তপনানন্দ
সেন ও তার পূর্বাভাস
অরিন্দম
দেবনাথ
“কোনও সাহায্য করতে পারি?”
লোকটাকে দেখে এগিয়ে এলেন পুলিশ স্টেশনের এক কর্মী।
“আপনাদের অফিসার ইন-চার্জ কে? আমাকে
নিয়ে যেতে পারেন ওঁর কাছে? খুব জরুরি।
ভয়ংকর
বিপদ ধেয়ে আসছে।”
শান্ত
সমুদ্রসৈকত ধুঁদুলের পুলিশ স্টেশনের ‘মে আই হেল্প ইউ’ ডেস্কের সামনে দাঁড়িয়ে প্রায় ফিসফিস
করে বলে উঠলেন ফরসা গোল মুখ, একমাথা কালো চুল, মাঝারি উচ্চতা, পেটাই চেহারার লোকটি।
ভদ্রলোকের পরনে খাকি প্যান্ট আর সাদা গেঞ্জি।
হাতে ছোটো
একটা কালো যন্ত্র আর গলায় একটি বেঢপ ক্যামেরা চওড়া বেল্টের সাথে ঝুলছে।
পুলিশ-কর্মীটি ভদ্রলোককে নিয়ে গেলেন
পুলিশ স্টেশনের ভেতরের একটা ঘরে। একটা
বিশাল বড়ো টেবিলের একদিকে একটি চেয়ার আর অন্যদিকে অনেকগুলো
চেয়ারের দিকে হাত দেখিয়ে বললেন, “একটু বসুন, বড়ো সাহেব এক্ষুনি আসছেন।”
ঘরের
বাইরে বেরিয়ে এসে নিজের মনে হেসে উঠলেন পুলিশ
স্টেশনের কর্মীটি। ‘হ্যাহ্,
ভয়ংকর বিপদ আসছে! কত বড়ো সবজান্তা রে!’
গত
একবছরে এখানে কোনও খুন, ডাকাতি, চুরি কিচ্ছু হয়নি। এমনকি
কোনও ছিঁচকে কেসও আসেনি। থানায় বসে বসে খালি খবরের কাগজ
পড়া ছাড়া সেরকম কোনও কাজ নেই।
সেই প্রথমদিন বড়ো সাহেব এই থানার দায়িত্ব
নিয়েই সব পুলিশ-কর্মীকে ডেকে বলেছিলেন, “কেউ কোনও অভিযোগ নিয়ে এলে তাকে সসম্মানে অফিসে বসিয়ে তার কথা শুনতে হবে।
প্রয়োজনে অভিযোগ লিখতে হবে ডায়েরিতে। প্রতিটি
অভিযোগের তদন্ত করতে হবে। কেউ যেন মনে অসন্তোষ নিয়ে পুলিশ
স্টেশন থেকে ফেরত না যায়। মনে রাখতে হবে,
নিরাপত্তা প্রদান পুলিশের অবশ্য কর্তব্য।
এই কাজের জন্যই আমরা পুলিশরা বেতন পাই।”
মানতে
হবে, কোনও লোক এই থানার পুলিশদের নামে বদনাম করতে পারবে
না। কোথাও কোনও ছোটো ঘটনা ঘটলেও বড়ো সাহেব স্বয়ং পৌঁছে
যান সেখানে।
রত্নোপসাগরের ধারে ছোট্ট সমুদ্র কিনারার গ্রাম ধুঁদুল।
সমুদ্রের কোল ঘেঁষে পাহাড় আর জঙ্গল। হাজার
চারেক লোকের বাস ধুঁদুলে। সমুদ্রে মাছ ধরা এদের অন্যতম
জীবিকা। শক্ত মোটা চকচকে হলুদ বালির
সৈকত। দূর থেকে দেখলে মনে হয় সোনার
দানা ছড়িয়ে আছে সৈকতে। সত্যি সত্যি সোনা মিশে আছে
এই বালিতে। অনেক আগে নাকি মাছ ধরার পাশাপাশি
এই বালি মাটির পাত্রে চেলে ধুয়ে সোনা বের করতেন স্থানীয় লোকজন।
তবে সোনা পাওয়া যেত খুব কম। তাই
