স্কুলের
কুইজের ফাইনালের শেষ প্রশ্ন। টানটান উত্তেজনা। সপ্তক আর ওর বন্ধু সুচরিতা একেবারে সমান সমান পয়েন্টে রয়েছে। শেষ প্রশ্নটা সুচরিতার,
যদি বলতে পারে ওই জিতবে। আর যদি না
পারে, সপ্তকের কাছেই বোনাস
পয়েন্টের জন্য আসবে। সেটা পারলেই ও বেরিয়ে যাবে।
কুইজ
মাস্টার ওদের স্কুলের ভূগোলের মাস্টারমশাই মোজাম্মেল স্যার। তিনি প্রশ্ন
করলেন, “উত্তর মেরু কে আবিষ্কার
করেছিলেন? মানে উত্তর মেরু বলে একটা জায়গা আছে সে তো সবাই জানত,
কিন্তু প্রথম মেরুবিন্দু কে চোখে দেখেছিলেন?”
স্যার
নিশ্চয়ই সুচরিতাকে জেতাবেন ঠিক করেছেন,
এটা পার্শিয়ালিটি হচ্ছে। এই প্রশ্ন
সুচরিতার কাছে জলভাত। সপ্তক মনে মনে গজগজ করছে। সুচরিতা লাফিয়ে উঠে বলল,
“রবার্ট পিয়েরি।”
জিতে
গেল সুচরিতা। সপ্তক হতাশভাবে উঠতে যাবে,
এমন সময় স্যার বললেন, “হয়নি। সপ্তক, বোনাসের জন্য চেষ্টা করবে নাকি?”
“আমাকে বলছেন?” সপ্তক নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছে
না।
“হ্যাঁ, তোমার কাছেই তো প্রশ্নটা গেছে।”
“কিন্তু সুচরিতা যে উত্তর দিল।”
সপ্তক বোকার মতো বলল।
“বললাম তো ওর উত্তরটা ভুল। তুমি কি চেষ্টা করবে? নাকি ছেড়ে দেবে?”
“না না, বলছি।”
সপ্তকের মাথাটা ঘুরে গেল। ও তো পিয়েরিই
জানত! তাহলে কি স্যার দক্ষিণ
মেরু জিজ্ঞাসা করেছিলেন? কিন্তু সুচরিতাও তো নিশ্চয়ই উত্তর মেরুই
শুনেছে। তাড়াতাড়িতে যে নামটা প্রথম মনে এল বলে দিল, “রোয়াল্ড আমুন্ডসেন।”
“ঠিক, সপ্তকের পাঁচ পয়েন্ট। ওই জিতেছে। কনগ্রাচুলেশনস! আজ আমার আর সময় নেই, দেরি
হয়ে গেছে। চলি।” স্যার প্রায় দৌড়ে বেরিয়ে গেলেন।
কেমন
একটা ঘোরের মধ্যে বেরিয়ে এল সপ্তক,
সঙ্গে সুচরিতা। দু’জনে পাশাপাশি বাড়িতে থাকে, ছোটোবেলা থেকেই খুব বন্ধুত্ব।
সুচরিতা
হাঁটতে হাঁটতে বলল, “স্যার নিশ্চয় উত্তর আর দক্ষিণ মেরু গুলিয়ে ফেলেছেন। নাহলে কিনা পিয়েরিতে না দিয়ে আমুন্ডসেনে নাম্বার দে্ন? এটা কেমন হল তুইই বল।”
“একবার না হয় আমি প্রথম হলাম। আগের তিন জায়গায় তো তুই জিতেছিলি।”
“সে তো গতবছর তোকে একবারও আমি হারাতে পারিনি। তা বলে এইরকম
হবে?”
“আচ্ছা,
স্যার কি এইরকম ভুল করবেন? নাকি আমরা কিছু ভুল
করছি? সিধুজ্যাঠাকে জিজ্ঞাসা করলে কেমন হয়?”
