মায়ামূর্তির বিভীষিকা
সুমন্ত বোস
(১)
আজ থেকে বহুবছর আগে ভারতবর্ষের উত্তর-পূর্বে পার্বত্য ভূমির পাদদেশে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ছিল ঘন অরণ্য। আর সেই অরণ্যে ছিল অজস্র জীবজন্তু। শিকারের লোভে অনেকেই ঢুকে পড়ত সেখানে। রাজপ্রাসাদের যুবকরাও শখ মেটাতে জঙ্গলে ছুটে যেত মাঝেমধ্যেই। প্রকৃতির নিয়ম লঙ্ঘন করে তিরের আঘাতে শেষ হতে থাকল একেকটা পশু, একেকটা প্রজাতি।
যুবরাজ সৌমিত্রর কাছেও মৃগয়া যেন এক বিচিত্র নেশা। তাই সঙ্গীদের নিয়ে হামেশাই চলে আসে শিকারে। কিন্তু এরকম ভুল সে আগে কখনো করেনি। এমনিতেই বেলা পড়ে এসেছিল। অথচ মনোমতো একটা শিকারও সে পায়নি। মনখারাপ করে যখন ফিরবার উপক্রম করছে, ঠিক তখনই হাত দশেক দূরের একটা ঝোপ থেকে একটা দলছুট শূকর ছুটে গেল অন্য একটা ঝোপের দিকে। সৌমিত্র বরাহের পশ্চাতে অগ্রসর হতেই সঙ্গীরা তাকে বারণ করল। কিন্তু হাতের নাগালে পাওয়া এত ভালো শিকার ফেলে রেখে যাওয়া চলে না। বারণ অগ্রাহ্য করে ধনুকে তির জুড়ে এগিয়ে গেল সে।
মাঝেমধ্যে জানোয়ারটাকে দেখতে পাচ্ছে সে, কিন্তু নিশানা তাক করার আগেই আবার কোনো একটা ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে পড়ছে সেটা। এদিকে সূর্য ডুবে গিয়ে সন্ধ্যা নেমেছে। সঙ্গীরা এইসময় এই স্থানে আর অপেক্ষা করা সমীচিন নয় ভেবে জঙ্গল ত্যাগ করেছে। সৌমিত্রর যখন খেয়াল হল, তখন সে অন্ধকারাচ্ছন্ন জঙ্গলে একা দাঁড়িয়ে আছে। আজ বোধ হয় পূর্ণিমা। গোল চাঁদটা আকাশে নিজের জায়গা দখল করেছে ঠিকই, কিন্তু এই আঁধারে শূকরটাকে যে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না এ ব্যাপারে সে এখন নিশ্চিত। এদিকে ওটার পিছনে ছুটতে ছুটতে জঙ্গলের অনেকটা গভীরে প্রবেশ করে ফেলেছে সে। সাহসী যুবরাজের বুকটাও ক্ষণিকের জন্য শিরশির করে উঠল।
ফিরে যাওয়ার জন্য পিছনে পা বাড়াতেই সে থমকে দাঁড়াল। সামনের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসেছে একটা বড়সড় জানোয়ার। দুটো জ্বলজ্বলে চোখ সৌমিত্রর উপরেই স্থির। সর্বনাশ! হাতের তির-ধনুকটা শক্ত করে ধরল সে। জন্তুটা প্রথমে মুখ থেকে একটা ঘড়ঘড়ে শব্দ বার করল, তারপর সেই দুটো চোখ আর নিকষ কালো শরীরটা নিয়ে এগিয়ে আসতে লাগল তার দিকে। অন্ধকারে ভালো বোঝা যাচ্ছে না। ভাল্লুক বা নেকড়ে জাতীয় কোনো প্রাণী হবে।
