ভূতের চিঠি
অভিজিৎ চৌধুরী
১
যা কিছু সাবেকি তা আমার প্রিয়। আবার এই যে ফস করে সাবেকি বলে ফেললাম, তাও কি তোমাদের পরিচিত! ভেঙেই বলি, পুরোনো যা কিছু।
আমার বোতলে জল খেতে একটুও ভালো লাগে না। ভালো লাগে কাচের গ্লাসে টলটলে সাদা জল। অ্যাকোয়া-গার্ডের পরিস্রুত জল নয়, ঝরনার জল, ইঁদারার জল।
আমি এক আশ্চর্য জায়গায় চাকরি করতে এসে বেশ কিছুদিন ছিলাম, তার নাম শাপলাদিঘি। সেখানকার অনেক কিছু ছিল পুরোনো পৃথিবীর। যেমন ঘাসের ডগায় শিশিরবিন্দুর মধ্যে লুকিয়ে থাকা থুতুপোকা।
এক দুপুরে কমলা-বৌ পাখিটির সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল যখন, আমার কাজের মেয়ে ময়না আসেনি সেদিন। ময়না খবর পাঠিয়েছিল তার মেয়েকে ভূতে ধরেছে। জায়গাটা ভোর থেকে সন্ধে অবধি সুন্দর, কিন্তু রাত্রি নামলেই অন্যরকম। শেয়ালগুলো ছাড়া আর চারপাশে যারা থাকে তাদের চলতি কথায় ‘ভূত’ বলে।
সাবেকির প্রতি শ্রদ্ধা থাকলে এই অশরীরীদের আমার বেশ ভয় করে। সুখেন আমার দিনের বেলার ছায়াসঙ্গী। তার ঘোড়া বুধু এসে সামনের মাঠে চক্কর দেয়।
ময়না কয়েকদিন পর এল, বেশ হাসিখুশি। সে যা বলল তা প্রায় অবিশ্বাস্যーভূতটা নাকি বেশ ভালো। ঝন্টু ওঝা তাকে ভয় দেখানোর পর ‘ভূত’ বেশ ভালো হয়ে গেছে। খুব দুঃখী ভূত। এখন সে এবং তার শাকরেদেরা গলাকাটায় থাকে। মাঝে মাঝে শাপলাদিঘিতে বেড়াতে আসে।
এরপর থেকে ময়না সেই ভূতকে পাঠাত। সে-ই বাসন মেজে, রান্না করে আমায় ইঁদারা থেকে জল তুলে রাখত। আমি পরে কাচের গ্লাসে সেই জল পান করতাম।
সুখেন চলে গেলে রাতে আমার সঙ্গে শুতে উজ্বল আসে। সেও জানে গলাকাটার ভূতেদের কথা। ওরা সবাই অপঘাতে মারা গেছিলーনানা দুঃখে, অনেকটাই অভাবের জ্বালায়।
এখন সেই দুনিয়ায় তাদের অভাব নেই। বরং ‘ভোজ’ বসে রাতের বেলা। ভূতেদের রান্নার সোয়াদই আলাদা। একবার খেলে ভোলা যাবে না জীবনভর।
শাপলাদিঘির সুখেন, ময়না, কম্পিউটার অপারেটর উজ্বলーকখনো কখনো মনে হয় এরা সব জ্যান্ত মানুষ তো! নাকি আমি ভূতেদের সঙ্গে বসবাস করছি? গায়ে চিমটি কেটে দেখি নিজের। আমার ছায়াও তো মাটিতে পড়ে। অফিসের নিয়মিত কাজও তো করছি। জেলা শহরে মিটিং করতেও যাই।
মোদ্দা কথা হল, আমি বেঁচেবর্তে আছি, এখনও ভূত হয়ে যাইনি। শুধু রাতের বেলা টের পাই, ওঁরা আসেন। বাসনগুলো ঝনঝন করে ওঠে।
এখন মোবাইল আর মেইলের যুগ। এছাড়া আছে হোয়াটস অ্যাপ। কেউই চিঠি লেখে না, তাই চিঠি আসেও না।
রোববার দুপুরে বসে আছি। বাইরের নিঝুম প্রকৃতি চুপচাপ আমায় দেখছে। আমিও দেখছি যেমন ছেলেবেলা থেকে দেখতামーরোদ্দুরের ভিতরে বেলাশেষে কেমন ছায়ার দল ঢুকে যাচ্ছে, আর একটু রাত হলেই ওরা ছায়াশরীর নেবে। তাদেরই সবাই ভূত, পেত্নী এসব বলে। ওদের পরিচয় তো আগেই দিয়েছি। আগের চেয়ে সাহস খানিকটা হয়েছে। উজ্বল মাঝেমধ্যে আসছে না।
সুখেন একটা চিঠি এনে দিল। ইনল্যান্ডে। সাদা আর নীলের মিশেল। আঠাটা খুলে নিলে চিঠিটা পড়া যায়।
তেমন কসরত করতে হল না, চিঠিটা আপনিই খুলে গেল। আঠাটা তেমন জোরালো ছিল না। পড়তে যাব, তখনই দেখি বকুলগাছের ঝাঁকড়া ডালে বসে আড়াল থেকে এক বিদেশিনী বুলবুল পাখি আমায় দেখছে।
যাই হোক, খুললাম চিঠিটা। হাতের লেখা মুক্তোর মতন। আমার বাবার হাতের লেখাও তাই ছিলーগোটা গোটা, মনে হবে যেন ছাপা বই থেকে বুক ফুলিয়ে সটান সাদা কাগজে চলে এসেছে।
তুমি কি ভূতে বিশ্বাস করো!
