সামনে রাখা
চেয়ারে বসে বলল, “এবারে আসি আপনার কথায়। এই এলাকায় ঢোকামাত্রই আপনার প্রভাবের কথা সর্বদাই
শুনে এসেছি। তাই খটকা একটা ছিলই যে আপনার মতো এত প্রভাবশালী
ব্যক্তি আমার মতো সামান্য এক গোয়েন্দার
শরণাপন্ন হচ্ছেন শুধুমাত্র নিজের পিতার সেই জিনিসটি খুঁজে পাওয়ার জন্য! এটা আমার একদমই বিশ্বাস হয়নি। তারপর গতকাল ইন্সপেক্টর মিত্রর থেকে আপনার সম্বন্ধে
আরেকটু জানতে পারলাম। ওঁর মাধ্যমেই জানতে পারলাম যে আপনি একজন বিলেত-ফেরত উকিল। ফলে
আপনার বুদ্ধিও খুব একটা কম নয়। সুতরাং এই চিঠির মানে বের করা আপনার পক্ষেও সম্ভব।”
টেবিলে রাখা বিলেতি ম্যাগাজিন
হাতে নিয়ে সমুদা আবারও বলল, “এবার আসি
সেদিনের কথায়। শঙ্করের ঘরে তার সমস্ত বইখাতা ঘেঁটে বুঝলাম যে ও সত্যি কবিতা লেখায় পারদর্শী। টেবিলের উপর রাখা খাতা খুলতেই আমার চোখে পড়ল ওর
লেখা শেষ কবিতাটা আর তখনই প্রমাণ পেলাম ওই খাতায় লেখা কবিতার লাইনগুলোর সাথে সেই চিঠির
হাতের লেখার হুবহু মিল রয়েছে। সুতরাং আপনার এই প্ল্যানের ব্যাপারটা তখন আমার
কাছে একদম পরিষ্কার হয়ে গেল।”
সমুদার কথা শেষ হতেই মানিকচাঁদ
বলে উঠল, “আপনাকে আমি ভুল ভেবেছিলাম,
সমরেশবাবু। নিজের
বুদ্ধির উপর খুব গর্ব ছিল, তাই আজ
আপনার কাছে উপযুক্ত শিক্ষা পেলাম।”
মানিকচাঁদের কথা শুনে মনে
হল, গল্প এখানেই শেষ। কিন্তু সমুদার কাছে এই গল্প
তখনও শেষ নয়। সে মানিকচাঁদের
উদ্দেশ্যে বললেন, “এবার কি
আপনি আসল বন্দুকটা দেখাবেন, মিঃ লাহিড়ি?”
মানিকচাঁদ হাসতে হাসতে বললেন, “এটাও আপনি ধরে ফেলেছেন?”