সৌমিত্র লক্ষ্য স্থির করে পরপর দু-বার তির ছুড়ল। ঠিকমতো লাগল কি না বুঝতে পারল না। জঙ্গল কাঁপিয়ে একটা হুঙ্কার দিল জন্তুটা। সৌমিত্র বুঝতে পারল এবার কী হতে চলেছে। তির-ধনুক ফেলে কোমর থেকে বড়ো ছুরিটা বার করল সে। আর কিছু ভাববার অবকাশ পেল না। জন্তুটা ঝাঁপিয়ে পড়ল তার বুকের উপর। কামড়ে ধরল তার গলার কাছটায়। সেও প্রাণপণে ওটার শরীরে বিঁধিয়ে দিতে থাকল হাতের ছুরিটা। একসময় প্রাণ হারিয়ে সেখানেই পড়ে রইল জন্তুটা। তার নীচে কাঁপতে কাঁপতে স্থির হয়ে গেল যুবরাজ সৌমিত্রর নিষ্প্রাণ দেহটাও।
পরদিন সকালে অনেক খোঁজাখুঁজি হল, কিন্তু যুবরাজের দেহ আর কোনোদিন কেউ খুঁজে পেল না।
এই ঘটনার পর কেটে গেল বেশ কিছুদিন। শুরু হল এক নতুন সমস্যা। লোকমুখে শোনা যেতে লাগল এক ভয়ংকর অপদেবতার কথা। পূর্ণিমার রাতে বনসংলগ্ন গ্ৰামগুলো থেকে হারিয়ে যেতে থাকল মানুষজন। কারোর আধ-খাওয়া দেহ মিলল জঙ্গলের ধার থেকে। আতঙ্কে গ্রাম ত্যাগ করে পালিয়ে গেল গ্ৰামবাসীরা। জঙ্গলের দিকে যাওয়া বন্ধ করে দিল সকলে। গভীর অরণ্য জুড়ে সেই আতঙ্ক মিশে রইল বহুবছর।
এরপর এক রাজার বদলে এল অন্য রাজা, বদলাতে থাকল রাজত্ব। জঙ্গলের গাছ কাটা শুরু হল। জঙ্গলের বিস্তার কমে গিয়ে গড়ে উঠতে শুরু করল বসতি। ধীরে ধীরে মানুষ ভুলেই গেল সেই আতঙ্কের কথা। শুধু একটা ছেলেভোলানো গুজব হিসাবেই রয়ে গেল কিছু মানুষের মুখে মুখে।
(২)
কিছুদিন হল সৌম্যর মন বেজায় খুশি। আবার ঘুরতে যাওয়ার দিন ঠিক হয়েছে। শুধু তাই নয়, এবার আমরা দুজনের বদলে চারজন। দীপ আর সানি যোগ দিয়েছে আমাদের দলে। ঘুরতে যেতে আমি আর সৌম্য খুবই ভালোবাসি, সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়ি এদিকে ওদিকে। দলে লোকজন বেশি হলে বেশি আনন্দ হয়।
এখন শরতের সূচনা। পরিষ্কার নীল আকাশে সাদা মেঘ নিশ্চন্তে ভেসে বেড়াচ্ছে। বর্ষার দিন শেষ হয়ে গেছে কয়েকদিন আগেই। বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছে দুর্গাপূজার গন্ধ। চারদিন পর আমরা ট্রেনে উঠব। ফিরে আসব পূজার আগেই।
এই সময় ঘুরতে যাওয়ার দুটো কারণ। প্রথমত, আমরা নিরিবিলি পছন্দ করি। ভিড়ভাট্টা আমাদের একদম ভালো লাগে না। দ্বিতীয়ত, পূজার দিনগুলো আমরা কলকাতাতেই কাটাতে চাই।
আমাদের এবারের গন্তব্য ডুয়ার্স, সৌম্যর পছন্দের জায়গা। আমরা চারজনেই খুব ব্যস্ত। আর তো বেশিদিন বাকি নেই। সবকিছু জোগাড় করে গুছিয়ে নিতে হবে। টিকিটের দায়িত্ব সৌম্যর। ও বলেছে, ওখানে গিয়ে পছন্দমতো কটেজ খুঁজে নেবে। বাকি জিনিস ঠিকমতো নেওয়ার দায়িত্ব আমাদের তিনজনের।
দেখতে দেখতে চলে এল সেই দিন। আমাদের অপেক্ষার অবসান। সময়মতো আমরা চার বন্ধু পৌঁছে গেলাম শিয়ালদহ স্টেশনে। কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেস সেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
