মেঘরৌদ্রের খেলা
লেখকঃ দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য
আলোচকঃ রুমেলা দাস
বইয়ের নামঃ মেঘরৌদ্রের খেলা
(দুটি উপন্যাসের সংকলন)
প্রকাশকঃ বর্ণদূত
বাঁধাইঃ পেপার ব্যাক
পৃষ্ঠাসংখ্যাঃ ২০১
মূল্যঃ ১৮০ (ভারতীয় মুদ্রা)
প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণঃ শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য
মন ভালো করা গল্প হয়তো একেই বলে। কীভাবে একের পর এক সেজে
ওঠেছে গ্রাম, গ্রামের বসতি, মানুষজন, তাঁদের সরল জীবন কিংবা কখনও ছাপোষা অবাধ আক্রোশ,
মনের লুকানো পর্দায় কিছু গুপ্তকথা, আবার স্বাভাবিক
ঋতুচক্রে বাঁধা পড়া কিছু অযাচিত সত্য ঘটনাক্রমে ফুটে উঠেছে কলমচি দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য্যর
‘মেঘরৌদ্রের
খেলা’ ও ‘পঞ্চা তাঁতির কড়চা’ উপন্যাসের পাতায় পাতায়।
‘মেঘরৌদ্রের খেলা’ কাহিনির আবহে লেখকের কৈফিয়ত
অক্ষরে অক্ষরে সত্যি - “...উপন্যাসটা তো চোখ বুজে ছোটোবেলার
দিনগুলোকে মনে করা, আর সেই গ্রামটার কথা মনে করা, যেখানে আজও আমার নোঙরটা
বাঁধা।”
গল্প-ভিতের উঠানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে আমাদের শিশুকালের এক্কা-দোক্কা, জলছবি, সরল আবডালের অগুনতি
আবদার।
অপরদিকে শ্রীমতি জর্জ এলিয়েটের কালজয়ী উপন্যাস ‘সাইলাস মার্নার’কে অবলম্বন করে লেখা ‘পঞ্চা তাঁতির কড়চা’। পঞ্চা তাঁতির জীবনের মোড়ক বাইরে থেকে আর পাঁচটা গ্রামীণ দীনদরিদ্রের
মতো হলেও সময়ের সাথে সাথে মোড় নিয়েছে মুহূর্তরা। সাধারণের থেকে ভিন্ন। আর তাতেই গড়ে উঠেছে গোটা একটা কড়চা, কাহিনি, দিনলিপির সারস্বত। কখনও হারিয়েছে নিজস্ব পরিধি, কখনও অপরিচিত পরিধিই হয়েছে নিজ।
খুব অনায়াসেই গড়েছেন দুই উপন্যাসের কাঠামো। নেই তত্ত্বজ্ঞানের ভার। নেই বোঝা খানেক নীতিকথার ভিড়। মিথ আছে। আছে ভালোবাসা। সেই ভালোবাসায়
কখনও এসে মিশেছে আদিম রিপু, কখনও
বা ভিড় করেছে কর্তব্যটুকু। গল্পকথার সার না হয়ে আজ এ-শতকে দাঁড়িয়েও
অবাধে মেনে নিতে পারি সেসব। ভাবতে কষ্ট হয় না। ক্লেশ হয় না। বলতে তো ইচ্ছে হয় আরও
গুচ্ছকথা। ইচ্ছে হয় বলতে,
কেমন করে গোটা একটা দিনে লাইনের পর লাইনে বুঁদ হয়ে থেকেছি। সবটা হয়তো বলা উচিত নয়। পাঠকের আগ্রহ কমে তাতে।
দেড় শতকের ব্যবধানে গড়ে তোলা দুই সামাজিক সহজাত রূপ, গ্রাম-মানুষের রূপকথা, রূপ ও কথার আড়ালে রাগ-ক্রোধ-হিংসা
যেন ছবির মতো ভেসে উঠছিল। এ যেন আমার পড়া কিশোরবেলার কথাকাহিনি। অথচ প্রতি সহজের মাঝে নিগূঢ়,
ভারী অব্যক্ত। টুকি আর সৌম্যর খুনসুটি, বাল্যকালের নাছোড় দস্যিপনা লতানে গাছের মতোই বেড়ে
চলেছে অবাধে। আবার মাদরালের পার্কের ধার দিয়ে কালোদীঘি
পেরিয়ে হর্তুকিতলা হয়ে বড়ো রাস্তায় চলতে চলতে সৌম্য বোঝে প্রথম স্বাধীনতার
