আছে হুঁশ না হই মানুষ
অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রথম পর্ব
বুদ্ধি বলতে আমরা কী বুঝি? একটা কঠিন অঙ্ক চোখের নিমেষে সমাধান করে ফেলা, নাকি ঝট করে একটা ঝকঝকে প্রবন্ধ লিখে ফেলতে পারবার ক্ষমতাই বুদ্ধি নির্ধারণের একমাত্র উপায়? সম্ভবত এই প্রশ্নের উত্তর ‘হ্যাঁ’ ভেবে নিয়েই আমরা বলি, ‘প্রাণীদের মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তিতে মানুষই সবচাইতে উন্নত শ্রেণীর।’
কোনও কোনও জীববিজ্ঞানী জানিয়েছেন, মাথার ওজন আর শরীরের ওজনের অনুপাত মানুষের ক্ষেত্রে অন্য যেকোনও প্রাণীর চাইতে বেশি হওয়ায় সে বেশি বুদ্ধিমান। কিন্তু বুদ্ধির সাথে মাথা-শরীরের অনুপাতের এই সরল হিসেব অনেক প্রাণীবিজ্ঞানী মেনে নিতে পারেন না। তাঁদের কারও কারও মতে, প্রাণীদের বুদ্ধি মানুষের চাইতে শুধু বেশি তাই নয়, অনেক গুণে বেশি।
চটজলদি সমস্যার সমাধান করে ফেলাই বুদ্ধিবৃত্তি বিকাশের লক্ষণ বলে ধরে নেওয়া যায়, নাকি বুদ্ধি বলতে সাধারণত আমরা যা বুঝি তার চাইতেও বিষয়টি আরও জটিল? বর্তমানের শিক্ষিত মানব সমাজ জ্যোতির্পদার্থবিদ প্রফেসর স্টিফেন হকিংকে পৃথিবীর সবাচাইতে বুদ্ধিমান ব্যক্তি হিসাবে আখ্যা দিয়েছে। তিনি বলতেন, প্রকৃতির সাথে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতাই হচ্ছে বুদ্ধির একমাত্র মাপকাঠি। তাই তিনি বিশ্বাস করতেন, এই ব্রহ্মাণ্ডে মানুষের চাইতে উন্নত জীবের সন্ধান পাওয়ার সম্ভবনা প্রবল। মানুষের বুদ্ধিশুদ্ধি নিয়ে কম রসিকতা করে যাননি ভদ্রলোক।
কেউ যদি খুব ঝটপট কোনও প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে বা নিমেষে অঙ্ক কষে দিয়ে তাক লাগিয়ে দিতে পারে, তখন আমরা বলি, ‘দেখেছ, মানুষটার কী বুদ্ধি! একেবারে যেন কম্পিউটার!’ সবেগে কাজ করবার কম্পিউটারের এই যে ক্ষমতা, তাকে কিন্তু বুদ্ধি বলা ঠিক হবে না। কম্পিউটারের সব তথ্য মনে রাখার ও দ্রুতবেগে কাজ করবার বিশেষ ক্ষমতা আছে, যা মানুষ তাকে শিখিয়ে পড়িয়ে রেখেছে আগে থেকে, যাকে আমরা বলি প্রোগ্রামিং। শেখানো বুলি আওড়ানো কখনওই বুদ্ধির প্রমাণ দেয় না। নিজে থেকে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে তাকে বুদ্ধিমান বলে স্বীকৃতি দিতে আমরা নারাজ। যদিও নিজে থেকে সিদ্ধান্ত নিতে পারবার মতো কম্পিউটার বানাবার কাজ বিজ্ঞানীরা শুরু করে দিয়েছেন, যাকে বলা হয় আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স।
এই প্রবন্ধে আলোচনা করব প্রাণীদের বুদ্ধিবৃত্তি নিয়ে। ডুব দেব প্রকৃতির সাথে তাল মিলিয়ে চলবার প্রাণীদের সহজাত ক্ষমতা পরখ করতে। এবার ডলফিনদের মতিগতি বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করা যাক। দেখা যাক তাদের বুদ্ধিশুদ্ধির দৌড়।