ট্রেনে উঠে আমরা নিজেদের বার্থে বসে পড়লাম। সেই ছোটো থেকে এই চার বন্ধুর বড়ো হয়ে ওঠার নানা স্মৃতি এসে ভিড় করল। সেই স্মৃতিমাখা মনে একটা মৃদু দোলা দিয়ে ট্রেনটা চলতে শুরু করল। তারপর দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেল প্ল্যাটফর্ম চত্বর। আমাদের নিয়ে এগিয়ে চলল আমাদের ভালোবাসার গন্তব্যে। গান, গল্প, খাওয়াদাওয়ায় আমরাও সময় কাটাতে লাগলাম।
(৩)
সকাল সকাল ঠিক সময়ে ট্রেন নিউ মাল জংশনে পৌঁছল। স্টেশনের বাইরে এসে আমরা আর দেরি করলাম না। গাড়ি ভাড়া করে রওনা দিলাম। মসৃণ রাস্তা ধরে গাড়ি ছুটে চলল। রাস্তার দু-ধারে কখনো চা-বাগান, কখনো জঙ্গল। সবুজে সবুজ। চোখ যেন জুড়িয়ে যায়। গোরুমারা জঙ্গল, মূর্তি নদী একপাশে ফেলে আমরা এসে পৌঁছলাম সামসিং গ্রামে। বেলা তখন সাড়ে বারোটা। ততক্ষণে পেটে টান পড়েছে, এবার খাওয়াদাওয়া করা দরকার। ড্রাইভারদাদাকে সঙ্গে নিয়ে ছোটো একটা হোটেলে ঢুকলাম। বেশ সুস্বাদু খাবার। ভাত, ডাল, ঝুরি আলুভাজা, মাছের কালিয়া, পাঁপড়। সানি মাছ খায় না। ওর জন্য ডিম।
খাওয়া শেষ করে আমরা চা-বাগানে ঢুকলাম। ড্রাইভার নরেশদা সাবধান করে দিয়ে বলল বেশি ভিতরে না যেতে। চা-বাগানের ভিতরে নাকি চিতাবাঘ বাচ্চা প্রসব করে। কথাটা আমাদের কাছে খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য না হলেও আমরা বেশিদূর গেলাম না। সামনাসামনি দাঁড়িয়ে কয়েকটা ছবি তুলে গাড়িতে এসে বসলাম। বেলা পড়ে আসছে, ঘর খুঁজতে হবে।
ড্রাইভারদাদা নরেশ ছেত্রী খুব ভালো মানুষ। আমরা কীরকম ঘর চাইছি ওকে বুঝিয়ে বললাম। ও একজায়গায় এসে গাড়ি থামাল। জায়গাটার নাম রকি আইল্যান্ড। সুন্তালেখোলা নামের একটি পাহাড়ি নদী বয়ে গেছে সেখান দিয়ে। চারপাশে অনুচ্চ পাহাড় আর জঙ্গল। রাস্তার যেখানে আমরা দাঁড়িয়ে, সেখান থেকে একটা নীচু উপত্যকা ঢালু হয়ে নদীর কাছে চলে গেছে। সেখানেই চোখে পড়ছে একটা ছোটো কটেজ। ঢালু পথ বেয়ে হেঁটে নামতে শুরু করলাম আমরা পাঁচজন।
ছোট্ট নদীর একদম পাড়ে কটেজটা। দুটো ঘর, একটা ডাইনিং এবং কিচেন। আর একটা সুন্দর বারান্দা। বলতে গেলে বারান্দা ঘেঁষেই বয়ে গেছে সুন্তালেখোলা।
নরেশদা বলল, “সান্তালি হল কমলালেবু, আর খোলা মানে ঝোরা অর্থাৎ খরস্রোতা নদী। এই পরিবেশ আপনাদের পছন্দ হলে এখানে থেকে যান, ফ্রেশ হয়ে বিশ্রাম নিন। আমি ফিরে যাব। আমার বাড়ি চালশা গ্রামে। এখন তবে আসি। কাল সকাল সকাল চলে আসব। তখন আবার দেখা হবে।”
