ফিরে দেখা গল্পঃ
রিটায়ার করে প্রহ্লাদবাবু গিন্নিকে নিয়ে কলকাতা শহর ছেড়ে ফুলডাঙায় চলে গেলেন বেশ খুশি মনে। প্রহ্লাদবাবু মিতব্যয়ী ছিলেন বলে টাকাপয়সার দিকটা চিন্তা করতে হয় না। এছাড়া ভদ্রস্থ একটা পেনশন আছে। শরীর-স্বাস্থ্যও ঠিকঠাক। একমাত্র মেয়ে থাকে আমেরিকায়। সে তার কাজকর্ম, সংসার নিয়ে ব্যস্ত। ফোনে অবশ্য নিয়মিতই মা-বাবার খোঁজখবর রাখে। সেইজন্য ঝাড়া হাত-পায়ে কলকাতার পাট গোটাতে প্রহ্লাদবাবুর কোনও অসুবিধে হল না। গিন্নির কিন্তু কলকাতা শহর ছেড়ে একটুও যাবার ইচ্ছে ছিল না। আত্মীয়স্বজন-বন্ধুবান্ধব-সিনেমা-থিয়েটার ছেড়ে ওই ধ্যাধধেরে পাড়াগাঁয়ে সাধ করে কেউ যায়?
প্রহ্লাদবাবু বললেন, “সারাজীবন কলকাতার দু’কামরা ঘরে কাটিয়েছি। শহর থেকে দূরে এই বাড়িটা কিনলামই তো হাত-পা ছড়িয়ে থাকব বলে। তা ছাড়া অবসর জীবনে সময়-স্বাস্থ্য-টাকা তিনটেরই যখন অভাব নেই তখন যা যা করতে চেয়েছি অথচ করা হয়নি সেগুলো করব। বেড়াব, বাগান করব।”
প্রথম বছরটা গিন্নির মন রাখতে বেড়িয়েই কেটে গেল। ফুলডাঙারই একটা ভ্রমণরসিক দলের সঙ্গে দক্ষিণ ভারত ভ্রমণ করলেন প্রায় একমাস ধরে। ফিরে এসে একটু জিরিয়ে গেলেন হিমালয়ের চার তীর্থ - কেদার-বদ্রী-গঙ্গোত্রী-যমুনোত্রী দর্শনে। এইসব পথে আনন্দ যেমন, পরিশ্রমও তেমন। তবে মনের মতো দলবল ছিল বলে মোটের ওপর ভালোই কেটেছে। ফিরে এসে প্রহ্লাদবাবু বললেন, “একনাগাড়ে ঘুরে ঘুরে আধখানা ভারতবর্ষ দেখে হাঁপিয়ে গেছি। এখন কিছুদিন বেড়ানো বন্ধ।”
প্রহ্লাদবাবু অবশেষে বাগান করায় মন দিলেন। গিন্নির গাছপালায় উৎসাহ নেই বলেই ভেবেছিলেন। কিন্তু ঘাস-আগাছা পরিষ্কার করে মাটি ফেলে জমিটা ধোপদুরস্ত হতেই তিনি তুলসী, জবা, টগর, জুঁই, ধনেপাতা, কাঁচালঙ্কা, লেবু এসবের গাছ লাগিয়ে অনেকটা জমি দখল করে নিলেন।
এরপর পাল্লা দিয়ে চলল স্বামী-স্ত্রীর বাগান করা। এ বলে আমায় দেখ, ও বলে আমায় দেখ।
প্রহ্লাদবাবু জীবনে এত খুশিতে থাকেননি। শেষজীবনে এসে যে স্ত্রীর সঙ্গে মিলেমিশে একইরকম একটা শখের চর্চা এত আনন্দ দিতে পারে তা তিনি জানতেন না। পড়শীরা এসে যখন স্বামী-স্ত্রীর বাগানের প্রশংসা করে তখন গর্বে প্রহ্লাদবাবুর বুক ভরে যায়। শহরে না থাকার দুঃখ গিন্নি প্রায় ভুলে গেছেন বলেই মনে হয়।
বছর ঘুরে গেল। প্রহ্লাদবাবুর বাগান এই তল্লাটের অন্যতম ট্যুরিস্ট অ্যাট্রাকশন হয়ে উঠল। যেমন তরিতরকারি, তেমনই ফল-ফুল। মেয়ে পর্যন্ত এবার দেশে এসে মা-বাবার যৌথ কেরামতি দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল।
