বিপদ যখন ওত পেতে
লেখকঃ বাবিন
আলোচকঃ সৈকতা দাস
প্রকাশকঃ বর্ণদূত
বাঁধাইঃ পেপার ব্যাক
পৃষ্ঠাসংখ্যাঃ ১৮২
মূল্যঃ ১৫০ (ভারতীয় মুদ্রা)
প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণঃ সুমিত রায়
সবার আগে মনে হয় বইটা আমি পেয়েছিলাম। সবার শেষে লিখতে বসলাম। দুটো কারণ - এক, একটু ঘেঁটে ছিলাম,
দুই, বইয়ের ঘোরটা কাটতে সময় লাগল।
লেখকের প্রথম বই এটি। ন’টি গল্প ও একটি উপন্যাস আছে।
প্রথমেই বলি প্রচ্ছদের কথা। আমাদের মতো ভূত-অলৌকিক দেখলেই যারা ঝাঁপিয়ে পড়ি তাদের কাছে তো বটেই, বই পড়তে ভালো না বাসলেও শুধুমাত্র প্রচ্ছদের জন্য একবার অন্তত বইটা হাতে নিয়ে
দেখতেই হবে। এককথায় অসাধারণ প্রচ্ছদ। সুমিত রায়
মহাশয়কে ধন্যবাদ।
বই
‘ভূতের গপ্পো’-র মতো ছড়া দিয়ে শুরু হলেও মোটেই
শুধু ভূতের গল্প নেই। ভূত,
রহস্য, কল্পবিজ্ঞান সব রয়েছে। তবে ছড়াটি বেশ। লেখকের লেখা এই প্রথম কোনও ছড়া পড়লাম।
১। গাড়িবারান্দা
গল্পে শুধু ভূত নয়,
মস্ত বড়ো রহস্যও আছে। দাদুর অধরা ইচ্ছে নাতিকে পূর্ণ করতে দেখে
যখন মনটা আর্দ্র হবে ঠিক তখনই শুরু হবে...। আমি কেন বলব? পড়ে দেখতে হবে তো। তবে শেষ প্যারার টুইস্টটা পুরো গল্পটাকেই
অন্যমাত্রা দেয়। যেখানে ভয়, স্নেহ, দুঃখ সব অনুভূতিগুলো কেমন মিলেমিশে যায়!
২। ঘাটশিলার ঘটনা
এমন এক গল্প, যে গল্প খুব সাধারণভাবে শুরু হলেও যত শেষের দিকে গিয়েছে তত উত্তেজনা বেড়েছে। এক বিখ্যাত লেখকের ঘাটশিলায় দিদির বাড়ি বেড়াতে আসার পর তাঁর সাথে
যে এরকম ঘটনা ঘটতে পারে তা কল্পনারও অতীত। রহস্য তো আছেই, তবে এই গল্পকে আমি শিক্ষামূলক গল্পই বলব। লেখক মহাশয় অত্যন্ত মুন্সিয়ানার সাথে একটা ছোট্ট কথা মনে করিয়ে
দিতে চেয়েছেন। আমরা ছোটোবেলায় বা বড়ো হয়েও অনেক সময় ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় এমন কিছু
কাজ করে ফেলি যার ফলে অন্য একজনের জীবন,
স্বপ্ন, পরিবার তছনছ হয়ে যেতে পারে। আর ঠিক সেই একই পরিস্থিতি যদি আমাদের সামনে তৈরি হয়? তাই একটু সৎ সাহস বোধহয় থাকা ভালো।
৩। সাহেবি স্কুলের ভূত
মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করানোর দিন পনেরোর মধ্যে যে ভৌতিক ঘটনার জন্য
প্রিন্সিপাল ম্যামের কাছে ছুটে যেতে হয় লেখক মহাশয়কে তা যেকোনও বাবা-মায়ের কাছেই উদ্বেগজনক। সেখানে গিয়েও পরপর যে ঘটনাগুলো ঘটে চলে তাতে সত্যিই মনে হয়, বিজ্ঞান বোধহয় সবকিছুর ব্যাখ্যা দিতে পারে না
আজও। তবে গল্প শেষ হওয়ার পরও বড্ড মনখারাপ করে। ডরোথির মতো আমারও তো কোনও বন্ধু ছিল না!
