জলপরি
রুমেলা দাস
মাথা নিচু করা
চার-পাঁচটা আলোর স্ট্যান্ড। মিইয়ে যাওয়া মেজাজ পুল চত্বরে। সন্ধে হয়ে এসেছে। আকাশটা ঘোলাটে। বৃষ্টিটা তেমন জোরে নয়। ইতস্তত বিক্ষিপ্ত কয়েক ফোঁটা সজোরে। আবার কিছু
সময় অন্তর হালকাভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। স্বচ্ছ টলটলে জল সামান্য নড়ছে। মৌর্যর মন ভালো নেই। মাম্মাম কিছুতেই রাজি হচ্ছে না। পাপা সারাদিন নিজের নতুন অফিস নিয়েই ব্যস্ত। ঘর গোছানো,
নতুন জিনিস কেনা। কেউ,
কেউ ওর কথা শুনছে না। অথচ প্রথম যেদিন ওরা এই বাড়িটায় আসে, কী ভালোই না লেগেছিল ওর। আর তাছাড়া মাম্মাম কলকাতায় থাকতে বলেইছিল, সিক্সে ওঠার পর ঠিক ভর্তি করাবেই। এটা দেখামাত্রই
মনে হয়েছিল, হাতে চাঁদ পেয়েছে।
আজ সারাদিন বৃষ্টি। এখানে নাকি এমনটাই হয়। মৌর্য ম্যাপে দেখেছে, ভারতের ওপরে উত্তরের দিকে তো জায়গাটা। গরমকালে একটু গরম পড়লেই তাপ বাষ্পীভূত হয়ে মেঘ জমাট বাঁধে। বারবার বৃষ্টি হয়। তবে মেঘ, জলোভাব, ধারালো হাওয়ার মধ্যে একটা মনখারাপও আটকে থাকে আঠার মতো। এই দিনগুলোতে মন বসে না কিছুতে। বাড়ি থাকলে কার্টুন দ্যাখে। সেটুকুও উপায়
নেই। টিভির কানেকশন করা হয়নি এখনও। মোবাইল?
বাবা নিয়ে থাকে সারাক্ষণ। গেম খেলাও যায় না। বন্ধুবান্ধবও হয়নি। সবে তো একমাস হল এসেছে। স্কুল খোঁজা শুরু হয়েছে। তাই আর!
বৃষ্টিটা অনেকটা বাথরুমের হ্যান্ড
শাওয়ারের মতো। কমা-বাড়ার সুইচ লাগিয়ে রেখেছে যেন কেউ। কম হলে জানালাটা যে খুলবে তার উপায় নেই। প্রতিদিন দ্যাখে মৌর্য। একটু একটু করে চেনে। পরিচয় হয় পুল ঘিরে থাকা চারটে গাঢ় সবুজ, আরও কয়েকটা ঝাঁকড়া মাথা গাছ, আর ঐ বেঁটে মোটা গুঁড়িওয়ালা গাছগুলোর সাথে। চেঞ্জিং রুমের দরজাটা এখন বন্ধ। সবাই হয়তো
বিকেলে এসেছিল। ফিরে গেছে। যা বৃষ্টি! বাড়ছে আরও। জানালার কাচের ভেজা
ভাবটাও। বৃষ্টিমাখা হাওয়াটা ওদের জানালার কাঠের ফ্রেমটাকে
হালকা ধাক্কা দিচ্ছে। মৌর্যর একটু শীত শীত করছে। ও একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জলের দিকে। ফোঁটাগুলো
নিচে
নামতে নামতেই মিশে যাচ্ছে পুলে। ফাঁকা জায়গাটার মধ্যে সোঁ সোঁ শব্দ হচ্ছে
হাওয়ার। আর ঠিক তখনই ঝপাং করে ভারী একটা কিছু যেন পড়ল পুলের ঠিক মাঝখানে। মৌর্য চোখদুটো টানটান করে মুখটাকে আরও খানিকটা এগিয়ে
নিয়ে গেল। কী হল! কী পড়ল ওখানে! দেখা যাচ্ছে! নাহ্,
কিচ্ছু বুঝতে পারছে না। দু’হাতে কাচটাকে মুছে আরও খানিকটা দেখবার চেষ্টা করতেই
বুঝল, কেউ একজন পুলের ডানপাশ দিয়ে আস্তে আস্তে সাঁতার কাটছে। কে!