বাগান বাগান করে মত্ত থাকায় অনেকদিন বেড়ানো হয়নি। ফুলডাঙ্গার দল এবার অমরনাথ যাবে শুনে গিন্নি একেবারে নেচে উঠলেন। প্রহ্লাদবাবুর বারবার নিষেধ করা সত্ত্বেও তিনি কিছুতেই শুনলেন না। গিন্নি পুরোদমে যাবার তোড়জোড় করছে দেখে তিনি মেয়েকে খবর দিলেন। মেয়ে ফোনে যতটা কাকুতি-মিনতি করা সম্ভব সব করল। গিন্নির এক কথা, “সব তীর্থের সার অমরনাথ। সেখানে যেতে গেলে দলবল লাগে। এ তো আর দিল্লি-বম্বে বেড়ানো নয় যে যখন খুশি গেলেই হল। এ হল অমরনাথ। এমন সুযোগ বারবার আসে না। তাছাড়া এখনও হাঁটু-কোমর ঠিক আছে। এরপর তো আর ওই দুর্গম পথে যেতেই পারব না।”
স্বামী, মেয়ে দু’জনের রাগ-অভিমান, অনুনয়-বিনয় তুচ্ছ করে তিনি যাত্রা করলেন অমরনাথের পথে। আর আশ্চর্য, সবার ভয়-দুশ্চিন্তা নস্যাৎ করে দলটা ভালোভাবেই তীর্থদর্শন শেষে বাড়ির পথ ধরল। যেখানে যেখানে নেটওয়ার্ক পেয়েছেন সেখান থেকে কথা বলে প্রহ্লাদবাবুর দুশ্চিন্তাও দূর করেছেন। পহেলগাঁও পৌঁছনোর আগের দিন গিন্নি খুশি হয়ে ফোন করলেন। “বাসের ড্রাইভার মনসুর লোকটা এত ভালো, আমার গাছের শখ শুনে খুব সুন্দর পাহাড়ি গাছের চারা দিয়েছে যেগুলো গরমেও বেঁচে থাকে। কীভাবে যত্ন নিতে হবে সব বলে দিয়েছে। আমি ওকে বাগান দেখার নেমন্তন্ন করেছি। এই শীতেই ও আসবে আমাদের বাড়ি।”
গিন্নির গলা খুশিতে ঝলমল করছিল। তিনি এও জানালেন, “ঠাণ্ডা একটু কমেছে বলে কাল ভোরবেলাতেই বেরোব। পরশু সকালে প্লেন। আশা করি তার মধ্যে চারাগুলো মরে যাবে না।”
তার পরদিন বাস ছাড়ার কয়েক মিনিট পরই বিরাট বিস্ফোরণে বাসটা উড়ে যায়। কয়েকটা খুনি লোকের পাগলামির জন্য আঠেরোজন নিরীহ লোক তাদের সমস্ত আশা-আকাঙ্ক্ষা অপূর্ণ রেখে মুহূর্তের মধ্যে ছাই হয়ে গেল।
খবরটা ফুলডাঙায় পৌঁছনো মাত্র সারা পাড়ায় শোকের ঝড় বয়ে গেল। সেই বাসে পাড়ারই আরও দু-তিনজন ছিল। কিছুদিন ধরে কাগজে, টেলিভিশনে এই খবর নিয়ে চর্চা হল। নেতারা এসে দেখা করে গেলেন। তারপর আস্তে আস্তে যা হয়, সবাই শোক ভুলে প্রতিদিনের জীবনে ফিরে গেল। শুধু প্রহ্লাদবাবুর মধ্যেই এক বিরাট পরিবর্তন দেখা দিল। সমস্ত কাজকর্ম থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে কেমন যেন জবুথবু হয়ে গেলেন। মেয়ে ছুটি নিয়ে একমাস রইল। বাবাকে নিয়ে যেতে চাইল তার কাছে। কিন্তু একজন বুড়ো মানুষকে তো আর তার অনিচ্ছায় টেনে নিয়ে যাওয়া যায় না। সে জোর করে বাবাকে বাগানে ধরে নিয়ে আসে। অত সাধের বাগানের দিকে তিনি তাকান না পর্যন্ত। অযত্নে, মনোযোগের অভাবে শুকিয়ে গেল প্রহ্লাদবাবুর সাধের বাগান।
রাতে ঘুমোতে পারেন না বলে পায়চারি করেন। সকালে সবাইকে জিজ্ঞেস করেন, “তোমরা কাল রাতে বোমার শব্দ পাওনি?”