নরেশদাকে বিদায় জানিয়ে আমরা ঘরে প্রবেশ করলাম। মালিক ভদ্রলোক খুব ভালো মানুষ। আমাদের জন্য ঘরদুটো খুলে দিলেন। তারপর চলে গেলেন সামসিংয়ে নিজের বাড়িতে। ঘরের ভিতরে ঢুকে মন ভরে গেল। স্নান সেরে আমরা বারান্দায় বেরিয়ে এলাম।
কৌতূহলবশত কটেজের পিছনের দিকে এসেই বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। হোটেলের কেয়ারটেকার ভদ্রলোক একটা আলখাল্লা জাতীয় কালো পোশাক পরে মাটিতে বসে মন্ত্রোচ্চারণ করে কার যেন পূজা করছেন। সৌম্য এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল ব্যাপারটা কী। বয়স্ক কেয়ারটেকার কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আমতা আমতা করে বললেন, “এখানে অপদেবতা আছে দাদাবাবু। বেশি তো কেউ এই কটেজে এসে থাকে না, তাই যখন কেউ আসে এই পূজা করে বিপদ কাটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি।”
আমরা আর কিছু বললাম না। তবে মনটা একটু মুষড়ে গেল। এত সুন্দর পরিবেশে এই কটেজ, কিন্তু কেয়ারটেকার ভদ্রলোকটি বেশ সন্দেহজনক।
হাঁটতে হাঁটতে আমরা নদীর ধারে এলাম। বড়ো বড়ো পাথর পড়ে রয়েছে নদীর বুকে। তাদের গায়ে ধাক্কা খেয়ে তিরতির করে বয়ে চলেছে নদীর স্বচ্ছ জল। একটা বড়ো পাথরের উপর আমরা চারজন গিয়ে বসলাম। প্রকৃতির অপরূপ দৃশ্য দেখে আমরা মোহিত হয়ে গেলাম। আমাদের ডানদিকে কতগুলো পাহাড় সজ্জিত হয়ে পিছনদিকে সারিবদ্ধ হয়েছে। তারই হয়তো অজানা পথ অতিক্রম করে বয়ে এসেছে এই নদী, বাঁদিকে এঁকে-বেঁকে গড়িয়ে গিয়ে পাথরের ভাঁজে হারিয়ে গেছে। সম্মুখে ঘন জঙ্গল। তার ছায়া এসে পড়েছে নদীর জলে। আমরা শীতল জলে পা ডুবিয়ে দিলাম।
বিকেলের শেষ আলো গাছপালার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিল শেষবারের মতো। সৌম্য বলল, “এমন দৃশ্য ভোলা যাবে না। কী বল ঋজু!”
আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম। সানি একটা গান ধরল। দীপও গুনগুন করে উঠল ওর সঙ্গে। মনটা উদাস হয়ে কোথায় যেন হারিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর দূরে একটা পাহাড়ের কোলে লুকিয়ে পড়ল সূর্যটা। এই পাহাড়ের গায়ে যে দু-একটা কাঠের ঘর আছে, সেগুলোতে আলো জ্বলে উঠল। সন্ধে নেমে এল ধীরে ধীরে।
(৪)
“সন্ধ্যা হয়ে গেছে, এখনো এখানে কী করছেন? এবারে উঠে আসুন বাবুরা।”
নিস্তব্ধ পরিবেশে আচমকা কারোর কথা শুনে আমরা যেন চমকে উঠলাম। পিছনে ফিরে দেখলাম সেই কেয়ারটেকার এসে দাঁড়িয়েছেন।
দীপ বলল, “কেন বলুন তো! আমরা তো এখানে আনন্দ করতেই এসেছি।”