এবার খানিকটা দেখতে পাচ্ছে। মুখ,
মাথা, চুল, গা সবটা। তাকিয়ে আছে। দেখছে। আরে, একে তো মৌর্য
দেখেছে আগে! খুব চেনা। মনে ঠিক…
“মৌর্য, কী করছিস ওখানে দাঁড়িয়ে!”
*****
“দাঁড়িয়েই থাকে সারাদিন! কী যে করি ছেলেটাকে নিয়ে! জানালার কাছ
থেকে নড়ানোই যায় না!”
“কেন, কী হয়েছে?”
“কী আর বলব তোমাকে? মোটে একমাস হয়েছে। এত্ত বায়না শুরু করেছে!”
“আহা তনিমা,
মাথা গরম করো না। কী বায়না করছে তা তো বলবে!”
“কী আর! সুইমিং শিখবে।”
“বোঝাও। আগে একটা ভালো স্কুলে ভর্তি হতে হবে, তারপর ওসব সুইমিং-টুইমিং হবে’খন।”
“কে শোনে কার কথা। ছেলেকে তো ভালো করেই তুমি চেনো, দীপ্ত। মনে নেই? প্রথম স্কুলে
ভর্তি করার পর ম্যাডামদের মানিয়ে নিতে ওর কতদিন সময় লেগেছিল!”
“মনে আছে। এক কাজ করো, যতদিন না
স্কুলে যায় টুকটাক সামনেটা নিয়ে ঘুরে বেড়াও। এত প্লিজেন্ট ওয়েদার আর কোথায় পাবে তুমি!”
“তাইই তো ভেবেছিলাম। কিন্তু যা বৃষ্টি চলছে ক’দিন ধরে!”
“এখানে শীতকালেও শুনেছি বৃষ্টি হয়, ডিসেম্বরেও।”
“শীতেও?
সেসব আমি ঠিক ম্যানেজ করে নেব, শুধু ছেলেটার পড়াশুনাটা আবার শুরু হলে বাঁচি। আর…”
“তনি! আবার ওসব নিয়ে ভাবতে বসলে! কে কী বলেছে, সেই নিয়ে!”
“তুমি আর কী বুঝবে!”
“আহা, আমি কি বারণ করেছি? মৌর্য তো
এখন বড়ো হয়েছে। ওর ইচ্ছেটাকে ক’দিন চেপে রাখবে তুমি?”
“আমি কী করব তুমিই বলে দাও!”
“চিন্তা করো না। ঠিক হয়ে যাবে সব। ক’টা বাজে বলো তো! রাত তো অনেক হল!”
“বারোটা বেজে পনেরো।”
“মৌর্য ঘুমিয়েছে?”
