রহস্য যখন সোনালি
সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী
২৫শে ডিসেম্বর, ২০০৪, গভীর রাত
এক ঝটকায় ঘুম থেকে উঠে পড়ল বিপ্লব। কেমন যেন ঘোরের মধ্যে সে। শীতের রাতেও গায়ে
আলাদা গরম কাপড় না জড়িয়েই এসে দাঁড়াল নিঝুম ঘুমন্ত বারান্দায়। নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে
সামনের আদিগন্তবিস্তৃত কুয়াশাঘেরা মাঠ যেন হয়ে উঠেছে এক প্রবল সমুদ্র, ধেয়ে আসছে সে দানবিক গর্জনে উন্মত্ত হস্তীযূথের মতো।
দুঃস্বপ্নেও তো এমনই দেখল সে! অজানা আশঙ্কায় আতঙ্কে চিৎকার করে সংজ্ঞা হারাল
বিপ্লব।
বছর চারেক বাদেঃ
পাহাড়ি এলাকার এক কাঠচেরাই কলে কাজ করা সামান্য কর্মচারী বিপ্লবের নিস্তরঙ্গ
জীবনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছিল চার বছর আগের সেই রাতের পর। ভয়াল সুনামিতে ২৬শে
ডিসেম্বর সকাল থেকে যখন মুহুর্মুহু দুঃসংবাদের ঢেউ আছড়ে পড়ছিল ভারতের সমুদ্রসীমা
ধরে। হতবাক বিপ্লব তখন ভাবার চেষ্টা করছিল
গতরাতে দেখা স্বপ্নের সাথে এই দুর্বিষহ বাস্তবের কোনও সম্পর্ক আছে কি না!
দুঃস্বপ্ন তো আগেও দেখেছে। এমন তো আগে কখনও হয়নি! নাকি হয়েছে, সে খেয়াল করেনি! এত গুরুতর ঘটনা না হওয়ায় হয়তো সেসব আর
কর্ণগোচর হয়নি তার।
হয়তো এই দোলাচল চলত আরও কিছুদিন, কিন্তু যখন ২০০৮-এর নভেম্বরের সেই ২৫ তারিখেই আবার এক ভয়ানক রক্তাক্ত দুঃস্বপ্ন
দেখে ঘুম ভাঙল বিপ্লবের। সে দেখল যেন কোনও এক বিরাট শহর হয়ে উঠছে হাহাকারের মৃত্যুপুরী, বারুদের ধোঁয়ায় আর আগুনের হলকায় ঢেকে যাচ্ছে রক্তাভ আকাশ। আর তার ঠিক পরের
রাতই বাস্তবে অভিশপ্ত হল মুম্বইয়ের তাজ হোটেলে সন্ত্রাসবাদী হানায়। সে নিশ্চিত হবার
সাথে সাথে যথেষ্ট ভীতও হল।
সে স্বপ্নে ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছে! এমন এক ভবিষ্যৎ যা ভয়ংকর! এর কী ব্যাখ্যা
হতে পারে?
কেই বা বিশ্বাস করবে? বিশ্বাস করলেও ঠেকানো যাবে কি নিয়তি?
বিপ্লব হারিয়ে গেল সমাজের চেনা গণ্ডি থেকে। এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ লোক তো আর
সে ছিল না, এই শহরে তার কোনও প্রিয়জনও নেই। তাই
কেউ খোঁজও করল না।
রামতনু বোস লেন, ১৪ই জানুয়ারি, ২০১৮
প্রতীকদের উত্তর কলকাতার বাড়ির ড্রয়িং রুমে ঢুকতেই অনিলিখাদির নজরে পড়ল
বুকশেলফের উপরে রাখা একজোড়া বড়ো সূর্যমুখী ফুল। ওর মুখ থেকে সঙ্গে সঙ্গেই বেরিয়ে
এল, “বাহ্!”
নীল জিনসের উপরে সোনালি ফুলস্লিভ টপে ওকেও দেখাচ্ছিল একদম সদ্য ফোটা ফুলের মতোই।
একরাশ খোলা চুল পশ্চিমের জানালা দিয়ে আসা শেষবেলার রোদ লেগে ঝিকমিক করছে। প্রতীক
বলল, “মা সাজিয়েছে আজ।”
অনিলিখাদি সোফায় বসতে বসতেই বলে উঠল, “খুব সুন্দর। কিন্তু সূর্যমুখীর মাঝখানটা
লক্ষ করেছিস ভালো করে?”