সিধুজ্যাঠা
ওদের জ্যাঠা নয়, পাড়ার দাদা। সিদ্ধার্থদা কলেজে পড়ে,
আর নানারকম খোঁজখবর রাখে। ফেলুদার গল্পের
সঙ্গে মিল আছে বলে সপ্তকরা ওকে মজা করে সিধুজ্যাঠা বলে ডাকে। সিদ্ধার্থদা
কিছু মনে করে না।
“চল, দেখি বাড়িতে আছে কি না।” সুচরিতা রাজি।
বাড়ির
সামনে দাঁড়িয়ে দু’জনে মিলে একসঙ্গে ‘সিদ্ধার্থদা’ বলে ডাক দিল। একবার সপ্তক ‘সিধুজ্যাঠা’ বলে চেঁচিয়েছিল। সিদ্ধার্থদার মা বেরিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “কাকে খুঁজছ?”
সপ্তক
খুব লজ্জা পেয়েছিল।
সিদ্ধার্থদা
দোতলার বারান্দা থেকে উঁকি মেরে বলল,
“উপরে চলে আয়।”
সিদ্ধার্থদার
ঘরটা বইয়ে ঠাসা। চেয়ার-টেবিল কোনও জায়গা বাকি নেই। সুচরিতারা জানে কী করতে হবে। দুটো চেয়ার থেকে বইগুলো মেঝেতে নামিয়ে বসল।
“তারপর বল, দু’জনে এই সময়,
কী ব্যাপার?” সিদ্ধার্থদা হাতের বইটা টেবিলে নামিয়ে
প্রশ্ন করে।
সুচরিতা
বলল, “দেখো না, স্কুলের কুইজে স্যার আমাকে হারিয়ে সপ্তককে জিতিয়ে দিয়েছেন।”
“তা আমি কী করব? ব্যাপারটা খুলে বল।”
সুচরিতাই
পুরোটা বলল। সব শুনে সিদ্ধার্থদা সপ্তককে জিজ্ঞাসা করল, “তুই হঠাৎ আমুন্ডসেনের নাম বললি কেন?”
“কী জানি, একটাই নাম মাথায় এল। মেরু অভিযাত্রীদের ক’জনেরই বা নাম শুনেছি? ভাবলাম, স্যার
হয়তো দক্ষিণ মেরু বলতে চেয়েছেন, কিংবা আমরা দু’জনেই ভুল শুনেছি।”
সিদ্ধার্থদা
কোন স্যার কুইজটা চালাচ্ছিলেন শুনে বলল,
“আমি যখন ক্লাস টেনে পড়তাম তখন উনি স্কুলে এলেন। আমি ক্লাস করিনি,
তবে শুনেছি খুব ভালো পড়ান।”
“হ্যাঁ, তা পড়ান। কিন্তু ভূগোলের
লোক হলেও মোজাম্মেল স্যার এটা ভুল বলেছেন। সবাই জানে, উত্তর মেরুতে প্রথম গিয়েছিলেন রবার্ট পিয়েরি।” সুচরিতা নিশ্চিতভাবে বলে।
সিদ্ধার্থদা
হাসতে হাসতে বলে, “যারা জানে তারা ভুল জানে। আজকাল খুব কম লোকেই পিয়েরির মেরু আবিষ্কারের
কথায় বিশ্বাস করে। পিয়েরি আসলে উত্তর মেরুতে পৌঁছোতে পারেননি। তোদের স্যার ঠিকই বলেছেন।”
“তাহলে আমাদের বইতে কি ভুল লেখা আছে? যত বই দেখেছি,
সবেতেই তো পিয়েরির নাম উত্তর মেরুর আবিষ্কর্তা হিসাবে আছে।” সুচরিতা বলল।
“শোন তবে। রবার্ট পিয়েরি ১৯০৯ সালে মেরু অভিযান
থেকে ফেরেন। তারপরেই খবর পান যে ডক্টর ফ্রেডরিক কুক বলে আরেক অভিযাত্রী দাবি
করেছেন যে আগের গ্রীষ্মে তিনি মেরুবিন্দুতে পৌঁছেছিলেন। কিন্তু বরফে
আটকে পড়াতে তিনি খবরটা কাউকে দিতে পারেননি। গোটা শীতকালটা মেরুতে কাটিয়ে সবে ফিরতে
পেরেছেন।
“পিয়েরি আর দেরি না করে নিজের দাবি পেশ করেন। সেই নিয়ে