ডলফিনের দুনিয়া
বিশেষজ্ঞদের অনেকের মতে, মানুষের পর সবচাইতে বুদ্ধিমান প্রাণী হল ডলফিন। মাথা ও শরীরের ওজনের অনুপাতে মানুষের পর দু’নম্বর স্থানে আছে ডলফিন। কিন্তু তাদের বুদ্ধি মানুষের চাইতে এক ধাপ কম কি না, তা আজও জানা যায়নি ঠিকভাবে। তাদের সাথে মানুষের যেটুকু সময়ের মেলামেশা, সেটা ডলফিনদের বুদ্ধি যাচাই করবার জন্য আদৌ যথেষ্ট নয়। মানুষ আর ডলফিনের ভাষা তো আর এক নয় যে সহজেই তাদের বোঝা যাবে। তবে প্রাণীবিজ্ঞানীরা প্রায় সত্তর-আশি বছর ধরে ডলফিনদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে চলেছেন তাদের জানা ও চেনার জন্য। ভাষার ব্যবধান কাটিয়ে তাদের বুদ্ধি মাপতে ব্যবহার করেছেন নিত্যনতুন পদ্ধতি। তবুও যেন রহস্যের আড়ালে তারা ঢেকে রেখেছে নিজেদের। তবে ডলফিনদের জীবন নিয়ে মানুষের কৌতূহল সারা পৃথিবী জুড়ে জন্ম দিয়েছে নানা গল্পগাথা।
ডলফিন মানুষের মতোই স্তন্যপায়ী জীব, মানে তারা জন্মাবার পর মায়ের দুধ খেয়ে বড়ো হয়। প্রধানত এরা জলে থাকে। কিন্তু শ্বাস নেবার জন্য জলের উপরে উঠে আসতে তারা বাধ্য। মাছ যেমন জলে গুলে থাকা অক্সিজেন কানকোর সাহায্যে শুষে নিতে পারে, ডলফিন তেমন পারে না। এর কারণ, প্রকৃতি ডলফিনকে কানকো দেয়নি। কানকোর জায়গায় আছে বিরাট বিরাট দুটো শ্বাস নেবার গর্ত, যাকে ইংরেজিতে বলা হয় ‘ব্রিদিং হোল’ বা ‘ব্লো হোল’। জলের নিচ থেকে লাফ দিয়ে শূন্যে শরীর ভাসিয়ে, লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে ফুসফুসে বাতাস ভরে নেয় ডলফিন। তারপর তার শ্বাস নেওয়ার গর্তের দরজা বন্ধ করে আবার জলের তলায় চলে যায়। নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য কোনও প্রাণীকেই ভেবেচিন্তে কাজটা করতে হয় না। ঠিক একই কারণে ডলফিনের শ্বাসপ্রশ্বাস নেওয়ার এই পদ্ধতি তার ইচ্ছে অনুযায়ী ঘটে না।
আধ থেকে একঘণ্টা পর্যন্ত ডলফিন জলের নিচে একটানা নিঃশ্বাস আটকে থাকতে পারে। তারপর জলের উপরিতলে তাকে নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য উঠে আসতে হয়। সেই কারণে সমুদ্রের খুব গভীরে ডলফিন ডুব দিয়ে থাকতে পারে না। খুব বেশি হলেও আড়াইশো থেকে তিনশো মিটার পর্যন্ত জলের গভীরে থাকতে দেখা যায় ডলফিনদের। তবে ডলফিনদের একটি বিশেষ প্রজাতিকে গভীর সমুদ্রে বিচরণ করতে দেখা যায়।
