এক বিশ্ববন্দিত
বিজ্ঞানীর ছেলেবেলা
কমলবিকাশ
বন্দ্যোপাধ্যায়
রোমের
বিখ্যাত চিত্রশিল্পী মিকেলাঞ্জেলোর মৃত্যু হয়েছিল ১৫৬৪ খ্রিঃ ১৫ ফেব্রুয়ারি। ঠিক ওইদিনই পিসায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন গ্যালিলিও গ্যালিলি। এই বিজ্ঞানীর নাম তোমরা নিশ্চয়ই শুনেছ। মহাকাশের
গ্রহ-নক্ষত্র দেখার জন্য তিনিই
প্রথম দূরবিন ব্যবহার করেছিলেন। এই যশস্বী বিজ্ঞানীর মৃত্যু হয়েছিল ১৬৪২
খ্রিস্টাব্দের ৮ জানুয়ারি। এর ঠিক তিনশো বছর পরে, অর্থাৎ ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৮ জানুয়ারি জন্মেছিলেন
আরেক বিশ্ববন্দিত জ্যোতির্বিজ্ঞানী। কে সেই বিজ্ঞানী? না, এখনই বলছি না,
একটু ধৈর্য ধরো। আগে তাঁর বাবা-মার কথা কিছু বলে নিই।
ইয়র্কশায়ারের
এক সম্পন্ন কৃষক পরিবারে জন্মেছিলেন ফ্রাঙ্ক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ
শুরু হওয়ার পর তাঁদের পরিবারে নেমে আসে বিপর্যয়। ফ্রাঙ্কের
বাবা সমস্ত জমিজায়গা বিক্রি করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। ফ্রাঙ্কের অসম্ভব মনের জোর ছিল। শত অভাব অনটনের
মধ্যেও তিনি পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন। অবশেষে গবেষক-চিকিৎসক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।
বিজ্ঞানীর
মা ছিলেন স্কটল্যান্ডের মেয়ে। নাম ইসোবেল। তাঁর বাবা
ছিলেন একজন চিকিৎসক। সাত ভাইবোনের মধ্যে ইসোবেল ছিলেন তাঁর
বাবা-মার দ্বিতীয় সন্তান। ছোটোবেলা থেকেই পড়াশনার প্রতি তাঁর খুব আগ্রহ ছিল। তাঁর চিকিৎসক পিতা সেটা লক্ষ করেছিলেন। উচ্চশিক্ষা
লাভের জন্য তিনি ইসোবেলকে দেশের অন্যতম বিশ্ববিদ্যালয় অক্সফোর্ডে ভর্তি করে দেন। পড়াশোনা শেষে তিনি আয়কর বিভাগে ট্যাক্স-ইন্সপেক্টরের পদে যোগ দেন। কিন্তু এই চাকরি তাঁর পছন্দ হল না। কিছুদিন পরে
তিনি চাকরিতে ইস্তফা দেন। এরপরে তিনি একটি চিকিৎসাসংক্রান্ত গবেষণা
কেন্দ্রে সেক্রেটারির কাজে যোগ দেন। কাজের সূত্রে এই প্রতিষ্ঠানে ফ্রাঙ্কও
আসতেন। এখানেই দু’জনের দেখা হয় এবং পরে বিবাহ হয়।
বিবাহের
পর দু’জনে উত্তর লন্ডনের হাইগেট-এ থাকতে শুরু করেন। গবেষণার কাজে ফ্রাঙ্ককে মাঝেমাঝেই আফ্রিকা
যেতে হত। ১৯৩৭ সালে তিনি পূর্ব আফ্রিকায় যান। এর প্রায়
দু’বছর পর ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধের খবর পেয়ে ফ্রাঙ্ক তড়িঘড়ি লন্ডনে
ফিরে আসেন।
যুদ্ধ
চলছে। জার্মানদের ছোড়া রকেট এবং বোমা বিভিন্ন জায়গায় এসে পড়ছে। অক্সফোর্ড এবং কেমব্রিজ ছাড়া ইংল্যান্ডের আর কোনও জায়গাই নিরাপদ
নয়। তোমাদের নিশ্চয়ই জানতে ইচ্ছে করছে, কেন এই দুটি জায়গা নিরাপদ ছিল? ইংল্যান্ডে যেমন অক্সফোর্ড এবং কেমব্রিজ দুই অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয়,
তেমন জার্মানিতে ছিল হাইডেলবার্গ এবং গটিনগেন দুই পৃথিবী বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলি যাতে ধ্বংস না হয় এই কারণে যুদ্ধ শুরুর সময়