পরিশ্রমে পোষাত না। যান্ত্রিক নৌকো এসে যাবার পর
আর কেউ সোনা চালতে যায় না। সেই
সময়টা মাছ বালিতে ফেলে শুকোয়। আঁশটে
গন্ধ মিশে থাকা সৈকতে মোটরচালিত নৌকোর আনাগোনা চলে সবসময়। পর্যটকের
ভিড় এখানে প্রায় নেই বললেই চলে। মৎস্য
দফতরের একটা গেস্ট হাউস অবশ্য আছে এখানে, ইচ্ছে করলে সেখানে থাকা যায়।
অফিসে
বসে ছটফট করছিলেন ফরসা গোলমুখো। মিনিট
পাঁচেকের মধ্যেই অফিসে ঢুকলেন কালো প্যান্ট আর হলুদ গেঞ্জি পরা
ছিপছিপে চেহারার একজন লোক।
“নমস্কার। আপনাকে অপেক্ষা করতে হল বলে
দুঃখিত। আমার নাম পুরোহিত পুরিন্দা,
আমি এই থানার অফিসার ইন-চার্জ।
আপনার জন্যে কী করতে পারি?”
“নমস্কার, আমি তপনানন্দ সেন, একজন
বিজ্ঞানসাধক। একটা বড়ো বিপর্যয় হতে চলেছে, এক্ষুনি সমুদ্রের ধারের গ্রামগুলো থেকে লোকজন সরিয়ে নেবার ব্যবস্থা করুন।”
পুরোহিত
পুরিন্দা ভাবলেশহীন মুখে বসে রইলেন। থানায়
কেউ সাহায্য চাইতে এলে তাকে না বলা যাবে না বলে তিনিই নির্দেশ দিয়েছেন।
এই লোকটাকে বেশ কয়েকদিন ধরে সমুদ্রের ধারে নানারকম যন্ত্র হাতে
ঘুরে বেড়াতে দেখা যাচ্ছে। লোকটা একা একা ঘুরে বেড়ায় আর
নিজের মনে বিড়বিড় করে কথা বলে। লোকটার
ভাবগতিক ঠিক সুবিধের ঠেকছিল না। সেইজন্য
একজন লোককে এর পেছনে গোপনে লাগিয়ে রেখেছিলেন তিনি। আরে
বাবা, ধুঁদুল পুলিশ স্টেশনের কোনও বদনাম হতে দেওয়া যাবে
না। কে জানে,
সুমদ্রের ধারে কোনও অসৎ উদ্দেশ্যে এসে ডেরা বেঁধেছে কি না লোকটা! তবে কোনও খারাপ রিপোর্ট এখনও পাননি তিনি। তাহলে?
লোকটার মাথার কোনও ব্যামো আছে, মনে মনে ভাবলেন
পুরোহিত পুরিন্দা। ভবিষ্যবাণী করছেন
‘বিপদ আসছে!’ হ্যাহ্!
ঘণ্টা
বাজালেন পুরোহিত পুরিন্দা। একজন
লোক ঢুকলেন ঘরের পর্দা সরিয়ে।
“একটু চা আর জল দাও আমাদের দু’জনকে।”
তপনানন্দ
সেন বললেন, “না না, চা খাবার সময় নেই। তাড়াতাড়ি গ্রাম থেকে লোক সরাবার ব্যবস্থা করুন,
না হলে অনেক লোক মারা যাবে।”
“মারা যাবে? কেন?” পুরোহিত পুরিন্দা
প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে তাকিয়ে রইলেন লোকটার দিকে। বললেন,
“আপনি কী বলছেন বুঝতে পারছি
না। গ্রাম থেকে লোকজন সরাতে বললেই
তো আর সরানো যায় না! তাছাড়া আপনি বলছেন বিপদ
আসছে। কী বিপদ আসছে শুনি? আবহাওয়া
দফতর বা মৎস্য দফতর কোনওরকম বিপদের পূর্বাভাস তো দেয়নি!