প্রচুর জল ঘোলা হয়। কুকের কাগজপত্র পরীক্ষা করার জন্য কমিশন বসে। তারা কুকের সফরসঙ্গী তিন এস্কিমোকেও জিজ্ঞাসাবাদ করে। কমিশন সিদ্ধান্ত করে কুক যে মেরুবিন্দুতে পৌঁছেছেন তার কোনও প্রমাণ
নেই। কুকেরই পুরনো একটা কথা তাঁর বিপক্ষে যায়। কুক দাবি
করেছিলেন যে তিনি উত্তর মেরুর কাছে মাউন্ট ম্যাকিনলের চূড়ায় উঠেছেন। পরে প্রমাণ হয়ে যায় যে তিনি মিথ্যে কথা বলেছিলেন। তাই কমিশন তাঁর মেরুবিন্দুতে পৌঁছানোর দাবিও নাকচ করে দেয়।”
“তাহলে তো আমিই ঠিক, পিয়েরিই প্রথম।” সুচরিতা বলে।
“সেই সময় লোক তাই মেনে নিয়েছিল। কিন্তু পরে
কয়েকজনের সন্দেহ হয়। তখন পিয়েরির বিবরণ নতুন করে পরীক্ষা করতে
গিয়ে প্রচুর অসঙ্গতি ধরা পড়ে।”
সপ্তক
জিজ্ঞাসা করে, “এত কাগজপত্র
দেখার কী আছে? কেউ সত্যি সত্যি গিয়ে থাকলে তো একটা চিহ্ন রেখে
আসবে। সেটা দেখলেই হল।”
“উত্তর মেরু তো আসলে সমুদ্র, তার উপরে বরফ ভেসে বেড়ায়। চিহ্ন রাখলেও তা ভেসে অন্য জায়গায় চলে যাবে। সেজন্য তখন নিয়ম ছিল,
প্রতিদিন সেক্সট্যান্ট যন্ত্র দিয়ে আকাশ পর্যবেক্ষণ করে তা লিখে রাখতে
হত। মেরু অভিযান হত গ্রীষ্মকালে,
তখন মেরুবৃত্তের উপরে সবসময়ই দিন। তাই সূর্যের
অবস্থানই লেখা হত। কুকের সঙ্গী ছিল শুধু ইনুইট,
মানে এস্কিমোরা। তাঁরা কেউ সেক্সট্যান্ট ব্যবহার করতে
জানত না। শুরুতে পিয়েরির সঙ্গে মার্কিন নৌবাহিনীর অনেক অফিসার ছিলেন, কিন্তু তাঁরা সবাই একে একে ফিরে যান। মেরু অভিযানে তখন ওইরকমই নিয়ম ছিল, একেক বারে একেক দল লোক ফিরে যেত। শেষপর্যন্ত পিয়েরির সঙ্গী ছিল চারজন ইনুইট আর ম্যাথু হেনসন বলে
এক কৃষ্ণাঙ্গ। হেনসনকে পিয়েরির রাখতেই হয়েছিল,
কারণ পিয়েরি ইনুইটদের ভাষা জানতেন না। হেনসন ছিলেন
দোভাষী। ছ’জনের মধ্যে একমাত্র পিয়েরিই সেক্সট্যান্ট ব্যবহার করতে পারতেন।
“পিয়েরির বিবরণ থেকে জানা যায় যে শেষ পাঁচ দিনে পিয়েরির দল বরফের উপর দিয়ে একশো
তিরিশ নটিক্যাল মাইল গিয়েছিলেন। সেটা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। নটিক্যাল মাইল মানে জানিস তো?
জাহাজিরা যে মাইল ব্যবহার করে সেটা সাধারণ মাইলের থেকে বড়ো। তাকে বলে নটিক্যাল মাইল। তখন মেরু
অভিযানে লোকে গড়ে বারো-তেরো নটিক্যাল মাইলের বেশি যেতে পারত না। মজার কথা
হল যে পিয়েরির সঙ্গে যতদিন মার্কিন নেভির অফিসাররা ছিলেন, ততদিন গোটা দলটা গড়ে দিনে তেরো নটিক্যাল মাইল
যাচ্ছিল। কিন্তু তাঁরা ফিরে যাওয়ার পরেই পিয়েরির বেগ দ্বিগুণ হয়ে যায়। ফেরার সময় সেটা আরও অনেক বেড়ে যায়। পিয়েরির বিবরণ
অনুযায়ী তিনি শেষের ক’দিন একেবারে সরলরেখায় গিয়েছিলেন। বরফের উপর
দিয়ে সেরকমভাবে যাওয়া সম্ভব? তার উপর আবার উত্তর মেরুবিন্দুর কাছে, যেখানে কম্পাস
ভালো কাজ করে না?
