ভালো থাকার
চাবি
হিমি মিত্র
রায়
গ্রাম
থেকে কিছুদিন হল শিলিগুড়িতে এসেছে সায়নরা। আগে ওরা আলিপুরদুয়ারের কাছে সুন্দরীগাঁও
বলে একটা ছোট্ট গ্রামে থাকত। নামের মতোই ছিল সেই গ্রাম - গাছগাছালিতে
ভরা, কত্তরকমের পাখি, হাঁস, মুরগি ইত্যাদি
দিয়ে ঠাসা। ছিল সবুজ মাঠ,
কচুরিপানা, শালুকে ভরা দিঘি - যার মধ্যে সূর্য ওঠার সময় প্রথম আলো মেখে ঝিকমিকিয়ে
উঠত, যেন সোনার পদ্মফুল। দিগন্তবিস্তৃত
ধানক্ষেত জুড়ে নরম মৃদু বাতাস বইত,
আল দিয়ে দৌড়ে বেড়াত সায়নরা -
সায়ন,
তিথি, ঘন্টু, ওসমান আর চন্দনারা।
সায়ন
এখন একা, বড্ড একা। শহরে আসার পর ওর কোনও খেলার সাথী নেই। সারাদিন ঘরে বসে থাকে ও। এইটুকুনি ফ্ল্যাটে একফালি বারান্দাও নেই। শুধু দুটো ছোটো ছোটো
ঘুপচি ঘর। মা বলেন, “তোর বাবার তো এত্ত পয়সা নেই
রে তাতাই, যে বড়ো বাড়ি কিনবে। কোনওরকমে এই বাড়ি একজন
লোকের কাছে সস্তায় পেয়ে গেছে, তাই লোন করে নিয়েছে। এইটুকু বাড়িতেই সন্তুষ্ট থাকো বাবা, যা পেয়েছ ওটাই অনেক। গ্রামের সঙ্গে মিলিও না,
তবে কষ্ট পাবে।”
সায়নের মন
মানে না। ওর মন পড়ে থাকে সুন্দরীগাঁওয়ে। ওখানকার সবকিছু
টানে ওকে। খুব মনে পড়ে শঙ্করীঠাকুমার কথা। ঠাকুমার আশি
বছরের মতো বয়স। বাচ্চাদের নিয়েই তাঁর দিন কাটত। দু’কূলে কেউ ছিল না। সায়নরা শঙ্করীঠাকুমার
কাছে প্রায় প্রতিদিনই যেত। উনি কী সুন্দর সুন্দর গল্প বলতেন ওদের সবাইকে! কত ধরনের যে গল্প, রূপকথা, ভূত, স্বাধীনতা
সংগ্রামী, দস্যুরানি - আরও কত কী। সায়নরা বিভোর
হয়ে শুনত। ঠাকুমার কাছে একটা চটের ব্যাগ ছিল।
উনি সেটায় ভর্তি করে নাড়ু-মোয়া-মুড়কি বানিয়ে রাখতেন ছোটো ছোটো অ্যালুমিনিয়ামের টিফিন বক্সে।
সায়ন চলে
আসবার দিন ওকে জড়িয়ে ধরে রেখেছিলেন ঠাকুমা। বলেছিলেন, “তরে আবার কবে দেখুম?”
