ফিরে দেখা গল্প
এক গ্রামে এক বুড়ো থাকত। বুড়ো কানে কম শুনত, চোখেও তার ছানি পড়েছে। আর তার মেজাজ ছিল বেজায় খিটখিটে। বাড়ির লোক আর গ্রামের লোকের সঙ্গে সবসময়ই তার খিটিরমিটির লেগে থাকত।
বুড়োর বাড়িতে ছিল তার বুড়ি, ছেলে, ছেলের বউ আর দুই নাতি-নাতনি। কিছু জমিজমা ছিল, বুড়োর ছেলে তাতে চাষবাস করত। চাষবাস করেই সংসার চলত তাদের।
রোজ সকালবেলা বুড়ো জলখাবার খেয়ে বুড়ির সঙ্গে খুব একচোট ঝগড়া করে নিত। তারপর বাড়ি থেকে রেগেমেগে বেরিয়ে যেত। গ্রামের কালীমন্দিরের পাশে একটা বকুলগাছের তলায় গোঁজ হয়ে বসে হুঁকো টানত। বুড়োর ছেলে ভোর থেকে খেটে পরিশ্রম করত। দুপুরবেলা বাড়ি ফেরার পথে রোজ বকুলতলা থেকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে বুড়োকে বাড়ি নিয়ে আসত। হাজার হোক, ছেলের পরিশ্রমেই সংসার চলে। তাই বুড়ো ছেলের সঙ্গে বিশেষ ঝামেলা করত না।
বাড়ি ফিরে বুড়ো স্নান-খাওয়া সেরে একটু ঘুমিয়ে নিত; ছেলে ফের চলে যেত মাঠে। তারপর রোদ একটু পড়লে একটা লাঠি হাতে ঠুক ঠুক করতে করতে বেরিয়ে পড়ত বুড়ো। হাঁটতে হাঁটতে চলে যেত নদীর ধারে। সারা বিকেল সেখানে বসে থেকে সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরত।
একদিন সকালবেলা বুড়ির সঙ্গে ঝগড়াটা একটু বেশিই হল। জলখাবারের মুড়ির বাটি ছুড়ে ফেলে দিয়ে বুড়ো লাঠি হাতে বেরিয়ে পড়ল বাড়ি ছেড়ে। বকুলতলায় গোঁজ হয়ে বসে রইল দু’ঘন্টা। আজ আর সে কিছুতেই বাড়ি ফিরবে না। পাছে ছেলে এসে তাকে ফের ভুলিয়ে-ভালিয়ে বাড়ি নিয়ে যায়, তাই সে দুপুরবেলাই হাঁটা দিল নদীর দিকে। মাথার ওপর তখন গনগনে রোদ। তার ওপর বুড়োর মাথা তখন এমনিতেই গরম। নদীর কাছে পৌঁছে তার মাথা ঘুরতে লাগল। তারপর একটা পাথরে হোঁচট খেয়েই চোখে অন্ধকার দেখল বুড়ো। মনে হল আকাশ অন্ধকার করে ধুলোর ঝড় উঠেছে। শোঁ শোঁ শব্দ করে হাওয়া শুকনো পাতা নিয়ে বুড়োর চারদিকে ঘুরপাক খাচ্ছে। সূর্যটা অসম্ভব বড়ো হয়ে গেছে, প্রচণ্ড তার তেজ, আর সূর্যের মাঝখানে ঘন কালো একটা গহ্বর।
একটু একটু করে চোখটা সয়ে আসতে বুড়ো দেখল, তার সামনে একটা কালো মুশকোমতো লোক দাঁড়িয়ে আছে। প্রকাণ্ড তার চেহারা। চোখদুটো ভাঁটার মতো লাল, আর তার দুই কান আর নাকের ফুটো দিয়ে ধোঁয়া বেরোচ্ছে।
বুড়োর মেজাজ তখন বেজায় গরম। সামনে এরকম একটা লোককে পথ আগলে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বুড়ো তিরিক্ষিভাবে জিজ্ঞেস করল, “তুই কে রে?”
লোকটা বলল, “আমি যমরাজ। তোমায় নিয়ে যেতে এসেছি।”
“নিয়ে যেতে মানে? কোথায় নিয়ে যাবি?”