“মাঝখান মানে ঐ কালো জায়গাটা? যেখানে বীজ থাকে?”
“রাইট! মন দিয়ে দেখ একবার কাছে গিয়ে।”
দেবসেনাপতি, সহেলী, আমি আর প্রতীক চারজনেই কৌতূহলে এগিয়ে গেলাম ফুলদানির দিকে। বিশ্বজিৎদার কোনও
হেলদোল নেই অবশ্য। সে তখন কফির পেয়ালা নামিয়ে আয়েশ করে কামড় দিচ্ছে গরম শিঙাড়ায়।
“কী রে, দেখলি?”
“হ্যাঁ গো অনিলিখাদি, কী অদ্ভুত
একটা প্যাটার্ন মধ্যিখানে। একটা প্যাঁচের মধ্যে আরেকটা জড়িয়ে কেমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছে
ভেতর থেকে বাইরে।”
“এর কারণ কী জানিস? পৃথিবীর যেকোনও
জীবের - সে প্রাণী বা
উদ্ভিদ যাই হোক, যেটা জীবনের মূল উদ্দেশ্য, সেই বংশবিস্তার।”
“মানে? ঠিক বুঝলাম না গো অনিদি।” সহেলী বলে ওঠে।
“আরে, এ তো সিম্পল ব্যাপার! বীজগুলো যদি ওইভাবে সাজানো থাকে পরপর, তাহলে সবদিকে সুন্দরভাবে ছড়াতে পারে জমিতে, তাহলে সমান দূরত্বে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক গাছ জন্মাতে পারে
আবার।” শিঙাড়ার সদ্গতি করতে করতে অবশেষে মুখ খোলে বিশ্বজিৎদা।
“থ্যাঙ্ক ইউ, বিশ্বদা। তবে প্রতীক, আমি আরেকটা কথা বলছি। এই যে তুই বললি অদ্ভুত প্যাটার্ন, প্রকৃতি নিজেই আপন খেয়ালে সত্যিই এক বিস্ময়কর অঙ্ক কষেছে
এখানে। ইরেশনাল নাম্বার মানে অমূলদ সংখ্যার ব্যাপারে তো তোরা সবাই অল্পবিস্তর
জানিস।”
দেবসেনা বলে ওঠে, “হ্যাঁ, ঐ তো পাই-এর মতো যেগুলো তো? ভগ্নাংশটা সহজে সমাধান করা যায় না।”
“এক্স্যাক্টলি। তবে পাইও দশমিকের বেশ কিছু ঘর যাওয়ার পরেই খানিকটা ১/৭-এর মতো
হয়ে যায়। মানে নির্দিষ্ট একটা সংখ্যার কাছাকাছি। কিন্তু এমন একটা অমূলদ রাশি আছে
যা আরও অনেকদূর বিস্তৃত, দূরে গেলেও ক্রমাগত
ছড়িয়ে পড়ে অনিশ্চিতভাবে।”
“কী সেটা?”
“গোল্ডেন রেশিও। সোনালি অনুপাত। যেটার মান প্রায় ১.৬১৮। প্রতিটা কোষ তৈরি হবার
সময়ে আগেরটার অবস্থানের সঙ্গে প্রায় ঐ ০.৬১৮ অংশ ঘুরপাক খেয়ে তবে নতুন কোষ জন্মায়
সূর্যমুখীতে। এভাবে আপনা থেকেই গোল্ডেন রেশিও মেনে ঐ প্যাঁচগুলো তৈরি হয়ে যায়।”
“আচ্ছা, তোমার ঝুলিতে কি এই নিয়েও কোনও অভিজ্ঞতা আছে? যেভাবে বলে যাচ্ছ গড়গড় করে।”
দেবসেনাপতির এই মোক্ষম প্রশ্নে অনিলিখাদি ফের সেই রহস্যময়ী নিঃশব্দ হাসিটি
ছড়িয়ে দিল ঘরে, আর কিঞ্চিৎ বিরক্ত বিশ্বজিৎদা ফুট
কাটল, “বেশ তো, শুরুই করো না হয় তোমার গল্প থুড়ি
অভিজ্ঞতা!”