“একটা স্টোরি বুক দিয়ে এসেছি। সারাদিন ঘ্যান
ঘ্যান করেছে। এতক্ষণে মনে হয় ঘুমিয়েছে।”
“তুমিও শুয়ে পড়ো।”
মৌর্যর বাবা পাশ
ফিরে বেড লাইটের সুইচটা নেভাল। ঝুপ করে একটা অন্ধকার ঢুকে পড়ল ঘরটায়। বাইরের ঝিঁঝিঁ যেন নিজেদের শব্দ বাড়াল কয়েক ডেসিবেল। আশঙ্কার মেঘ অচিরেই আঁকড়ে ধরল তনিমা চৌধুরীর মন। দীপ্ত বিশ্বাস করে না এসব। তবুও তনিমা
কিছুতেই মুছে ফেলতে পারে না। সুবীরকাকুর কথাগুলো। পাঁচ বছর বয়সেই মৌর্যর হাত দেখে বলেছিলেন, জলে ওর মৃত্যুযোগ আছে। অদ্ভুতভাবে ছেলেটার বড়ো হবার সাথে সাথে জলের প্রতিই কী প্রবল টান! আজ নয় কাল
করে করে এতদিন ঠেকিয়ে রেখেছিল। বিপদটা বাড়ে দেরাদুনে আসার পর থেকে। এই বাড়িটার পাশেই Vardha Academy, সাঁতার
শেখানো হয়। মৌর্যকে কী করে আটকে রাখবে ও! দুশ্চিন্তায় ঘুম আসে না। চোখ চলে যায়
জানালার ওপারে। দূরের পাহাড়গুলো বোবার মতো
দাঁড়িয়ে। শহর,
শহুরে বসতি থেকে অনেকটা ভেতরে
এই তেরাগাঁও জায়গাটা। জনবসতিও কম। স্থানীয় লোকের
রাত হয় অনেক তাড়াতাড়ি। দোকানপাটও বন্ধ হয়ে যায়। মেন রোড থেকে দূরে হওয়ায় এ-পথে যানবাহনের
চাকার শব্দ পাওয়া যায় না বললেই চলে। দিনের সেই রঙিন সবুজ শহর রাত নামার সাথে
সাথে অন্য চেহারা নেয়। কালো মাথার গাছগুলো মাথা দুলিয়ে কী
এক অশনি সংকেত দিতে চায়। বুকটা কেঁপে ওঠে ওর। ভাইবোনের মধ্যে রীতিমতো ডাকাবুকো বলেই সক্কলে চেনে। তবে?
তবে কীসের ভয়! ঝিরঝিরে,
খসখসে গাছগাছালির শব্দগুলো রাত বাড়ার
সাথে সাথে প্রকট হচ্ছে। বুকের ভেতর ফাঁকা ফাঁকা
লাগছে। মৌর্য কি ঘুমিয়ে পড়েছে? একবার দেখে
এলে হয় না? সারাদিন ধরে ছেলেটাকে তো কম বকাঝকা করা
হয় না। নতুন পরিবেশ,
নতুন মানুষজন সবকিছু সামলে নিজেও ডিস্টার্বড
হয়ে আছে ক’দিন। খাট থেকে নেমে চটিতে পা গলিয়ে এগিয়ে যায়
পাশের ঘরের দিকে। হঠাৎই তীক্ষ্ণ,
চেরা একটানা একটা ডাক! কী দেখে ভয়ে
ডেকে চলেছে জন্তুটা! বাড়িওয়ালার ল্যাব্রাডর কুকুরটাও ডেকে উঠল একই সাথে সুর মিলিয়ে। যেন ওদের
তল্লাটে আচমকা কেউ ঢুকে পড়েছে। আশেপাশের বাড়ির আরও
কতকগুলো কুকুরও ডাকছে। কী ওটা!
কী ডাকছে! করুণ একটানা শব্দ, কী ভয়ংকর! শেয়াল!
কিন্তু তেমন ডাক তো ছোটোবেলায় শুনেছে। এমন তো নয়! কোথায় এসে
পড়ল ওরা? ভীতু ভাবটা কিছুতেই কাটিয়ে উঠতে পারছে
না। দীপ্তকে কি ডাকবে!
নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে মৌর্যর বুকের
উপর থেকে বইটা সোজা করে টেবিলে রাখল তনিমা। ডাকটা হয়েই চলেছে। বারে বারে। থেমে থেমে। ভয় আর কৌতূহল
কোনওটাই চেপে রাখতে না পেরে জানালা দিয়ে মুখ বাড়াল ও। চোখ জুড়ে শুধু কালো। একটুকরো আলো কোথাও নেই। অদ্ভুত ডাকটা দু’হাত চিরে তুলে আনছে অশরীরী শঙ্কা। আর সহ্য করতে পারছে না। শব্দটা ঘরের ভেতরেও ঢুকে আসছে। বাতাসের বিপরীতে পাল্লাদুটো টেনে বন্ধ করতে গিয়েই চমকে উঠল ও। বুকের ভেতর হাজার হাতুড়ি পেটা শুরু হল একের পর
এক।
*****
“এক গিধড় আতে হ্যায় কভি
কভি। ডারনেকা কোই বাত নহি। আপ লোগ তো উপরওয়ালে কামরে মে রহতে হ্যায়।”
“কিন্তু যদি গাছ বেয়ে ছাদ মে…”
“নহি নহি, ওয়হ তো
কভি নহি হুয়া। পর ওয়হ যব আতে
হ্যায় কুছ না কুছ অশুভ... পিছলে বার তো…” ভদ্রমহিলা যেন কিছু বলতে গিয়েও
থমকে গেলেন।
“অশুভ!” আঁতকে উঠল তনিমা।
মৌর্যর বিরক্ত
লাগছে এবার। মাম্মাম খালি কীসব ভেবে ভেবে ভয় পায়। একটা জন্তু
ওদের কী করবে?