“দেখো, ওই ঘাটে নৌকো বেঁধে এসেছি। উঠে পড়ো গিয়ে চটপট। তারপর স্বর্গে যাবে না নরকে, সে বিচার পরে হবে।”
“তুই বললেই আমায় যেতে হবে নাকি? আমি কোথাও যাব না।”
“শোনো বুড়ো, পৃথিবীর মেয়াদ তোমার শেষ। যেতে তোমায় হবেই। তাছাড়া তুমি তো আর বাড়ি ফিরবে না বলেই বেরিয়েছ।”
“আমি কোথায় যাব না যাব, বাড়ি ফিরব কি ফিরব না, তা তুই ঠিক করার কে? অবশ্য দু-তিনদিন ঘুরে এলে মন্দ হয় না, বুড়িকে উচিত শিক্ষা দেওয়া যাবে। এই ঘাটে আবার ফিরিয়ে দিয়ে যাবি তো?”
“সে হবে না বুড়ো। একবার পৃথিবী ছেড়ে গেলে আর কেউ ফেরে না। একেবারে মায়া কাটিয়ে যেতে হয়। নাও, চলো তাড়াতাড়ি।”
“তাহলে আমি কোত্থাও যাব না। এইখানেই বসে থাকব। উনি বললেন, আর অমনি আমায় ড্যাং ড্যাং করে ওঁর সঙ্গে যেতে হবে! ঈশশ্! যা, ভাগ হতভাগা।”
বুড়োর কথা শুনে যমরাজের নাক-কান দিয়ে ধোঁয়া বেরোনো বন্ধ হয়ে গেল। চোখদুটোও সাদা হয়ে গেল। এ তো ভারি ফ্যাসাদে পড়া গেল! মাথা-টাথা চুলকে বুড়োকে সে বলল, “দেখো বুড়ো, সবাইকেই তো একদিন না একদিন পৃথিবী ছেড়ে যেতে হয়। তোমার বয়স তো আশি বছর হল। আর কতদিন থাকবে এখানে? এতদিন তো কাটালে পৃথিবীতে, এখনও শখ মেটেনি?”
বুড়ো নদীর ধারে গ্যাঁট হয়ে বসে বলল, “বুঝেছি, তুই আমায় মরে যেতে বলছিস। আমি এখন মরব না। আমি একশো বছর বাঁচব।”
“সেরেছে! বেশ, আশি বছর তো এখানে বাঁচলে, আমার সঙ্গে স্বর্গে চলো, বাকি কুড়ি বছর নয় সেখানে বাঁচবে।”
“ঈশ, মামার বাড়ি আর কি! তোদের স্বর্গের বা নরকের কী ব্যবস্থা সে আমার জানা নেই। কী খেতে দিবি, কোথায় রাখবি কে জানে! না না, তার চেয়ে এই গ্রামেই আমি বেশ আছি। কুড়ি বছর পরে আসিস। তখন না হয় ভেবে দেখা যাবে।”
“এই গ্রাম তো জন্ম থেকে দেখছ, আর কত দেখবে? তাছাড়া তুমি চোখেও ভালো দেখো না, কানেও ভালো শোনো না। চাষবাসও তো করতে পার না! বাড়ির কাজকর্মও করো না। তোমার পৃথিবীতে থাকার দরকারটা কী শুনি?”
“আমার দরকার আমি বুঝব। কানের গোড়ায় ভ্যানর ভ্যানর করিস না আর, যা পালা।”
“সে হবে না বুড়ো। যেতে তোমায় হবেই। আমি যে খাতায় টিক মেরে বেরিয়েছি। তোমায় আজ নিয়ে না গেলে তো হিসেব মিলবে না।”
“বললাম তো, আমি আরও কুড়ি বছর বাঁচব। আমাকেই নিয়ে যেতে হবে তার কী মানে আছে? হিসেব মেলাতে হয় তো অন্য কাউকে ধরে নিয়ে যা। দুনিয়ায় লোক কি কম আছে?”