দুই দেশের মধ্যে এক ভদ্রলোকের চুক্তি হয় যে এই চারটি এলাকাকে বোমাবর্ষণের আওতার বাইরে
রাখা হবে।
ইসোবেল
তখন মা হতে চলেছেন। ফ্রাঙ্ক কোনও ঝুঁকি নিলেন না। স্ত্রীকে
নিয়ে অক্সফোর্ডে চলে এলেন। এখানেই ১৯৪২ সালের ৮ জানুয়ারি পৃথিবীর
প্রথম আলো দেখলেন ফ্রাঙ্ক ও ইসোবেল-এর প্রথম সন্তান স্টিফেন হকিং—বর্তমান যুগের স্বনামধন্য
জ্যোতির্বিজ্ঞানী। স্টিফেনের জন্মের দিন পনেরো পরেই তাঁর
বাবা-মা তাঁকে নিয়ে হাইগেট-এর বাড়িতে ফিরে আসেন। যুদ্ধ তখনও চলছিল। তবে তাঁদের তেমন কোনও বড়ো ধরনের বিপদে পড়তে হয়নি।
স্টিফেনের
বয়স তখন দুই। হঠাৎই একদিন জার্মানদের ছোড়া ভি-২ রকেট এসে আছড়ে পড়ল তাঁদের বাড়ি থেকে কয়েকটা বাড়ি
ছাড়িয়ে। রকেটটা যেখানে পড়েছিল তার আশেপাশের কয়েকটা বাড়ির ক্ষতি হলেও স্টিফেনদের
বাড়ির তেমন কোনও ক্ষতি হয়নি। কিন্তু রকেটটা যদি এসে ওঁদের বাড়িতে পড়ত
তাহলে কী ঘটত তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই ঘটনা কী মারাত্মক হতে পারত তা বোঝার
মতো ক্ষমতা ছোট্ট স্টিফেনের তখনও হয়নি।।
বরং কৌতূহল ছিল। তাই রকেটটা
যেখানে পড়েছিল সেখানে তিনি পাশের বাড়ির বন্ধু হাওয়ার্ডের সঙ্গে প্রায়ই যেতেন।
হাইগেটে
যাঁরা থাকতেন তাঁদের অনেকেই তাঁদের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার জন্য বায়রন হাউসে পাঠাতেন। স্টিফেনের যখন আড়াই বছর বয়স তখন তার বাবা-মা তাকেও ওই স্কুলের নার্সারি ক্লাসে ভর্তি করে
দেন। কিন্তু স্টিফেন কিছুতেই স্কুলে যাবেন না। স্কুলে যাওয়ার
সময় হলে রোজই কান্নাকাটি শুরু করে দিতেন। ছেলের এই অবস্থা দেখে তাঁরা তাকে আর স্কুলে
পাঠাননি। তবে দেড় বছর পরে স্টিফেন একটু বড়ো হলে তাঁরা তাঁকে আবার সেই বায়রন
হাউসেই ভর্তি করে দেন। এই স্কুলে অন্যান্য স্কুলের মতো প্রচলিত
পদ্ধতিতে পড়াশোনা হত না। খেলার মাধ্যমে এমনভাবে শেখানো হত যে পড়ুয়ারা
অজান্তেই সব শিখে যেত। এতে অবশ্য কোনও কিছু শিখতে সময় একটু বেশি
লাগত। স্টিফেনের এই ধরনের পড়াশোনা ভালো লাগত না। তিনি চাইতেন সবকিছু তাড়াতাড়ি শিখতে। তাই তিনি
প্রায়শই তার বাবা-মায়ের কাছে এই বলে নালিশ করতেন যে স্কুলে তাঁকে কিছুই শেখাচ্ছে না।
যুদ্ধ
একদিন শেষ হল। গোলাগুলির শব্দ বন্ধ হল। যুদ্ধবিধ্বস্ত
ইংল্যান্ড আবার নতুন করে গড়ে উঠতে লাগল। ১৯৫০ সাল। স্টিফেন তখন
আট বছরের বালক। মিলহিল-এর ‘ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট ফর মেডিকেল রিসার্চ’
কেন্দ্রে ফ্রাঙ্ক নতুন চাকরি পেয়েছেন। এটি ছিল চিকিৎসাবিজ্ঞানে
গবেষণার জন্য জাতীয় প্রতিষ্ঠান। এই সময়ে তাঁরা বাসস্থান বদল করেন। হাইগেট ছেড়ে সেন্ট অ্যালবান্স-এর ক্যাথেড্রাল টাউনে চলে আসেন।
ছেলেমেয়েদের
নিয়ে ফ্রাঙ্ক ও ইসোবেলের সুখেই দিন কাটছিল। দুই বোন ও এক ভাইকে খেলার সঙ্গী করে হাইগেট