“পিয়েরিও যে মিথ্যে কথা বলতেন তাও পরে বোঝা গেছে। পিয়েরি তো আগেও কয়েকবার মেরু অভিযানে গিয়েছিলেন। ১৯০৬ সালে এক অভিযানের সময় তিনি দাবি করেছিলেন, একটা নির্দিষ্ট দিনে তিনি ডাঙা দেখতে পেয়েছিলেন। সে ডাঙা আর পরে খুঁজে পাওয়া যায়নি তো বটেই, অনেক বছর পরে দেখা যায় যে পিয়েরি ডায়েরিতে সেইদিনই
লিখে রেখেছেন কোনওদিকে ডাঙা দেখা যাচ্ছে না। হেনসনও মেরু
অভিযান নিয়ে বই লিখেছিলেন। তাতে আছে যে মেরুবিন্দুতে পৌঁছোনোর আগে
তাঁদের অনেক ঘুরে ঘুরে যেতে হয়েছিল। তাঁরা যেদিন মেরুবিন্দুতে পৌঁছেছিলেন, সেদিন পিয়েরিকে দেখে হেনসনের একবারেই মনে হয়নি
যে তাঁর সারাজীবনের স্বপ্ন, এত বছরের চেষ্টা সফল হয়েছে। সেদিন পিয়েরি নাকি ডায়েরিতে কিছু লেখেননি। এসব কারণে আজকাল কেউ আর পিয়েরির দাবিতে বিশ্বাস করে না।”
“সে না হয় হল। কিন্তু আমুন্ডসেন তো দক্ষিণ মেরুতে গিয়েছিলেন। তাঁর নাম শুনে সপ্তককে স্যার নাম্বার দিলেন কেন?” সুচরিতা জানতে চায়।
“প্রশ্নের
ভাষাটা তোরা আমাকে ঠিকঠাক ঠিক বলেছিলি তো?”
“হ্যাঁ, স্যার বলেছিলেন কে মেরুবিন্দু প্রথম চোখে দেখেছিলেন।” সপ্তক বলে।
“১৯২৬ সালে রোয়াল্ড আমুন্ডসেন এক বেলুন অভিযানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তিনি তার আগে একবার প্লেনে করেও উত্তর মেরু যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু ব্যর্থ হন। বেলুন বলছি বটে,
কিন্তু তাতে ইঞ্জিন ছিল। এগুলোকে বলা
হত এয়ারশিপ। এই এয়ারশিপটার নাম ছিল নাম ছিল নর্গে। ইতালি, আমেরিকা আর নরওয়ে থেকে মোট ষোলোজন অভিযাত্রী ছিলেন। তাঁরা উত্তর মেরুর উপর দিয়ে উড়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু আবহাওয়া খারাপ থাকায় সেখানে নামতে পারেননি। তাই মেরুবিন্দু চোখে দেখেই তাঁদের সন্তুষ্ট থাকতে হয়। আলাস্কার আগে কোনও জায়গাতেই তাঁরা মাটি ছুঁতে পারেননি। এটাকেই প্রথম সফল উত্তর মেরু অভিযান বলে আজকাল মেনে নেওয়া হয়।”
“তুমি এত খবর জানলে কোথা থেকে?” সপ্তক জিজ্ঞাসা করে।
“খবরের কাগজে পিয়েরির মেরু অভিযান নিয়ে লেখালেখি হয়েছিল, তখন পড়েছিলাম। তারপর ইন্টারনেট ঘেঁটেছি। তার থেকে যেটুকু মনে আছে তোদের বললাম।”
সপ্তক আর
সুচরিতা একসঙ্গে বলে, “সত্যিই তুমি
সিধুজ্যাঠা!”
_____
![]() |
আমুন্ডসেন |
![]() |
পিয়েরি |
![]() |
কুক |
ছবিঃ আন্তর্জাল
খুব সুন্দর লাগল। অনেক নতুন তথ্য জানলাম। এরকম লেখা আরও অনেক চাই।
ReplyDeleteধন্যবাদ পুষ্পেন।
Deleteগল্পের মত করে বলা সত্য কাহিনী
ReplyDeleteধন্যবাদ
Deletedarun
ReplyDeleteধন্যবাদ
Delete