মানব শরীর এবং গোল্ডেন রেশিও বিষয়ে একটা চমৎকার পেপার পড়েছিলাম গতবছর। একটা আন্তর্জাতিক
জার্নালে প্রকাশিত হয়েছিল সেটা। খুব খুশি হয়েছিলাম পেপারটির অথর মিঃ বোরা একজন ভারতীয়, এটা জেনে। ওঁকে
ইমেলে নিজের পরিচয়সহ একটা ছোট রিভিউ পাঠিয়েছিলাম সেটা পড়ে। আর আশ্চর্যের ব্যাপার,
উনিই নিজে তাতে আপ্লুত হয়ে আমায় একটা মিটিংয়ের ডেট দেন গৌহাটিতে, ওঁর নিজের
বাসস্থানেই। আরও জানান, এই বিষয়ে উনি হাতেকলমে গবেষণাতেও বেশ কিছুদূর এগিয়ে গেছেন। সেটাও নিজের চোখে
দেখার এক লোভনীয় প্রস্তাব দিলেন আমাকে। সচরাচর এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের গবেষকরা
যথেষ্ট গোপনীয়তা বজায় রাখতে ভালোবাসেন। কিন্তু আমার প্রোফাইল দেখে এতটাই ইম্প্রেসড
হয়েছেন যে আমার মতামতও তাঁর কাজে লাগবে এমনটা আশা করছেন বলে জানান। তবে আমার ওখানে
ওঁর সাথে দেখা করার বা এই সংক্রান্ত আলাপ আলোচনার কথা আর কাউকে জানাতে নিষেধ
করেছিলেন শুধু। আমি আর দ্বিতীয়বার ভাবিনি। গৌহাটির ফ্লাইট বুক করে ফেলি পরের
সপ্তাহেই।
গৌহাটি, ২০শে অগস্ট, ২০১৭
হিমালয়ের সেভেন সিস্টার নামে পরিচিত রাজ্যদের সবচেয়ে বড়োটিতে পৌঁছে এয়ারপোর্ট
থেকে বেরিয়েই দেখলাম আমার নাম লেখা বোর্ড হাতে অপেক্ষা করছে একজন। ডঃ বোরা
ড্রাইভারকে পাঠিয়ে দিয়েছেন আমায় রিসিভ করতে। এত বড়ো বৈজ্ঞানিকের আতিথেয়তা আর
আন্তরিকতা সত্যিই মুগ্ধ করল। পাহাড়ি ঢালে সবুজ চা-বাগিচার শোভা উপভোগ করতে করতে
এসে পৌঁছলাম ডঃ বোরার বাংলোর সামনে। গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালাম। ড্রাইভার সেটা
গ্যারেজে রাখতে গেল। আমি পা বাড়াচ্ছিলাম গেটের দিকে। হঠাৎ কানে এল, “ওদিকে যাবেন
না! বিপদ হবে!”
চমকে ঘাড় ঘোরালাম। একজন বছর চল্লিশেক বয়সের লোক। অদূরে একটা গাছের তলায়
দাঁড়িয়ে কেমন যেন অদ্ভুত দৃষ্টিতে ঠায় চেয়ে রয়েছে। অস্বস্তি হল। কিন্তু সেই গলার
স্বরে এমন কিছু ছিল যা আমাকে টেনে নিয়ে গেল তার দিকে।
“আমায় কিছু বলছেন?”
“না না, মাফ করবেন। আমি বলতে চাইনি কিছু।”
তাড়াতাড়ি সরে পড়তে চাইছিল লোকটা। মুহূর্তের মধ্যে আমার হাত ওর কব্জি চেপে ধরল
এক ঝটকায়। “দাঁড়ান, কোথায় যাচ্ছেন? আপনি যে আমাকেই বলেছেন এটা নিশ্চিত। এখন এড়িয়ে যেতে চাইছেন কেন? কী ব্যাপার বলুন তো? কে আপনি?”
“আ-আমি, আমি বিপ্লব।”
“তো?
আমায় চেনেন আপনি?”
“ন-না, চিনি না, কিন্তু, কিন্তু আমি দেখেছি।
এই বাড়ির মধ্যে গেলে, বাড়ির মধ্যে গেলে
আপনার...”