জানি বলবে, না। চিঠির শুরু এরকম হেঁয়ালি দিয়ে, কিন্তু জানো, ভূত আছে। সে-ই তোমার বাসন মেজে দিল একটু আগে। কাচের গ্লাসে টলটলে জল তারই তো দেওয়া।
এরকম হঠাৎ চিঠি… উত্তর কী করে দেব! প্রেরকের জায়গায় দেখলাম কিছু লেখা নেই। ঠিকানা নেই, নামও নেই। শ্রীচরণেষু, প্রিয়ভাজনেষু যেমন নেই আবার চিঠির শেষে কোনো ‘ইতি’ লেখাও নেই। তবে মস্ত হাইফেন দিয়ে লেখা আছে একদম শেষে, ‘জনৈক ভূত’। তার আগে শেষ লাইনে আমন্ত্রণ, ‘চলে এসো গলাকাটা মোড়ে। রাতের খাওয়া সেরে তবে যেও। ভয় নেই, জনৈক ভূত’ーএইটুকু।
গলাকাটার মোড় জায়গাটা সুবিধের নয়। অপঘাতে মৃত্যু বেশ হত একসময় ওখানে।
সুখেনকে বললাম ভূতের চিঠির কথা। সে বেশ খুশিই হল। বুধন ঘোড়াকে ডাকল সে। গাড়িও জুড়ে দিল তৎক্ষণাৎ।
আমি সুখেনকে বললাম, “ভূতেদের ভোজবাড়িতে খেয়েছ কখনো?”
সে বলল, “কয়েকবার। বেশ খাসা রান্না হয়।”
উজ্বল কয়েকদিন আসছে না রাতে। তার বাড়িটাও অনেক দূরে। ওর বদলে সুখেন আসে, আবার কখনো আসে না। তখন ইষ্টনাম জপ করতে করতে চোখ বুজে থাকি। ঘুম হয় না।
২
শেষমেশ ঠিক করলাম, ভূতেদের নিমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে দেখি কী হয়। উজ্বল তো ওদের গল্প করতে চাইত। অনেক রাতে আমায় চা করে দিত। ও আসছে না বলে মনটাও ভালো নেই আমার।
গোল করে আকাশে চাঁদ উঠতেই বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের ঘোড়ার গাড়িতেও যে একজন আছেন, উঠেই টের পেলাম।
গলাকাটা গিয়ে মনটা ভালো হয়ে গেল। এমনিতে লক ডাউনের কারণে বহুদিন বের হইনি। দেখলাম, ঝিলের জল টলটলে হয়ে গেছে। সাদা বকের দল চাঁদের আলোয় জলঙ্গির দিকে উড়ে গেল। শ্যামা পাখি ডাকছে। আরও সব বিচিত্র রাতচরা পাখিরা ডাকছে।
দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু টের পেলাম। কাঠের গনগনে আঁচের গন্ধ। সুন্দর করে বসতে দিল ভূতেরা। বললেন, “কফি খাবেন?”