৪। কাঁকরডাঙার নীলকুঠি
ভূতেরা যে মোটেই ভয়ংকর হয় না সবসময়, তা শিখিয়েছিলেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় মহাশয়। এই গল্পটা পড়ার পর সেই অনুভূতিই আবার ঘিরে ধরবে। তিনটে ছোট্ট ছেলের সাথে আম কুড়োনোর বিকেলে হঠাৎ নীলকুঠির হাতছানি! বাকিটা নাহয় পাঠকের জন্য তোলা থাক। আবার একটা অনেক বড়ো সাবলীল ভঙ্গিতে লেখক মহাশয় বলে দিলেন। নিজেদের ভাষা বাংলাকে আমরা বড়ো অবজ্ঞা করি, অকারণে ইংলিশ বলে নিজেকে জাহির করার চেষ্টা করি। অথচ এক ইংরেজ সাহেব কী সুন্দর বললেন, “আমি এতদূর হইতে এই দেশে আসিয়া পড়িয়া রহিয়াছি
কীসের টানে জানো? শুধু এই মিষ্টি ভাষাটির জন্য।” গর্বে, আনন্দে মন ভরবেই
গল্পটা পড়ার পর।
৫। সময়ের চোখ
প্রতিটা গল্পই অত্যন্ত ভালো হলেও আমার মতে এটাই সেরা গল্প বইয়ের। নিখুঁত কল্পবিজ্ঞানের গল্প যার সাথে লোভ, শয়তানি, মৃত্যু,
বন্ধুত্ব, বিশ্বাস মিলেমিশে এক হয়ে গিয়েছে। পাঠককে অন্তত দু’বার পড়তে হবেই, কারণ চোখের সামনে ঘটনাগুলো এত দ্রুত ঘটতে
থাকবে যে ঠিক ভুল আর বিশ্বাসের জায়গাটা আবার অনুভব করতে ফিরতে হবেই। শেষ লাইন পর্যন্ত টানটান উত্তেজনা ধরে রাখতে বাধ্য করবে। অনেক অনেক ধন্যবাদ লেখক মহাশয়কে এত সুন্দর এক গল্প পরিবেশনের জন্য।
৬। প্রতাপগড়ের রোশনিবাঈ
ভূত আছে কি নেই
- তর্ক তো বহুদিনের। আর দুইপক্ষের তর্কে বাজি ধরা হবেই এবং
অবিশ্বাসীকে বিশ্বাস করানোর জন্য ষড়যন্ত্র!
কিন্তু তারপর? ইতিহাস যদি সামনে এসে দাঁড়ায়!
ইতিহাসের একটুকরো ঘটনার সাথে খুব সুন্দরভাবে বাঁধা হয়েছে এ-গল্প। তবে পড়ার পর কিন্তু ভয়ের চেয়ে কষ্টই বেশি
হবে।
৭। গুল্টেদার বাঘ শিকার
ইন্টারনেটের সৌজন্যে গল্প বলিয়ে দাদাদের তো আর খুঁজেই পাওয়া যায়
না। তাই প্রথমেই লেখক মহাশয়কে ধন্যবাদ জানাব সান্ধ্য আসরে গুল্টেদাকে
হাজির করানোর জন্য। গুল্টেদার শিকারের গল্প
- তাও যে সে শিকার নয়, রাজাসায়েবের রাজ্যের জঙ্গলে
মানুষখেকো বাঘ শিকার। কিন্তু এই শিকারের পর থেকে গুল্টেদার
শিকারের ইচ্ছেটাই চলে যায়। কেন?