বিজ্ঞানীদের মতে লক্ষ লক্ষ বছর আগে ডলফিন ডাঙায় চলে ফিরে বেড়াত। তারপর বিবর্তনের পায়ে পায়ে চলে সে এসে পৌঁছেছে সমুদ্রের জলে। বিবর্তনের ঠিক সেই সময়টিতে শিম্পাঞ্জি থেকে মানুষের রূপান্তর ঘটেছে। দুটি হাত ও পায়ের সাহায্য নিয়ে মানুষের অবাধ গতি ডাঙায় ও জলে। তবে ডাঙাতেই সে বেশি স্বচ্ছন্দ। আর ডলফিনেরা জলে।
ডলফিন খুবই মিশুকে প্রকৃতির। একা একা থাকা তারা মোটেই পছন্দ করে না। নিজেরা দল পাকিয়ে ঘোরাঘুরি, খেলাধুলোই শুধু করে না, মানুষদের নিয়ে কৌতূহলও তাদের অপরিসীম। মানুষের জীবন বাঁচানো বা সমুদ্রে পথ হারানো নাবিকদের রাস্তা দেখানো, সবই কিন্তু মনগড়া কাহিনি নয়। আশ্চর্যের ব্যাপার হল, ডলফিন মানুষের কাছ থেকে এতটুকু সাহায্য দাবি করে না। শুধু সামান্য ভালোবাসার বিনিময়ে সে নানারকমভাবে মানুষের মনোরঞ্জন আর উপকার করে থাকে। তাই ডলফিন আর মানুষের মেলামেশার নানা গল্প ছড়িয়ে আছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের লোককথায়।
মানুষের মতোই ডলফিনদের সমাজ আছে। সমুদ্রে ডলফিনের দলে তাদের সংখ্যা ৪০ থেকে ৩০০ পর্যন্ত দেখা গেছে। সমুদ্রের খাঁড়িতেও ডলফিনদের দেখা পাওয়া যায়। সব প্রজাতির ডলফিনরাই খুব মিশুকে। নিজেদের মধ্যে খেলাধুলো করতেও তারা ওস্তাদ। প্রতিটি ডলফিন একে অপরকে নাম ধরে ডাকে। তবে ডলফিনদের নামের সাথে মানুষের নামের মিল খুঁজতে যাওয়া বৃথা। মানুষের মতোই ডলফিনদের নিজস্ব ভাষা আছে, যে ভাষায় তারা একে অপরের সাথে যোগাযোগ রাখে। মানুষের কানে ডলফিনের কথা শোনায় সিটি বাজানোর শব্দের মতো। তীক্ষ্ণ এই শব্দের আছে রকমফের। ডলফিন বিশেষজ্ঞরা পরীক্ষা করে দেখেছেন একটি ডলফিন আরেকটি ডলফিনকে শুধুমাত্র একটি বিশেষ কম্পাঙ্কের শব্দের সাহায্যে চিনতে ও ডাকতে পারে। এই প্রসঙ্গে বলে নেওয়া ভালো, মানুষের প্রকৃতির সাথে সংযোগের যা কিছু মাধ্যম, তার মূলে আছে দুটি চোখ ও দুটি কান। সব দৃশ্য এই দুটি চোখে ধরা পড়ে না, সব শব্দও দুটি কানে শোনা যায় না (যেমন শুঁয়োপোকার গাছের ডালে চলে ফিরে বেড়ানোর আওয়াজ, প্রজাপতির উড়ে যাওয়ার শব্দ আমরা শুনতে পাই না। দেখতে পাই না ডেঙ্গু রোগের মূলে থাকা সেই ভাইরাসদের, চোখে ধরা দেয় না জলের তলায় সাঁতার কাটতে থাকা মাছের দল)। কিন্তু ডলফিনের শরীরের বিশেষ গঠন তাকে দিয়েছে এক বিশেষ ক্ষমতা। দুটি চোখের সাহায্যে জলের নিচে সে যে খুব ভালো দেখতে পায় এমন কথা জোর দিয়ে বলা যায় না। কিন্তু প্রকৃতি তার মাথায় লাগিয়ে দিয়েছে এক যন্ত্র, যেটিকে বলা যেতে পারে এক অতি উন্নতমানের রাডার। এই প্রাকৃতিক রাডার ব্যবহার করে ডলফিন আলট্রা-সাউন্ড পাঠিয়ে এবং সেই সাউন্ড প্রতিধ্বনির মাধ্যমে ফেরত পেয়ে সহজেই যেকোনও জিনিসের দূরত্ব আর অস্তিত্ব সঠিকভাবে জেনে নেয়। শিকার ধরা ও বিপদ থেকে বাঁচতে এই বিশেষ ক্ষমতা ডলফিনকে তার জীবনে নানারকমভাবে সাহায্য করে থাকে।