আমি বললাম, “না।”
“তবে একবারে খেতে বসে যান।”
পুরোনো দিনের মতন কলাপাতায় সুগন্ধি ভাত। সেই মাছের মাথা দেওয়া ডাল। বোঁটা বের করা বেগুন ভাজা। মাটির ভাঁড়ে জল। লেবু, নুন। মাছের কালিয়া। তার আগে ফুলকপির তরকারি। তারপর কচি পাঁঠার মাংস। রসগোল্লা, সন্দেশ, রাজভোগ।
তৃপ্তিতে ভরে উঠল মন। পেট পুরে খেলাম অর্থাৎ ভুরি ভুরিভোজই হল।
ঘোড়ার গাড়িতে ওঠার সময় বেনারসি পান দিলেন ওঁরা। মুখে দিতেই মিলিয়ে গেল।
একবার বললাম, “এই আয়োজনটা কেন?”
মূল আমন্ত্রণ কর্তা ভূত বললেন, “আপনার জন্যই। আপনি তো আমাদের শ্রদ্ধা করেন, ভালোবাসেনও। তবে…”
আমি বললাম, “কী?”
“ভয়ও পান।”
হেসে বললাম, “এখন থেকে আর পাব না।”
ফিরতে ফিরতে আকাশে ভোরের শুকতারা দেখতে পেলুম।
চিঠিটা নিয়ে পরের দিন পোস্ট অফিসে গেছিলাম। পোস্ট মাস্টার তো আতান্তরে পড়ে গেলেন। চিঠির সন, তারিখ বহু বহু বছর আগের। ডাকপিওনই বা কে ছিলেন মনে করতে পারলেন না।
সুখেন বলল সে চেনে তাকে। তেনাদের মধ্যেই একজন এসেছিলেন।
বেশ কয়েকদিন হয়ে গেল উজ্বল আর রাতে আসে না, তার কোনো খবরও নেই। তবে আমার আর ভয় করে না। শাপলাদিঘিতে সাহসী বলে আমার বেশ সুনামও হয়েছে। শুধু উজ্বল আমায় রাতে চা করে দিত, এই অভাবটা খুব টের পাচ্ছি। ভয় চলে যাওয়াতে দেখতে পাচ্ছি ভূতেদের আনাগোনা একেবারে কমে গেছে।
সেই রাতে খানিকটা চায়ের তেষ্টা নিয়ে শুয়ে আছি। লাইট নেভাতে যাব, দেখি উজ্বল লিকার চা করে আমার বিছানার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আমার প্রিয় সাবেকি কাপ থেকে উষ্ণ ধোঁয়া উঠছে। চায়ের গন্ধটাও হাওয়ায় ছড়িয়েছে চমৎকার। বললাম, “কী রে, কখন এলি!”
মুখে হাসি ছড়িয়ে উজ্বল বলল, “এই তো।”
বললাম, “তোকে দেখে বড্ড আনন্দ হচ্ছে। আসিস না কেন আর!”
উজ্বল ম্লান হাসল। তারপর বলল, “ভোজ কেমন খেলেন?”
আমি বললাম, “দারুণ।” তারপর বললাম, “সুখেন ওঁদের চিঠি আমায় দিয়েছিল। পোস্ট মাস্টার কিছুই বুঝতে পারছিল না। ভূত কি কখনো চিঠি লিখতে পারে!”
উজ্বল বলল, “চিঠিটা আমিই লিখেছিলাম। একটা পুরোনো ইনল্যান্ড, ডাকটিকিট সাবেকি সবই ছিল। আপনি পুরোনো দিন ভালোবাসেন বলে আমারও জন্মের আগের একটা দিন, মাস, বছর লিখে দিয়েছিলাম।”
“সব তোর কীর্তি!” বলে চায়ে চুমুক দিলাম। চোখ বুজলাম তৃপ্তিতে।
তবে চোখ খুলেই দেখি উজ্বল নেই।
পরের দিন ভোরে সুখেন এল। তাকে বললাম উজ্বলের কথা। সে বলল, “বেশ কয়েকদিন হয়ে গেছে উজ্বল মারা গেছে।”
ময়নাও তখন এসেছে। সেও একই কথা বলল। ময়না বলল, “কষ্ট পাবেন বলে বলিনি।”
‘ভূতের চিঠি’র রহস্যের কিনারা দেখতে পেলাম যেন। ঘোড়ার গাড়িতেও সওয়ার হয়েছিল উজ্বল, যাতে পথে যেতে ভয় না করে।
ভূতেদের প্রতি ভয় নয়, এক অপূর্ব ভালোবাসা টের পেলাম নিজের মধ্যে। মৃত্যু তবে কিছু নয়, সকলেই আছেন। আর তেনারা আমাদের বন্ধু। সেই থেকে সাবেকি বা পুরোনো কালের মতন ভূতেদের আমি ভালোবাসি।
___
অঙ্কনশিল্পীঃ অনির্বাণ সরকার
No comments:
Post a Comment