দীপের কথা শুনে মানুষটা একটু উদ্বিগ্ন চোখে আমাদের দিকে তাকালেন। তারপর যেন মরিয়া হয়ে বললেন, “আপনাদের কোনো বিপদ হলে মালিক আমাকে তাড়িয়ে দেবে। আপনারা বারান্দায় বসুন। নাহয় আমি ছাতের দরজা খুলে দিচ্ছি, সেখানে বসে গল্পগুজব করুন। দয়া করে এখানে এই অন্ধকারে বেশিক্ষণ থাকবেন না।”
আমাদের মন একটু বিষণ্ণ হয়ে গেছিল ঠিকই, কিন্তু ছাতে উঠে এবং সান্ধ্যকালিন জলখাবার ও তৎসহ চা-পকোড়া খেয়ে মেজাজ ভালো হয়ে গেল। মানুষটা যখন আমাদের হাতে চায়ের কাপ তুলে দিলেন, সৌম্য তাঁর নাম জিজ্ঞাসা করল। তিনি হাসিমুখে জানালেন, “স্মরণ।”
লক্ষ করলাম, তাঁর মুখে আর দুশ্চিন্তার ছাপ নেই। আমরা তাঁর কথামতো ছাতে চলে এসেছি বলেই হয়তো তিনিও মনে মনে খুশি হয়েছেন।
আজ বোধ হয় পূর্ণিমা। রাতের আকাশে ভেসে বেড়ানো গোল চাঁদটা আলো ছড়িয়ে দিয়েছে চারদিকে। ছাতটা সত্যিই অনবদ্য। চারপাশের অপরূপ দৃশ্যপট ধরা দিচ্ছে এখান থেকে। সেই ক্যানভাসের বুক চিরেই বয়ে গেছে সরু নদীটা। নদীর পাড়ে না বসতে পারার দুঃখটা কেটে গেল আমাদের।
রাত দশটা নাগাদ ডাইনিংয়ে ডাক পড়ল। রাতের খাবারের মেনু রুটি, সবজি, স্যালাড আর চিকেন কষা। বলতে কী, এত সুস্বাদু খাবার আমরা বহুদিন খাইনি। স্মরণদার উপর সব রাগ যেন নিমেষে হারিয়ে গেল। খাসা রান্নার হাত মানুষটার। সেই স্বাদ যেন বহুদিন মুখে লেগে থাকবে।
খাওয়া সেরে আমরা ডাইনিং টেবিল থেকে উঠে পড়লাম। ডাইনিং রুম থেকে একটা ছোটো করিডোর সামনের বারান্দায় এসে মিশেছে। করিডোরের দু-পাশে দুটো ঘর। আমি করিডোর দিয়ে বারান্দার দিকে এগোলাম। বাকি তিনজন আমার পিছনে। কেন জানি না, একটা অদৃশ্য টান অনুভব করলাম নিজের মধ্যে। নদীর আরো কাছে যেতে পারলে কিছু একটা দেখতে পাব, যেটা এতদূর থেকে ঠিকমতো দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ কাঁধের উপর কারোর হাত পড়তে চমকে উঠলাম। দেখলাম স্মরণদা। বললেন, “বাবু, যাই হয়ে যাক, রাতে কেউ বাইরে বেরোবেন না। এই বুড়ো মানুষটার কথা একটু শুনবেন। আর শোওয়ার সময় ঘরের জানালা ভালো করে বন্ধ করে দেবেন।”
(৫)
ঘরে ঢুকে পড়লাম আমরা। একটা ঘরে আমি আর সৌম্য, অন্য ঘরে দীপ আর সানি। ঘরে দুটো সিঙ্গেল খাট। একটা বাইরের জানালার দিকে, অন্যটা বিপরীতে দেওয়ালের দিকে। স্মরণদার কথামতো জানালা বন্ধ করে দিলাম। শুয়ে শুয়ে সৌম্যর সঙ্গে গল্প করতে করতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়লাম।