ওরা তো দোতলার ঘরে দরজা বন্ধ রাখে। ধুস!
এসব ভাবার ওর সময় নেই। দিব্যি ছিল স্কুলটা। ভর্তি হয়ে এল। সামনের সোমবার
থেকে ক্লাস। কত্ত বড়ো ক্লাসরুম! কলকাতার মতো ঘেঁষাঘেঁষি নয় রুমগুলো। আর তারপরই উইক-এন্ডে সুইমিংয়েও পাপা নিয়ে যাবে বলেছে। বাড়ির পাশে এমন একটা সুইমিং পুল থাকতে
আর চিন্তা কী! যখন ইচ্ছে,
যেমন ইচ্ছে জলে ঝাঁপাবে মৌর্য। কতদিনের ইচ্ছে। কলকাতা ছেড়ে যখন এখানে আসছিল তখন পুরনো
বন্ধুদের জন্য মনখারাপ করছিল ঠিকই। কিন্তু জল দেখলেই ওর মনটা ভালো হয়ে যায়
আপসেই। কিছুক্ষণ দাঁড়ায় জানালার সামনে। সাঁতার শিখতে
আসা ওরই বয়সী কয়েকজন আসে। নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব করে। হাসে। খুব কম তবে। হাতে গোনা
চার কি পাঁচজন। কলকাতায় থাকতে দেখেছে কত ভিড় হত এই সমস্ত জায়গায়! ওদের কি জল ভালো লাগে না? কে জানে!
“ও মা চলো না, কী হল?
খিদে পেয়েছে!”
“যাচ্ছি। দেখতে পাচ্ছিস না, কথা বলছি? তুই তালা খোল। আমি আসছি। এই নে চাবি।”
“দাও।”
মৌর্য চাবি হাতে
নিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে তরতর করে উঠে গেল সিঁড়ি বেয়ে। জুতো খুলে
ঘরে ঢুকে বিছানায় এলিয়ে দিল শরীরটা। ক্লান্ত লাগছে খুব। এখানকার রাস্তাগুলো সাংঘাতিক উঁচু-নিচু-খাড়াই। দম বেরিয়ে যায় হাঁটতে গেলে। পার্কও নেই
আশেপাশে। সবার বাড়ির সামনেই এত্ত জায়গা তাই হয়তো এরা কেউ পার্ক বানায়নি। সোঁদা সোঁদা ভেজা গন্ধ নাকে আসছে। আবার কি বৃষ্টি
নামবে! আরাম লাগছে খুব। আরও জোরে শ্বাস টেনে গন্ধটাকে নিজের ভেতরে নিয়ে নেয় মৌর্য। অনেকটা হেঁটে চারকোনা দুটো পুল পাশাপাশি। নীল ডিজাইনের পাথরগুলো চকচক করছে। উফ্, খুব খুব ইচ্ছে করছে। ও তো ভালোমতোই শিখে গেছে। পাশ থেকে কে যেন বলে উঠল, ‘টেক ইয়োর মার্ক!’ তৈরি হয়ে
দু’হাত উপরের দিকে তুলে ঝাঁপাতে গিয়ে আচমকাই ঘটল ঘটনাটা। বেসামাল হয়ে মৌর্য পড়ে গেল একেবারে নিচে। কানের মধ্যে
দিয়ে হু হু করে ঠান্ডা জল ঢুকতে শুরু করল। নাক, গলা বুজে
এল। চিৎকার করতে চাইছে,
কিন্তু পারছে কই! আচমকা দেখল সেই চেনা মুখটা। হাসি হাসি
একটা মুখ, ওরই আশেপাশে। কী যেন বলবে।
কষ্ট হচ্ছে মৌর্যর। প্রবল হ্যাঁচকা টান। চোখ মেলে তাকাল মৌর্য।
*****
মৌর্য নেই।
ছাদে, ঘরে,
বাথরুমে সব জায়গায় খুঁজেছে তন্নতন্ন করে। কোত্থাও নেই!