সুস্থ হয়ে বেঁচে থাকতে গেলে প্রতিটি জীবের দরকার বিশ্রাম। মানুষের ক্ষেত্রে ছয় থেকে আট ঘণ্টা টানা ঘুম শরীরকে স্বাভাবিক রাখে। প্রাণী বিশেষে ঘুমের এই সময়ের তারতম্য আছে। কিন্তু বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে ডলফিন ঘুমোয় না। তবে তার শরীর সুস্থ থাকে কী করে? রাতের বেলায় ডলফিন জলতলের খুব কাছাকাছি শরীর ভাসিয়ে রেখে বিশ্রাম নেয়। তখন তার মস্তিষ্কের একটা দিক জেগে থাকে, আরেকটা দিক ঘুমোয়। ঘুমিয়ে থাকা মস্তিষ্কের অংশটি জেগে উঠলেই আবার অপর দিকটি ঘুমিয়ে পড়ে।
এ তো গেল ডলফিনের শরীরের বিশেষ গুণের দিক। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এই বিশেষ গুণের অধিকারী হওয়ার কারণেই ডলফিন অত্যন্ত বুদ্ধিমান জীব। নানা দেশের নানা বিজ্ঞানী ডলফিনের বুদ্ধিবৃত্তির উপর অনেক গবেষণা করেছেন। তাদের গবেষণায় আমরা পরিচিত হয়েছি ডলফিনের বুদ্ধির সাথে।
ডায়না রেইস নামে এক ভদ্রমহিলা ডলফিনদের আচার আচরণ ও বুদ্ধিমত্তা নিয়ে সারাজীবন ধরেই গবেষণা করেছেন। ২০১১ সালে তিনি একটা বই লেখেন, যার নাম – ডলফিন ইন দ্য মিরর। বইটিতে তাঁর মূল্যবান গবেষণালব্ধ চাঞ্চল্যকর তথ্য জানা যায়। তিনি বলেন, ডলফিনদের মানুষের মতো দুটি হাত ও দুটি পা না থাকতে পারে, কিন্তু পাখনা ও লেজের সাহায্য নিয়ে, মাথা খাটিয়ে, নানান কাণ্ডকারখানা করতে তাদের জুড়ি মেলা ভার। ডলফিনদের উপর গবেষণার জন্য বিরাট বিরাট চৌবাচ্চায় তাদের থাকবার ব্যবস্থা করে তাদের উপর নজর রাখা হয়।
ডলফিনদের একটা অদ্ভুত স্বভাব দেখা যায়, তারা নাকের ফুটো দিয়ে হঠাৎ হাওয়া বার করে গোল গোল বাতাসের রিং তৈরি করে জলে ছেড়ে দেয়, তারপর সেই রিংগুলো নিয়ে খেলা করে। নিজেদের তৈরি এই হাওয়ার রিং তৈরি করে বিভিন্ন প্যাটার্ন বানানোর জন্য ডলফিনদের মধ্যে রীতিমতো প্রতিযোগিতা হয়। নিষ্ঠাবান শিক্ষার্থীর মতো রিং বানানোর ওস্তাদ ডলফিনের কাছ থেকে এই অভিনব পদ্ধতি খুব তাড়াতাড়ি অন্য ডলফিনেরা শিখেও ফেলে। ডলফিনদের একটি প্রজাতি মাঝ সমুদ্রে লাফিয়ে উঠে শূন্যে নানারকম শারীরিক কসরতের খেলা দেখাতে পারদর্শী। এই খেলা তারা নিজেদের মনোরঞ্জনের জন্যই খেলে।
আপন সৃষ্টিতে মশগুল ডলফিন
রেইস একবার তাঁর গবেষণায় ডলফিনদের এক অভূতপূর্ব খেলা দেখে ফেলেন। একটা ডলফিন হাওয়ার রিং তৈরি করছে জলের মধ্যে, আরেক ডলফিন মন দিয়ে সেটা দেখে ও বুঝে নিয়ে চট করে চৌবাচ্চার তলা থেকে একটা মাছ ধরে এনে রিংয়ের মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। মাছটা রিংয়ের কেন্দ্রে জলের টানে সজোরে ঘুরতে ঘুরতে উপরে উঠছে রিংয়ের সাথে সাথে। খেলাটা বারবার চলতে দেখে রেইস বুঝতে পারেন, ডলফিন দুটো তাদের খেলার মধ্যে যে পদ্ধতি ব্যবহার করছে, তা তাদের উন্নত মস্তিষ্কের পরিচয় দেয়। চারপাশের পরিবেশ বদলে দিয়ে মনোরঞ্জন করবার ক্ষমতার অধিকারী তারা।