মাঝরাতে কী এক অস্বস্তিতে ঘুম ভেঙে গেল। ঘুমের মধ্যে মনে হল, কে যেন বহুদূর থেকে আমার নাম ধরে ডাকছে। আমি কিছুক্ষণ কান পেতে চুপ করে বিছানায় শুয়ে রইলাম। ঘরের ভিতরের নিভু আলোয় দেখলাম সৌম্য নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। বাইরে নদীর আওয়াজ কানে এল। একটু আশ্চর্য হলাম। সকালে যে নদী অল্প জল বয়ে নিয়ে কুলকুল করে শব্দ তুলছিল, এখন মনে হচ্ছে ক্ষিপ্রগতিতে প্রলয়-ভয়ংকরী হয়ে সেই নদী কটেজের গা ঘেঁষে ছুটে চলেছে। মনে হল যে-কোনো মুহূর্তে সেটা আমাদের কটেজটাকে ভেঙেচুরে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। ঘরের মধ্যে কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে এল আমার। আর কিছু না ভেবে জানালাটা খুলে দিলাম।
বাইরের পরিবেশ জ্যোৎস্নার আলোয় ভরে গেছে। নদী বয়ে চলেছে তার পুরোনো ছন্দেই। চাঁদের আলো গায়ে মেখে তার জল চিকচিক করছে। সেই বড়ো পাথরটার উপর চোখ পড়তেই শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। পাথরের উপর এত রাতে বসে আছে কে ও! দূর থেকে ভালো বোঝা যায় না। তবু যেন মনে হল আমার দিকে পিছন ফিরে পাথরের উপর দীপ বসে আছে। সর্বনাশ! স্মরণদার কথা মনে পড়ল। দীপের কোনো বিপদ হবে না তো! সৌম্যকে ডাকলাম না। আস্তে করে দরজা খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। হ্যাঁ, দীপই তো। ওই তো ওর সবুজ গেঞ্জিটা পরে পরিচিত ভঙ্গিতে বসে আছে। এখান থেকে ডাকব, না কাছে গিয়ে দেখব? মনে মনে স্থির করলাম, এখান থেকে চেঁচামেচি করে বাকিদের ঘুম নষ্ট করে লাভ নেই, ওখানে গিয়ে দেখি ব্যাপারটা কী।
বারান্দার গ্রিল খুলে ধীর পায়ে বাইরে এলাম। দীপ যেখানে বসে আছে সেই পাথরটার দিকে এগোতে লাগলাম ধীরে ধীরে। এখন আমি ওর অনেকটাই কাছে। কিন্তু ও এখনো বুঝতে পারেনি আমি ওর দিকেই আসছি। জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে দীপ মূর্তির মতো বসে আছে। শত সাবধানতা অবলম্বন করলেও পায়ের চাপে ঝোপঝাড়ে মৃদু খসখস শব্দ হচ্ছে। তবু সেই শব্দ ওর কানে যাচ্ছে না কেন বুঝতে পারছি না। আরো একটা ব্যাপার আমি বুঝতে পারিনি। বাইরে আসার সময় দেখেছি সানিদের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। দীপ বাইরে এল কীভাবে? তাহলে কি দীপের বাইরে আসার ঘটনাটা সানি জানে?
এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে জলে পা দিলাম। আর দু-তিন পা এগোলেই সেই পাথর। জলের উপর আমার পা ফেলার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ পেয়েও দীপ যখন তাকাল না তখন সত্যিই খুব দুশ্চিন্তা হল। পাথরটার একেবারে সামনে গিয়ে ওকে ডাকলাম, “দীপ, অ্যাই দীপ, এখানে কী করছিস?”