রাতের দিকে হটাৎ ঘুমটা ভেঙে
গেছিল। অভ্যাসবশত মৌর্যকে দেখতে গিয়েই শিউরে ওঠে। ঘর ফাঁকা। ছেলে নেই। মনের মধ্যে
কু ডাকছিল তনিমার এখানে আসার পর থেকেই। রোজ কিছু না কিছু ঘটনা। পাগল করে দিচ্ছে। আতঙ্কের ভিতটা লকলকিয়ে তেড়ে
আসছে। মাথার দু’পাশের ধমনী দপদপ করছে। আগাছা, শ্বাপদ, কালো ওত পেতে আছে ওদের দিকে। কোথায় যাবে,
কী করে
খুঁজে পাবে মৌর্যকে? প্রতিটা শ্বাস, প্রতিটা সেকেন্ড অসহনীয়। উন্মাদের
মতো দিকভ্রান্ত হয়ে এদিক ওদিক দেখে চলেছে
দু’জনে। হলুদ ভেপারের ঝাপসা আলোয় খুঁজে চলেছে
রাস্তাগুলো। অলিগলি। দীপ্তর সাথে আরও কয়েকজন স্থানীয়। ওদেরই ল্যান্ডলর্ড। কোথায়, কেন, কীভাবে যেতে পারে
মৌর্য জানা নেই ওদের। তনিমার সমস্ত শরীর অযাচিত অব্যক্ত যন্ত্রণায়
কুঁকড়ে উঠছে। আশঙ্কার মেঘ দানা বাঁধছে জোরালোভাবে। তবে কি সুবীরকাকুর
কথাই সত্যি হতে চলেছে! হা ঈশ্বর! কাঁপা কাঁপা
হাতে তনিমা শক্ত করে ধরে দীপ্তর হাতটা। এক পা, এক পা করে
এগিয়ে যায় Vardha
Academy-র দিকে। শোনা কথাগুলো দুমড়ে মুচড়ে জুড়তে শুরু করে একেকটা
ইঙ্গিত। মাকড়সার জালে পা আটকে গেছে ওদের। বেরোবার পথ
নেই আর। মৌর্যকে খুঁজে পেতেই হবে। যেভাবেই হোক। যে করেই হোক।
মিশমিশে কালো অন্ধকার
গিলে খাচ্ছে গোটা এলাকা। কড়া চোখে তাকিয়ে অশরীরী অস্তিত্ব। কানের গা ঘেঁষে চলে যাচ্ছে ছুরির মতো সূচালো হাওয়া। হাড় হিম হয়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে রোমকূপ। ভিজে উঠছে হাত-পায়ের তলা ক্রমশ। তনিমার জেদ চেপে যায়। সামনে লোহার গেট। বন্ধ। উঁচুনিচু আগাছায় ঘেরা চৌহদ্দি। ডালপালা ঝোপঝাড় সরিয়ে একফালি সরু জায়গা দিয়ে ঢুকে পড়ে ওরা। ধূ ধূ চত্বর। কোত্থাও কিচ্ছু
নেই। ‘মৌর্য, মৌর্য’
নাম ধরে ডাকতে থাকে। কিন্তু কোথায় মৌর্য?
কোথায়? নাহ্। কান খাড়া করে আছে ওরা। চোরা স্রোতে ভয় জমাট
বাঁধছে। তীক্ষ্ণ,
চেরা আওয়াজটা আবারও আরও
একবার শুনল তনিমা। শুনল ওরা সবাই। পুলের শেষের মোটা গুঁড়ির দিক থেকে। আরও এগিয়ে। আরও আরও
এগিয়ে আসছে।
“ভাবিজী, মত যাইয়ে!”