উত্তরে সমুদা বলল, “সন্দেহটা আমার আগেই হয়েছিল। পরে এই বন্দুকটা হাতে পেয়ে বুঝলাম, এটা নকল। কারণ, শুধুমাত্র আমার বুদ্ধির পরীক্ষা নিতে আপনার মতো একজন বুদ্ধিমান ব্যক্তি কখনওই
শঙ্করের হাতে আসল বন্দুকটা তুলে দিয়ে তাকে
মন্দিরের মাটি খুঁড়ে সেটি সেখানে রেখে আসতে বলবে না। সেই বন্দুক হল এক ঐতিহাসিক জিনিস এবং আপনার পরিবারের
অমূল্য সম্পদ। তাই এইভাবেই
দুয়ে দুয়ে চার করে ফেললাম, মিঃ লাহিড়ি।”
সমুদার কথা শেষ হতেই আবারও অবাক হয়ে গেলাম আমি আর বনবিহারীবাবু। মনে হচ্ছিল, সেদিন যেন খালি অবাক হওয়ার দিন। সমুদা একের পর এক কথা বলে
আমাদের অবাক করে দিচ্ছে।
অবশেষে এই নকল বন্দুক রেখে
মানিকচাঁদ নিজের ঘর থেকে সেই ঐতিহাসিক জিম করবেট-ব্যবহৃত ওঁর বন্দুকগুলোর মধ্যে অন্যতম সেই বন্দুক এনে সমুদার হাতে তুলে দিলেন। আমরাও এগিয়ে এলাম সমুদার কাছে এবং সেই বন্দুক ধরে
বেশ এক আলাদা অনুভূতির স্বাদ পেলাম।
সুন্দরবনে ঘুরতে এসে এ যেন
এক ইতিহাসকে স্পর্শ করার সুযোগ পেলাম। বনবিহারীবাবু সমুদার কাছে সেই বন্দুকের বিষয়ে জানতে
চাইলেন এবং সমুদার কথা শুনে বুঝলাম, জিম করবেট তাঁর বিখ্যাত সেইসব শিকারে এই বন্দুক ব্যবহার করেননি। অর্থাৎ, ওঁর লেখা ‘ম্যান ইটার অফ কুমায়ুন’
বা ‘দ্য ম্যান ইটিং লেপার্ড অফ রুদ্রপ্রয়াগ’-এর মতো বইগুলোতে যেসব বন্দুকের বর্ণনা দেওয়া রয়েছে, তার মধ্যে এই বন্দুক একেবারেই
পড়ে না।
বনবিহারীবাবু সেই বন্দুকটিকে
ছাদে নিয়ে গিয়ে জঙ্গলের দিকে তাক করে বিভিন্নরকম পোজে ছবি তুলতে লাগলেন, আর এই কাজে আমি ছিলাম ওঁর সঙ্গী। শেষে উনি ছাদের পশ্চিমদিকে
সাজানো বাঘের মূর্তিটির পাশে ওই বন্দুকটি রাখতেই অদ্ভুতভাবে সূর্যাস্তের আলোয় সেই দৃশ্য হয়ে উঠল সুন্দরবনে কাটানো আমাদের
অন্যতম এক শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত। সেই দৃশ্য দেখে মনে হচ্ছিল, কোনও এক মায়াবী পুরুষ যেন হাতে বন্দুক নিয়ে ওই বাঘটির গায়ে
হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। সেই অদ্ভুত অলৌকিক মুহূর্তটা ক্যামেরাবন্দি করতে
ভুললেন না বনবিহারীবাবু।
এই সূর্যাস্তের আলোই আমাদের
এই গল্পের সমাপ্তির ইঙ্গিত দিল। নিচে নেমে এসে আমরা মানিকচাঁদকে তাঁর বন্দুক ফিরিয়ে
দিলাম এবং তাঁর বাড়ি থেকে বিদায় নিলাম। সেদিন রাতে আমাদের জন্য এক বিশেষ খাবারদাবারের
আয়োজন করেছিলেন মানিকচাঁদ এবং তাঁর আপ্যায়নে আমরা বড়োই মুগ্ধ হলাম। শঙ্করকে তার দৈনদিনের কাজের
সাথে কবিতা লেখার কাজটাও চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন সমুদা ও বনবিহারীবাবু।
ইন্সপেক্টর কাশীরাম মিত্রও
পরে এসে হাজির হলেন সেখানে এবং পুরো ঘটনাটা শোনার ইচ্ছাপ্রকাশ করলেন। বনবিহারীবাবু ওঁকে পুরো