আমি ইচ্ছে করলেও লোক সরাতে পারব না। জেলাশাসককে
জানাতে হবে, লোকজন কোথায় সরবে তার
ব্যবস্থা করতে হবে। লোকজনকে
সরতে বললে তারাই বা সরবে কেন?”
“কী বলছেন আপনি? সমুদ্রের ধার থেকে লোকজন সরাতে পারবেন
না? এই ছবিটা দেখুন, খানিক আগে সমুদ্রের
ধার থেকে তুলে নিয়ে এসেছি।”
গলা
থেকে ধামসা মার্কা ক্যামেরাটা খুলে কোলের ওপর নিয়ে ক্যামেরার পেছনে একটা বোতামে চাপ
দিলেন গোলমুখো বিজ্ঞানী তপনানন্দ। ক্যামেরার
পেছন থেকে নিঃশব্দে একটা ভাঁজ করা কিছু খুলে গিয়ে একটা বেশ বড়ো কম্পিউটার মনিটরের আকার নিল। চমকে
উঠলেন পুরোহিত পুরিন্দা। ওঁর
নিজেরও ছবি তোলার নেশা আছে। দুটো
ডিজিটাল ক্যামেরাও আছে। কিন্তু এরকম কোনও ক্যামেরা
দেখা তো দূরের কথা, শোনেনওনি।
হবে কোনও নিউ গ্যাজেট। রোজই
তো কিছু না কিছু বেরোচ্ছে।
ওই
বড়ো স্ক্রিনে একটা ছবি দেখালেন তপানানন্দ। বালির ওপর পরে আছে একটা বিশাল সাদা সরু সাপ জাতীয় প্রাণী।
কিন্তু পিঠের ওপর মাছের মতো
কাঁটা। ছবিটা জুম করতে দেখা গেল,
মাছটার সারা গায়ে পিঁপড়ে খেকো আর্মাডিলোর মতো বড়ো বড়ো আঁশ, তাতে আঘাতের চিহ্ন।
বেশ কিছু জায়গা থেকে আঁশ উঠে গিয়ে মাংস বেরিয়ে আছে।
মুখটা অদ্ভুতরকম বড়ো,
দেখতে অনেকটা পুরুষ সিংহের কেশরওয়ালা মাথার মতো।
সমুদ্রের
ধারে হামেশাই অনেকরকম মাছ বা সামুদ্রিক জন্তু দেখা যায়। কখনও সমুদ্রের ঢেউয়ে ভেসে আসে, কখনও বা জেলেদের
জালে ধরা পড়ে। এই মাছ অথবা সামুদ্রিক জন্তুটা
অবশ্য একটু অন্যরকমের। কিন্তু সমুদ্রের ধারে একটা
অজানা মাছ পড়ে থাকতে দেখে এত উত্তেজিত হবার কী আছে বুঝলেন না পুরোহিত পুরিন্দা। নাহ্, লোকটাকে পাত্তা দেবার দরকার নেই।
লোকটা
মাছের ছবিটা দেখিয়ে ঢাউস ক্যামেরাটা নিয়ে খানিক খুটখাট করে আবার একটা ছবি দেখালেন।
ছবি তো নয়, যেন বিলকুল
এক্স-রে প্লেট একটা।
তপনানন্দ
বললেন, “এটা ওই মৃত মাছটার
এক্স-রে ছবি।” এক্স-রের ওপর আঙুল দিয়ে দেখালেন,
মাছটার মেরুদণ্ডের অস্থিসন্ধি কয়েক টুকরো হয়ে গেছে।
ভুরু
কুঁচকে উঠল দুঁদে পুলিশ অফিসার পুরোহিত পুরিন্দার। বললেন,
“আপনি বলছেন এটা মাছ। আমার
তো মনে হচ্ছে অন্য কোনও সামুদ্রিক প্রাণী। ধরে
নিলাম এটা মাছ। তা মাছের এক্স-রে করালেন কী
করে? ধুঁদুলে এক্স-রে করার কোনও
ব্যবস্থা নেই। তাছাড়া এত বড়ো মাছের এক্স-রে করা যায় কি না আমার জানা নেই। আপনার
ক্যমেরাতে এক্স-রের ছবি এলই বা কী করে? ক্যমেরা দিয়ে তো আর এক্স-রে করা যায় না!”
