খাবারটা শেষ করে সবে জলের গ্লাসের দিকে হাত বাড়িয়েছি। আমার সহধর্মিণী বেলার যথারীতি প্রশ্ন, “কী খেলে বলো তো?”
নিয়মমাফিক নিষ্ফল চেষ্টা দেখালাম একটু। ইতস্তত করে বললাম, “গরম পরোটার সঙ্গে দারুণ জমেছিল কিন্তু।”
তারিফ পাওয়ার ব্যাপারটা বেলার কাছে প্রাত্যহিক ব্যাপার। তবুও এসব তার কাছে খুবই উপভোগ্য। দিগবিজয়ী হাসি ঠোঁটে ফুটিয়ে সে বলে উঠল, “বলতে পারলে না তো!”
একটু সময়ের অপেক্ষা, তারপরেই আবার রহস্যভেদের ভঙ্গি, “চিকেন চিচিঙ্গা।”
“মানে!” বিষম খেলাম প্রায়।
“চিকেনের সাথে চিচিঙ্গার প্রিপারেশন।”
“ইউনিক! ফাইন!” সামাল দিলাম উচ্ছ্বসিত হয়ে। “তোমার রেসিপি?”
“হ্যাঁ।” গর্বিত কণ্ঠস্বর বেলার, “একটা নতুন এক্সপেরিমেন্ট।”
এই নিত্যনতুন রান্নার এক্সপেরিমেন্টের চাপেই এখন আমার হাল ত্রাহি মধুসূদন।
আমার বাড়ির রান্নাঘরটিকে কোনও হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলের কেমিস্ট্রি ল্যাবরেটরির সঙ্গে তুলনা করলে কোনও ভদ্রজন আশ্চর্য হবেন না। কী নেই সেখানে? বার্নার, কুকার, মিক্সার, রেফ্রিজারেটরের মতো সাজসরঞ্জামে বোঝাই। পোর্সেলিন, অ্যাকোলাইট, স্টিল, কাচের ডিশ-প্লেট-গ্লাস। বাদশাহি, চাইনিজ, দক্ষিণী, পশ্চিমি প্রভৃতি দিগ্বিদিকের স্বীকৃত রান্নার মশলাপাতি।
শুধু রাঁধলেই কেউ রন্ধন পটীয়সী হন! যদি না পরখ করার মতো সমঝদার গুণগ্রাহী থাকে! তারও আছে। প্রথমটায় ছিলাম একা আমি। এখন অগুনতি।
শুধু একটুকু পরিধির মধ্যেই এখন আর আবদ্ধ নেই বেলার গুণপনা। তার রন্ধন-খ্যাতির এখন বিশাল ব্যাপ্তি। বিভিন্ন সাময়িক পত্রপত্রিকায় ছাপা হচ্ছে এখন তার পাঠানো রান্নার রেসিপি।
আহা বেচারা! এই নিয়ে মেতে আছে, থাক। এটাই তো ওর হবি। আমার যে হবিーএকটু আধটু লেখা-টেখা। ও কি বাধা দেয়? সুতরাং ওর উৎসাহে আমার বাধাদানের প্রশ্নও নেই। আমার বিড়ম্বনা বলতে ওই লাগামছাড়া অর্থব্যয়। তা যাক গে।
যাই হোক, চিকেন-চিচিঙ্গে শেষ করে গতদিনের সম্পূর্ণ না হওয়া একটা গল্পের পরবর্তী অংশটা শুরু করার ইচ্ছেয় সবে বসেছি লেখার টেবিলে, আবার বেলার আবির্ভাব। একহাতে চায়ের কাপ, অন্য হাতে একটা সুদৃশ্য সাদা খাম। আদুরে গলার অনুরোধ, আদুরে ভঙ্গিতেই মেলে ধরলাম খামটা। বড়ো বড়ো হরফে লেখাーপ্রেস ফটো, আর্জেন্ট। ডোন্ট ফোল্ড।
মনে পড়ল, দিন তিনেক আগেই বাড়িতে এসেছিলেন একটা বিখ্যাত বাংলা দৈনিকের এক চিত্র-সাংবাদিক। তাঁদের পত্রিকার ম্যাগাজিন পেজে নাকি খুব শীগগিরই যাচ্ছে ‘বেলাদেবীর সচিত্র বিচিত্র রন্ধন’।
উৎসাহের সঙ্গে ছবিগুলো বের করলাম। আহা! প্রথমটিই আমার সহধর্মিণীর কোমরে আঁচল জড়ানো চোখ জুড়নো ছবি। কী মেক-আপ! কী ড্রেস! চতুর্দিকে ছড়ানো ছেটানো তার সন্তানসন্ততি, মানে বার্নার, কুকার, মিক্সার-টিক্সার এইসব আর কী। আর ছবিগুলো ওইসব পদের। কোনওটা কলাপাতায়, কোনওটা প্লেটে, কোনওটা প্যানে। কী কারিকুরি, কী কায়দা, কী বাহার!
“অপূর্ব!” তারিফ করলাম। “ওরা দিয়ে গেল?”