“খুব শিগগির পাবে ঠাকুমা।
তুমি দেখো,
আমি শিলিগুড়ি থেকে পালিয়ে চলে আসব এখানে।”
“অরে, অমন বলতি হয় না বাছা। বাবা অনেক কষ্ট কইরা মানুষ করতাসে তকে। ভালো ইস্কুলে পড়াইব। ওইখানে গেলে পরেই সব ঠিক হইয়া যাইব, দেইখ্যা নিস।” ফোকলা দাঁতে হাল্কা হেসে সায়নের মাথায় হাত বোলান ঠাকুমা।
কিন্তু সায়নের
কিছুই ঠিক হয়নি। ওর দমবন্ধ লাগে ওই উঁচু বিল্ডিং আর পাঁচিল ঘেরা স্কুলে। ক্লাসে স্যার পড়ানোর সময় কতবার যে ওর চোখ জানালার বাইরে চলে যায়! ফেলে আসা দিনগুলোর কথা ভাবে আর ওর দু’চোখ জলে ভরে যায়, কান্না আটকাতে পারে না। নতুন ক্লাসের বন্ধুরা ওর কষ্ট বুঝতে পারে না। ওরা শুধু মোবাইলে নানারকম গেমের গল্প করে। কে ক’টা নতুন গেম ডাউনলোড করল, কার কত দামি স্মার্টফোন - শুধু এইসব গল্প।
আচ্ছা, ওরা কি খোলা হাওয়াতে জাম-জামরুল-আমড়া চুরি করেনি কখনও? বোধহয় না। কারণ, গাছই তো নেই! গাছের জায়গা দখল করে নিয়েছে শপিং মল। সায়ন মনে মনে ভাবে,
বাবাকে বলবে যে শহরের পরিবেশ ওর একদম ভালো লাগছে না।
ওকে যেন বাবা সুন্দরীগাঁওয়েই এই নিয়ে যায়। তারপর ভাবে, এত কষ্ট করে ওর কথা চিন্তা করে বাবা শিলিগুড়িতে
এই ফ্ল্যাট কিনেছে, আর ও-ই যদি এমন কথা বলে তবে বাবার
কত কষ্ট হবে!
সেদিন শনিবার
ছিল। সায়ন ওর ক্লাসের ছেলেদের সঙ্গে ফিরছিল বাড়ি। ওর স্কুল থেকে বাড়ি হাঁটাপথ,
বেশি দূর নয়। তাই ও হেঁটেই ফেরে ওদের সঙ্গে। দীপ, রিয়ম, অনুজ ওদের পাড়াতেই থাকে। মা ঠিক খোঁজ নিয়ে ওদের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছে ওকে। কিন্তু সায়ন অত কথা বলে না,
কম বলে। রাস্তা দিয়ে ফেরার সময় ওরা এগিয়ে যায়
গল্প করতে করতে, আর সায়ন নিজের মনে হাঁটতে থাকে। একটা ছোট্ট
পাথরকে পা দিয়ে ঠেলতে ঠেলতে চলে। আচমকা একটা আওয়াজ পেয়ে থমকে দাঁড়ায় ও।
“সামনের দিকে দেইখ্যা চলতে পারস না? যদি গাড়িঘোড়া আসে তহন কী হইব?”
চমকে
ঘুরে দাঁড়ায় ও, যেদিক থেকে
আওয়াজটা আসছিল।দেখে একটা
অশ্বত্থগাছের নিচে বসে আছেন শঙ্করীঠাকুমা। ওকে দেখে
ফোকলা দাঁতে হাসি উপচে পড়ছে। মনে হচ্ছে কোনও শিশুর হাসি। সায়ন প্রথমে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। তারপর এক লাফে ঠাকুমার কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরে তাকে। ঠাকুমাও দু’হাতে জাপটে ধরেন ওকে। তারপর কত আদর চলে নাতি-ঠাকুমায়! সায়ন তো কোলেই
মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ে।
“তোমার হাতগুলো এত ঠান্ডা কেন, ঠাকুমা? তোমার কি খুব শীত করছে?”