“দেখুন, এই ক্যামেরাটা আমার নিজের আবিষ্কার।
এটা দিয়ে অনেক কিছুই করা যায়। যদিও
এটার পেটেন্ট আমি নিইনি।
এটা একটাই আছে। আর
সেটা আমার নিজের কাজের জন্য। এখন
কথা না বলে লোকগুলোকে সরানোর ব্যবস্থা করুন প্লিস।”
কী করবেন ঠিক করতে পারছেন না পুরোহিত পুরিন্দা।
লোকটা নির্ঘাত পাগল। এই
যন্ত্রটা নাকি ক্যামেরা কাম এক্স-রে মেশিন!
বিশ্বাস করতে হবে?
পুরোহিত
পুরিন্দার চোখে অবিশ্বাস দেখে তপনানন্দ বললেন, “আপনার আংটি
পরা হাতটা একবার টেবিলের ওপর রাখবেন?”
পুরোহিত
পুরিন্দা দোনামনা করে হাতটা টেবিলের ওপর রাখতে ওই ঢাউস ক্যামেরাটা দিয়ে একটা ছবি তুলে
ক্যামেরার কম্পিউটারের মতো বিশাল স্ক্রিনটা
ঘুরিয়ে ধরলেন পুরোহিত পুরিন্দার দিকে। অবাক
হয়ে গেলেন উনি। ওঁর
আংটি পরা হাতের এক্স-রে! না, এই নতুন যন্ত্র নিয়ে আর কোনও সন্দেহ নেই।
কিন্তু
সে যাই হোক, বিশেষ অনুমতি ছাড়া সমুদ্রের কিনারা
থেকে লোক সরানোর অধিকার ওঁর নেই।
নিজে একটু খোঁজখবর না করে ওপরতলায় রিপোর্ট পাঠানো পুরোহিত পুরিন্দার ধাতে নেই।
বললেন, “ঠিক আছে, চলুন, সমুদ্রের ধারে গিয়ে মাছটাকে দেখে আসি।”
“চলুন, কিন্তু অনেক সময় নষ্ট হয়ে যাবে। যেকোনও সময় বিপদ ঘটে যেতে পারে।” বললেন তপনানন্দ সেন।
ঘর
থেকে বেরোতেই এগিয়ে এলেন পুরোদস্তুর পুলিশের পোশাক পরা একজন অফিসার।
পুরোহিত পুরিন্দা তপনানন্দ সেনকে দেখিয়ে অফিসারকে বললেন, “ইনি তপনানন্দ সেন, একজন বৈজ্ঞানিক।
সমুদ্রের ধারে একটা অদ্ভুত মাছের দর্শন পেয়ে আমাদের খবর দিতে এসেছেন।
দু’জন কনস্টেবলকে
বলুন আমার সঙ্গে যেতে, গাড়ি লাগবে না,
হেঁটে যাব।” তারপর তপনানন্দ সেনের দিকে ঘুরে বললেন,
“আলাপ করিয়ে দিই,
ইনি থানার সেকেন্ড অফিসার রত্নাকর কক্কর।”
পুরোহিত
পুরিন্দার কথা শুনে ক্ষেপে গেলেন তপনানন্দ। “ভুল করছেন, অফিসার। আমি মাছের খবর দিতে আসিনি।
আপনাদের জানাতে এসেছি যে, যেকোনও মুহূর্তে একটা
মারাত্মক প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটতে চলেছে। সমুদ্রের
ধারের গ্রামগুলো থেকে লোকজন সরিয়ে দিতে হবে এক্ষুনি। সময়
নষ্ট করা যাবে না।”
রত্নাকর
বললেন, “স্যার তো আপনার সাথে স্পটে যাচ্ছেন। উনি দেখে এসে না হয়...”