রাত হলেই মানুষের আর্তনাদ, বিস্ফোরণের কান ফাটানো শব্দ তাঁকে পাগল করে দেয়। মেয়ে বেশ কয়েকজন ডাক্তারকে দেখাল। নানারকম পরীক্ষা, ওষুধপত্রে কিছুদিন ভালো থাকেন, আবার শুরু হয়। যে রাতগুলোতে এইরকম অস্থির লাগে, তিনি কাউকে বিরক্ত না করে স্টেশনে চলে যান। ছোট্ট স্টেশনটাতে বসে ট্রেনের আসার জন্য অপেক্ষা করা, ট্রেন কখন স্টেশন ছেড়ে চলে যাচ্ছে এসব দেখতে দেখতে সময়টা কোনওরকমে কাটিয়ে দেওয়া।
বাবার রকমসকম দেখে মেয়ে আবার দৌড়োয় ডাক্তারের কাছে। বিচক্ষণ ডাক্তারবাবু বলেন, “দেখুন, লাগাতার ওষুধ খাওয়া কোনও কাজের কথা নয়। আপনার বাবার তো কোনও অসুখ করেনি। আচমকা একটা শক পেয়েছেন। সেটা কাটিয়ে উঠতে পারছেন না।”
“কিন্তু আমাকে তো ফিরতে হবে। এই অবস্থায় ওঁকে কী করে একলা রেখে যাই?”
“সেটাই পয়েন্ট। উনি একেবারে একলা। কারও জন্য কিছু করার নেই। একটা কোনও দায়িত্ব থাকলে মানুষ আপনা থেকেই একটু অ্যালার্ট হয়ে যায়।”
“বাগানে জল-টল দেবার দায়িত্ব তো ছিল। এখন সেসব কিছুই করছেন না।”
“দেখুন, গাছের প্রাণ থাকলেও না খেতে দিলে তো চেঁচামেচি করে না। উপকার হবে কি না জানি না, আমি কিন্তু জীবন্ত কোনও পোষ্যের কথা ভাবছিলাম। ধরুন, কুকুরছানা। তারা ছোটাছুটি করবে। চোখের সামনে বড়ো হবে। জ্বালাতন করবে, আবার আনন্দও দেবে।”
মেয়ের মনঃপূত হল কথাটা। সে একেবারে দুটি অ্যালসেশিয়ানের বাচ্চা কিনে নিয়ে এল। প্রহ্লাদবাবুর কোনও আপত্তি না শুনে বাবার ঘরেই কুকুরদের ঘুমোবার বিছানা পেতে দিল। তারা কখন কী খাবে, কবে ওষুধ-ইনজেকশন নেবে সমস্ত ডায়েরিতে বিস্তারিত লিখে বাবাকে বুঝিয়ে সে ফিরে গেল নিজের জায়গায়।
প্রহ্লাদবাবু অগত্যা প্রথমে বিরাগ নিয়ে, তারপর কোনওরকমে কুকুরের দায়িত্ব পালন করতে লাগলেন। মেয়ে ফোন করলে তাঁর প্রথম কাজ হল সে যে কী বিপদে ওঁকে ফেলে গেছে এইটা নিয়ে অভিযোগ করা। তারপর আস্তে আস্তে প্রহ্লাদবাবুর সুর বদলাতে লাগল। অভিযোগ করার বদলে মেয়েকে পোষ্যদের দস্যিপনার গল্পই করতে লাগলেন বেশি করে। ভাব করেন যেন কত বিরক্ত, এদিকে গলার স্বরে খুশির ভাবটা মেয়ে ঠিকই টের পায়।
ক্রমশ প্রহ্লাদবাবু ফিরে এলেন তাঁর জীবনের পুরনো ছন্দে। পাড়াপড়শিদের ডাক-খোঁজ, বাগানের যত্ন নেওয়া আস্তে আস্তে সবই শুরু হল। শুধু বেড়াতে যাবার অনুরোধ বিনীতভাবে প্রত্যাখ্যান করেন পোষ্যদের দোহাই দিয়ে - কী করে যাই বলুন? এদের কার কাছে রেখে যাব ইত্যাদি ইত্যাদি। কেউ দায়িত্ব নিতে চাইলেও নানা অজুহাতে এড়িয়ে যান। আর এখনও মাঝে মাঝে রাত হলে স্টেশনে গিয়ে বসে থাকেন। তবে এখন আর একা নন। দু’পাশে দুই পুষ্যি স্থির হয়ে বসে থাকে যতক্ষণ তিনি থাকেন।
এইরকমই এক রাতে স্টেশনের বেঞ্চিতে বসে আছেন আর ভাবছেন, মেল ট্রেনটা চলে গেলেই বাড়ির পথ ধরবেন। রাত হলেও ভয়ের কিছু নেই। ফুলডাঙা সবদিক দিয়েই নিরাপদ। তার ওপর তার সঙ্গে আছে দুই পাহারাদার।
ঝিরিঝিরি হাওয়া দিচ্ছে। আরামে চোখটা লেগে এসেছে। হঠাৎ দুই পোষ্যর ডাকাডাকি, জামা ধরে টানাটানিতে চটকা ভেঙে গেল প্রহ্লাদবাবুর। ওরা তাকে যেদিকে টানছে সেদিকে তাকিয়ে দেখলেন একটি কিশোর ছেলের আবছা শরীর। স্টেশনের একদম শেষ বেঞ্চিতে পা তুলে হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে আছে। প্রহ্লাদবাবু খুবই অবাক হলেন। এত রাতে এই ছোটো স্টেশনে কোনও ট্রেন থামে না। এই ছেলেটা কী করছে এখানে? সঙ্গে কোনও লোকও তো নেই।