ও এবার আমার দিকে ফিরে তাকাল, আর আমার সারা শরীর অবশ হয়ে গেল। এটা দীপ নয়, দীপ হতে পারে না। কী বীভৎস ওর মুখ! ঠিক যেন প্রাচীন কোন অপদেবতা ঘাড় ঘুরিয়ে স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে আছে।
ভয় পেয়ে গেলাম। একটা ভয়ার্ত আর্তনাদ নিজে থেকেই বেরিয়ে এল আমার মুখ দিয়ে। পিছনে সরতে গিয়ে পড়ে গেলাম জলের মধ্যে। সেই জলস্রোতের ভয়ানক গর্জন আবার কানে এল। মনে হল এখনই অগাধ জলরাশি আমায় ভাসিয়ে নিয়ে চলে যাবে বহুদূরে। চাঁদের আলো পাথরটার উপর চুঁইয়ে পড়ছে। দীপের চেহারাধারী অদ্ভুত প্রাণীটা হাতে পায়ে ভর করে সন্তর্পণে পাথর থেকে নেমে আসছে আমার দিকে। ওর দুটো দাঁত চকচক করছে, মুখগহ্বর থেকে একটা লম্বা জিভ বেরিয়ে বাতাসে নড়ছে। আমার চারদিকে অন্ধকার ঘনিয়ে এল। আমি জ্ঞান হারিয়ে সেখানেই পড়ে রইলাম।
(৬)
চোখ মেলে দেখলাম কটেজের বারান্দায় আমি শুয়ে। আমার তিন বন্ধু, কেয়ারটেকার স্মরণদা, হোটেল মালিক সুজনবাবু, ড্রাইভার নরেশদা সবাই আমার উপর ঝুঁকে পড়ে জ্ঞান ফেরার প্রতীক্ষা করছে। রাত পেরিয়ে দিনের আলো ফুটেছে। তবু দীপকে দেখে আমি চমকে উঠলাম। কিছু বলতে চেষ্টা করলাম, পারলাম না। শরীরটা দুর্বল লাগছে।
স্মরণদা আমার পাশে বসে বললেন, “গতকাল রাতে আমি সজাগ ছিলাম। কারণ, জানতাম পূর্ণিমার রাতে সে আসবে। কিন্তু কোন রূপে আসবে আর কাকে তার শিকার বানাবে তা জানতাম না। তবু বোধ হয় একটু তন্দ্রা লেগেছিল। তাই যখন বাইরে বেরিয়েছেন, তখন টের পাইনি। একটা আর্তনাদ শুনে তন্দ্রা ভেঙে যায়। ছুটে গিয়ে দেখি নদীতে পড়ে গোঙাচ্ছেন। টেনে তুলে নিয়ে আসি। ততক্ষণে আমার ডাকে আপনার বন্ধুরাও জেগে গেছে। আর কিছুক্ষণ দেরি হলে বোধ হয় বাঁচাতে পারতাম না আপনাকে। ঈশ্বরের অশেষ কৃপা, এ-যাত্রায় বেঁচে গেলেন ওই অপদেবতার হাত থেকে।
পুরোপুরি সুস্থ হতে আমার খানিকটা সময় লেগেছিল। তাই সেইদিন আর কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয়নি। যদিও পরের দিন পুষিয়ে দিয়েছিল নরেশদা। ঝুলন্ত ব্রিজ, ঝালং, জলঢাকা ব্যারেজ, ছোটো গ্রাম বিন্দু—সবকিছু দেখেছি মন ভরে।
বেশ কয়েকদিন হল বাড়ি ফিরে এসেছি। শুধু কয়েকটা কথা মনে পড়লে আজও মন ভারী হয়ে যায়। যে মানুষটাকে সন্দেহ করেছি প্রথম থেকে, তিনিই আমার প্রাণ বাঁচিয়েছেন। আর সেই ভয়ংকর অপদেবতা। নিস্তব্ধ জ্যোৎস্নাস্নাত রাতে, নদী-পাহাড় জঙ্গলময় মায়াবী জগতে সত্যিই সে অপেক্ষা করে থাকে তার শিকারের জন্য। একদিন হয়তো এই স্থানে আরো কটেজ গড়ে উঠবে। লোকজন গমগম করবে। বিরক্ত, বিষণ্ণ সেই অপদেবতা হয়তো এই নদীতট ত্যাগ করে আশ্রয় নেবে জঙ্গলের আরো গভীরে কোনো নতুন নিরিবিলি স্থানে। আসলে সেই প্রাচীন যুগ থেকেই প্রকৃতির সৌন্দর্যের বিপরীতে আনাগোনা করে এসেছে তার ভয়ংকর দিক। মানুষের তাকে উপেক্ষা করার সাধ্য কোথায়!
___
অঙ্কনশিল্পীঃ রাখি পুরকায়স্থ
No comments:
Post a Comment