“স্পটে যাচ্ছেন মানে? চুরি-ডাকাতি বা খুনখারাপি
হয়েছে নাকি? এই জায়গাটা খানিকক্ষণের
মধ্যে না ছেড়ে গেলে আপনারাও বাঁচবেন না। শিগগিরি
ফোন করুন ওই জেলাশাসক না কী বললেন,
তাঁকে।”
দুটো
কড়া কথা বলতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলেন পুরোহিত পুরিন্দা। মানতে
হবে, লোকটার এলেম আছে। এই
ক্যামেরাটা লোকটার আবিষ্কার যদি নাও হয়, তাহলেও এইরকম গ্যাজেটের কথা উনি আগে শোনেননি। দেখা
তো দূরের কথা। তাছাড়া অতি-ভদ্র পুলিশ অফিসার হিসেবে ওঁর একটা সুনাম আছে।
“মিস্টার সেন, জেলাশাসক বা পুলিশ সুপারকে কিছু রিপোর্ট করার আগে আমাদের ব্যাপারটা ভালো করে একবার নিজের চোখে দেখে বুঝে তারপর ওঁদের জানাতে হয়।
মুখের কথায় আমরা কিছু করতে পারি না। তাছাড়া
আপনি সমুদ্রের ধারে পড়ে থাকা একটা অজানা মাছ দেখে এসে বলছেন, লোকজন সমুদ্রের ধারের গ্রাম থেকে সরিয়ে দিন। কেউ
আমাদের কথা শুনবে? উল্টে পাগল বলে হাসবে।
আগেই বলেছি, প্রাকৃতিক
বিপর্যয়ের কোনও আভাস সংশ্লিষ্ট কোনও দফতর দেয়নি। মাছটা
হয়তো কোনও জাহাজ বা
ট্রলারে ধাক্কা খেয়ে মরে গেছে।”
সময়
নষ্ট হবে বুঝেও পুলিশের দলের সাথে সমুদ্রের ধারে চললেন তপনানন্দ।
হাজার হাজার মানুষ মারা যেতে বসেছে। সেটা
জেনে-বুঝে চুপ করে বসে থাকা তপনানন্দের পক্ষে সম্ভব
নয়।
মিনিট
সাতেক হেঁটে সমুদ্রের ধারে মাছটার কাছে পৌঁছলেন সবাই। জোয়ার
শুরু হতে চলেছে। মৃত মাছটার লেজ ছুঁয়ে যাচ্ছে
জল। সমুদ্রের ধারে জেলেদের অনেকগুলো
দল উপস্থিত। নৌকা ভাসাবার সময় হয়ে গেছে।
পুলিশকে দেখে ওরাও অবাক হয়ে গেছে। গুটি
গুটি পায়ে কয়েকজন এগিয়ে এল। পুরোহিত
পুরিন্দাকে দেখে একজন জেলে বললেন, “সালাম,
সাব। আপনি
এখানে? কিছু হয়েছে নাকি?”
মাছটাকে
দেখিয়ে পুরোহিত পুরিন্দা জিজ্ঞেস করলেন, “এই মাছ তোমরা
আগে দেখেছ?”