“হ্যাঁ, প্রিন্ট হওয়ার আগে আমি একবার দেখব বলেছিলাম। আর আইটেমগুলোর নামকরণও বাকি। কাল অবশ্য সব পৌঁছে দেওয়ার কথা।”
“কাল পৌঁছে দেবে কে!” অবাক হয়ে বলি। “কাল ভোরবেলার ট্রেনেই তো তোমার বাপের বাড়ি যাবার কথা!”
“কাউকে দিয়ে দিও না গো পাঠিয়ে। নইলে পরের সপ্তাহে ছাপবে না।”
ঢেঁকি গিলতে হল অগত্যা। “বেশ, দেখা যাবে। তোমার যা কাজ বাকি সেরে রাখো এখন।”
বেলা কিন্তু তবুও নড়ল না। আমার চেয়ারের হাতলে সে বসে। এবার তার হাতের আঙুল আমার মাথায় বিলি কাটতে লাগল। লেখায় মন দিতে না পেরে এবার একটু বিরক্ত হলাম। “কী ব্যাপার?”
“দাও না গো আইটেমগুলোর জুতসই নাম ঠিক করে।”
“আমি!” চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠলাম। “আরে বাবা, এসব ব্যাপারে আমার কোনও ধারণাই নেই। আমাকে খেতে দাও, আমি খাই। খেয়ে ভালোমন্দ মন্তব্যও করতে পারি। কিন্তু এসবের নাম-টাম ঠিক করতে দেওয়া আর আমাকে ফাঁসি দেওয়া একই ব্যাপার।”
বেলাও নাছোড়। “দেখো, এত বড়ো কাগজে এই প্রথম সুযোগ। কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে বলো তো! রঙিন ছবি ছাপছে কতগুলো! বায়োডাটা দিচ্ছে আমার। সেজন্য রান্না শুধু চমকদার হলেই চলবে না, নামও চাই চমকপ্রদ। তাই তোমাকে বলা।”
বেলা থামল। উত্তরে আমি নীরব।
কিছুক্ষণের স্তব্ধতা। তারপরই হঠাৎ ‘ফ্যাঁচ’। শেষ অস্ত্র ছেড়েছে বেলা।
ঠিক হল, এখন আমার অসমাপ্ত গল্পের অবশিষ্টাংশতেই মনোনিবেশ করব আমি। বেলার কাজটা করব ধীরেসুস্থে আগামীকাল।
দিন কয়েক পরেই সেই দৈনিকে বেরিয়ে গেল বেলার আর্টিকেল। সকালে খবরের কাগজের পৃষ্ঠা ওলটাতে-ওলটাতেই আবিষ্কার করলাম। রীতিমতো রোমাঞ্চকর অবস্থা আমার। নিজের গল্প প্রকাশ হতে দেখেও এই অনুভূতি হয়নি কখনও। বারবার করে দেখলাম ছবিগুলো, পড়লামও বেশ কয়েকবার।
খুব মনে পড়তে লাগল বেলাকে। কাছে নেই বেচারা। দিন কয়েকের জন্য গেছে বাপের বাড়ি দুর্গাপুরে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পেয়ে যাবে আজকের দৈনিক নিশ্চয়। খুব খুশি হবে। আর আনন্দিতও হবে ওর রেসিপির নামকরণ করে যথাস্থানে পৌঁছে দিয়েছি জেনে।
সারাদিন অফিস জুড়ে হইচই। সহকর্মীরা অনেকেই মুগ্ধ ব্যাপারটায়।
চমক ছিল রাতে, বাড়িতে। নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই বেলা ফিরে এসেছে। ঘাবড়ে গেলাম। “কী ব্যাপার?”
“কী করেছ এসব?” কৈফিয়ত তলব করে রংবাহারি পাতাটি আমার চোখের সামনে এগিয়ে দিল সে।
“কী করেছি?”
“আমার অত সুন্দর কিমা স্পেশালের নাম তুমি কী দিয়েছ? লঙ্কাকাণ্ড!”
“ও ওটা কিমা স্পেশাল! বুঝতে পারিনি। ছবিতে চারপাশে অত কাঁচালঙ্কা দেখে ওই নামটাই জুতসই মনে হয়েছে।”
“আর এটার নাম দিয়েছ চিনে-চিংড়ি!” সিংহীর গর্জন বেলার কণ্ঠে। “চাইনিজ মশলা ছিল কোথাও, লিস্টে?”
“সেজন্য তো এ নাম নয়। এ নাম চিনেমাটির প্লেটে চিংড়ি দেখে।”
রাগে চোখ যেন ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে বেলার। “আর এই চামচ-পোস্তটা কী? তোমার মাথা?”
“এভাবে কথা বলছ কেন!” আশ্চর্য হই। “পোস্ত ছড়ানো কলাপাতার মাঝখানে এক পেল্লায় চামচ। এছাড়া আর চমকদার নাম কী হতে পারে এটার!”
ধপাস করে বেলা বসে পড়ল বিছানার ওপর। মুখে কথা সরল না তার। এই সুযোগে শেষ পদটির নামেরও ব্যাখ্যা রাখলাম আমি। “একই কারণে রুমালের ওপর সাজানো ইলিশ দেখে তার নাম দিয়েছি রুমাল ইলিশ। কী, জুতসই হয়নি?”
_____
Hats off .....sanjay bandyopadhyay
ReplyDelete