ঘটনাটা আবারও খুলে বললেন এবং সব শুনে উনি বললেন,
“মানিকচাঁদ, তুমি আর বুদ্ধির লড়াই করার জন্য লোক পেলে না! শেষে কিনা
সমরেশবাবুকে ধরলে! ওঁর মতো বুদ্ধিমান গোয়েন্দা এই সমাজে খুব কমই
রয়েছে।”
সবার সবকথা শুনে আমার আরও
গর্ব হতে লাগল সমুদার জন্য।
তারপর সেই রাতে আমরা ফিরে
এলাম সাধন মাঝির বাড়ি এবং রাত পেরোতেই পরদিন বেরিয়ে পড়লাম কলকাতার উদ্দেশ্যে। সাধন মাঝি ও তার স্ত্রী
বড়োই ভালো মানুষ। তারা গরিব হলেও আমাদের এই ক’দিনে কোনও অভাব বুঝতে দেননি। কী বা রোজগার তাদের, কিন্তু আমাদের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য তারা এই কিছুদিন
আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন। তাই ফিরে আসার আগে তাদের কিছু টাকা দিয়ে আমরা সাহায্য করে এলাম। জানি এই সামান্য কিছু টাকা হয়তো তাদের মতো মানুষের
কষ্টের কোনও অংশই কমাতে পারবে না, কিন্তু তবুও দিয়ে এলাম কারণ
সেই টাকা তাদের প্রতি আমাদের আন্তরিকভাবে শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা জানানোর এক চিহ্নমাত্র।
মানিকচাঁদের দেওয়া বোটেই
আমরা নদী পেরিয়ে গোসাবা ও সুন্দরবনকে বিদায় জানালাম এবং আবার ক্যানিং হয়ে ট্রেনে ফিরে
এলাম কলকাতা। কলকাতা
ফিরে বনবিহারীবাবু চলে গেলেন গড়িয়া, ওঁর নিজের বাড়ি এবং আমরাও বাড়ি ফিরে এলাম।
সেদিন রাতে বাবাকে সব ঘটনা
খুলে বললাম। সেই সাথে বনবিহারীবাবুর কথাও বলতে ভুললাম না। উনি অবশ্য কিছুদিনের মধ্যেই
আমাদের বাড়ি এসে ঘুরে গেলেন এবং ওঁর নতুন প্রদর্শনীর জন্য আমাদের নিমন্ত্রণও করে গেলেন। ওঁর সেই প্রদর্শনীতে গিয়ে
আমাদের খুবই ভালো লাগল। ওঁকে দেখে অবশ্য চেনাই যাচ্ছিল না যে উনিই সেই বনবিহারী গুপ্তপতি। এত মানুষের সমাগম দেখে বুঝতেই
পেরেছিলাম, ওঁর এই প্রদর্শনী একেবারেই সফল। ওই মুহূর্তে আমার সেই মাতা
সন্ন্যাসিনী ত্রিভুবনেশ্বরীর কথা মনে পড়ে গেল। জ্যোতিষ
চর্চা নিয়ে আমার তেমন কোনও ধারণা নেই, কিন্তু এক্ষেত্রে ওঁর এই ভবিষ্যৎবাণী একেবারেই মিলে গেল। বনবিহারীবাবুর প্রদর্শনীতে
সুন্দরবনে তোলা ছবির সংখ্যাই ছিল বেশি এবং তার চেয়েও উল্লেখ করার মতো ঘটনা হল, সেই সফরে ওঁর
তোলা শেষ ছবি অর্থাৎ ওই সূর্যাস্তের আলোয় সেই অলৌকিক দৃশ্যের ছবিটাই হল এই প্রদর্শনীর
মূল আকর্ষণ।
ভগবান জীবনের প্রতি মোড়ে
কী যে নতুন চিত্র লিখে রেখেছেন, তা উনি স্বয়ংই জানেন। না হলে তখনকার নামী আলোকচিত্রকর
বনবিহারীবাবু যে আমাদের জীবনের চলার পথে এইভাবে জুড়ে যাবেন তা আমরা কখনওই কল্পনা করিনি। কল্পনা করিনি বলেই হয়তো
এতটা ভালো লাগছে। তাই শেষ
লাইনে শুধু বলব, জীবন তোমারে জানাই সেলাম।
_____
অলঙ্করণঃ বিশ্বদীপ পাল
No comments:
Post a Comment