জেলেদের
একজন উত্তর দিল, “না স্যার, আজ সকালেই আমরা দেখেছি এটাকে।
কাল রাতের জোয়ারে ভেসে এসে বালিতে আটকে গিয়ে মরে গেছে হবে।
খানিক পরে জোয়ারের জলে আবার সমুদ্রে চলে যাবে।
সমুদ্রের প্রাণী নিয়ে আমরা মাথা ঘামাই না।
কত আজীব কিসিমের মাছ ধরা পড়ে! আমরা সব জলে ঢেলে দিই। তবে
এটা মাছ, সাপ না অন্যকিছু বোঝা যাচ্ছে না।”
পুরোহিত
পুরিন্দা বললেন, “তোমারা সবাই মিলে এটাকে টেনে একটু
ওপরের দিকে নিয়ে যাবে, যাতে জলে ভেসে না যায়?”
বেশ
কয়েকজন জেলে মিলে মাছটাকে টেনে নিয়ে চলল সমুদ্রতটের উঁচুর দিকে।
মাছটা প্রায় ফুট পনেরো লম্বা। সাপের
মতো হিলহিলে। সিংহের
মতো মুখটার পিঠের ওপর পাখনা না থাকলে এটাকে
মাছ বলা যেত না কোনওভাবেই। সত্যি
সত্যি বড়ো শক্ত শক্ত আঁশওয়ালা মাছটার গায়ে কয়েক জায়গায় বেশ
বড়ো বড়ো আঘাতের চিহ্ন। কোনও
সন্দেহ নেই, কোথাও প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা
খেয়েছে মাছটা।
মাছটাকে
দেখিয়ে পুরোহিত পুরিন্দা তপনানন্দকে বললেন, “মিস্টার সেন, আপনি কি মনে করেন, আমি গিয়ে যদি আমার ওপরওয়ালাদের বলি সমুদ্রের ধারে একটা অদ্ভুতদর্শন মাছ মরে
পড়ে আছে, যা দেখে একজন বৈজ্ঞানিক এসে বলছেন সমুদ্রের ধার থেকে
লোকজন সরিয়ে দিতে, ভয়ংকর কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয় এগিয়ে আসছে,
কেউ শুনবে আমার কথা? এই মাছটা দেখে এমন কিছু প্রমাণ
হয় না, যে বড়ো কিছু বিপর্যয়
হতে চলেছে। সরি মিস্টার সেন,
আমি কিছু করতে পারব না। তবে
মাছটার কথা মৎস্য দফতরে জানিয়ে দিচ্ছি এখনই। ওরা
প্রয়োজনে এসে দেখে যাবে।”
শুনে
পাগলের মতো নিজের মাথার চুল টানতে লাগলেন তপনানন্দ
সেন। তারপর ওঁর হাতে ধরা যন্ত্রটার
দিকে খানিক তাকিয়ে রইলেন। যন্ত্রটা দেখতে অনেকটা লম্বা
মোবাইল ফোনের মতো। একটা
ছোটো স্ক্রিনও আছে তাতে।
আর আছে অনেকগুলো রেডিওর মতো নব।
আচমকা
পুরোহিত পুরিন্দার হলুদ গেঞ্জির একপ্রান্ত ধরে একরকম হিড়হিড় করে টানতে টানতে সমুদ্রের
জলে ধাক্কা মেরে ফেললেন তপনানন্দ। রে
রে করে তেড়ে এলেন সঙ্গের পুলিশ দু’জন। হাত দেখিয়ে তাদের আশ্বস্ত করে হাতের যন্ত্রটা ভিজে সপসপে পুরোহিত পুরিন্দার হাতে ধরিয়ে দিয়ে