প্রহ্লাদবাবু একটু অবাক হয়েই এগিয়ে গেলেন। ছেলেটি বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিল। তিনি আলতো করে কাঁধে হাত রাখা মাত্রই সে ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াল। চোখে আতঙ্ক। গালের ওপর জলের দাগ শুকিয়ে আছে। ঘুমের মধ্যেই নিশ্চয়ই কাঁদছিল ছেলেটা। প্রহ্লাদবাবুর বুকটা টনটন করে উঠল। কতই বা বয়স, তের-চোদ্দর বেশি হবে না। ধবধবে ফর্সা রং। তীক্ষ্ণ নাক। নীলচে চোখ। মাথায় ফেজ টুপি, চোখে সুর্মা। পরনে পাজামা-কুর্তা। তিনি নরম গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “বেটা, কী হয়েছে তোমার? তোমার সঙ্গে কোনও লোক নেই কেন? আমাকে খুলে বলো। আমি তোমাকে সাহায্য করব।”
এটুকু আশ্বাসেই ছেলেটি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে যা বলল তার মর্ম হচ্ছে - প্রত্যেক বছর শীতে তার আব্বু শাল, জাফরান, আখরোট, বাদাম বিক্রি করতে আসে এখানে। তার মা মারা গেছে গতবছর। তাই আব্বু এ-বছর তাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছে। তারা শাল বিক্রি করতে এসেছিল এদিকে। সে জায়গাটার নাম জানে না। সারাদিন বিক্রিবাট্টার পর বিকেলে ট্রেন ধরার সময় কতগুলো লোক কিছুতেই তাদের ট্রেনে উঠতে দিল না। পরের ট্রেন ধরতে রাত হল। কামরায় বেশি লোক ছিল না। হঠাৎ আলো নিভে গেল। মুখে কাপড় জড়ানো কতগুলো লোক একমিনিটের মধ্যে আব্বুর টাকাপয়সা, জিনিসপত্র সব কেড়ে নিল। আব্বু দেবে না বলে ওদের সঙ্গে মারামারি করছিল। অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। ট্রেন থামলে পর আলো জ্বলল। তখন দেখা গেল, আব্বুও নেই, লোকগুলোও নেই। যারা বসেছিল তারা বলল, পুলিশ ঝামেলা করবে। সামনের স্টেশনে নেমে যাও। তাই সে এই স্টেশনে নেমে পড়েছে। তার কাছে কোনও পয়সা নেই। ভাষা জানে না। কাউকে চেনে না। কোথায় যাবে, কী করবে জানে না।
ছেলেটির কথা শুনে প্রহ্লাদবাবুর চোখে জল এল। মানুষ কী করে এত নিষ্ঠুর হয় তিনি বুঝতে পারেন না। তিনি তার মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞেস করলেন, “কিছু খাবে? খিদে পেয়েছে?”
ছেলেটি চোখে জল নিয়েই ঘাড় নাড়ল। প্রহ্লাদবাবু আদর করে তার হাত ধরে নিয়ে চললেন নিজের বাড়ির দিকে। মনে মনে বললেন, ‘একজন আসছিল তোর দেশের চারা গাছ নিয়ে। সে পৌঁছতে পারেনি। আজ আমার কাছে নিজে থেকেই পৌঁছে গেল সেই কচি কিশলয়। দেখি এই গরমের জায়গায় তাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারি কি না।’
দুই প্রান্তের দুটি অসমবয়সী মানুষকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল মানুষের সবথেকে কাছের এবং প্রিয় দুটি মনুষ্যেতর প্রাণী।
_____
অলঙ্করণঃ সুমন দাস
Great post and success for you..
ReplyDeleteKontraktor Pameran
Jasa Dekorasi Booth Pameran
Kontraktor Booth Pameran
Jasa Pembuatan Booth