“দেখো বুড়ো, আমার খাতায় পৃথিবীর সবার আয়ুর হিসেব বাঁধা। তোমায় যদি আরও কুড়ি বছর আয়ু দিতে হয়, অন্য কারও আয়ু থেকে কুড়ি বছর কেটে নিতে হবে। সেটা কি খুব ভালো হবে? যার আয়ু কাটব সে বেচারা তো কোনও দোষ করেনি। তুমি তো মহা স্বার্থপর দেখছি বুড়ো।”
“সে তুই কী করবি না করবি তোর ব্যাপার। আমি কী জানি? ফের যদি ঘ্যানর ঘ্যানর করবি তো এই লাঠিগাছা তোর পিঠে ভাঙব।”
এই বলে বুড়ো লাঠি বাগিয়ে তেড়ে গেল যমরাজের দিকে। যমরাজ দেখল, বুড়ো মহা ত্যাঁদড়! এর পেছনে সময় নষ্ট করার আর মানে হয় না। অগত্যা সে হাঁটা দিল গ্রামের দিকে। তার নৌকো ঘাটে বাঁধা রইল।
যমরাজ চলে যাবার পর বুড়ো স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। জোর বাঁচা বাঁচা গেছে আজ! যাক, এখন আর ভয় নেই। কুড়ি বছর নিশ্চিন্ত। হাতের লাঠি ছুড়ে নদীতে ফেলে দিল সে। হাতদুটো বারকতক আকাশে ছুড়ে শরীরের খিলটা ভেঙে নিল। তারপর হনহন করে নদীর ধারে বার দশেক পায়চারি করে নিল। দেহে-মনে যেন নতুন বল পাচ্ছে বুড়ো। ফের যেন জোয়ান হয়ে গেছে সে।
রোদ পড়ে আসছে দেখে তারপর গ্রামের দিকে হাঁটা দিল বুড়ো। লাঠি ছাড়াই সে তখন টানটান। লম্বা লম্বা পা ফেলে চলল সে। রাস্তার খানাখন্দ, ইট-পাটকেল লাফিয়ে ডিঙিয়ে গেল। হোঁচট খেয়ে পড়লেই বা কী হয়েছে, মরছে তো আর না! বুড়োর প্রাণে তাই আর কোনও ভয়ডর নেই।
বাড়ির সামনে পৌঁছে বুড়ো একটু থমকে গেল। উঠোনে এত লোকের জটলা কীসের? বাড়ির ভেতর থেকে কান্নার রোল ভেসে আসছে কেন? ভিড়ের মধ্য থেকে শ্রীনাথখুড়ো এগিয়ে এসে বলল, “আরে বুড়ো, তুমি কোথায় ছিলে এতক্ষণ? এদিকে যে সর্বনাশ হয়ে গেল! তোমার ছেলে দুপুরবেলা বাড়ি ফিরল না দেখে রাধেরা খুঁজতে গিয়েছিল মাঠে। গিয়ে দেখে সাপের কামড়ে নীল হয়ে আলের পাশে মরে পড়ে আছে। এই তো একটু আগে কাঁধে করে নিয়ে এল। উঠোনে শোয়ানো আছে। যাও, ভেতরে যাও।”
বুড়ো হন্তদন্ত হয়ে ভিড় ঠেলে উঠোনের মাঝখানে এসে দাঁড়াল। ছেলের শায়িত মৃতদেহের দিকে দেখল একবার। তারপর পেছন ফিরে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড় দিল নদীর দিকে। হোঁচট খেতে খেতে, পড়তে পড়তে, সামলাতে সামলাতে বুড়ো দৌড়ে চলল। আর চিৎকার করে বলতে লাগল, “ওরে যমরাজ, তুই যাস না। একটু দাঁড়া বাবা। আমি আসছি। আমার ছেলেকে তুই ফিরিয়ে দে বাবা। ওকে নিয়ে যাস না।”
নদীর ধারে পৌঁছে বুড়ো দেখল, কোথায় যমরাজ, কোথায় কী! ঘাট শূন্য। সন্ধের অন্ধকারে পুবের হাওয়ায় ফুলে ওঠা নদীর ঢেউ ছলাৎ ছলাৎ করে শূন্য ঘাটে আছড়ে পড়ছে। বুড়ো ধপ করে নদীর ঘাটে বসে পড়ল।
সেই যে বুড়ো নদীর ঘাটে বসল, আর উঠল না। গ্রামের লোকে বলে, একটানা কুড়ি বছর সে নাকি অমনিভাবে বসে ছিল। তার চুলের জটা লম্বা হয়ে মাটি অবধি পৌঁছেছিল। শরীর হয়ে গেছিল পাথরের মতো শক্ত আর কালো। তার কাঁধের ওপর থেকে অশথগাছের চারা বেরিয়েছিল। শ্বাসপ্রশ্বাস কিন্তু ঠিকই চলছিল তার। আর চোখ চেয়ে ছিল নদীর দিকে, যমরাজের আশায়।
তারপর... কুড়ি বছর পর... নদীতে একদিন ভয়ানক বান এল। কূল ছাপিয়ে বানের জল বুড়োকে ভাসিয়ে নিয়ে চলে গেল সাগরের দিকে।
_____
অঙ্কনশিল্পীঃ অরিজিত ঘোষ
upokothati khub e dookher
ReplyDeleteprosenjit
খুব ভালো লাগলো। শিক্ষামূলক গল্প
ReplyDeleteআমাদের দেশে এমন গল্প সচরাচর লেখা হয় না। খুব সুন্দর!
ReplyDeleteভীষণ ভাল লাগল
ReplyDeleteKhub bhalo laglo
ReplyDelete