ফিকে
দ্বৈতা হাজরা গোস্বামী
দরজার বাইরে একটা ছেলে এল। সে বলল, “আমার নাম জটা।”
সত্যিই তার মাথার ওপর জট পাকিয়ে পাকিয়ে মস্ত হয়ে গেছে। মাথায় তেল পড়ে না। সে বলল, “আমার কাছে আলু আছে চারটে। একটু সেদ্ধ করে দেবে? তুমিও একটা নিতে পারো।”
আমি বললাম, “ভেতরে মা আছে, করে দেবে। তুমি ভেতরে এসো না।”
সে বলল, “না না। থাক।”
পরেরদিন আরেকজন এল, তার নাম বলল নাকি বেগুন। তাকে বেগুনের মতোই দেখতে। ন্যাড়া মাথায় একটা টিকি আর সরু চেহারায় একটা লম্বা দেখতে ভুঁড়ি। লিকলিকে পা। সে বলল, “আমার কাছে দুটো সরপুঁটি আছে, ভেজে দেবে? একটা তুমি খেও।”
আমি বললাম, “সরপুঁটি তো সর দিয়ে ভাজলে খুব সরেস হয়। কিন্তু আমার মা তো সেটা জানে না। বাবাকে বলছি।”
পরেরদিন আরেকটা ছেলে এল। সে বলল, “আমার নাম ঘনা।”
ঘন কালো মেঘের মতো তার গায়ের রং। সে বলল, “আমার কাছে বুনো ওল আছে। রান্না করে দেবে?”
“বুনো ওল আমার বাবা রাঁধে। বাঘা তেঁতুল দিয়ে তার ডালনা হয়।” বললাম। “কিন্তু বাবা তো গেছে চাষ করতে। তুমি পরে এসো।”
“কেন, তোমার মা নেই?”
“মা গেছে নদীতে স্নান করতে।”
তো তার খুব মনখারাপ হল মনে হল। আমি বললাম, “ঠিক আছে দাও, ঠাকুমাকে বলছি। ঠাকুমা কিন্তু চোখে ভালো দেখে না। তেঁতুল দিতে গিয়ে যদি তেঁতুলবিছে দিয়ে দেয়! তখন আমাকে বোলো না।”
ঘনা বলল, “না না। আমরা সাপ, ব্যাঙ, বিছে সব খাই।”
তারও পরেরদিন একটা লিকলিকে হাড়-জিরজিরে মেয়ে এল। তার নাম বলল বাতাসি। ঝড়ো বাতাসে সে কেঁপে কেঁপে যাচ্ছিল। সে আবার দেখি জামায় করে একটু চাল আর ডাল এনেছে। আমাকে দেখিয়ে বলল, “একটু খিচুড়ি হবে?”
আমি অবাক হয়ে বললাম, “খিচুড়ি! না না, হবে না। আমার মা অসুস্থ।”
“তোমার বাবা নেই?”
আমি ভেবে বললাম, “বাবা গেছে মাছ ধরতে।”
“তোমার ঠাকুমা নেই?”
“ঠাকুমা গেছে পুজো দিতে। বিদেয় হও না বাপু!”
তাতে মনে হল বাতাসির মনে খুব দুঃখ হল। সে কেঁপে কেঁপে কাঁদতে শুরু করল।
ওর পেছনে একটু অন্ধকারের মধ্যে দেখলাম জটা, ঘনা, বেগুন সব দাঁড়িয়ে আছে। এবারে আমাকে বলতেই হল সত্যিটা।
খিচুড়ি রান্না করতে সত্যিই আমি জানি না। বাবা, মা, ঠাকুমার কথা বলে এবারে পার পাওয়া যাবে না। আমার বাড়িতে তো কেউই নেই। আমি অনেকদিন ধরে একাই আছি। এটা আমার বাড়িও নয়। সামনের জঙ্গল থেকে এখানে এসে ঠাঁই নিয়েছি। বাড়িতে কোনো লোক নেই। কিন্তু রান্নাঘরে একটা উনুন আছে, আর তেল-মশলাপাতি।
“তাহলে আমাদের মিথ্যে বলেছিলে কেন?” জটা বলল।
ভয়ে ভয়ে বললাম, “ভয়ে।”
“তবে কি এই বাড়িতে আমরা থাকতে পারি?” বেগুন বলল।
“আমরা কি এখানে ঘুমোতে পারি?” ঘনা বলল।
“আমরা কি এখানে খিচুড়ি রেঁধে খেতে পারি?” বাতাসি বলল।
“তোমাদের বুঝি নিজেদের ঘর নেই?”
ওরা মাথা নাড়ল। “এত ঝড় হল, বন্যা হল, মাটি কাঁপল, নদীর জল উথালপাতাল হল, তুমি কিছুই টের পেলে না? তোমার নাম কী?”
আমি ফিকফিক করে হেসে বললাম, “আমার নাম ফিকে। আমি সকালের দিকে আলো বাড়লেই ফিকে হয়ে যাই।”
“ও বাবা, তুমি কি তবে ভূত?” ওরা জানতে চাইল।
আমি ঠোঁট উলটে বললাম, “কী জানি!”
___
অঙ্কনশিল্পীঃ সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী
মনে হয় ভূতই হবে। রূপকথার মত।
ReplyDelete