“না না বাছা, বয়স হইলে গা-হাত-পা ঠান্ডা হইয়া যায়। রক্ত কইমা যায় তো শরীরে! অ কিছু না। এই নে।” বলে ঝুলি থেকে নাড়ু, মুড়কি, মোয়া আরও কতকিছু যে বের করে করে
সায়নকে খাওয়াতে থাকলেন
ঠাকুমা তার শেষ নেই। কী যে স্বাদ এই খাবারগুলোর তা যে না খেয়েছে
জানে না।
“তোমার এই ছোট্ট ঝোলায় এত কী করে আঁটালে ঠাকুমা? একের পর এক বের করেই চলেছ তখন থেকে! চলো, আমাদের বাড়ি চলো। এখন থেকে তুমি আমাদের বাড়িতে থাকবে। আর তুমি এখানেই বা কী
করছ বলো তো, একা একা?”
“বাছাটা বড়ো হইয়া গ্যাসে দেখতেসি। কত প্রশ্ন
জিজ্ঞেস করে! আমাগো গেরামের বিপুল পোদ্দার
আমাকে বসাইয়া রাইখ্যা গ্যাসে। শহরের একটা কেলাব গেরামের বুড়া-বুড়িদের শহর দেখাইতে নিয়া যাইব - মন্দির, পার্ক না কী বলে ওইসব। আর ডাক্তার দেখাইব।
চোখগুলায় ছানি পড়সে না? সেজন্যে। আমি গেলে হারাইয়া যাব যে, বাছা! তার চেয়ে তুই চল আমার সঙ্গে,
তরে ভালো জিনিস দেখাই।”
“তুমি আবার কী দেখাবে, ঠাকুমা? তুমি কিছু চেন নাকি এখানে?”
মুচকি হাসেন
ঠাকুমা। শুধু বলেন, “চল না! আয়, আমার পিছন পিছন।”
সায়ন কিছু
না ভেবে ঠাকুমার পেছন পেছন চলতে থাকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো।
কিছুদূর যাওয়ার
পর একটা ছোটো সাধারণ গেট দিয়ে ঢোকেন ঠাকুমা। সায়নও। ঢুকেই হাঁ
হয়ে পড়ে ও। ফুলে ফুলে ঠাসা সেই জায়গা। বড়ো বড়ো ঝাঁকড়া কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, পলাশ, জুঁই, কুন্দ, দোলনচাঁপা,
আর কত ফল! আম-জাম-সবেদা-লিচু-আমলকি আর যতরকম আছে সব,
উপচে পড়ছে যেন। আর আকাশে রামধনু, নানারকম পাখির কলতান। আহা, কী মনোরম দৃশ্য! কুলুকুলু আওয়াজে পাশ দিয়ে বয়ে
চলেছে একটা ছোট্ট নদী। ছোটোবেলায় পড়েছিল যেমন, ‘আমাদের ছোট নদী
চলে আঁকেবাঁকে।’
ঠিক তেমন। নদীতে খেলা করছে কতরকমের হাঁস, পানকৌড়ি! আরে, ওটা কী!
ছুটে
যায় সায়ন। দেখে, একজন কাকু একটা বাক্সের মধ্যে দিয়ে কিছু দেখাচ্ছে, আর
অনেক ছেলেমেয়ে তাকে ঘিরে ধরেছে। তারাও দেখছে, আর খিলখিল করে হাসছে। ও দৌড়ে গিয়ে ওদের মধ্যে ঢুকে যায় আর বাক্সে চোখ দিয়ে ছবি দেখে। বায়োস্কোপই তো ছিল এটা সত্যি!
কী যে আনন্দ হচ্ছে ওর!
হঠাৎ দেখে, ঠাকুমা গাছতলায় বসে গল্প শোনাচ্ছে সবাইকে। সায়ন ওদের মধ্যে গিয়ে বসে পড়ে। নীলকমলের গল্প শোনে মন দিয়ে। রুমাল চোর, গুলতি, চোর-পুলিশ খেলতে খেলতে যখন হাঁপিয়ে
যায় তখন ওর সামনে একটি ছোটো
মেয়ে এসে দিয়ে যায় ডাবের জল। প্রাণ জুড়িয়ে যায় ওর। কী মিষ্টি এই জল! তারপর একে একে আসে হাওয়াই
মিঠাই, কাঠি বরফ, মন্ডামিঠাই, কুলের আচার - কত কী!