কথা শেষ করল না লোকটা। হাত ছাড়িয়ে নিমেষে কোথায় উধাও হল। ঠিক তখুনি একটা গলার
স্বর শুনলাম, “আরে, মিস অনিলিখা! আপনি এখানে দাঁড়িয়ে এখনও? কার সাথে কথা বলছিলেন? আসুন আসুন, ভিতরে আসুন।”
এক গাল হাসিমুখে স্বয়ং ডঃ বোরা এগিয়ে এসেছেন। মাঝবয়েসী ভদ্রলোক। মাথায় ছোটো
করে ছাঁটা চুল। চোখে হাই পাওয়ারের চশমা। তার ভেতর দিয়ে দেখা যাচ্ছে ছোটো অথচ অসম্ভব তীব্র দুই
চোখের চাহনি। মুখের গড়নে পাহাড়ি এলাকার লোকের আদল স্পষ্ট।
এগিয়ে গেলাম পায়ে পায়ে বাড়ির ভেতরে। কিন্তু একটা অজানা খচখচে ভাব মাথার মধ্যে
রয়ে গেল। বিপ্লব নামের ঐ লোকটার অদ্ভুত কথাগুলো মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল।
তবে ডঃ বোরার অমায়িক ব্যবহার, খাওয়াদাওয়ার এলাহি
আয়োজন আর সর্বোপরি যে জিনিসটার জন্য এতদূরে ছুটে আসা, সেই জটিল গবেষণার টপিক নিয়ে ওঁর প্রাঞ্জল ভাষায় ব্যাখ্যা
রীতিমতো রোমাঞ্চিত করে তুলছিল আমায়।
পিরামিড, পার্থেননের মতো প্রাচীন ইমারত, লাস্ট সাপারের মতো ছবি, নত্রদাম গির্জা, সামুদ্রিক নানা
প্রাণীর শরীরের অংশ এমনকি সুন্দর মানুষের মুখ সবকিছুতেই প্রায় দেখা গেছে এই অনুপাত। সবটাই নেহাত
কাকতালীয় কি না সে বিষয়ে তর্ক থাকলেও বাস্তব এটাই! আসলে আমাদের মগজ যাকে পছন্দ করে
আমরা তাকেই সুন্দর বলে উঠি। আর ঐ অনুপাত বর্তমান এমন কিছুর দিকেই মগজ স্বাভাবিকভাবে
আকৃষ্ট হয়। শুনতে শুনতে আমার রবি ঠাকুরের ‘আমি’ কবিতাটার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। একটি রেখাকে যদি এমন অনুপাতে
ভাগ করা হয় যার বড়ো অংশটির সাথে ছোটো অংশের যা অনুপাত, সমগ্র রেখাংশের সাথে বড়ো অংশের অনুপাতও তাই, সেটাই গোল্ডেন রেশিও, সোনালি অনুপাত। দেখা গেছে এটা হয় ১.৬১৮ হলে তবেই - গ্রীক বর্ণমালার ফাই অক্ষর দিয়ে একে চিহ্নিত করা হয়। এগুলোর
বেশ কিছুটা আমারও জানা ছিল। কিন্তু এবার যেটা বললেন উনি, সেটা মারাত্মক! উনি নাকি চেষ্টা করছেন এই গোল্ডেন রেশিওর
পরিপূর্ণ কার্যকারিতার এক জীবন্ত নিদর্শন তৈরি করতে। এক সর্বাঙ্গসুন্দর মানুষ। যে
হবে টিকে থাকার লড়াইয়ে আরও যোগ্য। সারভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্ট-এর তত্ত্ব মেনে। কিন্তু
কীভাবে সেটা ভেঙে বললেন না। দেখানোর জন্য আমাকে নিয়ে এলেন একতলার কোণার দিকে একটা
বেশ বড়সড় ঘরে। এ-ঘর দেখলেই বোঝা যায় এটা একটা ল্যাবরেটরি। নানারকম রাসায়নিকের গন্ধ, একরাশ তার, কম্পিউটার আর বৈদ্যুতিন যন্ত্রপাতিতে ভরে আছে আধো অন্ধকার কুঠুরি।
“এই যে এদিকটায় আসুন অনিলিখা, আসল জিনিসটা
এখানে।”
একটা বড়ো রাসায়নিক আর কাচের বোতল ইত্যাদি ঠাসা আলমারির ওপাশে গিয়ে ডাক দিলেন
ডঃ বোরা।
আমি যেই সেদিকে পা বাড়ালাম অমনি কী যেন একটা হয়ে গেল। একটা সবল হাত আমার চোখে
নাকে ঠেসে ধরল একটা ভেজা ভেজা কাপড় আর সংজ্ঞা হারানোর আগে আমার নাকে এল একটা
মিষ্টি গন্ধ। ক্লোরোফর্ম!