কোনও কথা শোনার মতো অবস্থায় নেই আর ও। হাত চারেক দূরত্ব। লাল হাফ প্যান্টের খানিকটা…
“মৌর্যওওও…!”
হেঁটে, দৌড়ে, চিৎকার করে
আছড়ে পড়ল ছোট্ট শরীরটার উপর! মৌর্য...
*****
“মৌর্য, কেমন লাগছে এখন?”
“ভালো,
মাম্মাম।”
“কোথায় কষ্ট হচ্ছে তোমার?”
“মাথার পেছনের দিকটা একটু
ভারী। আমার কী হয়েছে?”
“কিচ্ছু হয়নি, মৌর্য!”
“প্লিজ মাম্মাম, বলো না!
তোমরা সবাই আমার দিকে এমন করে তাকিয়ে আছ কেন?”
“তার আগে তুমি বলো, কাল রাতে তুমি কেন ঘর থেকে বেরিয়েছিলে আমাদের না ডেকে? এমন তো কখনও করো না তুমি। তুমি জানো না, আমরা নতুন এসেছি এখানে!”
“মাম্মাম!”
“আহ্, তনি!”
“কী করব বলো, দীপ্ত?
ওকে এই অবস্থায় দেখে কি আর মাথার ঠিক থাকে, তুমি বলো? আমাদের সন্তান
এভাবে…”
“আমি তো নিজে থেকে যাইনি, মাম্মাম। ও যে আমাকে…”
“কে?” চিৎকার করে ওঠে
দীপ্ত আর তনিমা।
“ঐ তো ওই মেয়েটা ওখানে রোজ সুইমিং করতে আসে। হাসে আমাকে দেখে।”
“কোন মেয়েটা, মৌর্য?
তার জন্য তুমি এত রাতে বেরোবে?”
“পাপা,
ও আমাকে একটা জিনিস দেখাবে বলেছিল! আমি জানি না সেটা। কেউ জানে না!”
“কী জানো না?”
“ওই যেভাবে পিছলে গিয়ে ও পড়ে গেল। আর স্যারটাও
ফোনে কথা বলছিল। খুব খারাপ স্যারটা। ও খুব কাঁদছিল। আমাকে বারণ
করছিল। কিন্তু তারপরে আমার না আর কিচ্ছু মনে নেই। কালো দেখছিলাম চারপাশ। কী যে হল আমার!”
“কী বলছ তুমি, মৌর্য?”
“বিশ্বাস করো পাপা,
সত্যি বলছি। আমি একদিন
স্বপ্নেও দেখেছিলাম, আমি পুল থেকে পড়ে যাচ্ছি। ও এসে আমার হাতটা…”
“চুপ করো!”
“তোমরা কেউ আমার কথা বিশ্বাস করছ না কেন!”
“আমাদের ছেলে এসব কী বলছে, তনিমা!
তুমি চুপ করে আছ কেন? কিছু বলো!”