তপনানন্দ বললেন, “এই যন্ত্রটা দেখুন, আমার আরেকটা আবিষ্কার।”
পরক্ষণেই
পুরোহিত পুরিন্দার হাত থেকে একরকম কেড়ে নিয়ে যন্ত্রটা জলে চুবিয়ে বললেন,
“দেখুন, জলের তাপমাত্রা
স্বাভাবিকের থেকে তিন ডিগ্রি বেশি। আর আমার যন্ত্রটা আরও বলছে যে সমুদ্রের তলায় হালকা কম্পন হচ্ছে।
আর শুনুন, ওই মাছটা কম
সে কম সমুদ্রের দু’হাজার ফুট জলের
নিচের বাসিন্দা। সম্ভবত জলের নিচে কোনও পাথরের
গুহায় থাকত। জলের তলার কোনও প্রচণ্ড আলোড়নে
ছিটকে পাথরের গায়ে পড়ে আঘাত পেয়ে মারা
গেছে। তারপর জলের স্রোতে ভাসতে ভাসতে
এখানে এসে ঠেকেছে। শুধু তাই নয়,
মাছটা এই রত্নোপসাগর
অঞ্চলের নয়। কারণ,
সমুদ্র এখানে এতটা
গভীর নয়। এটা কয়েকশো কিলোমিটার দূর সমুদ্রের
মাছ। এর মোটা আঁশই বলে দিচ্ছে,
এটা অত্যন্ত গভীর জলের বাসিন্দা। যেসব
মাছ জলের গভীরে প্রচণ্ড চাপ সহ্য করে থাকে তাদের শরীরের উপরিভাগ শক্ত হতে বাধ্য।
আমার এই যন্ত্র কয়েকদিন ধরেই মৃদু কম্পনের আভাস দিচ্ছিল।
আজ দেখলাম, কম্পনের মাত্রা
আস্তে আস্তে বাড়ছে। আর
দেরি করবেন না। শিগগিরি আশেপাশের গ্রাম থেকে লোকজন সরিয়ে যতটা উঁচু
জায়গায় সম্ভব সরিয়ে দিন। শুধু
তাই নয়, সমুদ্রের ধারের অন্যসব জায়গাতেও সতর্কবার্তা পাঠান।”
জেলেরাও
সব শুনছিল। ওদের একজন বলে উঠল,
“স্যার, আপনারা কী বলছেন বুঝতে পারছি না। তবে
দু’দিন ধরে অনেক মরা মাছ উঠছে জালে।”
কথাটা
শুনেই লুফে নিলেন তপনানন্দ। হাতজোড় করে বললেন, “ভাইসব, আপনারা তো সব কথা শুনলেন। আগামী
দুয়েক দিন সমুদ্রে মাছ ধরতে যাবেন না।
এক্ষুনি গ্রাম ছেড়ে সবাইকে নিয়ে উঠে যান ওই পাহাড়ের ওপর,
আর খোলা জায়গায় থাকবেন।”
পুরোহিত
পুরিন্দা খানিক ভুরু কুঁচকে রইলেন। তিনি
আগ বাড়িয়ে তপনানন্দের এসব কথা পছন্দ করছেন না। বললেন,
“চলুন মিস্টার সেন, আগে থানায় ফেরা যাক।” তারপর জেলেদের বললেন, “এই ভদ্রলোকের কথা তো তোমরা শুনলে।
এখন তোমাদের যা ভালো মনে হয় করো।”
দ্রুত
হেঁটে থানায় ফিরলেন সবাই। থানার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন
সেকেন্ড অফিসার রত্নাকর কক্কর। ঠক
করে পুরোহিত পুরিন্দাকে একটা স্যালুট করে বললেন, “মাছটা দেখলেন, স্যার?”