জ্ঞান ফিরল যখন মাথায় অসহ্য একটা যন্ত্রণা। চিত হয়ে শুয়ে আছি কোথাও। হাত
নাড়াতে গিয়ে টের পেলাম সে দুটোই শক্ত করে বাঁধা। ঘোরের মধ্যে কানে এল ডঃ বোরার
ক্রূর কণ্ঠ, “নড়াচড়া করে লাভ নেই, মিস অনিলিখা! তুমি আমার ড্রিম প্রোজেক্টের একজন
অংশীদার হতে চলেছ! বিজ্ঞানের জন্য, দুনিয়ার জন্য তোমার এই অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, তুমি সেই
সম্মান উপভোগ করতে পারবে না। হা হা!”
“আপনি, আপনি কী করতে চান আমায় নিয়ে? ছেড়ে দিন বলছি! এর ফল ভালো হবে না!”
“আরে আরে, চটছ কেন? ঐ দেখ, তোমার বামদিকের
টেবিলটায়। ওখানে রয়েছে আমার স্বপ্নের আধার, আমার স্ত্রী রেণু।”
ঐ অবস্থাতেই কষ্ট করে ঘাড় ঘুরিয়ে যা দেখলাম, আমার হাড় হিম হয়ে গেল। ঠিক আমার
এক হাত দূরেই আরেকটা অপারেশন টেবিলের মতো বেডে শোয়ানো আছে একটা বিকৃত নারীশরীর।
জীবিত না মৃত বোঝার উপায় নেই। তবে মুখ বলে কিছু নেই। ক্ষতবিক্ষত রক্ত-মাংস-চামড়ার
একটা পিণ্ড সেখানে। আমার মুখ দিয়ে অস্ফুটে আর্তনাদ বেরিয়ে এল তৎক্ষণাৎ।
পৈশাচিক একটা অট্টহাসি হেসে উঠলেন ডঃ বোরা। উন্মাদের মতো গলায় বলে চললেন, “প্রথমে
ভেবেছিলাম রেণুই হবে সেই স্বপ্নের মানুষ। কিন্তু ওর মুখের আদলটা ঠিক গোল্ডেন
রেশিওতে ছিল না, জানো তো? প্লাস্টিক সার্জারি করতে গিয়ে... যাই হোক, তোমার প্রোফাইলটা দেখেই আমার মন ভরে যায় যখন ইমেল করলে।
আমার নিজস্ব সফটওয়্যারে মেপে দেখেছি, এত নিখুঁত মাপের গড়ন আর কোথায় পাব? তার উপর তোমার এই অসাধারণ আই.কিউ লেভেল! ব্রেনটাও কাজে লাগবে, বুঝলে? বেশি কষ্ট দেব না।
সব রেডিই আছে। মূল আধার আমার রেণুর শরীরটাই থাক, দরকারি জিনিসগুলো বাকি তোমার থেকে শুধু ট্রান্সপ্লান্ট করিয়ে নেব। হা হা!”
সম্ভাব্য বিপদের কথা ভেবে আমার হাত-পা অসাড় হয়ে আসছিল। বড়ো ফরসেপ, কাঁচি আরও নানা ভয়ানক যন্ত্রপাতি হাতে এগিয়ে আসতে থাকা ডঃ
বোরাকে দেখে তাও একটা মরিয়া চেষ্টা করলাম প্রাণপণে চেঁচিয়ে, “বাঁচাও!”
“কেউ আসবে না এইখানে! বৃথাই নিজের সুরেলা গলাটার অপব্যবহার করছ!”