ছেড়ে আসার দুঃখ স্টিফেন ভুলে গিয়েছিলেন। বড়ো বোন মেরি স্টিফেনের থেকে দেড় বছরের
ছোটো ছিল। বলা যায় পিঠোপিঠি। ছোটো বোন ফিলিপ্পা ছিল পাঁচ বছরের ছোটো। ছোটো ভাই এডওয়ার্ড অবশ্য অনেক ছোটো ছিল। এডওয়ার্ড
ছিল হকিং এবং ইসোবেলের দত্তক নেওয়া ছেলে।
সেন্ট
অ্যালবান্স অতি প্রাচীন একটি ছোট্ট শহর। তবে বেশ সাজানো গোছানো। ছোটো হলেও শহরটির গুরুত্ব কম ছিল না। সম্ভবত চতুর্থ
শতাব্দীতে কি তারও আগে এর পত্তন হয়েছিল। সেন্ট অ্যালবান্স ছিলেন রোমান। খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করায় তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তীকালে অ্যালবান্সের নামে এখানে একটি গির্জা তৈরি হয়। এখানে একটি মেয়েদের স্কুল ছিল। সেখানে দশ
বছর বয়স পর্যন্ত ছেলেমেয়ে এক সঙ্গে পড়তে পারত। স্টিফেনকে
ওই স্কুলেই ভর্তি করে দেওয়া হয়। বয়স দশ বছর হলে তাকে ছেলেদের সেন্ট অ্যালবান্স
হাইস্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হয়।
স্টিফেন
হকিং অত্যন্ত অগোছালো স্বভাবের ছিলেন। স্কুলের কাজকর্ম থেকে নিজের পোষাক-পরিচ্ছদে পরিচ্ছন্ন বা পরিপাটির অভাব দেখা যেত। হাতের লেখাও ছিল অপরিষ্কার। তবে অনর্গল
কথা বলতে পারতেন।
স্কুলে
স্টিফেনের সহপাঠী ছিল অনেক। সবাই যে তাঁর পছন্দের ছিল তা নয়। জন ম্যাকক্লেনহান,
রজার ফার্নিহাফ, বাসিল কিং, মাইকেল চার্চ এবং বিল ক্লেগহর্ন—এই জনা পাঁচেকের সঙ্গে
তাঁর বন্ধুত্ব ঘনিষ্ঠ ছিল। এদের সঙ্গে যোগাযোগ পরবর্তীকালেও থেকে
গিয়েছিল। এদের সঙ্গে নানা বিষয়ে আলোচনা,
তর্ক এবং ধ্রুপদী সঙ্গীত শোনা সবকিছুই চলত। মহাবিশ্ব নিয়ে কৌতূহল স্টিফেনের ছেলেবেলা থেকেই ছিল। বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা বা তর্কবিতর্কে এই বিষয়টি প্রায়শই গুরুত্ব
পেত।
স্টিফেন
হকিংয়ের খেলাধুলোর প্রতি তেমন আগ্রহ ছিল না। স্কুলের সহপাঠীরা যখন খেলত তিনি তখন দাঁড়িয়ে
দাঁড়িয়ে দেখতেন। তবে তিনি সাইকেল চালাতে ভালোবাসতেন। মাঝে মাঝেই
বন্ধুদের সঙ্গে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন। খেলার প্রতি আগ্রহ না থাকলেও খেলনার প্রতি
তাঁর আগ্রহ ছিল ভীষণ। বিশেষ করে স্প্রিং দেওয়া রেলগাড়ির প্রতি। এই আগ্রহ অবশ্য খেলনা নিয়ে খেলার জন্য নয়। খেলনার ভিতরে কী আছে তা দেখার জন্য। খেলনা পেলেই
সঙ্গে সঙ্গে খুলে ফেলতেন এবং দেখতেন সেটা কীভাবে তৈরি। এই ঘটনা থেকেই
অনুমান করা যায় যে কোনও কিছুর অন্তর্নিহিত রহস্য উদঘাটনের আকাঙ্ক্ষা স্টিফেন হকিংয়ের
ছেলেবেলা থেকেই ছিল, বড়ো হওয়ার পর যা পরিপূর্ণতা লাভ করে।
এই
বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানী আজ আর আমাদের মধ্যে নেই। ১৪ মার্চ
২০১৮ পৃথিবীর আকর্ষণ কাটিয়ে তিনি অন্তহীন মহাকাশের পথে পাড়ি দিয়েছেন।
_____
ছবিঃ আন্তর্জাল
No comments:
Post a Comment