স্বাদ। পিচ বাঁধানো পথটা যেন উল্টোমুখে বয়ে যাওয়া খরস্রোতা নদী। চোখের সামনে দেখি সাদাকালোর সতেজ কিশোরকাল। কিছু অবাধ অমান্য গোপনকথা। ঝাঁক ঝাঁক
নিষেধের বেড়াতেও যা মলিন হয় না। খুলে রাখা খাতার লাইন ছাড়িয়ে সেই স্বাদই খুঁজে পেতাম কখনও আমিও।
পরক্ষণেই যুগ-ব্যবধানে পঞ্চাতাঁতির ক্রোড়েও হেসে খেলে বেড়ে ওঠে সুরেশ্বরীর দস্যি-দামালে শিশুমন। কচি গলার ‘বাবা’ ডাক হয়ে ওঠে অমূল্য অগাধ
সম্পদ। প্রতিদিন প্রতিক্ষণে সে সোহাগ হারিয়ে দেয় সোনারূপার হিসাব। একেকদিন হয় রামধনুসম। এ অমৃত অসীম। নাম পরিচয়, স্বজ্ঞাতি-স্বজাতিবিহীন সাদা
পাতায় ভরে যায় একটু একটু রং। চোখে জল এনে দেয় এমন কিছু ছবি যা না লেখাটা
ঘোরতর অন্যায়। ক্ষেতে ভরা আউশের ধান। কাপড়ের বোঝা কাঁধে ন্যুব্জ এক মানুষের
সামনে দিয়ে ঘাস ফড়িংয়ের মতো উড়তে উড়তে হাঁটে সুরি। তার ছোট্ট কাপড়ের নীল রঙের আঁচলা উড়তে থাকে। অভাবনীয় কল্পনা। পাঠক আর কেবল পাঠক নয়, নিমেষে কলমচির সুতোর টানে চলে যায় এমন একটি দিনে,
যেখানে আপাদমস্তক নিটোল ভালোবাসার সুর। সুরের জোয়ার। ঠিকই তো, চারকোনা হলদেটে আঁকার খাতায় এমন ছবিই হয়তো আজও
আছে আমাদের সকলেরই। কাদামাটির মতো নরম তুলতুলে সে সুখে আঘাত হানে কঠিন
প্রপাত, তবুও সেসব ছোঁয়াচ খানিক
স্থায়ী হয়ে মাথা তুলে দাঁড়ায় রক্তহীন বাঁধনের আঁতাত, আঁতুরঘর। কোথাও যেন বারে বারে মিল খুঁজে পাই। পাতা উল্টে
উল্টে মিলিয়ে নিতে চেষ্টা করিও। এ-মিল দু’মলাটের ভিন্নগামী দুই লেখার মিল। মিল প্রায়
সোয়া শতক ব্যবধানের দু-পিঠের গ্রামজীবনের কথকথার। একই মুদ্রার এ-পিঠ আর ও-পিঠ যেন!
এক ছবি ঔপনিবেশিক শাসন না মানা, অন্যটি সেই শাসনেরই
যাপনচিত্র। এক শেকড় গ্রথিত হয়ে অঙ্কুরিত হয়েছে অন্য পাটে। এমন মিল তো আমাদের চারপাশে অহরহ হয়েই চলেছে। নিভৃতে। সংযোগ করা সম্ভব লেখকের পক্ষেই। আঁচলা ভরে শিউলির গন্ধ,
আবার কখনও স্থলপদ্মের বাগান বানানোর শখটা ছেলেমানুষি
হলেও ভাবতে, দেখতে ইচ্ছে
করে বারংবার। লিখে ওঠার সামর্থ্য আমার তেমন নেই। তবুও দিনের শেষে মনটা বড়ো
ভালো হয়ে যায় যে! চোখ বোলাতে
ইচ্ছে হয় এক নয়, একাধিকবার উপন্যাসের পাতায় পাতায়! কথায় কথায়!
প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ শিল্পী শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য বড়ো সুন্দর কাজ করেছেন। নিখুঁত, সূক্ষ্ম নয় - মোটা দাগে
লেগে থাকে এমন কিছু গ্রাম্যতা যার সত্যকে, সারসত্যকে আমরা অস্বীকার
করতে পারি না। গল্পদুটির সাথে একেবারে মানানসই।
আবারও ধন্যবাদ জানাই
বর্ণদূত প্রকাশনকে। নতুন করে কীই বা বলি। এটুকুই আবদার, এমন আরও অনেক আকর আমাদের
সামনে তুলে ধরুন আপনারা। খুব কম প্রকাশকই এমন যত্ন করে তুলে ধরেন
লেখকের সারাজীবনের সঞ্চয়। শুভেচ্ছা, শুভকামনা রইল অফুরান।
_____
No comments:
Post a Comment