কিন্তু বোরার কথা শেষ হবার আগেই এক অত্যাশ্চর্য কাণ্ড ঘটল। ল্যাবরেটরির এক
পাশের বন্ধ জানালাটা সশব্দে ভেঙে পড়ল, আর অসম্ভব ক্ষিপ্রগতিতে একটা মস্ত কুঠার
নিয়ে লাফিয়ে পড়ল বিপ্লব! ডঃ বোরা হকচকিয়ে হাতের উদ্যত ফরসেপটাই সবে উদ্যত করছিলেন
আগন্তুককে উদ্দেশ্য করে, তার আগেই কাঠ চেরাই
করা বলিষ্ঠ একটা হাত থেকে নিক্ষিপ্ত কুঠার পৌঁছে গেল অভীষ্ট লক্ষ্যে। বিকট আর্তনাদ
করে গোঙাতে গোঙাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন বোরা, রক্তাক্ত ডান হাত চেপে। ততক্ষণে আমার হাতের বাঁধন মুক্ত করেছে বিপ্লব। নাকে
আমার নিজের রুমালটা বেঁধেই চটপট ক্লোরোফর্মের শিশিটা হাতে নিয়ে সজোরে স্প্রে করে
দিলাম মাটিতে গড়াতে থাকা নরপিশাচটার নাকে।
ব্যস! তারপর কীভাবে আমি সেখান থেকে বেরিয়েছি; একটানা ছুটে কয়েকজনের সাহায্যে পৌঁছেছি লোকাল থানায়, গোটা ঘটনা জানিয়েছি পুলিশকে সেসব আরেক কাহিনি। তবে নির্বিঘ্নে
ফিরে আসতে ওঁদের সহায়তা পেয়েছিলাম যথেষ্ট।
এই পর্যন্ত বলে অনিদি দম নেবার জন্যই একটু থামল বোধহয়। অমনি সহেলীর প্রশ্ন, “তারপর কী হল? বদমাশ বোরা ধরা পড়ল? আর সেই সুপারম্যান বিপ্লব?”
অনিলিখাদি হেসে বলল, “সব অনুমতিবিহীন গবেষণার জিনিসপত্র এবং অপরাধের প্রমাণ
সমেত গ্রেপ্তার হলেন ডঃ বোরা। বাড়িতে তাঁর বাংলোর কেয়ারটেকার কাম ড্রাইভারকে পাওয়া
যায়নি। সে ব্যাটা বিপদ বুঝে ভেগেছিল। আর বিপ্লব, সে যেমন এসেছিল আবার সেভাবেই উধাও হয়ে গেছিল। নিজের কাজটুকু সেরে। তবে যাবার
আগে আরও একবার আমার সাথে একান্তে দেখা করে গেছিল। বলেছিল ওর কথা, ওর গোপন ক্ষমতা এবং ওর যন্ত্রণার কথা। অবচেতনে স্বপ্নের
গভীরে এমন কিছু ও দেখতে পেত যা ভবিষ্যতে ঘটতে চলেছে। অত গভীর ঘুমন্ত অবস্থায়
সাধারণ মানুষ জেগে ওঠে না, আর জাগলেও স্বপ্নের
স্মৃতি এভাবে রিকভার করতে পারে না। সত্যিই ও সুপারম্যান। আসলে কী জানিস, সব মানুষের মধ্যেই হয়তো এমন একজন সুপারম্যান লুকিয়ে থাকে।
ওর একটা অনন্য প্রতিভা ছিল ঠিকই, কিন্তু সেটাকে ও
মানুষের কল্যাণের জন্য ব্যবহার করার মতো মহত্ত্ব দেখিয়েছিল। আর অন্যদিকে ডঃ বোরার
মতো প্রতিভাবান বিজ্ঞানীরা নিজেদের ক্ষমতার চরম অপব্যবহার করে মানবজাতির কলঙ্ক হয়ে
ওঠেন। সোনালি ভবিষ্যৎ গড়তে পারে মানুষই, তার জন্য সোনালি অনুপাতই মুখ্য নয়, মনটা সুন্দর হলেই সব সুন্দর। তাই না?”
এবার সবাইকে অবাক করে উদাত্ত আবেঘঘন কণ্ঠে আবৃত্তি করে ওঠে বিশ্বজিৎদা, “বিশ্বভুবনে, দূরে দূরান্তে, অনন্ত অসংখ্য লোকে লোকান্তরে এ বাণী ধ্বনিত হবে না কোনও খানে, তুমি সুন্দর, আমি ভালোবাসি!”
আমরা সবাই, অনিলিখাদিও হাততালি দিয়ে উঠি একজোটে।
পুবের জানালা দিয়ে তখন আকাশে দেখা যাচ্ছে থালার মতো সোনালি পূর্ণিমার চাঁদ!
_____
স্বর্গীয় শ্রী অজিতকুমার রায়চৌধুরী
স্মৃতি গল্প প্রতিযোগিতা, অনিলিখা ফ্যান
ক্লাব আয়োজিত গল্প প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কারপ্রাপ্ত গল্প
অলঙ্করণঃ সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী
No comments:
Post a Comment