যেন ওর মনের সুপ্ত বাসনা এরা কেমন করে বুঝে যাচ্ছে আর না চাইতেই এইগুলো
হাজির হয়ে যাচ্ছে ওর সামনে।
ধীরে ধীরে
চোখ বুজে যায় সায়নের। আরামের ঘুম ঘুমোয় রাধাচূড়া গাছটার নিচে নরম সবুজ ঘাসে শুয়ে। যখন ঘুম ভাঙে, দেখে ঠাকুমা মাথার কাছে বসে মিটিমিটি হাসছেন।
“কী,
কেমন লাগল রে?”
ঠাকুমাকে
জড়িয়ে ধরে সায়ন বলে, ওর দারুণ লেগেছে। ওর সব দুঃখ দূর হয়ে
গেছে মনের।
“কাল থিকা এইখানে আসবি রোজ, কেমন? গেট খুইল্যা ভিতরে আসবি, তাপর যত খুশি খেলবি, কেউ বাধা দিব না
বাছা।”
“কিন্তু তুমি কোথায় চললে?”
ঠাকুমা হেসে
বলেন, “আমার যাইতে হইব। তর মতো আরও ছেলেমেয়েদের আমারে দরকার।
অদের কাছে যাই।”
সায়ন
আধোঘুমে মাথা নাড়ল। ঠাকুমা চলে গেলেন ওকে মাথায়
হাত দিয়ে আদর করে। ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেলেন
দূরে।
সায়ন এইবার
উঠে বাইরে এল। দেখল, ওর স্কুলের বন্ধুরা ঠিক
তখন যেখানে ছিল ওখানেই আছে, দূরে চলে যায়নি। ও ওদের পিছু পিছু চলল বাড়ির পথে। সময়টা থেমে
ছিল যেন ওর মনে হল।
বাড়ি ফিরে
দেখে মা চুপ করে জানালার দিকে
তাকিয়ে বসে রয়েছে। দেরি হয়েছে দেখে রেগে
গেল নাকি? সায়ন দৌড়ে গেল।
মাকে জড়িয়ে বলল, “তুমি রাগ করো না মা, আমি শঙ্করীঠাকুমাকে…”
ওর মুখের
কথা ছিনিয়ে নিয়ে মা বলল, “জানি সোনা, ঠাকুমাকে আজ দুপুরবেলা বিপুল পোদ্দার ডাক্তার দ্যাখাতে গেছিল,
খুব শরীর খারাপ হয়ে যাওয়ায় হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়েছে। একটু পর আমরা
সবাই ঠাকুমার কাছে যাব। তুমি খেয়ে নাও, চলো।”
সায়ন কিছু
বলার খুঁজে পায় না। নিজেই জানে না ওর সঙ্গে কী হল আজ। ও কি জেগে জেগে স্বপ্ন দেখল! সত্যিই তো ঠাকুমার সঙ্গে ওর আজ কত গল্প হল!
ও তো স্বপ্ন দেখেনি, সব সত্যি হয়েছে। মাকে বললে যদি মা বিশ্বাস না করে, তাই বলে না। চুপ করে ঘরে
গিয়ে খুব কাঁদে ও। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করে ঠাকুমাকে সুস্থ করে তুলতে।
_____
অলঙ্করণঃ
রুমেলা দাস
গল্পটা পড়তে পড়তে আমার নিজের ঠাকুমার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল| সুন্দর লিখেছেন
ReplyDeleteখুব আনন্দ পেলাম,আন্তরিক ধন্যবাদ
ReplyDeleteএমন কেন সত্যি হয় না, আহা। দারুণ লাগল।
ReplyDelete'ঠিক যেন এক স্বপ্ন হত তবে'!
Deleteঅনেক ধন্যবাদ আপনাকে