তনিমা স্পর্শহীনের মতো নিস্তব্ধ নিথর। ও জানে, মৌর্যর প্রতিটা কথা নিখাদ সত্যি। এতটুকু মিথ্যে
নেই তাতে। দিন দিন ছেলেটা মনমরা হয়ে যাচ্ছিল। মা হয়ে এসব
চোখে দেখা যায় না। নিতান্ত অনিচ্ছাকে সংযত করে ওর মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছিল শেষমেশ। সেদিন স্কুলে যাবার পর অ্যাকাডেমির খোঁজখবর নিতে যায়। আর তখনই শোনে এক ভয়াবহ ঘটনা। সংস্থাটির পরিচালনা, তত্ত্বাবধান খুবই নিম্নমানের। সমস্তটা বলেন
এক অভিভাবক। সেদিন তিনিও তার সন্তানকে ছাড়িয়ে দিতে এসেছিলেন ওখান থেকে। ভীত প্রত্যেকেই প্রতি মুহূর্তে। বিগত ছয় মাসে আতঙ্ক ছড়িয়েছে আরও। যখন থেকে
প্রিয়াঙ্কা নৌটিয়াল তলিয়ে গেছে জলের তলায়। পুলের গভীরতা ছয় ফুটের বেশি থাকায় উঠতে পারেনি দশ বছরের মেয়েটি। কোচের দায়িত্বহীনতা। এক সপ্তাহ ভর্তি হয়েছিল সবে। জানত না সাঁতারের
আদ্যোপান্ত। আর তাতেই... বৃষ্টি পড়ছিল বলে অন্যরাও সেদিন দেরি করে আসে। আর এসে ওরা দ্যাখে,
কোচ তখনও ফোনে কথা বলে যাচ্ছিলেন। অভিভাবক তাকেও নিষেধ করেন।
ছোটোবেলায় মায়ের কাছে শুনেছিল, ছোটোদের মনের রং সাদা। তারা সত্যি মিথ্যে সবটা যাচাই করতে পারে। দেখতে পায়, বুঝতে পারে অনেক কিছু যা আমরা বুঝি না। হয়তো বা বুঝতে
পারি না। মৌর্যকে অজ্ঞান অবস্থায় দেখে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছিল
ওরা। হয়তো স্পষ্ট কারণটা ওদের কাছেও অজানা। তবে সত্যি
একটাই, মৌর্য ওদের কাছেই। আবার আগের মতোই। সুবীরকাকুর বিপদ সংকেত, কিংবা বন্যজন্তুর আর্ত
আতঙ্ক ভয়ঘুণ ধরিয়েছিল তনিমার মনে। অপরিচিত জায়গায় সমস্তটাই কালো, অজানা। জানালা দিয়ে সেই রাতে স্বচক্ষে জন্তুটাকে দেখে শিউরে উঠেছিল আরও। না জানি কী কী বিপদের সংকেত দিচ্ছে ও। হয়তো এর থেকেও আরও অনেক বিপদ
অপেক্ষা করছিল ওদের জন্য। বুকের মধ্যে দু’হাতে চেপে জড়িয়ে ধরল মৌর্যকে ওর মাম্মাম। মৌর্যও দুর্বল হাতে
মাম্মামকে জড়িয়ে ধরে বলল, “মাম্মাম, ওই মেয়েটা কে? কেন আসে ও
আমার কাছে? আমাকে ওখানে যেতে বারণ করে
কেন?”
তনিমা ছেলের মাথায় আলতো করে
হাত বুলিয়ে কপালে একটা চুমু দিয়ে বলে,
“জলপরি।”
সরু শিরশিরে হাওয়াটা চারপাশে
ঘুরতে ঘুরতে জানালার ওপারে চলে যায়। হয়তো আবারও একপশলা বৃষ্টি নামবে।
_____
অলঙ্করণঃ রুমেলা দাস
খুব ভালো গল্প। ভালো লাগলো।
ReplyDeleteঅনেক ভালোলাগা
Deleteদারুণ লাগলো।
ReplyDeleteধন্যবাদ
DeleteThis comment has been removed by the author.
Deleteখুব ভালো, বর্ণনা অনবদ্য
ReplyDeleteদাদা তোমার অপেক্ষাতেই ছিলাম যে!😊
Deleteখুব ভালো, বর্ণনা অনবদ্য
ReplyDeleteলেখার স্টাইল এবং গল্পের টোটালিটি দুটোই খুব সুন্দর। আরো লিখুন পড়ার অপেক্ষায় রইলাম।
ReplyDeleteধন্যবাদ
Deleteখুব খুব সুন্দর লাগল গো। লেখার স্টাইলটাও খুব সুন্দর। -সুস্মিতা
ReplyDeleteথ্যাঙ্কু অনেক
Deleteবাহ, বেশ ভালো লাগল গল্পটা|
ReplyDeleteভালোবাসা দাদা
Deleteখুব ভালো হয়েছে দিদি। একদম টানটান লেখা হয়েছে, কোনো ফাঁকফোকর নেই। অনেক শুভেচ্ছা তোমায়।
ReplyDeleteথ্যাঙ্কু
Deleteখুব ভালো লাগল। গা শিরশিরে।
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ
Delete