ডলফিনদের আরও একটি খেলা হল, জলের মধ্যে জোরে নিঃশ্বাস ছেড়ে বুদবুদের টুপি তৈরি করা। বুদবুদগুলোকে দেখতে হয় অনেকটা মাশরুমের মতো। এটা বেশ কষ্টসাধ্য কাজ, অনেক সাধনা করে ডলফিনরা একে অন্যকে এই খেলা শিখিয়ে দেয়। তবে তাদের এই শেখানোটা মানুষের বাচ্চাদের হাত ধরে শেখানোর মতো নয়। পর্যবেক্ষণের মধ্যে দিয়ে শিশু ডলফিন তার মা এবং বন্ধুদের কাছ থেকে জীবনের একেকটা শিক্ষা যত্ন করে শিখে নেয়।
অনেক গবেষক ভুল পথে গবেষণা করে ডলফিনদের মানুষের ভাষা শেখাবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। রেইসের মতো গবেষক প্রমাণ করে দিয়েছেন, ডলফিন তার স্বাভাবিক নিয়মে পরিবেশ থেকে শিক্ষা নেয়। যদি কোনও জ্যামিতিক আকার, যেমন ক্রস, রিং বা ত্রিভুজ কোনও শিক্ষার্থী ডলফিনকে দেখানো হয়, তবে খুব কম সময়ের মধ্যেই জলের তলায় রাখা একই জ্যামিতিক আকার মাথা দিয়ে ঠেলে দিয়ে সনাক্ত করবার সহজাত ক্ষমতা তার আছে। তবুও মানুষের ভাষা ডলফিনকে শেখানোর চেষ্টা একেবারেই বালখিল্যতা।
রেইসের গবেষণার সময় একটা খুব মজার ঘটনা ঘটে। পরিষ্কার করবার জন্য ডলফিনদের চৌবাচ্চায় ডুবুরি নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ডুবুরি চৌবাচ্চার তলা থেকে খুরপি দিয়ে ময়লা ও লতাপাতা পরিষ্কার করছিল। দেখা গেল, একটা ডলফিন খুব মনোযোগ দিয়ে পরিষ্কার করবার কাজ দেখে চলেছে। ডুবুরি ভুল করে খুরপিটা ট্যাঙ্কের তলায় ফেলে গিয়েছিল। দুয়েকদিন পর দেখা গেল, সেই ডলফিনটি তার পাখনা দিয়ে খুরপিটা চেপে ধরে ট্যাঙ্কের তলা থেকে ময়লা তোলার চেষ্টা করছে। রেইস ডুবুরিকে ডেকে খুরপিটা সরিয়ে নিতে বললেন। তারপর দেখা গেল ডলফিনটা মনমরা হয়ে, উদাস হয়ে এদিক ওদিক জলের মধ্যে ঘোরাঘুরি করছে। ক’দিন পর দেখা গেল, ডলফিনটা চৌবাচ্চার তলা থেকে ভাঙা টাইলের টুকরো তুলে এনে খুরপির মতো ব্যবহার করে ময়লা পরিষ্কারের চেষ্টা করছে। এই ঘটনা প্রমাণ করে, পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে খুব তাড়াতাড়ি কাজ শেখাই শুধু নয়, অনুকরণ করবার সহজাত ক্ষমতা ডলফিনদের মজ্জাগত।
ডায়না রেইসের সাথে তার প্রিয় ডলফিন
মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন মানুষের বুদ্ধির হদিস দেয় তার আত্মচেতনা। অর্থাৎ মানুষ তার আত্মচেতনার ফলে নিজেকে জানতে ও চিনতে পারে এবং অন্য মানুষের চাইতে পৃথকভাবে সনাক্তও করতে পারে। মানবশিশুর আঠারো মাস বয়স থেকে এই সচেতনতার পুরোপুরি বিকাশ হয়। ডলফিনদের মধ্যে এই আত্মসচেতনতা আছে কি না প্রমাণ পাওয়ার জন্য রেইস তাঁর গবেষণার চৌবাচ্চায় নামিয়ে দিলেন বিরাট মাপের আয়না। প্রথমে ডলফিনেরা খুব উৎসাহী হয়ে পড়ল আয়নায় তাদের চেহারা দেখে। মাথায় লাগানো রাডার থেকে আলট্রা-সাউন্ড পাঠিয়ে জিনিসটা সনাক্ত করবার চেষ্টা করল কিছুক্ষণ। তবে সাধারণত অন্য পশুরা আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে যেমন তাকে নিজের দলের আরেক পশু বলে মনে করে, এক্ষেত্রে এমন হল না। আয়নায় তারা দেখল ত্রিমাত্রিক ছবি, অথচ আলট্রা-সাউন্ড পাঠিয়ে বুঝে ফেলল ছবিটি দ্বিমাত্রিক। কাজেই ক্ষেপে গিয়ে তারা নানাধরনের আওয়াজ তুলতে শুরু করল। আয়নাতে ডলফিনেরা যে নিজেদের প্রতিবিম্ব দেখছে, তা বুঝতে ওদের বেশি সময় লাগল না। নানারকমভাবে আয়নার সামনে মানুষের মতোই নিজের মুখ দেখবার জন্য ডলফিনদের উৎসাহ দেখা গেল। এমনকি নিজেদের শরীর উলটো করে আয়নায় চেহারা দেখা হয়ে উঠল ওদের নতুন খেলা। দেখা গেল বড়ো ডলফিনেরা মুখ ভেংচিয়ে নিজেদের আয়নায় দেখছে উৎসাহের সাথে।
একবার এক বিজ্ঞানী ডলফিনদের চৌবাচ্চার পাশে বসে পাইপ খেতে খেতে ধোঁয়া ওড়াচ্ছিলেন। মাঝে-মাঝেই একটা বাচ্চা ডলফিন তাকে খুব মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করছিল। কিছুক্ষণ পর দেখা গেল সেই বাচ্চাটি তার মায়ের দুধ মুখে নিয়ে জলের মধ্যে এমনভাবে ছড়িয়ে দিতে লাগল, ঠিক যেন সে পাইপ খেতে খেতে ধোঁয়া ওড়াচ্ছে। এই ঘটনায় বোঝা যায়, ডলফিন খুব ছোটো অবস্থা থেকেই পরিবেশের সবকিছুই অনুকরণ করতে ও তা থেকে মজা পেতে ভালোবাসে।
জীববিজ্ঞানী ডায়না রেইসের নিরলস গবেষণায় উঠে আসা বিভিন্ন তথ্য সমীক্ষা করে এটুকু বোঝা গেছে যে, ডলফিনের মুখে মানুষের ভাষা বসিয়ে দেওয়া বা তাকে দিয়ে জোর করে অঙ্ক শেখানো মূর্খতা। আসলে অন্যান্য প্রাণীর মতোই ডলফিনের নিজস্ব দুনিয়াতে সবকিছুই সে নিজের মতো করে এবং নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী বোঝে এবং শিখে নেয়। মানুষের অনেক উপকারে ডলফিনকে দেখতে পাওয়া গেলেও মানুষের সাহচর্য ডলফিনের আদৌ প্রয়োজন হয় না। তাই বোধহয় গ্রীস দেশে হাজার হাজার বছর আগে ডলফিনকে সেখানকার মানুষ ভগবানের প্রতিনিধি বলে মনে করে থাকে। অরণ্যদেবের কমিক্সেও আমরা দুই অসাধারণ ডলফিন, সলোমন আর নেফারতিতির গল্প শুনেছি।
(পরের পর্বে আরেক না-মানুষের বুদ্ধিশুদ্ধি নিয়ে গল্প শোনাব)
অসাধারণ নিবন্ধ
ReplyDeleteধন্যবাদ
DeleteKhub sundor
ReplyDelete