চমক তো গল্পে। জমিদারবাড়ির ইতিহাস যে ফিরে ফিরে আসে। অভিশাপ আর ভদ্র,
শান্ত স্বভাবের আড়ালে লুকনো ষড়যন্ত্রের জাল। যাহ, অনেকটা বলে ফেললাম। দারুণ,
দারুণ এক গল্প যা শুধু শিকার কাহিনিতে আটকে থাকেনি। লেখকের কাছে অনুরোধ,
যে গুল্টেদাকে হাজির করেছেন সেই গুল্টেদা যেন না হারিয়ে যায়। বাঙালির আড্ডায় এইরকম দাদাকে ফিরিয়ে আনতে হবে।
৮। নিউমেরোলজি
আবার এক দুর্ধর্ষ রহস্য গল্প,
তবে তার চেয়েও বেশি সামাজিক গল্প। সংখ্যাতত্ত্বের
জটিল কচকচানিকে বেশ সহজ ভাষায় বুঝিয়েছেন লেখক মহাশয়। আমার বাবা
একটা কথা বলে, “যখনই তুই
কোনও জ্যোতিষীর কাছে যাবি তিনি একটা কথা বলবেনই - এখন আপনার একটু
খারাপ সময় চলছে, বিপদ পিছু ছাড়ছে না, ঘুমোতে
পারছেন না! আসলে ওরাও জানে, ভালো সময়ে কেউ
ওদের কাছে যায় না।” কথাগুলো কেন বললাম তা গল্পটা পড়লেই বুঝতে পারবেন। নিজেদের দুর্বলতাগুলো আর হঠাৎ ঘটা কিছু খারাপ ঘটনাকে হাতিয়ার করে
অদ্ভূতভাবে লোকজন আমাদের ঠকিয়ে চলে যায়। আর আমরা অসহায়ের মতো কুসংস্কারের জালে
জড়িয়ে পড়ি আবার। ভীষণ, ভীষণ দরকারি এক গল্প।
৯। তুফানি রাতের ভূত
ভূতের গল্প অথচ ভূত থাকবে না!
যাকেই ভূত ভাবছি সবাই বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা দিয়ে চলেছে। ভয় পেতে পেতেও যখন পাচ্ছিলাম না, ঠিক তখনই তুরুপের তাসের মতো আসল ভয়টা খাওয়ালেন
লেখক। হসপিটালের এক নার্সের বিদায়ের আড্ডায় একের পর এক ঘটনা উঠতে শুরু
করে সঙ্গে ব্যাখ্যাও। কিন্তু ডঃ বোসের শেষ কথায়... নাহ, আর তো বলা যাবে না। ভয়টা পেতে একটু একটু করে ঢুকতে হবে গল্পে।
১০। গয়নার গণ্ডগোল
শুরুতেই বাউণ্ডারি। রহস্য গল্প, অথচ প্রতিটা গল্পে লেখক খুব সহজভাবে কঠিন শিক্ষাগুলো
দিয়ে গিয়েছেন। যাদের দেখে, হাঁটাচলায়, ব্যক্তিত্বে
মুগ্ধ হয়ে আমরা একটু দেখা করার জন্য পাগল হয়ে উঠি তাদের কদর্য রূপটা যদি হঠাৎ বেরিয়ে
পড়ে! এক শ্যুটিংয়ে গয়না বদলে যাওয়া থেকে কাহিনির সূত্রপাত। টোটোদা আর বাঘু,
বুল্টির সঙ্গে রহস্যে জড়িয়ে পড়তে মন্দ লাগবে না। কারণ ধীরে ধীরে এমন কিছু ঘটনা সামনে আসতে শুরু করবে...! তবে এক্ষেত্রে কিন্তু অপরাধীকে আমি আগেই চিনে
ফেলেছিলাম।
প্রতিটা গল্পই অসাধারণ। তবে আমার একটা আর্জি আছে। প্রচ্ছদের
মতো ভয়াল-ভয়ংকর একটা গল্প পেলাম
না। আশা করি পরের বার লেখক মহাশয় এই অনুরোধ রাখবেন।
তবে আর দেরি কেন? শীতের সন্ধ্যায় লেপ মুড়ি দিয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে
কাঁপতে কিংবা আমার মতো পড়ার বইয়ের তলায় গল্পের বইয়ের স্বাদ নিতে, নতুন বইয়ের ঘ্রাণ নিতে চটপট হাতে তুলে নিন ‘বিপদ যখন
ওত পেতে’। কারণ, বিপদ কখন কীভাবে কোনদিক থেকে আসবে তা কিন্তু কেউ জানে না!
_____
থ্যাঙ্কিউ সৈকতা| খুব ভালো লিখেছিস|
ReplyDelete