রহস্যের রাত
প্রত্যক চক্রবর্তী
একটা ভাড়াবাড়িতে উঠেছে ঋক। বেশ কয়েক বছর হয়ে গেল, কোনো বিপদ-আপদ তেমন হয়নি। ঋকের মা গত হয়েছেন। বাবা নিখোঁজ। আশেপাশের লোকজনের বিশ্বাস, ঋকের বাবাও আর বেঁচে নেই। ঋকের বাড়িতে ঋক ছাড়াও আছে তার বিশ্বস্ত চাকর গোপাল। গোপালদের বাড়িতে খুব অভাব-অনটনের কারণে অনেক অল্প বয়েসেই পড়াশুনো ছাড়তে হয়েছিল। তাছাড়া গোপাল খুব সহজ-সরল ছেলে। ঋক স্কুল-শিক্ষক। সারাদিন বাড়ির দেখাশুনো গোপালই করে। গোপালের ওপরে ভরসা করে ঋক মাস খানেক কাটিয়ে ফেলল নতুন ভাড়াবাড়িতে।
সেইদিন খবরে বলছিল, রাতে খুব ঝড়বৃষ্টি হবে। ঋকের পাশে বসে গোপালও সে খবর শুনল। গোপাল বলল, “বাবু, আজ তো খুব জল হবে। মা আমার একা আছে বাড়িতে। খুব চিন্তা করবে আমার জন্যে। আমায় আজ একটু তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিন।”
ঋক বলল, “ঠিক আছে। আমার কোনো অসুবিধা নেই। শুধু কাল একটু তাড়াতাড়ি চলে আসিস। স্কুলে সকালে কিছু কাজ আছে।”
যথারীতি সন্ধে সাতটা বাজতে না বাজতে গোপাল উতলা হয়ে উঠল। আকাশ ডাকছে। বৃষ্টিও শুরু হয়ে গেল ঝমঝম করে। গোপাল আটকে গেল। বৃষ্টি থামল যখন, ঘড়িতে রাত এগারোটা। গোপাল তখন ঋকের খাবার টেবিলে চাপা দিয়ে তাকে বলে বাড়ির দিকে রওনা দিল।
স্কুলের প্রচুর কাজ ছিল। খাওয়ার কথা প্রায় ভুলেই গেল ঋক। কাজ যখন শেষ, রাত তখন পৌনে একটা। বাইরে আবার খুব বৃষ্টি শুরু হয়েছে ততক্ষণে। এখন সঙ্গে আবার ঝড়ও এল পুরোদমে। ঋকের খেয়াল হল, টেবিলের ওপরে খাবারটা চাপা দেওয়াই পড়ে আছে। বাইরের এই অবস্থা। এত কাজ করে প্রচণ্ড ক্লান্তও লাগছিল ঋকের। ঘুমে চোখ বুজে আসছিল। ‘নাহ্, আজ আর খেতে ভালো লাগছে না। শুয়েই পড়ি গিয়ে। কাল সকাল সকাল গোপাল এসে ডেকে দেবে’খন।’ এই ভেবে যেই ঋক বিছানার দিকে এগোচ্ছে, অমনি কলিং বেল বেজে উঠল ডিং ডং শব্দ করে। রাত একটার পরে আবার কে এল! একটু বিরক্তই হল ঋক। দরজা খুলে দেখে, একজন অচেনা ব্যক্তি। বৃষ্টিতে পুরো ভিজে গেছেন। ভদ্রলোক বললেন, “নমস্কার। আমার নাম সুমন বাগচী। খুব ঝড়ে রাস্তার ওপরে বহু গাছই ভেঙে পড়েছে। আমার পক্ষে গাড়ি নিয়ে এগোনো প্রায় অসম্ভব। আজ রাতটা আমায় যদি এখানে একটু আশ্রয় দেন তাহলে বড়ো উপকার হয় মশাই। কাল সক্কাল হলেই আমি চলে যাব। আমাকে খেতে দেবার দরকার নেই। মাটিতেই একধারে শুয়ে পড়ব নাহয়। আমাকে নিয়ে বিব্রত হবার একটুও দরকার নেই।”
ঋক নিজের বিছানাতেই তাঁকে শুতে দিল। হাজার হোক, অতিথি ভগবান। ঋক পাশের ঘরের ক্যাম্প খাটটায় শুয়ে পড়ল।
পরের দিন কাজে এসে দরজা খোলা দেখে অবাক হয়ে গেল গোপাল। ইতস্তত ভঙ্গিতে ঘরে ঢুকে পড়ল সে। আর ঢুকেই অবাক হয়ে গেল। ঋক ক্যাম্প খাটে ঘুমোচ্ছে আর তার নিজের বিছানা একেবারে ছিমছাম, পরিপাটি করে গুছিয়ে রাখা। চাদরটা এমন সুন্দর করে রাখা, দেখলেই বোঝা যায়, বিছানাটা রাতে ব্যবহারই করেনি ঋক। গোপাল ঋককে ডেকে তুলল। ঋক গোপালকে দেখে বলল, “এ বাবা, যাহ্, কত দেরি হয়ে গেল। তোকে বললাম আজ একটু তাড়াতাড়ি আসতে! সেই তুই দেরি করে দিলি। আজ আর কাজে যাওয়া হল না।”
এরপর গোপাল যা বলল তা সত্যিই ভয়ানক। “কাল রাতের ঝড়ে রাস্তার ওপরে প্রচুর গাছ পড়েছে। একটা গাছ তো দামি একখানা গাড়ির ওপরে পড়ে গাড়িটাকে একেবারে তুবড়ে দিয়েছে। গাড়িটার কিছুই আর নেই বলতে গেলে। গাড়িতে আরোহী একজনই ছিলেন। অ্যাকসিডেন্টে বেচারা লোকটা একদম থেঁতলে গেছে। স্পট ডেড। সকালে শুনছিলুম, রাস্তার লোক বলাবলি করছিল, লোকটার নাম সুমন বাগচী। ওইজন্যেই তো আমার আসতে এত দেরি হয়ে গেল।”
মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল ঋকের। কেমন যেন অস্থির লাগছে মনের মধ্যেটা। সারাদিন কোনো বিষয়েই আর মন বসাতে পারল না সে। শেষপর্যন্ত অতিথি ভগবান না হয়ে কিনা...
সেইদিনেই রাত বারোটার সময় আবার কলিং বেল বেজে উঠল ঋকের বাড়িতে। একটু ভয়ে ভয়েই দরজা খুলল সে। আর খুলেই অবাক হয়ে গেল। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন তার বাবা। তিনি নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন ঋকের দিকেই। এক অদ্ভুত অজানা আতঙ্কে শরীরটা শিউরে উঠল ঋকের।
___
অঙ্কনশিল্পীঃ প্রত্যক চক্রবর্তী
সপ্তম শ্রেণী
সেন্ট মন্টফোর্ট সিনিয়র সেকেন্ডারি স্কুল, বারুইপুর
সপ্তম শ্রেণির কলমে এত জোর! কী গল্প গঠন। কারা যেন বাংলা সাহিত্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভেবে ভেবে ঘুম ছেড়েছে। তারা কই?প্রত্যকের বাবা- মা কে অভিনন্দন।
ReplyDeleteখুব ভালো লাগল 👌
ReplyDeleteদারুণ দারুণ
ReplyDeleteবাঃ নিটোল গল্প। খুব ভালো।
ReplyDeleteকী অসাধারণ গল্প। খুব ভালো লাগলো।
ReplyDelete