পুরোহিত
পুরিন্দা গম্ভীর হয়ে বললেন, “মিস্টার সেনকে নিয়ে
ভিজিটর রুমে বসান, আমি এখুনি ভেজা পোশাক পাল্টে আসছি।”
নিজের
কোয়ার্টারে ঢুকে একটা চেয়ারে খানিক চুপ করে বসে থাকলেন পুরোহিত পুরিন্দা।
ভেজা জামাকাপড় পাল্টানোর কথা ভুলেই গেছেন।
ঘরের কোণে
রাখা ফোনটা তুলে ফোন করলেন এস পিকে। তারপর
যা যা ঘটেছে বলে গেলেন।
“হ্যাঁ স্যার, ভদ্রলোকের নাম তপনানন্দ সেন, বৈজ্ঞানিক। হ্যাঁ
স্যার, আপনি চেনেন? আপনার সাথে
স্কুলে পড়তেন? ঠিক আছে, স্যার।”
ফোনটা
নামিয়ে পোশাক না পাল্টেই পুরোহিত পুরিন্দা ছুটলেন অফিসে।
“রত্নাকর, এক্ষুনি গাড়ি বের করুন।
হ্যান্ড মাইক নিন, জেলেদের গ্রামগুলোতে গিয়ে বলুন, গ্রাম ছেড়ে সবাই যেন
পাহাড়ের মাথায় চলে যায়। আমি
সমুদ্রের ধারে যাচ্ছি। জেলেদের সমুদ্রে যাওয়া আটকাতে
হবে। ডিজাস্টার
ম্যানেজমেন্ট টিম নিয়ে এস পি সাহেব ডি এমকে নিয়ে ঘণ্টা খানেকের মধ্যে হাজির হবেন।
মিস্টার সেন যা বলছেন তা ফলো করতে হবে আমাদের।
আর মিস্টার সেন, এস পি সাহেব যে আপনার পরিচিত আগে বলেননি তো? আপনি কি
আমার সাথে সমুদ্রের ধারে যাবেন?”
তপনানন্দ
বললেন, “আপনাদের এসপি কে, আমি জানি
না। আমি যা বুঝেছি তাই আপনাদের
বলেছি।”
সমুদ্রের
ধারে পৌঁছে পুরোহিত পুরিন্দা ও তপনানন্দ সেন দেখলেন, জোয়ারের জলে অজস্র মরা মাছ ভেসে আসছে। কিন্তু
জোয়ারের সময় সমুদ্রের জলে যে ঢেউ ওঠে সেটা নেই। কীরকম থম মেরে আছে সামনের দিগন্তে মিলিয়ে যাওয়া নীল জলরাশি।
মাথার ওপর একদল সমুদ্রচিল কর্কশ চিৎকার করে ক্রমাগত গোল হয়ে উড়ছে।
দুটো কুকুর সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে ঘেউ ঘেউ করে ডেকে চলেছে।
জেলের দল ভুরু
কুঁচকে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছে। জোয়ারের
এই সমুদ্র ওদের কাছে অচেনা।
জলে
নেমে পড়ে হাতের মোবাইলের মতো যন্ত্রটা জলে
চুবিয়ে ধরলেন তপনানন্দ। তারপর জলে দাঁড়িয়েই পাহাড়ের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে চিৎকার করে উঠলেন,
“ভাগো, জলদি ভাগো।”
একদিন
পরে পৃথিবীর সমস্ত টিভি চ্যানেল আর রেডিওতে খবরটা
প্রচারিত হয়েছিল।
খবরের
কাগজে ছাপা হয়েছিল এভাবে - রত্নোপসাগরের ধুঁদুল সমুদ্রসৈকতে
অজানা মাছের মৃতদেহ দেখে সমুদ্রের নিচে ভূকম্পের আভাস দেন বৈজ্ঞানিক তপনানন্দ সেন। প্রশাসন
বৈজ্ঞানিকের উপদেশ মেনে সমুদ্রের ধারের গ্রাম থেকে লোকজন সরিয়ে দেয় কাছের পাহাড়ের মাথায়।
পঞ্চাশ ফুটেরও বেশি উঁচু ঢেউ এসে ভাসিয়ে নিয়ে যায় রত্নোপসাগর উপকূলবর্তী গ্রামগুলো। হালকা
ভূকম্পনে ভেঙে পড়ে অনেক বাড়িঘর।
তবে কোনও প্রাণহানি হয়নি।
_____
অলঙ্করণঃ
বিশ্বদীপ পাল
দারুন গপ্পো
ReplyDelete